post

অফুরন্ত রহমতের মাস মাহে রমজান

১৫ জুন ২০১৫
kb-m-1 মোশাররফ হোসেন খান# পবিত্র মাহে রমজান। মাহে রমজান হলো মুমিনের জন্য আত্মিক উন্নতির মাস। এই বরকতপূর্ণ মাসে মহান রাব্বুল আলামিনের রহমতের দরোজাগুলো তার নেক বান্দাদের জন্য খুলে যায়। হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন : আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আদম সন্তানের প্রত্যেকটা কাজ তার নিজের জন্য। তবে রোজা ছাড়া। কেননা রোজা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেবো। আর রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। কাজেই কেউ যখন রোজা রাখে, তখন সে যেন কোনো অশ্লীল কথাবার্তা না বলে ও হইচই না করে। কেউ যদি তাকে গাল মন্দ করে, অথবা লড়াই করতে আসে, তবে সে যেন বলে : আমি রোজাদার। যার হাতে মুহাম্মদের জীবন তাঁর (সেই মহান আল্লাহর) শপথ করে বলছি, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ মেশকের সুগন্ধের চেয়েও উত্তম। রোজাদারের দুটো আনন্দ : একটা হলো যখন সে ইফতার করে। আর একটা হলোÑযখন তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ পাবে। (বুখারী ও মুসলিম) বুখারীর অন্যতম বর্ণনায় আছে : সে তার খাদ্য, পানীয় ও যৌন আবেগ আমার কারণেই বর্জন করে। রোজা আমার জন্যই এবং আমিই তার প্রতিদান দেবো। সৎকাজের সওয়াব দশ গুণ। মুসলিমের বর্ণনায় আছে : আদম সন্তানের সকল কাজের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশো গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়, কিন্তু রোজার কথা ভিন্ন। কেননা রোজা আমারই জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেবো। ওপরের হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা গেল যে, রোজার তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন : ১.    রোজার সওয়াব সাতশো গুণের চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি। ২.    রোজা দোজখ ও যাবতীয় পাপ কাজ থেকে বাঁচানোর জন্য ঢালস্বরূপ। ৩.    কেউ আক্রমণ করতে এলে তাকে বলতে হবে : আমি রোজাদার। তাই লড়াই করতে চাই না। কিন্তু তার পরও যদি সে আক্রমণ করে তবে তার আক্রমণের জবাব দেয়া বা লড়াই করা তখন ফরজ হয়ে পড়ে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বদরের যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল পবিত্র রমজান মাসে। রোজা এমন এক বরকতময় ইবাদত, যার সাথে অন্য কোনো ইবাদতেরই তুলনা হয় না। রোজাদারের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে রয়েছে বিশেষ পুরস্কার এবং মর্যাদা। এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায় হযরত উমর (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে। তিনি বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা) বলেছেন : আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে মানুষের আমল বা কাজ সাত রকমের। দুই রকমের কাজ এমন যে, তার দুটো অনিবার্য ফল রয়েছে। আর দুই রকমের কাজ এমন যে, তার ফল কাজের সমান। আর এক রকমের কাজের দশগুণ সওয়াব রয়েছে। আর এক রকমের কাজের সওয়াব সাতশো গুণ। আর এক রকমের কাজের সওয়াবের পরিমাণ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। প্রথম দুটো হলো : যে ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করে, কাউকে তার সাথে শরিক করে না এবং এই অবস্থায় আল্লাহর কাছে উপস্থিত হয়, তার জন্য জান্নাত অনিবার্য। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরিক করা অবস্থায় তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছে, তার জন্য জাহান্নাম অনিবার্য। আর যে ব্যক্তি কোনো খারাপ কাজ করে সে তার একগুণ শাস্তি পায়। আর যে ব্যক্তি কোনো ভালো কাজ করার ইচ্ছা করে, কিন্তু কাজটা করে না- সে ঐ কাজ করার এক গুণ সওয়াব পায়। আর যে ব্যক্তি ভালো কাজ করে, সে তার কাজের সাতশো গুণ পর্যন্ত সওয়াব পায়। আর রোজা আল্লাহর জন্য হয়ে থাকে। এর সওয়াবের পরিমাণ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। (তাবারানি ও বাইহাকি) হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণিত আর একটি হাদিস থেকে জানা যায়। রাসূল (সা) বলেছেন : রোজা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে : হে আমার প্রতিপালক, একে আমি পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত রেখেছিলাম। কাজেই তার সম্পর্কে আমার সুপারিশ শোনো। আর কুরআন বলবে : আমি একে রাতের বেলা ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার সম্পর্কে আমার সুপারিশ শোনো। এরপর তাদের উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে। (আহমাদ, তাবারানি, হাকেম) পবিত্র রমজানের রোজার রয়েছে একটি বিশেষ ফজিলত। রয়েছে এমন এক মর্যাদা যা অতুলনীয়। রমজান হলো সেই বরকতময় মাসÑ যে মাসে মহান রাব্বুল আলামিন তার বান্দার জন্য নাজিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল কুরআন। এই মাসেই রয়েছে সেই পুণ্যবান রাতটিÑলাইলাতুল কদর। রাসূল (সা) বলেছেন : যে ব্যক্তি কদরের রাতে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা সহকারে নামাজ পড়ে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা সহকারে রমজানের রোজা রাখে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবন মাজাহ) পবিত্র রমজান মাসে রোজাদারের জন্য মহান আল্লাহ তার রহমত এবং নিয়ামতের অফুরন্ত ভান্ডারের দরোজা খলে দেন। রাসূল (সা) নিজেই বলেছেন : আমার উম্মতকে রমজানের পাঁচটি বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে, যা তাদের পূর্ববর্তী আর কোনো উম্মতকে দেয়া হয়নি। সেই পাঁচটি সুবিধা হলো : ১.    রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম। ২.    ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত মাছেরা তার গুনাহ মাফ চায়। ৩.    আল্লাহ তায়ালা প্রতিদিন তার জন্য বেহেশতকে সুসজ্জিত করেন এবং বলেন : আমার পুণ্যবান বান্দারা অচিরেই সমস্ত দুঃখ-ক্লেশ থেকে মুক্ত হয়ে তোমার কাছে আসবে। ৪.    রমজান মাসে খোদাদ্রোহী শয়তানদেরকে বন্দী করে রাখা হয়। ফলে অন্য সময়ে তারা যেখানে যেখানে যেতে পারে, রমজানে সেইসব জায়গায় যেতে পারে না। ৫.    রমজানের শেষ রাতে তাদের গুনাহ মাফ করা হয়। জিজ্ঞেস করা হলো : হে রাসূল! ওটা কি লাইলাতুল কদর বা শবে কদর? তিনি বললেন : না। শ্রমিক যখন তার কাজ শেষ করে,তখনই তাকে পূর্ণ মজুরি দেয়া হয়। (আহমাদ, বাযযাব, বাইহাকি) কী অসাধারণ ফজিলত রমজান এবং রোজাদারের জন্য আল্লাহপাক নির্ধারণ করে রেখেছেন। একমাত্র রোজাদারের জন্যই রয়েছে সেই অফুরন্ত পুরস্কারের ভান্ডার। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে জানা যায়। রাসূল (সা) বলেছেন : রমজান মাসে আমার উম্মাতকে পাঁচটা বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে, যা আমার পূর্ববর্তী কোনো নবীকে দেয়া হয়নি। প্রথমটি হলো : রমজানের প্রথম রাতে আল্লাহ যার দিকে দৃষ্টি দেন, তাকে কখনো শাস্তি দেননা। দ্বিতীয়ত : সন্ধ্যার সময় তাদের মুখ থেকে যে দুর্গন্ধ বের হয়, তা আল্লাহর কাছে মেশকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম। তৃতীয়ত : রমজানের প্রত্যেক দিনে ও রাতে ফেরেশতারা রোজাদারদের জন্য দোয়া করে। চতুর্থত : আল্লাহ তায়ালা তার বেহেশতকে বলেন : তুমি আমার বান্দার জন্য সুমজ্জিত ও প্রস্তুত হও। আমার বান্দারা অচিরেই দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট থেকে অব্যাহত পেয়ে আমার বাড়িতে ও আমার সম্মানজনক আশ্রয়ে এসে বিশ্রাম নেবে। পঞ্চমত : রমজানের শেষ রাতে আল্লাহ তাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। এক ব্যক্তি বললো : এটা কি লাইলাতুল কদর? রাসূল (সা) বললেন : না, তুমি দেখনি, শ্রমিকরা যখন কাজ শেষ করে, তখনই পারিশ্রমিক পায়? (বায়হাকী) সালমান ফারসি (রা) থেকে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা) একবার শাবান মাসের শেষ ভাগে আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বললেন : “হে জনমন্ডলী! তোমাদের ওপর একটি মর্যাদাপূর্ণ ও বরকতপূর্ণ মাস এসে পড়েছে। এই মাসে এমন একটা রাত আছে, যা এক হাজার kb-m2 মাসের চেয়েও উত্তম। এই মাসের দিনে রোজা রাখাকে আল্লাহ ফরজ করেছেন এবং রাতে নামাজ পড়াকে (তারাবী) ইচ্ছাধীন করেছেন। এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো একটা কল্যাণমূলক কাজ করবে, সে অন্য মাসে একটা ফরজ আদায়কারীর মত মর্যাদা লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এই মাসে একটা ফরজ আদায় করবে, সে অন্য মাসে সত্তরটা ফরজ আদায়কারীর সমান হবে। এটা ধৈর্যের মাস। ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়। এটা পরস্পরের প্রতি সমবেদনা জানানোর মাস। এ মাসে মুমিনের জীবিকা বাড়ানো হয়। এ মাসে যে ভ্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে এবং সে দোজখ থেকে মুক্তি পাবে। এ ছাড়া যে রোজাদারকে ইফতার করালে, তার রোজার কিছুমাত্র কমবে না। লোকেরা বললো : হে রাসূল, রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য আমাদের সবার হয় না। রাসূল (সা) বললেন : যে ব্যক্তি রোজাদারকে একটিমাত্র খোরমা, এক ঢোক পানি বা দুধ খাইয়ে ইফতার করাবে, আল্লাহ তাকে এই সওয়াব দেবেন। এটা এমন এক মাস, যার প্রথম অংশÑরহমতের, মধ্যম অংশ গুনাহ মাফের এবং শেষাংশ দোজখ থেকে মুক্তির জন্য নির্দিষ্ট। যে ব্যক্তি তার অধীনস্থ ব্যক্তির কাজ রমজান মাসে হালকা করে দেবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং দোজখ থেকে মুক্তি দেবেন। অতএব তোমরা রমজান মাসে চারটি সৎকাজ বেশি বেশি কর। এর দুটো কাজ দিয়ে তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করতে পারবে, তা হলোÑআল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেইÑএই সাক্ষ্য দান, আর আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চাওয়া। আর যে দুটো কাজ অত্যন্ত জরুরি তাহলোÑ তোমরা আল্লাহর কাছে জান্নাত চাইবে এবং দোজখ থেকে মুক্তি চাইবে। আর যে ব্যক্তি রোজাদারকে পানি পান করাবে (ইফতারের সময়) আল্লাহ তায়ালা তাকে আমার হাউজ থেকে এমন শরবত পান করাবেন যে, বেহেশতে প্রবেশ করা পর্যন্ত তার আর পিপাসা লাগবে না।” (ইবনে খুযায়মা) অসীম রহমত আর নিয়ামতের পূর্ণ রমজান মাস। রোজার মাধ্যমে একদিকে মুমিন বান্দারা যেমন আত্মিকভাবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, অপর দিকে তারা পেয়ে যা মহান আল্লাহর কাছ থেকে অশেষ রহমত। এসব সংবাদ কেবল তাদের জন্যই, যারা কেবল আল্লাহর জন্যই একটি মাস রোজা রাখে, নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখে কেবল মাত্র তাঁরই রাজি-খুশির জন্য, ইবাদাতের মাধ্যমে। আর এসব মুমিনই তো দুনিয়া এবং আখেরাতে সফল। কিন্তু দুর্ভাগা তারা, যারা এমন একটি রহমত এবং বরকতের মাস পেয়েও বঞ্চিত রয়ে গেল তার সুফল থেকেই প্রকৃত অর্থে যে রোজা নেই, যার সম্পর্ক নেই রমজানের কোনো ইবাদতের সাথে, তার জন্য দুঃসংবাদ ছাড়া আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। হাদিসেও এর বাখ্যা রয়েছে প্রচুর। হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসের উল্লেখ এখানে আবশ্যক। তিনি বর্ণনা করছেন। রাসূল (সা) বলেছেন : “তোমাদের কাছে রমজান মাস এসেছে। এটা একটা কল্যাণময় মাস। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাগুলো খোলা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয়, খোদাদ্রোহী শয়তানগুলোকে শেকল পরানো হয়। এ মাসে আল্লাহর জন্য এমন এক রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এই মাসের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত, সে সবকিছু থেকেই বঞ্চিত।” (নামায়ী ও বাইহাকি) শুধু বঞ্চিতই নয়। রোজা ত্যাগকারীর জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে অত্যন্ত কঠোর শাস্তি এবং অপমানজনক লাঞ্ছনা। আবু হুরাইরা রা: কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূল (সা) বলেছেন : যে ব্যক্তি রমজানের কোনো একটি রোজাও রোগ-ব্যাধি বা কোনো বৈধ কারণ ছাড়া ভঙ্গ করে, সে যদি সারা জীবনও রোজা রাখে, তবুও তার কাজা আদায় হবে না।” (তিরমিযি, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, ইবনে খুযায়মা ও বাইহাকি) সুতরাং সহজেই অনুমেয়, রোজা ভঙ্গকারীর শাস্তি কতটা ভয়াবহ এবং কঠিন। অপর দিকে রোজাদারের জন্য রয়েছে কেবল কল্যাণ আর কল্যাণ। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকেই এই বরকত মাসÑমাহে সিয়াম থেকে যাবতীয় কল্যাণ, বরকত, রহমত এবং মাগফিরাত অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : কবি, সম্পাদক ও প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির