post

অমুসলিম মনীষীদের চোখে আল্লাহর রাসূল সা.

এম মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্ফার

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

মহানবী সা.কে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর রহমতস্বরূপ। যার অর্থ হলো তিনি বিশ্বমানবতার মুক্তির বাণী বহন করে নিয়ে এসেছেন পৃথিবীতে সকল প্রকার হানাহানি, ভেদবৈষম্য, আল্লাহদ্রোহী নেতৃত্ব, মানুষের ওপর মানুষের শোষণ বঞ্চনা, জুলুম, নির্যাতন, অশ্লীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে উৎখাত করে ন্যায়, সাম্য, ইনসাফ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শ কায়েমের লক্ষ্যে এক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দাসত্ব ও আনুগত্যের জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আর আমি তোমাকে কেবলমাত্র সমগ্র বিশ্বের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। পবিত্র কুরআনের এ আয়াতের ভাষণ থেকে স্পষ্টভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, বিশ্বনবী সা. বিশ্বের সবার নিকট সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান বাতলে দেয়ার জন্যই মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে পৃথিবীতে পদার্পণ করেছিলেন। মানুষের ব্যক্তিগত, আত্মিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মহানবীর সা. জীবনাদর্শ অনুসরণ ভিন্ন কোন উপায় নেই। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন ‘আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সূরা আহযাব : ২১)।

মহানবীকে সা. নিয়ে বিশ্বের অমুসলিম মনীষীগণ কী লিখেছেন এবং তারা কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বনবীকে সা. মূল্যায়ন করেন এ সম্পর্কে কিছু লিখতে চাই। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইংরেজ কবি কিটসের একটা উক্তি উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন- পৃথিবীর যা কিছু মঙ্গলময়, যা কিছু মহৎ ও সুন্দর সবই নবী মুহাম্মদ সা.। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। বাংলার শীর্ষস্থানীয় কবি তথা সর্ববিষয়েই সুদক্ষ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ‘মানুষের ধর্মবুুদ্ধি খণ্ড খণ্ড হয়ে বাহিরে ছড়িয়ে পড়েছিল তাকে তিনি (মুহাম্মদ সা.) অন্তরের দিকে অখণ্ডের দিকে নিয়ে গিয়েছেন। বিশ্বের পরম দেবতাকে একটি বিশেষরূপে, একটি কোনো বিশেষ স্থানে আবদ্ধ করে না রেখে তিনি সেই মহাপুণ্যের দ্বারকে সমস্ত মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।’ (গ্রন্থ: ধর্মেও অনুরাগ)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলেছিলেন- যিনি মহত্তমদের মধ্যে অন্যতম সেই পবিত্র পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদের সা. উদ্দেশ্যে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তিনি এনেছিলেন নিখাদ শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ।

ইসলাম ও মহানবীর সা. আদর্শ এবং তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যিনি ভারতে মহাত্মা গান্ধী নামে পরিচিত- তিনি বলেছেন ও I become than ever convinced that it was not the sword that won a place for Islam in those days in the scheme of life. It was the rigid simplicity the utter self-efface meat of the prophet the scrupulous regard for pledges. His intense devotion to his friends and followers, his intrepidity his fearlessness, in his absolute trust is God and in his own these and not the sword carried everything before him and surmounted every obstacle. অর্থাৎ আমার ক্রমে দৃঢ় প্রতীতি জন্মেছে যে, পুরাকালে জীবন সংগ্রামে তরবারি ইসলামকে এই বিশ্বজগতে স্থান প্রদান করেনি। নবীর সা. একনিষ্ঠ সরলতা, পূর্ণমাত্রার আত্মত্যাগ, অঙ্গীকারে অবিচল শ্রদ্ধা, বন্ধুবর্গ ও অনুচরগণের প্রতি তাঁর প্রগার অনুরক্তি, তাঁর সাহস, নির্ভীকতা, আল্লাহর প্রতি ও স্বীয় জীবনব্রতে তাঁর ঐকান্তিক নির্ভরতা এ সকল গুণরাজি ইসলামকে বিজয়ী শক্তির মর্যাদা দান করেছে তরবারি নহে, সমস্ত বাধাবিঘœ অতিক্রম করে তাকে সাফল্যমণ্ডিত করেছে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, একজন ইংরেজ সাহিত্যিক লিখেছেন ‘হযরত মুহাম্মদের সা. উদাহরণ তিনি নিজেই। পৃথিবীর কেউ-ই তাঁর সাথে তুলনীয় হতে পারে না বা বিশ্বনীর সা. সক্ষমতা দাবি করতে পারে না। মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে বসবাস করতে যেসব বিষয়গুলোর প্রয়োজন তার সবগুলোরই পূর্ণাঙ্গ উপস্থিতি ছিল জনাব রাসূলে খোদা সা.-এর মধ্যে। ব্যক্তি থেকে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা, বিচার, রাজনীতি ও রাষ্ট্র, সামরিক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল অতুলনীয় সফলতায় উদ্ভাসিত। বিশ্বের কোন ধর্মীয় তথা আধ্যাত্মিক নেতাই রাষ্ট্রীয়, সামরিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এমন অভূতপূর্ব সাফল্যের দাবিদার হতে পারেন নাই। এক্ষেত্রে কেবল মহানবীই সা. ছিলেন ব্যতিক্রম। মহানবীর সা. অতুলনীয় সামরিক দক্ষতা সম্পর্কে বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক ও গবেষক হুগো মার্কাস বলেন, In Laten times and throughout the middle ages in Europe, chivalry has been held in high esteem. But it was born and practiced first of all in Arabia by Mohammad (sm.). Mohammad (sm.) is the first knight. অর্থাৎ পরবর্তী কালেও মধ্যযুগে ইউরোপ বীরত্বকে অতীব সম্মানের চোখে নিরীক্ষণ করেছে কিন্তু এই বীরত্বের জন্মস্থান আরব দেশ ও হযরত মুহাম্মদ সা. হলেন এর প্রথম পথপ্রদর্শক।

মহানবী সা. ছিলেন পৃথিবীতে আল্লাহর রহমত তথা শান্তির দূত। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনুল কারীমে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় মানবতাবাদী দার্শনিক ও লেখক জর্জ বার্নার্ড শ বলেন, If a man like him were to assume the dictatorship in the modern world he would succeed in the much needed peace and happiness. অর্থাৎ আমি প্রগাঢ় প্রত্যয় পোষণ করি যে, মুহাম্মদ সা.-এর মতো কোনো মানুষ যদি মানবমণ্ডলীকে পরিচালিত করার জন্য বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন তাহলেই আজকের বিরাজিত জটিল বিশ্বসমস্যার সমাধান করে মানবসমাজ যাতে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হতেন। মহানবী সা. প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা যে পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বকে শিক্ষা, সাংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করেছিল এ সম্পর্কে অধ্যাপক লেইক বলেন, Islam opened the gate of learning by its introduction of Freedom of thought and brought the cultivation of learning into Europe অর্থাৎ স্বাধীন চিন্তার অগ্রদূত (মুসলিমগণ) ইসলামই সপ্তম শতাব্দীতে ইউরোপের বদ্ধ শিক্ষার দ্বার খুলে দেয় এবং তথায় উচ্চ শিক্ষার পথপ্রদর্শন করে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক গবেষক ও বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম হার্ট বিশ্বের একশত জন শ্রেষ্ঠ মনীষীর তালিকায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদকেই সা. প্রথম স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন এই বলে যে, একটি মানুষের মধ্যে যে অনন্য ১২টি গুণের সমাবেশ ঘটেছে তা একমাত্র হযরত মুহাম্মদের সা. ব্যক্তিত্বেই পাওয়া যায় অন্য কোন ব্যক্তির মধ্যে এতগুলো গুণ বা বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি কল্পনাও করা যায় না।

রুশ ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয় ছিলেন একজন অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগের কারণে ১৯০১ সালে জারের সরকারি চার্চ তাকে সমাজচ্যুত করে। মহান ইসলাম ধর্মের ওপর স্টাডি করে তিনি আলোড়িত হয়েছিলেন। ইসলামী জীবনপদ্ধতি ও দর্শন তাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি যখন স্বদেশ ত্যাগ করে ক্রিমিয়া হতে রুমানিয়ার পথে যাত্রা করেন, পথে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে তাকে এক রেলস্টেশনে নামিয়ে স্টেশন মাস্টারের বাসায় আনা হলে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো ১৯১৩ সালের ৭ই নভেম্বর তার মৃতদেহ থেকে যখন ওভারকোট খোলা হয় তখন তার পকেটে পাওয়া গেল ইংরেজিতে লেখা একটা পুস্তিকা যার নাম ছিল The sayings of Muhammad (sm). মহানবীর সা. বাণীর সংকলনটি ডক্টর স্যার আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক অনূদিত ছিল আর এটাই ছিল টলস্টয়ের মূল্যবান মানসসম্পদ। টলস্টয় লিখেছেন, আমি মুহাম্মদের সা. কাছে অনেক কিছুই শিখেছি। তাঁর আবির্ভাবের আগে পৃথিবী ছিল ভ্রান্তির অন্ধকারে আচ্ছাদিত। তিনি সেই আঁধারে উজ্জ্বল আলোরূপে জ্বলে উঠলেন। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়েছে যে, মুহাম্মদের সা. ধর্ম প্রচার ও প্রদর্শন ছিল যথার্থ। পৃথিবীজুড়ে তুমুল আলোচিত নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত টি. এস. ইলিয়ট ১৯৪৮ সালে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন। তিনি বলেছেন ‘মুহাম্মদ সা. আজীবন অকাতরে কেবল দানই করেছেন, কারো দান গ্রহণ করেননি।’ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিন্ন মতাবলম্বী নোবেল বিজয়ী লেখক যিনি বিশ বছর যাবৎ নির্বাসনে প্রবাস জীবনযাপন করেছেন তিনি দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন যে, ‘রাসূল সা. কর্তৃক প্রচারিত ইসলাম আগামী দিনে একটা বৃহৎ শক্তি হতে যাচ্ছে।’

বিজ্ঞান জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন স্যার সি. ভি রমন। তার আবিষ্কৃত রমন এফেক্ট পদার্থবিজ্ঞানের জগতে অনন্য উদাহরণ হয়ে রয়েছে। ১৯৩০ সালে তিনি নোবেল প্রাইজ লাভ করেন। তিনি মহানবী সা. সম্পর্কে মন্তব্য করেন ‘মুহাম্মদের সা. চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ কলঙ্কহীন। তিনি নিজেকে ভগবানের সমকক্ষ মনে করেননি এবং তাঁর অনুসারীরা কখনো একবারের জন্যও বলেননি যে, তিনি একজন মানুষের চেয়ে বেশি অন্য কিছু ছিলেন। তারা কখনো তাঁর ওপর ঐশী সম্মান আরোপ করে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সা. অন্য যে কোনো ব্যক্তির চেয়ে পৃথিবীর অধিকতর কল্যাণ সাধন করে গেছেন।’ পরিশেষে ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত An Introduction to the History of Medicine MÖ‡š’ Charles Green Cumston এর একটি মন্তব্য দিয়ে আলোচনার ইতি টানতে চাই। Charles Green Cumston e‡jb, When they came in contact with the debris of ancient civilizations they showed their aptitude by putting into practice the beautiful precepts of the Prophet. Who said to his followers teach science which teaches fear of God -------- Science protects from error and sin --.

লেখক : গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির