post

অর্থনীতির নানা চ্যালেঞ্জ

২৯ জানুয়ারি ২০১৪

ইকবাল কবীর মোহন Orthonityবাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক হালচাল নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা নানা শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের শেষদিকে দেশ অস্থিরতার ধকল কাটিয়ে অতি সম্প্রতি স্বস্তির আবহে ফিরে এসেছে। ফলে মানুষ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আশা করলেও অর্থনীতিতে কালোছায়ার বিস্তার ঘটেছে তার প্রভাব থেকে খুব সহজে নিস্তার পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। গত তিন মাসে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্পে যে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে উত্তরণ যে সহজ নয়, তা অনেকেই বলছেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে হলেও সম্প্রতি প্রশ্নবোধক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করলেও আন্তর্জাতিক পরিম-লে এর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। ফলে সরকারের জন্য রয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ। সরকারকে একদিকে তার বৈধতার বিষয়ে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হবে, অন্য দিকে স্থবির অর্থনীতির কঠিন বাস্তবতাকেও সামাল দিতে হবে। আবার দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে অবস্থান করায় সবার অংশগ্রহণমূলক সম্ভাবনার দিকটিও অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা কাজ করছে। তা ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়ে গ্যারান্টি না থাকায় সঙ্কট যে কোন সময় ঘনীভূত হতে পারে। ফলে অর্থনীতি একটি নিরাপদ অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে-এমন নিশ্চয়তা নেই। ইতোমধ্যে দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাক্সিক্ষত ধারা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। যার ফলে জিডিপি কমে ৫.৮ শতাংশে ঠেকেছে। এ বছর বেসরকারি খাত ও সরকারি খাতের বিনিয়োগ পড়তির দিকে থাকায় সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হারের পতন ঘটেছে। বিগত দুই বছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কম হলেও সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিনিয়োগ মোট বিনিয়োগ আগের বছরের সমান ছিল। অথচ এ বছর দুই খাতেই বিনিয়োগের নি¤œমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সরকারি বিনিয়োগ কম হওয়ার বড় প্রমাণ হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) হার গত পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে এ বছর সর্বনি¤œ। গত বছরের চার মাসের ২০ শতাংশের বিপরীতে এই হার ১৫ শতাংশের কাছাকাছি বলে অনুমান করা হচ্ছে। এডিপি বাস্তবায়নে বড় সমস্যা হচ্ছে অর্থের অভাব। আর অর্থের বড় অংশ হলো কর থেকে সংস্থান। কিন্তু সরকারের কর আদায় গত মাস পর্যন্ত ৬ হাজার কোটি টাকা কম হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে এডিপি বাস্তবায়নে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে দেশ বেরিয়ে আসতে না পারলে বছর শেষে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এডিপি বাস্তবায়নে ব্যয়ের জন্য আরেকটি উৎস হলো বৈদেশিক সাহায্য। এ বছর প্রাক্কলিত পরিমাণ বৈদেশিক প্রকল্প সাহায্য কম আসায় উন্নয়ন ব্যয়ের সুযোগ কমে গেছে। উল্লেখ্য, গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বৈদেশিক সাহায্য এসেছিল ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবারে তা নেমে গেছে ৮৫ মিলিয়ন ডলারে। একতরফা নির্বাচনের কারণে অর্থবছরের বাকি সময়ে বৈদেশিক সহায়তা ও প্রতিশ্রুতি কোনোটাই বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা কম। সব মিলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন এডিপি বাস্তবায়নে এ ধারা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে এডিপি বাস্তবায়ন ৭০ শতাংশের ওপরে উঠানোই কষ্টকর হবে। কারণ, আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক সঙ্কট আরো ঘনীভূত হতে পারে। সম্প্রতি সময়ে দেশে শিল্পঋণ বৃদ্ধির হারও কমে যাওয়ায় ব্যাংকের তারল্য বেড়ে গেছে এবং বর্তমানে তা ৮৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বিগত কয়েক মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার কারণে অন্যান্য শিল্পের ন্যায় পোলট্রি শিল্পে চরম হতাশার চিত্র লক্ষ করা গেছে। এ শিল্পে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। অথচ বিগত তিন মাসে প্রায় ৩০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। তার কারণ সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বাচ্চা উৎপাদন, ডিম নষ্ট হওয়াসহ ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করতে না পারার কারণে এই শিল্পে তিন মাসে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬৩০ কোটি টাকা। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিল্প মালিকদের পুরো বছর লেগে যেতে পারে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকেরা আবারো পুঁজি সংগ্রহ করতে না পারলে অনেকের জন্য টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমাদের হিমায়িত পণ্য রফতানিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফলে কৃষি ও রফতানিমুখী এই খাতে প্রায় ১৮০ কোটি টাকার ক্ষতি বা লোকসান গুনতে হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য অনেক খাতেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরেকটি খাত হলো পরিবহন খাত। এই খাতে বিগত কয়েক মাসে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থির থাকায় চলতি বছরে জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল তা অর্জিত হয়নি। এবারেও আগামী ছয় মাসের জন্য (জানুয়ারি-জুন) বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে তাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের কাছাকাছি থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এই প্রবৃদ্ধি নিয়ে তেমন আশার বাণী শোনাতে পারেনি। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫.৭ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এটি ৫.৫ শতাংশ হবে বলে ধারণা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ধারণা সঠিক হলে বাংলাদেশের আগামী দিনের অর্থনীতির পথচলা খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হয় না। এ দিকে অরাজক পরিস্থিতির কারণে আমাদের অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স আয় প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বিদেশে শ্রমিক রফতানির পরিমাণ প্রায় ২১ শতাংশ কমে গেছে। ফলে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৬৭৭ কোটি ৮৫ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৭৪০ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। সম্প্রতি দেশে একটি নতুন সরকার নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে বিতর্ক ও প্রশ্ন থাকায় অনেকে মনে করছেন বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সরকারের সম্পর্কের টানাপড়েন বাড়তে পারে। এই সম্পর্ক আগে থেকেই অনেকটা শিথিল ছিল। তা ছাড়া অতি সম্প্রতি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের শ্রমিকদের ধরপাকড়ের ঘটনা রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক আবহ সৃষ্টি করবে। সব মিলিয়ে বিদেশে লোক সরবরাহ কমে গেলে রেমিট্যান্স আয় হ্রাস পাবে এবং এতে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও পোশাক খাতে রফতানি ভালো অবস্থায় আছে। এ ক্ষেত্রেও শঙ্কার নানা দোলাচল রয়েছে। কেননা, সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি পোশাক খাতের বিপুল পরিমাণ রফতানি আদেশ অন্যান্য দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এই কারণে আগামী মাসগুলোতে এই খাতে সঙ্কট তৈরি হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি একটি দীর্ঘমেয়াদি না হলেও মধ্যমেয়াদি সঙ্কটে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই আশঙ্কা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে ত্বরিত উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে দেশকে বের করে আনতে হবে এবং বিদেশের সাথে আস্থার যে ঘাটতি ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে তা দ্রুততার সাথে দূর করতে হবে। লেখক : ব্যাংকার, প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির