post

আজাদী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ বীর শহীদ তিতুমীর

এ্যাড. আবু তাহের

২৮ আগস্ট ২০২৩

শুরুর কথা

পলাশীর যুদ্ধের ঠিক পঁচিশ বছর পর ১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়া থানার বাগজোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের হায়দারপুর মতান্তরে চাঁদপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত ‘সাইয়িদ’ ও ‘মীর’ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আজাদী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ বীর সাইয়িদ মীর নিসার আলী তিতুমীর। তাঁর পিতার নাম সাইয়িদ হাসান আলী আর মায়ের নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। আমরা যদিও তাঁকে ‘তিতুমীর’ বলেই চিনি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর আসল নাম তিতুমীর নয়। এই নামের পেছনে আছে এক মজার ঘটনা। 

ছোটোকালে নিসার আলী ছিলেন খুব হালকা-পাতলা, রোগাটে এবং যারপরনাই দুর্বল। কোনো ঔষধেই কাজ হচ্ছিল না। শেষে তাঁর দাদি হেকিম ও কবিরাজের পরামর্শে গাছ-গাছালির ছাল, পাতা ও লতাগুল্ম বেটে রস সংগ্রহ করেন। সেই তেতো রস আদর করে নাতিকে খেতে দেন। ছোট্ট নিসার আলী ঢক ঢক করে খেয়ে নেন সেগুলো। এভাবেই একদিন তাঁর রোগ ভালো হয়ে যায়। তারপর থেকে দাদি তাঁকে আদর করে ‘তিতামীর’ বলে ডাকতেন। সেই তিতামীরই ধীরে ধীরে ‘তিতুমীর’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই কুরআনের হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়েও পান্ডিত্য লাভ করেন তিনি। একই সাথে বাংলা, আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন

১৮২২ সালে ৪১ বছর বয়সে সাইয়িদ মীর নিসার আলী তিতুমীর মক্কায় হজ¦ পালনের উদ্দেশ্যে গমন করেন। তিনি সেখানে উপমহাদেশের ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পথপ্রদর্শক সাইয়েদ আহমদ বেরলভি শহীদের সাথে সাক্ষাৎ শেষে অনুপ্রাণিত হন এবং শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তাঁর। ১৮২৭ সালে সেখান থেকে এসে গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন তিতুমীর। ‘তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়া’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে ‘তাহবান্দ’ নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন।

এসময় বিভিন্ন স্থানে সভা-সমিতির মাধ্যমে ইসলামী দাওয়াতের কাজ শুরু করেন মাওলানা তিতুমীর। তাঁর দাওয়াতের মূল কথা ছিল- ইসলামে পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন এবং প্রত্যেকটি কাজে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পালন। তিতুমীরের আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ত্রিমুখী। প্রথমত, মুসলমানদের অধর্মীয় আচার থেকে বাঁচানো। দ্বিতীয়ত, শাসক ইংরেজদের ইঙ্গিতে পরিচালিত অত্যাচারী শোষক জমিদারদের হাত থেকে শোষিত হিন্দু-মুসলমান প্রজাদের রক্ষা করা। তৃতীয়ত, ভারতবর্ষকে ইংরেজ শাসন মুক্ত করা। 

মি. হান্টার অবশ্য তিতুমীরকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘...এই সময় কলকাতায় ধর্মগুরুর যেসব শিষ্য-সাগরেদ ছিল, তাদের মধ্যে পেশাদার কুস্তিগির ও গুন্ডা প্রকৃতির একটা লোক ছিল তিতু মিয়া নামে। এই ব্যক্তি এক সম্ভ্রান্ত কৃষকের পুত্র হিসেবে জীবন আরম্ভ করলেও জমিদারের ঘরে বিয়ে করে নিজের অবস্থার উন্নতি করেছিল। কিন্তু উগ্র ও দুর্দান্ত চরিত্রের দরুন তার সে অবস্থা বহাল থাকেনি। কিছুদিন কলকাতায় মুষ্টিযোদ্ধার অসম্মানজনক জীবনযাপন করতে হয়েছিল তাকে।... লাঠিয়াল বাহিনীতেও তিনি যোগদান করেছিলেন।’

তিতুমীর প্রথমে সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং রক্তপাত চাননি। কিন্তু জমিদার বাবুরা তাঁর শান্ত আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করল। ইংরেজদের বলে বলীয়ান তারাগুনিয়ার বিখ্যাত জমিদার রাম নারায়ণ বাবু, পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, নগরপুরের গৌর প্রসাদ চৌধুরী প্রমুখ একত্রিত হয়ে তিতুমীরের আন্দোলন খতম করার জন্য তাঁদের এলাকায় পাঁচটা বিষয়ে আদেশ জারি করল। আদেশগুলো হলো-

১. যারা নিসার আলীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করবে, দাড়ি রাখবে, গোঁফ ছাঁটবে; তাদের প্রত্যেককে ফি দাড়ির ওপর আড়াই টাকা এবং ফি গোঁফের উপর পাঁচসিকা খাজনা দিতে হবে।

২. মসজিদ প্রস্তুত করলে প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচশত টাকা ও প্রত্যেক পাকা মসজিদের জন্য এক হাজার টাকা জমিদার সরকারে নজর দিতে হবে।

৩. পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন সন্তানের যে নাম রাখবে, সে নাম পরিবর্তন করে আরবি নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্য জরিমানা ফি পঞ্চাশ টাকা জমিদার সরকারে জমা দিতে হবে।

৪. গো-হত্যা করলে হত্যাকারীর দক্ষিণ হস্ত কেটে ফেলা হবে, যেন সে আর গো-হত্যা করতে না পারে।

৫. যে ব্যক্তি নিসার আলীকে নিজ বাড়িতে স্থান দেবে, তাকে তার ভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হবে।

নিসার আলী এহেন নির্দেশনা শুনেও সংঘর্ষে না গিয়ে বরং পুঁড়ার জমিদার বাবু কৃষ্ণদেব রায়ের নিকট শান্তি রক্ষার জন্য একটি পত্র লিখলেন। সেই চিঠি পাঠালেন জনৈক আমিনুল্লাহ নামক ব্যক্তির মাধ্যমে। কিন্তু জমিদার সেই দূতের ওপর অমানবিক অত্যাচার ও প্রহার করে। এর ফলে শহীদ হয়ে যান তিনি। 

সম্মিলিত ষড়যন্ত্র

সাইয়িদ নিসার আলী ও তাঁর অনুসারীদের দমন করার জন্য জমিদাররা উঠে পড়ে লেগে গেল। পরামর্শের জন্য সকলে কলকাতার জনৈক লাটু বাবুর বাড়িতে একত্রিত হলো তারা। এই সভায় হাজির ছিল কলকাতার লাটু বাবু, গোবরডাঙার জমিদার কালীপসন্ন মুখপাধ্যায়, গোবরা- গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়, নুর নগরের জমিদারের ম্যানেজার, টাকীর জমিদারের সদর নায়েব, রানা ঘাটের জমিদারের ম্যানেজার, পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, বশিরহাট থানার দারোগা রাম রাম চক্রবর্তী, যদুর আটির দুর্গাচরণ চক্রবর্তী প্রমুখ। সভায় তারা সিদ্ধান্ত হলো- যেহেতু নিসার আলীকে দমন করতে না পারলে আমাদের পতন অনিবার্য; সেই কারণে যে করেই হোক, তাকে শায়েস্তা করতেই হবে। এ ব্যাপারে সকল জমিদার একযোগে কাজ করবে এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা করবে। 

তারা নীলকরদের সাহায্যও নিবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। নীলকরদের বোঝানো হবে- নিসার আলী শুধু জমিদারদের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করছে না, বরং নীলকর ও ইংরেজদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করছে। আর হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে এ কথা ঢাউস করে প্রচার করে দিতে হবে- নিসার আলী গোমাংসের দ্বারা হিন্দুদের দেবালয়াদি অপবিত্র করছে। হিন্দুর মুখে কাঁচা গোমাংস গুঁজে দিয়ে জাতি নাশ করছে তাদের। বশিরহাটের দারোগাকে এ ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্য করার জন্য অনুরোধ জানানো হলো। দারোগাও অনুরোধে সাড়া দিলো তাদের।

কয়েকদিন পর শুক্রবার কৃষ্ণদেব রায় সশস্ত্র লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে যখন সরফরাজপুরে পৌঁছল, তখন জুমার মুসল্লিগণ নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন। কৃষ্ণদেবের লাঠিয়ালরা মসজিদে আগুন লাগিয়ে দিলো। মসজিদের মুসল্লিগণ বাইরে এলে আক্রমণ করল তাদের ওপর। দু’জন মুসল্লি সড়কিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলেন এবং আহত হলেন অনেকেই। নিসার আলী প্রাণে বেঁচে গেলেন। আশপাশের মুসলমানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিলো কৃষ্ণদেব। তাদের ওপর চালালো অকথ্য নির্যাতন। 

মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি

মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা কায়েমি স্বার্থবাদীদের রক্তে লেগে আছে। যুগে যুগে তারা সাধারণ মানুষ বা বিপ্লবীদেরকে মিথ্যা মামলার জালে আটকিয়ে বন্দি রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে। নিসার আলীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। কৃষ্ণদেব রায় ও তার গুন্ডাবাহিনী সরফরাজপুরের মসজিদটি পুড়িয়ে দেওয়ার ১৮ দিন পর নিজেই বাদি হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করল। মামলার এজাহারে উল্লেখ করল- নিসার আলীর লোকেরাই তার লোকজনকে মারপিট করেছে। তাকে ফাঁসানোর জন্য নিজেরাই মসজিদে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে নিসার আলী ও তার লোকেরা। 

এজাহারের মূল বক্তব্য ছিল এমন- ‘নীল চাষদ্রোহী, জমিদারদ্রোহী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিদ্রোহী তিতুমীর নামক ভীষণ গুণ্ডা প্রকৃতির এক ওহাবি মুসলমান এবং তার সহস্রাধিক শিষ্য পুঁড়ার জমিদার শ্রীযুক্ত কৃষ্ণদেব রায় মহাশয়ের দু’জন বরকন্দাজ ও একজন গোমস্তাকে অন্যায় ও বেআইনিভাবে কয়েদ করে গুম করেছে। বহু অনুসন্ধানেও আমরা তাদের পাচ্ছি না। আমাদের উক্ত পাইক ও গোমস্তা সরফরাজপুর মহলের প্রজাদের নিকট খাজনা আদায়ের জন্য মহলে গিয়েছিল। খাজনার টাকা লেনদেন ও ওয়াশিল সম্বন্ধে প্রজাদের সাথে বচসা হওয়ায় তিতুমীরের হুকুম মতে তার দলের লোকেরা আমাদের গোমস্তা পাইকদের জবরদস্তি করে কোথায় কয়েদ করেছে, তা জানা যাচ্ছে না। তিতুমীর দম্ভভরে প্রচার করছে যে, সে এ দেশের রাজা। সুতরাং, জমিদারকে আর খাজনা দিতে হবে না...।’

অন্যদিকে মুসলমানরাও কলিঙ্গের পুলিশ ফাঁড়িতে কৃষ্ণদেব রায় ও তার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে খুন, জখম, মারপিট প্রভৃতি ধরনের মামলা দায়ের করলে সেটাও আমলে নিলো। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে কলিঙ্গ পুলিশ ফাঁড়ির জমাদার দেখলেন- কৃষ্ণদেব রায় যে অভিযোগ করেছে, তা পুরোপুরি মিথ্যা এবং মুসলমানরা যে মামলা দায়ের করেছে, তা পুরোপুরি সত্য। তখন তিনি লিখলেন, ‘আমার মতে- এ জটিল মামলা দু’টির তদন্তের ভার বশিরহাটের অভিজ্ঞ দারোগা রাম রাম চক্রবর্তীর ওপর অর্পণ করা হোক।’

অতঃপর বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট কৃষ্ণদেব রায়কে ডেকে আগাম জামিন দিয়ে রাম রাম চক্রবর্তীকে মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার জন্য আদেশ প্রদান করলেন। এ যেন ‘একে তো নাচুনি বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি’ অবস্থা! রাম রাম চক্রবর্তী বেজায় খুশি। আগে থেকেই সে জমিদারদের সাথে একত্রিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কৃষ্ণদেবের বাড়িতে গিয়ে আরাম-আয়েশে কয়েকদিন কাটিয়ে মামলার একটি চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করল। রিপোর্টে সে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অবগত করল-

১. জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের গোমস্তা ও পাইকদেরকে তিতু ও তার লোকেরা বেআইনিভাবে কয়েদ করে রেখেছিল। পরে কৌশলে পলায়ন করে আত্মগোপন করেছিল তারা। পুলিশের আগমনের পর তারা আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং, এ মামলা অচল।

২. তিতুমীর ও তার লাঠিয়াল জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ও তার পাইক বরকন্দাজদের বিরুদ্ধে খুন, জখম, লুট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি মিথ্যা অভিযোগ এনেছে। 

৩. তিতু ও তার লোকেরা নিজেরাই তাদের নামাজঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। অতএব, এ মামলা চলতে পারে না।

এই মামলায় নিসার আলীকে নিয়ে রাম রাম চক্রবর্তীর মনগড়া সাজানো রিপোর্টের কারণে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় জয়লাভ করে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও শোষণের মাত্রা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো। ১৮৩১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মুসলমানরা কমিশনারের কোর্টে আপিল করার জন্য কলকাতা গেল কিন্তু কমিশনারের অনুপস্থিতির কারণে আপিল করা আর হলো না। সরফরাজপুর গ্রামবাসীর পরামর্শে ১৮৩১ সালের ১৭ অক্টোবর নিসার আলী কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়া নামক গ্রামে চলে গেলেন। কিন্তু সেখানেও তিনি নিরাপদে বসবাস করতে পারলেন না। ১৮৩১ সালের ২৯ অক্টোবর কৃষ্ণদেব রায় সহস্রাধিক লাঠিয়াল ও অস্ত্রধারী গুন্ডাবাহিনীসহ নারিকেলবাড়িয়া গ্রাম আক্রমণ করল। বহু মুসলিম নরনারীকে মারপিট ও জখম করল তারা। উপর্যুপরি জমিদার বাহিনীর আক্রমণে মুসলমানগণ দিশেহারা হয়ে পড়লেন। তখন বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে হলো তাদের।

ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা ও লাঠিয়াল বাহিনী গঠন

তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও নীলকরদের সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। আগেই তিতুমীর ‘পাহলোয়ান’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন এবং লাঠি চালনায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ভাগনে গোলাম মাসুমকে সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন তিনি। অন্যান্য অনুসারীদের নিয়ে লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা পাঁচ হাজারে গিয়ে পৌঁছায় একসময়। তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হন। ১৮৩১ সালের ২৩ অক্টোবর বারাসতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তৈরি করেন বাঁশের কেল্লা। বাঁশ এবং কাদা দিয়ে তাঁরা দ্বি-স্তরবিশিষ্ট এই কেল্লা নির্মাণ করেন। 

এর ঠিক চৌদ্দ দিন পর অর্থাৎ ১৮৩১ সালের ৬ নভেম্বর জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তার বাহিনীসহ মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয় এবং বহু লোক হতাহত হয় উভয়পক্ষের। এরপর কৃষ্ণদেব রায় চারদিকের হিন্দু সমাজে প্রচার করে দেয়- মুসলমানরা অকারণে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এ প্রচারণায় হিন্দুদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং গোবরডাংগার নীলকর জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় মোল্লাআটি নীলকুটির ম্যানেজার মি. ডেভিসকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে। প্রায় চারশত হাবশী যোদ্ধা ও বিভিন্ন মারণাস্ত্রসহ নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে ডেভিস। এবারও উভয়পক্ষের বহুলোক হতাহত হয়। ডেভিস পলায়ন করে। তার বজরা ধ্বংস করে দেয় মুসলমানরা। উক্ত ঘটনার কিছুদিন পরে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় এক বিরাট বাহিনীসহ নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে। উভয়পক্ষের প্রচন্ড যুদ্ধে সড়কির আঘাতে নিহত হয় জমিদার দেবনাথ রায়।

উপরিউক্ত ঘটনার পর চতুনার জমিদার মনোহর রায় জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের কাছে যে পত্র লেখেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি লেখেন, ‘নীলচাষের মোহ আপনাদেরকে পেয়ে বসেছিল। তার ফলেই আজ আমরা দেবনাথ রায়ের ন্যায় একজন বীরপুরুষকে হারালাম। এখনো সময় আছে- আর বাড়াবাড়ি না করে তিতুমীরকে তার কাজ করতে দিন, আর আপনারা আপনাদের কাজ করুন। তিতুমীর তার ধর্ম প্রচার করছে, তাতে আপনারা জোট পাকিয়ে বাধা দিচ্ছেন কেন? নীলচাষের মোহে আপনারা ইংরেজ নীলকরদের সাথে এবং ইংরেজ পাদ্রিদের একতাবদ্ধ হয়ে দেশবাসী ও কৃষক সম্প্রদায়ের যে সর্বনাশ করছেন, তা তারা ভুলবে কী করে? আপনারা যদি এভাবে দেশবাসীর ওপর গায়ে পড়ে অত্যাচার চালাতে থাকেন, তাহলে বাধ্য হয়ে আমি তিতুমীরের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসব। আমি পুনরায় বলছি- নীলচাষের জন্য আপনারা দেশবাসীর অভিসম্পাত কুড়াবেন না।’

এদিকে খবর পাওয়া গেল- শেরপুর নীলকুঠির ম্যানেজার মি. বেনজামিন বহু লাঠিয়াল ও সড়কিওয়ালাসহ নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণের জন্য যাত্রা করেছে। এ খবর প্রচারিত হওয়ার পর তাদেরকে বাধাদানের জন্য তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুমকে পাঠানো হলো মুজাহিদ বাহিনীসহ। তাঁরা বারঘরিয়া নামক গ্রামে এক ঝোপের পাশে লুকিয়ে রইলেন। যথাসময়ে শত্রুপক্ষের বজরা বারঘরিয়ায় ভিড়লে বজরায় দু’জন ইংরেজ ও কৃষ্ণদেবকে দেখতে পেয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নিলো মুজাহিদ বাহিনী। শত্রুপক্ষ মুজাহিদ বাহিনীকে দেখতে পেয়ে গুলি চালালো। মুজাহিদ বাহিনীও চালালো তাদের সড়কি। উভয়পক্ষের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হলো।

খলিফা হিসেবে পরিচিতি

তিতুমীর ইংরেজ রাজত্বের বিলুপ্তি এবং মুসলিম রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণা করলেন। বাস্তবক্ষেত্রে জমিদার, নীলকর ও শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধেই জিহাদ ঘোষণা করলেন তিনি। জমিদারদের খাজনা প্রদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। সুদ প্রথার বিলোপ করলেন এবং দেশকে ‘দারুল হরব’ ঘোষণা করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহ্বান জানালেন সবাইকে। একটি ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়; এই বিশ্বাস থেকে তিনি একটি ইসলামী স্বাধীন সরকার গঠন করলেন। একটি মন্ত্রিসভার অধীনে সরকার পরিচালনার ব্যবস্থাও করেন তিতুমীর। 

তিনি নিজে ছিলেন এই স্বাধীন সরকারের প্রধান বা খলিফা। মৈনুদ্দিন নামের একজনকে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। বারাসা, চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া অঞ্চলে তিনি পরিচিতি লাভ করলেন স্বাধীন ‘বাদশা’ হিসেবে। তখন মুজাহিদের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের অধিক। ভীত-সন্ত্রস্ত জমিদার ও নীলকুঠিয়ালরা তিতুমীরকে দমনের জন্য সামরিক সাহায্য চেয়ে বাংলার তৎকালীন গভর্নরের কাছে দরখাস্ত করল। গভর্নরের নির্দেশে কলকাতা থেকে একটি সেনাদল পাঠানো হলো। এদের সাথে যোগ দিলো রাইফেলধারী পুলিশ।

যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে এই বাহিনী ১৮৩১ সালের ১৫ নভেম্বর নারিকেলবাড়িয়ায় আক্রমণ করল। মুজাহিদ বাহিনী একপর্যায়ে এই বাহিনীকে ঘিরে ধরল চারদিক থেকে। যুদ্ধে ইংরেজ পক্ষের বহু লোক হতাহত হলো। কোনোমতে পালিয়ে আত্মরক্ষা করল আলেকজান্ডার। ১৭ নভেম্বর আবারও কৃষ্ণনগরের ম্যাজিস্ট্রেট আর একটি বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়া অভিমুখে যাত্রা করল। এই বাহিনীকেও বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করতে হলো শেষ পর্যন্ত। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করেছিল। তন্মধ্যে বারাসত বিদ্রোহ অন্যতম। উইলিয়াম হান্টার বলেন, ‘ওই বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষক সেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।’

শেষ লড়াই

জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি. আলেকজান্ডার পালিয়ে গিয়ে নিসার আলীকে শায়েস্তা করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি রিপোর্ট পেশ করল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষেপে গেল এতে। দেরি না করে কোম্পানি সরকার কর্নেল স্টুয়ার্টকে সেনাপতি নিযুক্ত করে তার অধীনে একশত ঘোড়সওয়ার সৈন্য, তিনশত পদাতিক সৈন্য, দু’টি কামান ও প্রচুর গোলাবারুদসহ পাঠিয়ে দিলো নারিকেলবাড়িয়ার দিকে। কোম্পানির সৈন্যরা নারিকেলবাড়িয়া পৌঁছে গ্রামটিকে অবরোধ করে ফেলল। কর্নেল স্টুয়ার্ট নিসার আলীর হুজরাখানার সামনে গিয়ে ইবাদাতে মগ্ন অবস্থায় দেখল তাঁকে। সে তার দোভাষী রামচন্দ্রের মাধ্যমে কথা বলতে চাইল। কারণ স্টুয়ার্টের কাছে তিতুমীরকে বিদ্রোহী বলে মনে হয়নি। 

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো- রামচন্দ্র দোভাষীর ভূমিকা পালন না করে বরং ষড়যন্ত্রের একটা মোক্ষম সুযোগ হিসেবে সেটিকে গ্রহণ করল। অনেক কথার একপর্যায়ে তিতুমীর বললেন, ‘আমি কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইনি, বরং জমিদার নীলকরদের অত্যাচার থেকে অত্যাচারিতদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছি মাত্র। আর চেষ্টা করেছি মুসলমানদেরকে ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী প্রকৃত মুসলমান হিসেবে গড়ে তুলতে।’ তখন দোভাষী হিসেবে রামচন্দ্র স্টুয়ার্টকে সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা বলল। সে স্টুয়ার্টকে বলল, ‘তিতুমীর বলছে- সে আত্মসমর্পণ করবে না, যুদ্ধ করবে। সে বলে যে, তোপ ও গোলাগুলিকে সে তোয়াক্কা করে না। সে-ই এ দেশের বাদশাহ, কোম্পানি আবার কে?’

রামচন্দ্রের এই বিশ্বাঘাতকতাপূর্ণ মিথ্যাচার এবং নিসার আলীর না বলা এসব বানানো কথা শুনেই স্টুয়ার্ট হিং¯্র পশুর মতো ক্ষেপে গেল। সে যুদ্ধের নির্দেশ দিলো। স্টুয়ার্টের সাথে আরও ছিল তুখোড় সৈনিক ক্যাপ্টেন সাদারল্যান্ড, ক্যাপ্টেন শেকসপীয়র প্রমুখ। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর। ফজরের নামাজ শেষে নিসার আলীর শেষ লড়াই। একদিকে ইংরেজদের ভারী কামান, রাইফেল এবং সুশিক্ষিত সৈন্য। অপরদিকে নিসার আলীর লাঠি, সড়কি ও তীর-ধনুকে সজ্জিত একদল জানবাজ দুঃসাহসী বাহিনী। এ এক অসম লড়াই! নিসার আলী তাঁর সাথীদেরকে জানিয়ে দিলেন- ‘যুদ্ধ চালিয়ে যাও, শাহাদাতই আমাদের সর্বশেষ মঞ্জিল।’ 

তারপর যুদ্ধ করতে করতে একসময় নিসার আলীসহ অনেকেই ঢলে পড়লেন শাহাদাতের কোমল বিছানায়। শহীদ হলেন তাঁর পুত্র জওহর আলী এবং আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ময়েজউদ্দিনসহ পঞ্চাশজন তেজোদীপ্ত মুজাহিদ। ইংরেজদের হাতে বন্দি হলেন ৩৫০ জন বীর মুজাহিদ। ইংরেজ দস্যুরা যুদ্ধ শেষে মৃতদেহগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেলল। বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিলো এবং সহায়-সম্পদ লুট ও অনেককে গ্রেফতার করল। কামানের গোলার মুখে ধ্বংস হয়ে গেল ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা।

এই যুদ্ধের পর ইংরেজ সরকার সর্বমোট ১৯৭ জনের বিচার করেছিল। তাঁদের মধ্যে প্রধান সেনাপতি নিসার আলীর ভাগনে গোলাম মাসুমকে দেওয়া হয়েছিল মৃত্যুদন্ড। ১১ জনের যাবজ্জীবন এবং ১২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছিল। বিচারকালে ৪ জনের মৃত্যু হয় এবং ৫৩ জন খালাস পান। এই যুদ্ধ সম্পর্কে ইংরেজ সেনাপতি মেজর স্কট আফসোসের সাথে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি ঠিকই, কিন্তু এতে প্রাণ দিয়েছেন একজন ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক মহাপুরুষ।’

শেষ কথা

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ইংরেজরা বাংলার বুকে শোষণের হাতিয়ার নিয়ে স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে বসে। বাংলার মুসলমানসহ নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও ইংরেজ ও তাদের তাঁবেদার জমিদারদের শোষণ ও নির্যাতনের মুখে পড়েন। শুরু হয় মীর জাফরের যুগ। অন্যদিকে এক এক সময় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে জ¦লে ওঠেন মীর কাসিম, মজনু শাহ, সাইয়েদ আহমদ বেরলভি, হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং নিসার আলী তিতুমীর প্রমুখ দুঃসাহসী সংগ্রামী নেতা। নিসার আলী সংগ্রাম করেছেন মজলুম জনতার পক্ষে, যুদ্ধ করেছেন জালিমের বিরুদ্ধে। তিনি যে সংগ্রাম করেছিলেন, তা পরবর্তীকালে মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় আজাদীর পথে এক অসামান্য আলোকবর্তিকার কাজ করেছে। শহীদ সাইয়িদ নিসার আলী তিতুমীর বাংলার মুসলমানের জন্য সংগ্রাম, শাহাদাত ও আজাদী আন্দোলনের এক অসাধারণ স্বপ্নপুরুষ।

তথ্যসূত্র :

১. দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস- ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার।

২. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস- আব্বাস আলী খান।

৩. একশ বছরের রাজনীতি- আবুল আসাদ।

৪. উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলিমদের রাজনৈতিক জীবন। 

৫. শহিদ তিতুমীর- মোশাররফ হোসেন খান। 

৬. উইকিপিডিয়া।

লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, লালমনিরহাট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির