post

আবদুর রহমান আল

কবি ড. কামরুল হাসান

০১ জুন ২০২২

আবদুর রহমান আল-আশমাবি (জন্ম-১৯৫৬-) প্রখ্যাত আরবি ও ইসলামি কবি। সৌদি আরবের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় ইসলামি কবি। একাধিক দিওয়ান বা কাব্য সঙ্কলন ছাড়াও সাহিত্য ও ইসলামমনস্ক প্রবন্ধ লিখে তিনি পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করে নিয়েছেন। তিনি তার জীবনের ষাট বছর অতিক্রম করলেও এখনও লিখে চলেছেন দু’হাতে। সৌদির দক্ষিণ এলাকায় আল-বাহা অঞ্চলের তারা নামক মহল্লায় ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আপন পিত্রালয় ও নিজ মহল্লায় প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর মাধ্যমিকের পাঠ শেষে ইমাম মুহাম্মদ ইবনু সাউদ ইসলামি বিশ^বিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ফ্যাকাল্টিতে ভর্তি হন এ বিশ^বিদ্যালয় হতেই ভাষাবিষয়ে ¯œাতক এবং পরবর্তীতে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। অলঙ্কার, সমালোচনা ও সাহিত্যকলা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

এবার তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি শিক্ষা, শিক্ষণ ও শিক্ষকতাকেই বেছে নেন। তিনি তার নিজ বিশ^বিদ্যালয় ইমাম মুহাম্মদ ইবনু সাউদ ইসলামি বিশ^বিদ্যালয়ে চাকরিতে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি আরবি ভাষা ফ্যাকাল্টির মডার্ন ক্রিটিসিজম বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। একই সাথে তিনি অলঙ্কার, সমালোচনা ও সাহিত্যকলা বিষয়ের প্রভাষক হিসেবেও লেকচার প্রদান অব্যাহত রাখেন। তিনি অবসর গ্রহণ পর্যন্ত এ দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। আবদুর রহমান আল-আশমাবি একজন সুবিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত ও বোদ্ধা। একই-সাথে তিনি ইসলামি কাব্যযোদ্ধা। তার সকল কবিতাই আলোকসঞ্চারী। অন্ধকারে নিপিষ্ট ও নিমজ্জিত ব্যক্তি, চেতনা ও আদর্শকে তিনি আলোর পথে ধাবিত করেন তার অনন্য কাব্যশক্তি সহযোগে। গান, সঙ্গীত ও গীতের এই জামানায় তিনি কবিতাকে সাজিয়েছেন নতুন ঢঙে, নব আঙ্গিকে।

তার হাতে আরবি কবিতা পেয়েছে এক অনুপম সৌষ্ঠব। যে সৌষ্ঠব তাকে এনে দিয়েছে মর্যাদার সুউচ্চ আসন। মুসলিম বিশে^র প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে তার কাব্যকীর্তি। অতি-আগ্রহের সাথে প্রলুব্ধ হয়েছে ইসলামি জনতা তার কাব্যসুষমায়। সত্যিই তার কাব্যগাঁথা আরবি কবিতায় এক নতুন সংযোজন। তার কাব্য বচন, অভিব্যক্তি, উপস্থাপনা, শব্দ চয়ন, গ্রন্থনা সবই যেন ইসলামের ছাঁচে ঢেলে সাজানো। তার কবিতার শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সর্বাঙ্গ সৌন্দর্যমণ্ডিত থাকে ইসলামের প্রোজ্জ্বল আলোক আভায়। তার কাব্যশক্তির নেপথ্যের ইসলামি প্রেষণা নিশ্চয়ই তাকে আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান করবে এবং তিনি এর যথাযথ প্রতিদান লাভে ধন্য হবেন।

আবদুর রহমান আল আশমাবির কাব্যঝুলিতে এমন অসংখ্য কবিতা রয়েছে যার প্রতিটি কবিতাই এক নতুন আলোকোজ্জ্বল প্রত্যুষের দিকে আহ্বান জানায়। তার সকল কবিতাই এক নতুন সূর্যোদয়ের হাতছানিকে সুনিশ্চিত করে। তার কাব্যশক্তিতে এমন প্রাণের ব্যঞ্জনা প্রত্যক্ষ করা যায় যা এই মৃত প্রায় জাতিকে সঞ্জীবনী শক্তি পূর্ণ মাত্রায় ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। তার কাব্যকৌশল ছিল এক সুমহান বীর্যবত্তা যা তার পাঠককে সাহসী করে তোলে। তার কাব্য মোহিনীতে মোহাবিষ্ট করে। জাতির দুর্দশা বর্ণনায় সে মনের অজান্তেই দুঃখ সাগরে সন্তরণ করে, অঝোরে রোদন করে। আবার স্বাপ্নিক কাব্যে সে আশা সঞ্চারী হয়। স্বর্ণালি ভবিষ্যত যেন সবাক হয়। আশা-আকাক্সক্ষার দিগন্তে নতুন সূর্যের অভ্যুদয় সমাসন্ন হয়। সূর্যালোকের হাতছানিতে জাতির ভাগ্যাকাশ নতুন করে যেন আলোকময় হয়ে ওঠে।

আবদুর রহমান আল-আশমাবি একজন সাব্যসাচী কবি, উদীয়মান লেখক, ধীসম্পন্ন গবেষক। সব থেকে ভালো লাগার বিষয় হলো- আশমাবি সাহিত্যে সর্বদা ইসলামি চেতনার প্রাবল্য অতি প্রকট। এতটাই প্রবল যে, তার প্রতিটি কবিতায় মুসলিম উম্মাহর আস্থা কিংবা দুরবস্থা, সঙ্কট কিংবা বিপর্যয় গর্জন করে উঠত শার্দুলের মতো। যে গর্জনের রেশ মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনুরণিত হতো অনেকক্ষণ ধরে। আশমাবি কাব্যের সফলতার নেপথ্য রহস্য সম্ভবত এখানেই। আবদুর রহমান আল-আশমাবি তার কবিতা কিংবা প্রবন্ধে তুলে এনেছেন বসনিয়া, চেচনিয়া কিংবা লেবাননের মুসলিম দুর্দশার চিত্র। বিশেষত পথশিশুদের নিয়ে রচনা করেছেন অনেক কবিতা। তিনি মুসলিম জাতির সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের প্রাসাদকে কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন। কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতাকে জুড়ে দিয়েছেন তার সাথে। কিয়ামতের দুর্বিষহ অবস্থার মতোই আজকের মুসলিম সমাজের দৈন্যদশা। দুনিয়াতেই যেন সাক্ষাৎ কিয়ামত। আশমাবির কলম সর্বদাই মুসলিম উম্মাহর খেদমতে নিয়োজিত থেকেছে। তার সকল লেখায়ই মুসলিম শৌর্য, ঐতিহ্য প্রোজ্জ্বল হয়েছে। এই দুধারী লেখকের চিন্তাশীল প্রবন্ধ ও সাহিত্যকর্ম নিয়মিত সৌদি আরবের প্রায় সকল পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে থাকে। এই বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সঙ্কলক মুসলিম উম্মাহর জন্য সৃষ্টি করেছেন এক সুবিশাল সাহিত্য খাজাঞ্চি। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে- ক. আল-ইত্তিজাহ আল-ইসলামি ফি আছরি আলি আহমদ বাকাছির- বাকাছির সাহিত্যের ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি। খ. জাকিরাতু আল-তারিখ আল-ইসলামি- ইসলামি ইতিহাসের স্মরণ। গ. বিলাদুনা ওয়া আল-মাইয়ুজ- আমার দেশ এবং বিশেষত্ব। ঘ. ইসলামিয়্যাতু আল-আদাব- সাহিত্যের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া।

বক্তব্য সঙ্কলন- ক. ইসলামিয়্যাতু আল-আদাব লি-মাজা ও কাইফা- সাহিত্যের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া কেন, কিভাবে? খ. ওয়াকফাতু মাআ জুরজি জায়দান- জুরজি জায়দানের সাথে কিছুক্ষণ। গ. ইলাকাতু আল-আদাব বিশাখছিয়াতি আল-উম্মাহ- জাতির ব্যক্তিত্বের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক।

আবদুর রহমান আল-আশমাবির রয়েছে অনেকগুলো কাব্যসঙ্কলন। তন্মধ্যে কয়েকটি হলো- ক. ইলা উম্মাতি- জাতির সকাশে খ. সারাউন মাআ আল-নাফস- মনের সাথে যুদ্ধ। গ. হিওয়ার ফাওকা শিরাই আল-জামান- জামানার তাঁবুতে আলাপচারিতা। ঘ. ইনদা-মা ইয়াজিফু আল-রাফাস- বন্দুকের গুলি যখন বেজে ওঠে। ঙ. শুমুখ ফি জামানি আল-ইনকিসার- পরাজিতের ঔদ্ধত্য। চ. ইনদা-মা ইয়াইন্নু আল-ইফাফ- সতীত্ব যখন কেঁদে বেড়ায়। ছ. জাওলাতুন ফি ইরাবাতি আল-হুজন- চিন্তার গাড়িতে এক চক্কর। জ. আনাকিদু আল-দিয়া- এক থোকা আলো। ঝ. কাল্লা- কখনও নয়। ঞ. বাইয়াতু আল-রাইহ- আতর বিক্রেতা। ড. মা’সাতু আল-তারিখ- ইতিহাসের দুঃখ। ঠ. ইলা হাওয়া- সমীরণ সমীপে ড. নুকুশ আলা ওয়াজিবাতি আল-কারন আল-খামিস আশারা- পঞ্চদশ হিজরি শতকের করণীয়। ঢ. ইয়া উম্মাতা আল-ইসলাম- হে মুসলিম জাতি। ণ. মাশাহিদ মিন ইয়াওমি আল-কিয়ামাতি- কিয়ামাতের দৃশ্য। ত. মারাকিবু জিকরিয়্যাতি- স্মৃতি রোমন্থন। থ. কাসাইদ ইলা লুবনান- লেবাননের জন্য কবিতা। দ. হুলাইমাতু ওয়া আল-ছাওত ওয়া আল-গাদা- স্বপ্ন, প্রতিধ্বনি ও পিপাসা। ধ. ইয়া সাকিনাতা আল-কালব- হে আত্মার প্রশান্তি। ন. কাওয়াফিলু আল-রাহিলিন- কাফেলা। প. হিয়া উম্মি- তিনিই আমার মা। ফ. আল-কুদস আনতি- জেরুজালেম তোমাকে বলছি। ব. কাইফা লাম-নাহজান? চিন্তামুক্ত হই কিভাবে? ভ. ওয়ারাকাতু মিন মুজাকারাতি মুদমানিন তায়িবিন- অনুতপ্ত মদ্যপের ডায়েরি। ম. মিন আল-কুদস ইলা সারায়েভো- জেরুসালেম হতে সারায়েভো। য. ইনাদা-মা তাশাররাকা আল-শামস- সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে।

কবি আবদুর রহমান আল-আশমাবি ছিলেন মানবতার কবি। জীবন, মানবতা, মানবিকতা ইত্যাদি ছিল তার কবিতার মৌল উপজীব্য। তার কবিতার পরতে পরতে রয়েছে নির্যাতিত মানবতার আর্ত চিৎকার। তার ‘হায় বাবা!’ কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে- বাবা! এই আমাদের উপত্যকা, মৃত্যুপুরী রক্তাক্ত এই আমাদের মহল্লা, অভিযোগে ব্যস্ত আমাদের স্বপ্নশাখা বিধ্বস্ত॥ বাবা! ঘর্মাক্ত তোমার চেহারা রক্তলাল তোমার নয়ন যুগল বিবর্ণ, বিষণœ তোমার কপোল হলুদাভ আজ বৃক্ষ-লতা বাবা! কী হচ্ছে এসব এখানে? তবে কি এটি তাতারীদের মৃত্যুপুরী?? বাবা! আমি নিশ্চিত এটিই প্রত্যুষের লগন সূচনাতেই যার দুঃখ রঙ তীরে বুঝি নোঙর করছে শান্তির মিছিল বাবা! আমিই কেবল শুনতে পারছি না তার আওয়াজ আজান ধ্বনি কী আশ্চর্য! শোনা যায় না আজান ধ্বনি।। (ইয়া আবি তথা হায় বাবা কবিতা থেকে) কবি আবদুর রহমান আল-আশমাবি অতিশয় আশাবাদী। প্রতিটি ভাগ্য বিড়ম্বনার পশ্চাতে কবি দেখতে পান আশার ঝলক। যে আশার আলোতে আলোকিত করতে চান সমগ্র মুসলিম জাতিকে। ‘বিচ্ছিন্ন বর্ণমালা’ কবিতায় কবির আশাদীপ্ত উচ্চারণ- আইন, লাম অতঃপর মিম আলিফ এবং নুন ইয়া তাশদিদ, হা এখান হতেই কষ্টের সূত্রপাত শুরু তব দালালির নদীপৃষ্ঠে মেঘের গর্জন॥ আইন-তে দালালি এবং বিদ্রোহের ঝাঁকুনি লাম-তে বিক্রীত আলিমের ঘৃণিত চেহারার নগ্ন প্রকাশ মিম-তে সন্ত্রাসী ঝাণ্ডার উল্লম্ফন আলিফ-তে গণ্ডগোলের সূত্রপাত নুন-তে পরিস্থিতির দ্রুত অবনয়ন ইয়া-তে জুয়ার ভাগ্য খেলায় জাতির নিমজ্জন হা-তে সকল আশা-আকাক্সক্ষার মূলোৎপাটন আইন, লাম অতঃপর মিম আলিফ এবং নুন ইয়া তাশদিদ, হা এই বর্ণগুলোই নষ্ট জামানায় আশার সঞ্চয়ন এই বর্ণগুলোই সমুদ্রতলে হতাশার নিমজ্জন বাদাম তোলা নৌকায় আশার সন্তরণ॥ (আল-হুরুফ আল-মুকাত্তায়াত তথা বিচ্ছিন্ন বর্ণমালা কবিতা থেকে) কবি আমাদের এ ঘুণে ধরা সমাজের জন্য সচল নেতৃত্বের প্রত্যাশা করেন। যে নেতৃত্ব জাতিকে আলোর পথ দেখাতে পারে না সে নেতৃত্বের কোনো প্রয়োজন নেই। ‘চাঁদ তুমি অস্ত যাও’ কবিতায় তাই কবির আকুতি- আমার আশঙ্কা হয় মানব দ্রোহের মেঘের আড়াল হও পর্বত ঢালে ছড়াবে না তোমার আলো চাঁদ তুমি অস্তমিত হও॥ আশঙ্কা করি তোমাকে গ্রাস করবে নাশ আমি আশঙ্কা করি হায় চাঁদ! আমি এক আরব শিশু ছেড়েছি আমার পবিত্র পরিবার আমার জীবনে আছে রক্তাক্ত কাহিনি যা সহসা কান্না উদ্রেককারী হ্যাঁ, আমিই। হায় চাঁদ! দখলদারের বলির পাঁঠা আমি পরাস্তের চামুচ মুখে জন্ম আমার আমার গৃহে দেখেছি আমি বিভ্রান্ত সৈন্যের উ™£ান্ত পদচারণা জমাটবাঁধা অন্ধকারে ভয়াবহ টহল যেন একত্রিত ক্ষুধার্ত হায়েনা আর শকুনের দল॥ বাবাকে ঘিরে ফেলেছে সৈন্যরা শুনেছি মায়ের আর্তনাদ সৈন্যদের বক্রদৃষ্টি আম্মাজানের প্রতি উঁচানো খঞ্জর-খড়গ সতীত্ব নিরুপায় অসহায় মা আমার চাঁদ তুমি অস্ত যাও॥ (গিব ইয়া হেলাল তথা চাঁদ তুমি অস্ত যাও কবিতা থেকে) মুসলমানদের যাবতীয় বিপদই কেবল কবির অন্তর স্পর্শ করে। স্বজাতির আপদে কবি তাই ব্যস্ত-সমস্ত। কবির চেতনায় বিশ^ মুসলিমের দুরবস্থার ভয়াবহ চিত্র। জাতির বিপদ সংকুলতা কবির কলমকে সচকিত করে। ‘বিষণœতার সড়ক’ কবিতায় কবির আবেগঘন উচ্চারণ- বিস্মিত নেত্রে মুসলিম কন্যা কোলে অবোধ শিশু কান্নার শক্তিও নিঃশেষিত। অভিযোগ নেই তার নেই কোনো অনুযোগও দেখেছি আমি তাকে রক্তাক্ত বসনে সালামের প্রত্যুত্তর শুষে নেয় আমার শোণিত ধারা কর্ণবিদ্ধ করে তার বিকট প্রশ্ন কেন? সব দিক থেকে ধেয়ে আসে অন্ধকার ছুঁয়ে যায় চিৎকার অনুভূতি, বারংবার কেন? আরে কে তুমি? কী চাও? এভাবে রক্ত টানছ কেন আমার? কেন এই চুক্তি? কিসের চুক্তি? কপালে-কপোলে খেলে যায় বিদ্যুৎ কানে বাজে রণ হুঙ্কার, কান্নার রোল এই তো ফিলিস্তিন হায় আমার ফিলিস্তিন!! (ফি ত্বারিক আল-হুজন্ তথা বিষণœতার সড়ক কবিতা থেকে) ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাসকে নিয়ে তার কবিতা অফুরান। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলিমরা তার ভালোবাসার তীর্থভূমি। ফিলিস্তিনকে নিয়ে তার স্বতন্ত্র কাব্য সঙ্কলনও রয়েছে। তবে কবির কোনো কোনো কবিতায় মরু অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনাও পরিদৃষ্ট হয়। তার ‘স্মৃতির আড়ালে পালিয়ে যাওয়া ছেলেটি’ কবিতায় সকাতর কবি তার হারানো বন্ধুকে নিয়ে আক্ষেপ করে বলেন- একদা দাঁড়িয়েছিলাম প্রত্যাশার জানালায় হাতড়ে বেড়াই স্মৃতির অ্যালবাম নিষ্পাপ ছেলেটিকে খুঁজছিলাম হন্যে হয়ে সেই আমার অস্তিত্বের সব বেড়ে উঠেছি একসাথে, একপাতে একই স্বভাবে, বিনা তফাতে ভাবনা কিংবা মমত্ব ছিল যুগপৎ কান্না কিংবা অভিযোগে ছিল সহমত অন্তরাকাক্সক্ষা মনোবাসনা তাতে ছিল না কোনো বৈপরীত্য খেলাধুলার মৃত্তিকায় ছড়ানো সুবাস সর্ব শরীরে প্রেমের আভাস ছুটে যেতাম প্রত্যুষ লগনে কে আগে কার হাসি-গল্পে মগ্ন, আনন্দে বিভোর দিবস সাবাড় ॥ (আল-ত্বিফলু আল-হারিব তথা স্মৃতির আড়ালে পালিয়ে যাওয়া ছেলেটি কবিতা থেকে) কবি আবদুর রহমান আল-আশমাবি তার বন্ধুর জন্য অতি মাত্রায় দুঃখকাতর। বন্ধুর বিয়োগ ব্যথা কবিকে যারপরনাই অস্থির করে তুলেছে। স্মৃতি অ্যালবামের প্রতিটি স্মৃতি কবিকে কান্নারুদ্ধ করেছে। বাল্যবেলার হাজারো স্মৃতি, একসাথে খেলা কিংবা পশুচারণ, একসাথে পাঠশালায় যাওয়া কিংবা খুনসুটি, সবই আজ স্মৃতি খাজাঞ্চির এক একটি হীরক খণ্ড। কবির এ বন্ধু আর দশ বন্ধুর মতো নয়। সততা, নিষ্ঠা, কর্তব্যবোধ ও বন্ধুত্ব সচেতন এ বন্ধুর অবস্থান তাই কবির মণিকোঠায়। বাল্যবেলায় হারানো এ বন্ধুর স্মৃতিতে কবি প্রকৃতই বেদনাবিধুর। বাল্যবন্ধুর বিয়োগ কষ্টে কবি অতিশয় বিষণœ। কারণ এ বন্ধু ছিল কবির সাথে একাত্ম। চিন্তা-চেতনা কিংবা মানসিকতায়, আশা-আকাক্সক্ষা কিংবা উচ্ছলতায়, হাসি-কান্না কিংবা আবেগ প্রবণতায় তারা ছিল দুই দেহে এক আত্মার মতো। জীবন চলার কোনো অনুষঙ্গে তাদের বিরোধ বা দ্বৈধতা ছিল না। বরং চলনে-বলনে, ভাবনার প্রক্ষেপণে তাদের সাযুজ্য ছিল অতি মাত্রায় ঈর্ষণীয়। তাই বাল্যবন্ধুর হারানো স্মৃতি বারবার কবিকে করেছে তাড়িত। আবার কবির কাছেও মনে হয় শিশুকালই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কবিতার শেষে তাই কবির উপলব্ধি ও উপদেশ সন্নিবেশিত হয়েছে এভাবে- মানুষ তো কেবলই বাল্য আত্মা সজীব তা সারাটি জীবন ভর নিষ্পাপ বাল্য আত্মা নয় অবজ্ঞার অন্যথা পাপ-ভ্রান্তির নামান্তর শিশুকাল নিষ্পাপ যার সেই তো মহাত্মার আধার জাগরূক হোক তব মাঝারে আত্মার নিষ্কলুষতা পূর্ণ করো আশিস দিয়ে, দূর করো যত অপূর্ণতা। (আল-ত্বিফলু আল-হারিব তথা স্মৃতির আড়ালে পালিয়ে যাওয়া ছেলেটি কবিতা থেকে) এভাবেই কবি সকলকে চরিত্র গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। কবি তার প্রায় সকল কবিতার মধ্যেই ইসলাম, সচ্চরিত্রতা, জুলুম প্রতিরোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়ের পুনঃস্থাপন, মানবতার মুক্তি, ¯্রষ্টার অসীম শক্তি, সর্বত্র আল্লাহর বিরাজমানতা, অহিংসতা, সত্যের জয়গান ইত্যাদি বিষয়কে সন্বিষ্ট করেছেন সচেতনভাবে। কবির শাব্দিক গ্রন্থনার কলা-কৌশল ছিল অতীব চমৎকার। তবে তিনি আরব বিশে^র সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ সতর্ক সচেতনতায় এড়িয়ে গেছেন বলে অনেকেই তাকে অভিযুক্ত করতে চান। আমরা অভিযোগের সত্যাসত্য নিয়ে কোনো মন্তব্য না করে এতটুকু বলতে চাই- যে প্রসঙ্গের অবতারণা কবিতার টুঁটি চেপে ধরার সম্ভাবনা রাখে সে প্রসঙ্গ সযতেœ এড়িয়ে গিয়ে জনকল্যাণের প্রয়োজনে উন্নয়নধর্মী কবিতা রচনা দোষের কিছু নয়। কারণ দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবতার কল্যাণ সাধনই একজন প্রকৃত কবির আদর্শ হওয়া সর্বদার কাম্য।

তার সকল কবিতায় কল্যাণ প্রেরণা, চেতনার উন্নয়ন, জ্ঞানের সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ের সন্নিবেশন রয়েছে। যা তাকে একজন জাত কবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। শুধু তাই নয়- আধুনিক সৌদি রাজতন্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা তিনি পেয়েছেন। মুসলিম জাতিসত্তার চিরশত্রু ইয়াহুদি জাতি জোরপূর্বক জবর দখল করে নিয়েছে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিকে। তথাকার নিরীহ জনগোষ্ঠীকে পিটিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে অন্যত্র। তাদের জায়গা, জমি, স্থাপনা, সম্পদ সর্বস্ব লুণ্ঠন করে তাদেরকে বানিয়েছে নিঃস্ব। আবার তারাই সমগ্র বিশে^র মোড়লিপনার খ্যাতিও অর্জন করছে সমানতালে। কিন্তু কবি আবদুর রহমান আল-আশমাবি এই সকল বিশ^মোড়লের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে নির্ভীক কবিতা রচনা করে মজলুমদের পক্ষ নিয়েছেন সরাসরি। আমরা তার রচিত একটি কবিতার কিয়দংশ উল্লেখ করছি। কবি বলেন- ভেঙে ফেলো লৌহ জিঞ্জির হামলে পড়েছে মহানায়কের দল, পাল্লা দিয়ে ভেঙে ফেলো লৌহ জিঞ্জির চূর্ণ করে দাও কুদসের বিরুদ্ধে উদ্যত যত হাত গুঁড়িয়ে দাও বোমার প্রক্ষেপক হাতকে॥ দখলমুক্ত করো প্রিয় কুদসকে দাঁড়িয়ে যাও শক্ত হাতে॥ যারা অসির ঝংকার তোলে যুদ্ধের ঘোষণা দেয় অসহায়দের সামনে বিধবার সম্মুখে যারা ধ্বংস করে গৃহের দেয়াল শিশুদের সামনে হত্যা করে একে একে সবাইকে নির্দ্বিধায়॥ ভেঙে দাও (সেই হাত) ফিরে আনো হারানো মর্যাদার স্মারকস্তম্ভ॥ হায়! আমার ফিলিস্তিন॥ (ফি ত্বারিক আল-হুজন্ তথা বিষণœতার সড়ক কবিতা থেকে) এভাবেই আবদুর রহমান আল-আশমাবির প্রতিটি কবিতা ইসলামি চেতনায় সমৃদ্ধ। নিরলস লিখে চলা কবি আশমাবির মসিযুদ্ধ হোক আরো শাণিত, ইসলামের কল্যাণে নিবেদিত। তার কাব্যকর্মসমূহ বাংলায় অনূদিত হলে এ দেশের কাব্যপ্রিয় ইসলামপ্রেমীর হৃদয় পল্লবিত ও সঞ্জীবিত হবে প্রতিনিয়ত। লেখক : অধ্যাপক, ইবি

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির