post

আমার আকুতি

১২ অক্টোবর ২০০৯

মাহমুদা মানসুরী মুন্নী

[caption id="attachment_29" align="alignleft" width="240" caption="শহীদ মুজাহিদ"]শহীদ মুজাহিদ[/caption] আমি আমার আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা রেখে, সন্তান শহীদ মুজাহিদ সম্পর্কে কিছু কথা লেখার চেষ্টা করছি মাত্র। চিন্তা-ভাবনা করে কূল পাচ্ছিলাম না কোথা থেকে শুরু করি। মুজাহিদ মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় সব সময়ই আল্লাহ-তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করতাম, আল্লাহ তুমি যা দান করবে তাতেই আমি সন্তুষ্ট। তবে তুমি যাকে দান করবে, সে যেন হয় সুস্থ, সবল এক পূর্ণাঙ্গ শিশু। সেই সাথে তোমার কাছে মিনতি আমার সেই শিশু হয় যেন মুমিন, মুত্তাকি, চক্ষুশীতলকারী, তোমার সন্তুষ্টি হাসিলকারী, দ্বীনের খেদমতকারী, সাহাবীদের মতো চরিত্রের অধিকারী এবং সদকায়ে জারিয়াহ এর গুণাবলিসম্পন্ন এক মানবশিশু।

১২ রবিউল আউয়ালের সুবেহ-সাদেকের মুহূর্তে দুনিয়া আলোকিত করে, আমার কোল জুড়ে প্রশান্তির ছোঁয়া দিয়ে সে এলো দুনিয়ায়। আমার বাবার বাসায় জন্ম হয় মুজাহিদের। আমি ৪টি সন্তানের মা হয়েছি। প্রসব বেদনার কষ্ট, অনেক কষ্টের। আল্লাহর অশেষ রহমতের ফলে সবচেয়ে কম সময়ের ব্যবধানে সে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। প্রিয় সময়ে, প্রিয় তারিখে দুনিয়ায় এসেছিল বলে ওর নানা বলেন, নাতির নাম হবে মুজাহিদুল ইসলাম (মুজাহিদ) ইসলামের সৈনিক। আল্লাহ ও রাসূলের পথের সঠিক অনুসারী। আমার চোখের মণি মুজাহিদ শিশু বয়স থেকে খুবই শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল। কথা বলতে শেখার পর বলতো আম্মু আমার ক্ষুধা লেগেছ। কাজের তাগিদে যদি আধা ঘণ্টা পরেও খাবার দিতাম তাতেই সই। কোনো কান্না-কাটি, চিৎকার চেঁচামেচি, পেছনে পেছনে ঘুর ঘুর করা, বায়না করা স্বভাব ওর শিশু বেলা থেকে এই পর্যন্ত আমি পাইনি। বিরক্ত কাকে বলে, বাবা-মাকে কষ্ট দেয়া কাকে বলে, হে আল্লাহ! তুমি তো সাক্ষী এ ছেলের কাছে তা কোনদিনই পাইনি। ও বকা খাওয়ার মতো ছেলে ছিল না বলে ওকে কখনো বকা-ঝকা করিনি, মারিনি। কেউ দুষ্টুমি করে ওকে মারলে ওর চোখে পানি দেখলে ব্যথায় বুকটা মুচড়ে উঠতো। ও কাঁদলে সাথে সাথে আমি কাঁদতাম।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্মরণীয় দিন, সবচেয়ে বেদনার দিন এবং সবচেয়ে বড় শুকরিয়া আদায়ের দিন। এই দিনে আমার পরম প্রিয় নাড়িছেঁড়া ধন, রক্তের বাঁধন ছিন্ন করে শাহাদাত বরণ করলো। সে হলো শহীদ মুজাহিদুল ইসলাম। সে ছিল আমার অতিপ্রিয় সন্তান। যাকে যাবে না কোন দিন ভোলা। সে যে অন্তরে থাকবে অতি যতনে। সে ছিল আমার চোখের মণি, কলিজার টুকরা, সাধনার ধন, আত্মারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার বিহনে আমি যে কিভাবে বেঁচে আছি তা শুধু আমি ও আমার সৃষ্টিকর্তা জানেন। সে শুধু আমার সন্তানই ছিল না, ছিল পরম প্রিয় বন্ধু। আমার জীবনের যত কষ্ট, যন্ত্রণা, বোবাকান্না তা শুধু তার সাথে শেয়ার করেছি, অন্য কারো সাথে নয়। নয় স্বামী, নয় বাবা-মা, নয় কোন আত্মীয় স্বজন। সে ছিল আমার পরামর্শদাতা। আজ সে নেই তাই আমার অব্যক্ত বুকফাটা আর্তনাদ। তার মত ভালো আমলের ভালো ছেলে পরকালে আমি পাবো তো? এই জীবনে তাকে আমি কিছু দিতে পারিনি তাই আল্লাহকে বলি, হে আল্লাহ এই জীবনে যতটুকু পুণ্য করেছি এবং মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যা পুণ্য অর্জন করবো, তার সবটুকু সওয়াবই আল্লাহ যেন তার আমলনামায় যোগ করে দেয়। আমার জন্য আমার পাপগুলো থাক জমা। আমার আল্লাহ যা ভালো মনে করবেন তাই করবেন।

মুজাহিদ বলত, মাগো বেশি বেশি কুরআন পড়ো, তাফসির সহকারে, আমল করার লক্ষ্যে কুরআনকে হৃদয়ে ধারণ করো। কুরআনের বর্ণনা মতে, কী অনুকরণীয়, কী পালনীয়, কী বর্জনীয় সেই মোতাবেক না চললে পরকালে পার পাবে না। যথাসাধ্য চেষ্টা করবে আল্লাহর আনুগত্য পরিপূর্ণরূপে করতে। সে রেগুলার ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন করতো বা পড়তো। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তো, মাঝে মাঝে নফল রোজাও রাখতো। রাত্রিবেলা তাহাজ্জুদের নামাজ খুব সুন্দর ও ধীর-স্থির গতিতে পড়তো। সব সময় প্রার্থনা থাকতো একটাই আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে শহীদি তামান্না হাসিল করা। মাগো, শহীদ হতে চাইলেই কি শহীদ হওয়া যায়? যায় না মা। শহীদ হতে হলে অনেক বড় ভাগ্য লাগে, সত্যিকার অর্থে আমার কি সেই ভাগ্য আছে মা, মাগো শহীদ হলে কর্মফলের কোন হিসাব দিতে হয় না, কোন শাস্তি হয় না কবরে, জাহান্নামে যেতে হয় না। শাহাদাত হলে সরাসরি জান্নাতে যাওয়া যায়। মানুষ চাইলেই কি শাহাদাত বরণ করতে পারে? পারে না মা, পারে না। এর জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হয়। দ্বীন ইসলামের জন্য জান, মাল ও সময় ব্যয় করতে হয়। নতুবা তোমার কোন কার্য সাধন হবে না মা। সকলের ঊর্ধ্বে, বাবা-মা ভাই বোন, দুনিয়াবি আরাম আয়েশের ওপর আল্লাহর কথার দাম দিতে হবে। তাই বলি আল্লাহ শুন তুমি, মুজাহিদ ছিল খুবই সুন্দর মনের একটা ছেলে। মুজাহিদের প্রিয় ইসলামী ছাত্র সংগঠনকে আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবি এই সংগঠন হলো একটি সুশোভিত, আলোকিত, ফুলের শক্ত ও মজবুত ঝাড়। যে ঝাড় কখনো ভাঙ্গবে না, দুমড়ে, মুচড়ে, পিষে ফেলা যাবে না। মোট কথা, যাকে কোনদিন নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। এই ঝাড়ে অজস্র ফুলকে সঠিকভাবে রাখা হলে, এর শোভা বৃদ্ধি পাবে শতগুণ এবং তা হবে চিরস্থায়ী। এর সুঘ্রাণে মোহিত হবে চারপাশ ও মনোমুগ্ধকর হবে পরিবেশ। এই ঝাড়ের ফুলকে ঠিকভাবে রাখতে জানলে, এ ফুল কখনো পচবে না, দুর্গন্ধ ছড়াবে না এবং কাঁটাও থাকবে না। আর এই ঝাড়ের যে অপরূপ আলো তার আলোয় সকল আঁধার কেটে যে দ্যুতির বিচ্ছুরণ ছড়াবে, তা পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলোকেও হার মানিয়ে যাবে। তাতে সকলেই বিমোহিত হবে, সে আলোর এমনই গুণ যে নিজকে আলোকিত করে, পরিবারকে আলোকিত করে, সমাজকে আলোকিত করে ও বিশ্বকে সকল আঁধারমুক্ত করে আলোয় উদ্ভাসিত করে। সেই ফুলের ঝাড়ের অজস্র অসংখ্য ফুলের মাঝখানে আমার সন্তান মুজাহিদ হলো তরতাজা ফুটন্ত এক রক্ত গোলাপ, যার সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণ ইতিহাস হয়ে থাকবে চিরদিন চির অম্লান । মুজাহিদের অসমাপ্ত কাজগুলো যেন পূর্ণতায় রূপ দিতে পারি সেই সুস্থতা, যোগ্যতা ও আমল দান করুন। আল্লাহ আপনার পছন্দনীয় পথে আমাদের সকলকে কবুল করুন। আমীন। লেখিকা : শহীদ মুজাহিদের প্রিয় মা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির