post

আল

ড. কামরুল হাসান

০২ জুন ২০২২

(১ম পর্ব) জন্ম এবং মৃত্যুই মূলত জীবনের সৌন্দর্য। যদি মৃত্যু না থাকত তবে জীবনের সৌন্দর্য অর্থহীন হতো। সব মানুষই যদি চিরঞ্জীব হতো তাহলে পৃথিবীর বিশৃঙ্খলা কেমনতর হতো তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। আজকের এই পৃথিবীতে কত বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন মানুষের বসবাস হতো। মানুষ আহত হতো, হাসপাতালে যেত, সুস্থ হতো অথবা হতো না। কিন্তু কেউ মারা যেত না। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতো। কিন্তু সে সুস্থ হতো না। কিংবা মারাও যেত না। ফলে তাকে দিনের পর দিন হাসপাতালে শুয়ে থাকতে হতো। কোনো ঔষধ প্রয়োগেও তাকে মারা যেত না। তখন কী যে সমস্যা হতো। এত সব সমস্যা থেকে বাঁচাতেই হয়তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জন্ম ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন। জন্ম যেমন আল্লাহর মহান সৃষ্টি, মৃত্যুও তেমনি আল্লাহর অপার সৃষ্টি। ব্যক্তিকে পরিশুদ্ধ করতে জগৎকে সুশোভিত করতে, সমাজকে শান্তিময় করতেই আল্লাহর এ অনবদ্য সৃষ্টির মাহাত্ম্য। তিনি বলেন-الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন। যেন তিনি পরীক্ষা করতে চান- কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম। ৬৭:০২; আয়াতে মৃত্যুকেও একটি স্বতন্ত্র সৃষ্টি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় মৃত্যুকে জীবনের পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতের দূরবর্তী ইঙ্গিত এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন পূর্বে। অতঃপর জীবনের উন্মেষ ঘটিয়েছেন।

আবার একজন মানুষের জীবন পরিক্রমায় তার জন্ম ও মৃত্যু কেবলই একবার তা নয়। জন্ম হয়ে পৃথিবীতে আসে। আবার মৃত্যুর মাধ্যমে পৃথিবী থেকে চলে যায়। জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়টুকুই তার জীবনের পরিক্রমা এটি ঠিক নয়। জন্মের পূর্বেও তার জীবন পরিক্রমা বর্তমান ছিল। আবার মৃত্যুর পরেও তার পরিক্রমা অব্যাহত থাকবে। মানব জীবনের জন্ম মৃত্যুর পরিক্রমা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-كَيْفَ تَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُون তোমরা আল্লাহকে অস্বীকার করো কিরূপে? অথচ তোমরা মৃত ছিলে, তিনিই তোমাদেরকে জীবন দিলেন। অতঃপর তোমাদেরকে মৃত্যু দিবেন। আবার তোমাদেরকে জীবন দান করবেন। অনন্তর তার নিকটেই তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। ২: ২৮; এ আয়াতে অন্তত জন্ম-মৃত্যুর চারটি স্তর বর্ণনা করা হয়েছে। যার প্রথম তিনটি স্তর আমাদের চাক্ষুষ। শেষ স্তরটি ঘটবে আমাদের মৃত্যুর পর। সেটিও একটি জীবন। সে জীবন অনন্ত। যার কোনো অন্ত নেই। শেষ নেই। সেই জীবনকেই বলা হচ্ছে আখিরাতের জীবন। আখিরাত মূলত এ দুনিয়ার পরের জীবন। মানুষের জীবন দুটি; এক- দুনিয়ার জীবন, দুই- আখিরাতের জীবন। তাই আখিরাতকে দুনিয়ার বিপরীত শব্দ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। আখিরাত ইসলামের অন্যতম অনুষঙ্গ। শুধু অনুষঙ্গ নয়। বরং অনিবার্য অনুষঙ্গ। আল-কুরআনে বিষয়টি যথাযথ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ ও উপস্থাপন করা হয়েছে। সংক্ষেপে আমরা সে আলোচনার দিকে অগ্রসর হবো। তৎপূর্বে আখিরাত শব্দের শাব্দিক, পারিভাষিক, ব্যবহারিক অর্থ এবং এতদসংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান দেখে নিব। আখিরাত শব্দটি আরবি। তবে বাংলায়ও শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। যেমন আখের গোছানো, আখেরে তোমার ভালো হবে না, রমজানের আখেরি জুমা ইত্যাদি। আখিরাত শব্দটি أخر মূল অক্ষর থেকে নিঃসৃত। অভিধানে শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন অন্য, অপর, আর, দ্বিতীয় ইত্যাদি। এছাড়াও শেষ, সমাপ্তি, পরবর্তী, পরিণাম, সর্বশেষ ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যদি বাবে তাফয়িল থেকে শব্দটি আসে তখন বিলম্বিত করা, দেরি করানো, পিছিয়ে দেওয়া ইত্যাদি অর্থ প্রদান করে। আবার শব্দটি إلى الأخر হলে ইত্যাদি অর্থ দিয়ে থাকে। آخر শব্দটি একবচন ও পুংলিঙ্গ। এর বহুবচন آخرون এর স্ত্রীলিঙ্গ آخرى। তবে শব্দটি ‘দ্বার আল-বাকা’ বা চিরস্থায়ী নিবাস অর্থেও এসে থাকে। দ্বার আল-বাকা হলো دار الحياة بعد الممات মৃত্যুর পরের জীবনের নিবাস (অভিধান: রাইদ- পৃ-৪২) অবশ্য কবি আখিরাতকে ভবিষ্যৎ অর্থেও ব্যবহার করেন। যেমন কবি সত্যেন্দনাথ দত্ত বলেন- অতীতের চেয়ে নিশ্চয় তোর ভালো হবেরে ভবিষ্যৎ একদিন তুই খুশি হবি লভি তার কৃপাসুমহৎ। এটি সূরা দুহার ৪র্থ ও ৫ম আয়াতের অনুবাদ।وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى- وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى নিশ্চয়ই পূর্বাপেক্ষা পরবর্তী জীবন তোমার জন্য উত্তম। শিগগির তোমার রব তোমাকে তুষ্টি পরিমাণ দিবেন। আয়াতে আখিরাত শব্দের অর্থ কবি ভবিষ্যৎ করেছেন। তবে তাতে অর্থের কোনো ক্ষতি হয়নি। আখিরাত দিবস বলতে ইসলামে কিয়ামতকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এখানে দুটি বক্তব্য রয়েছে। এক. কিয়ামাত দিবসই আখিরাত দিবস। যা দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি টেনে দেয়। এই পৃথিবীর পরিবর্তে আরেক পৃথিবীর সূচনা করে। এটিই একদল ওলামা ও তাফসিরকারকের অভিমত। ইমাম তাবারি বলেন- وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَবলে এটিই বুঝানো হয়েছে। আর আখিরাতকে আখিরাত বলা হয় যেহেতু তা সৃষ্টি হতে দূরে। যেমন দুনিয়াকে দুনিয়া বলা হয় যেহেতু তা সৃষ্টির নিকটে। ইমাম তাবারির ভাষ্য হতে বুঝা যায়- আখিরাত বলতে কিয়ামতের আশ্চর্য ঘটনারাজি, অলৌকিক কার্যাদি উদ্দেশ্য যার প্রতি ঈমান আনতে মুহাম্মদ সা. ও পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কাফিররা মূলত সেসবকেই অস্বীকার করত। যেমন পুনরুত্থান, প্রত্যাবর্তন, সাওয়াব, শাস্তি, হিসাব, মিজান ইত্যাদিকে কাফিররা অস্বীকার করত। যার সবই কিয়ামতের সাথে সম্পৃক্ত। কুরআনের আয়াত وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ এর দ্বারা পুনরুত্থান, কিয়ামাত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মিজান ইত্যাদি উদ্দেশ্য। ইবনু আব্বাস রা. এ মতামত ব্যক্ত করেন। ইমাম রাজি বলেন- আখিরাত দ্বারা একটি দীর্ঘ সময়ও উদ্দেশ্য হতে পারে। যেমন কবর থেকে উঠার পর হতে জান্নাতে বা জাহান্নামে যাওয়া পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়টুকু। কারণ জান্নাতে-জাহান্নামে যাবার পর হতে সময়ের আর কোনো ব্যাপ্তি থাকবে না। দুই. অনেক আলেম বলেন- কিয়ামাত শুরু হয় মৃত্যুর মাধ্যমে। আল্লাহর নবী বলেন-إن القبر أول منزل من منازل الآخرة الخ.. কবর হচ্ছে আখিরাতের প্রথম ধাপ।(ইবনু মাজাহ-৪২৫৭) আরো বলা হয়ে থাকে- من مات فقد قامت قيامته যে মারা যায় তার কিয়ামত শুরু হয়ে যায়। ((http://www.moqatel.com ১২/০৭/২০২১) যাহোক মৃত্যু পরবর্তী জীবনকেই আমরা সংক্ষেপে আখিরাত বলতে পারি। তবে আজকের আলোচনায় আমরা কবর হতে পুনরুত্থানের পর থেকে জান্নাত অথবা জাহান্নামে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যে সময় সে সময়ের অবস্থা, ভীতি, হিসাব-নিকাশ, ময়দানের নানাবিধ অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে আল-কুরআনের আলোকে আলোচনার প্রয়াস পাব। আখিরাত শব্দটি আল-কুরআনে ১১৫ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। آخر মূল ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়ে বিভিন্ন ছাঁচে আরো ১১০ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে।

আখিরাত কখন হবে? আখিরাত কখন হবে সর্বকালে এই প্রশ্ন মানুষের মধ্যে কাজ করেছে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে। তবে কোনো মানুষকেই এর প্রকৃত জ্ঞান দেয়া হয়নি। মানুষ বিশ^ চরাচরের কতটুকু জ্ঞানই বা রাখে।وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا আর তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছে খুবই স্বল্পজ্ঞান।১৭: ৮৫; আখিরাত কখন সংঘটিত হবে সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন- إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ নিশ্চয়ই সেই সন্ধিক্ষণের জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে। ৩১:৩৪; বিষয়টিকে খোলাসা করে আরো একটু বিস্তারিত পরিসরে মহান আল্লাহ বলেন- يَسْأَلُ أَيَّانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ- فَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ- وَخَسَفَ الْقَمَرُ- وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ- يَقُولُ الْإِنْسَانُ يَوْمَئِذٍ أَيْنَ الْمَفَرُّ- كَلَّا لَا وَزَرَ সে প্রশ্ন করে কিয়ামতের দিন কখন? যখন চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। চাঁদ আলোহীন হবে। চাঁদ-সুরুজ একীভূত হবে। মানুষরা বলবে এখন পালাবি কোথায়? না, নেই কোনো আশ্রয়। ৭৫; ৬-১১; সূরা নাজিয়াতে আল্লাহ বলেন-يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا- فِيمَ أَنْتَ مِنْ ذِكْرَاهَا- إِلَى رَبِّكَ مُنْتَهَاهَا তারা তোমাকে সেই সন্ধিক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তা কখন হবে? তা সংঘটনের সময়ের সাথে তোমার কী সম্পর্ক? এর সঠিক জ্ঞান তোমার রবের নিকট। ৭৯: ৪২-৪৪; আখিরাত ঠিক কোন মুহূর্তে হবে এটি জানা ঈমানের অপরিহার্য কোনো বিষয় নয়। বরং তৎপ্রতি বিশ^াস স্থাপনই ঈমানের মৌল শর্ত।

তবে এই আখিরাত ইসলামী বিশ^াসের অন্যতম মৌল অনুষঙ্গ। ইসলামে যে সাতটি মৌলিক বিষয়ে ঈমান আনতে হয় আখিরাত তার অন্যতম। কুরআন কারিমে প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে ও ছিটিয়ে রয়েছে- আখিরাতের আলোচনা। বিশেষত আল্লাহর রাসূল সা.-এর মাক্কী জিন্দেগির ১৩ বছর যে আত্মশুদ্ধির কাজ করেছেন সেখানে আখিরাতের বিষয়টি ছিল প্রণিধানযোগ্য। আল-কুরআনের মাসহাফে উসমানির প্রথম সূরা ফাতিহাতেই আখিরাত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ মালিকি ইয়াওমিদ্দিন অর্থাৎ বিচার দিবস তথা আখিরাতের মালিকানা যার।১:৩; এখানে আল্লাহ তায়ালাকে আখিরাতের সর্বময় অধিকর্তা হিসেবে পরিচিত করা হয়েছে। এই আখিরাতের প্রতি বিশ^াস স্থাপন প্রতিটি মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য। শুধু বিশ্বাস স্থাপন নয় বরং অবিচল ও টেকসই বিশ^াস স্থাপন কাম্য। সে কথাই বলা হয়েছে- ওয়াবিল আখিরাতে হুম ইউকিনুন- আর তারা আখিরাতের প্রতি অবিচল বিশ^াস স্থাপন করে। ২: ৪; আখিরাতের ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমরা জেনেছি যে, وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُمْ مِنَ الْأَجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنْسِلُونَ আর যখন শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে তখন তারা কবর হতে তাদের রবের কাছে দৌড়ে দৌড়ে ছুটে আসবে।৩৬: ৪৩; এই সময় হতে শুরু করে হিসাব-নিকাশ হওয়া এবং চূড়ান্তরূপে জান্নাত-জাহান্নামে যাওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়টুকুই আখিরাত। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণের অবস্থা কী হবে? বিচারের ধরন কেমন হবে? ময়দানের সার্বিক অবস্থা ও সমবেত উপস্থিতির দশা কেমন হবে? ইত্যাদি বিষয় আমরা অনুসন্ধানের প্রয়াস পাব আল-কুরআনের পাঠ থেকে।

আখিরাতের ময়দানের দৃশ্য ইসরাফিল (আ)-এর শিঙ্গায় শেষ ফুৎকারের পর এক ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা হবে। সেই দৃৃশ্যের প্রাথমিক অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন- إِنَّمَا يَسْتَجِيبُ الَّذِينَ يَسْمَعُونَ وَالْمَوْتَى يَبْعَثُهُمُ اللَّهُ ثُمَّ إِلَيْهِ يُرْجَعُونَ যারাই শুনবে তারাই ডাকে সাড়া দিবে। আর যারা মৃত আল্লাহ তাদেরকে উত্থিত করবেন। অনন্তর সবাই আখিরাতের ময়দানের দিকে ছুটে যাবে। ৬: ৩৬; যে ময়দানকে নির্দিষ্ট করা হবে নিকাশের জন্য। ওই ময়দানের প্রাথমিক দৃশ্যায়ন ও চিত্রায়ণ কেমন হবে সে সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সা. বলেন-ثم يرسل الله مطرا كأنه الطل فينبت منه أجساد الناس ثم ينفخ فيه آخرى فإذاهم قيام ينظرون এরপর হালকা এক পশলা বৃষ্টি দিবেন, যেন তা শিশিরের মতো হবে। তাতেই মানুষের দেহগুলো সজীব হবে। এরপর আরেক ফুৎকার দেয়া হবে। তখন সবাই কবর থেকে উঠে পড়বে। এরপর সকল মানুষ এক স্বচ্ছ মাঠের দিকে সমবেত হতে থাকবে। ((http://www.moqatel.com ১২/০৭/২০২১) ঐ ময়দানে কোনো নোংরা বা অপরিষ্কার কিছু থাকবে না। নবী সা. বলেন- يحشر الناس يوم القيامة على أرض بيضاء عفراء كقرصة النقي ليس فيها علم لأحد কিয়ামাত তথা আখিরাত দিবসে মানুষেরা এক সাদা সফেদ ময়দানে সমবেত হতে থাকবে। ময়দানটা যেন স্বচ্ছ কোনো বাসনের মতো। সেখানে কারো কোনো চিহ্ন থাকবে না। (যঃঃঢ়://িি.িসড়য়ধঃবষ.পড়স ১২/০৭/২০২১)

সে ময়দান হবে খুবই জনাকীর্ণ। সবাই কেবল সেখানে তার দুটো পা রাখারই জায়গা পাবে। ঐ ময়দানে কোনো টিলা, উপত্যকা, ক্ষেত-খামার থাকবে না। সব মানুষ হবে নগ্নপদ। বিবস্ত্র। ভীত। তারা হবে ক্ষুধার্ত। তৃষ্ণার্ত। ক্লান্ত। ময়দানের দিকে সবাই ছুটে আসবে দলে দলে। অহঙ্কারীরা সেখানে আসবে ছোট ছোট পিঁপড়ার মতো। অপরাধীরা আসবে শরীরে আগুন দিতে দিতে। এভাবেই সবাই পূর্বে কৃত আমল অনুযায়ী বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন আকৃতিতে আসতে থাকবে। তবে ঐ ময়দানে সবার স্থিতি হবে মাত্র একদিন। অবশ্য সেদিনের দৈর্ঘ্য হবে পঞ্চাশ হাজার বছর।تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ ফিরিস্তা এবং ঊর্ধগামী হয় আল্লাহর নিকট একদিনে, যার পরিমাণ পার্থিব পঞ্চাশ হাজার বছর। ৭০: ০৪;

সূর্য মাথার খুব সন্নিকট হবে। عن المقداد قال سمعت رسول الله يقول تدنى الشمس يوم القيامة من الخلق حتى تكون منهم كمقدار ميل কিয়ামতের দিন সূর্য মানুষের মাথার উপর এক মাইলের কাছাকাছি হবে। (বুখারি ও মুসলিম) সবাই আমল অনুপাতে প্রাপ্যানুসারে ঘামাধারে নিমজ্জিত হবে। ঘামের গভীরতা হবে পায়ের তালু, টাখনু বা হাঁটু পর্যন্ত। হাদিসে এসেছে-فيكون الناس على قدر أعمالهم في العرق، فمنهم من يكون العرق إلى كعبيه، ومنهم من يكون إلى ركبتيه، ومنهم من يكون إلى حقويه، ومنهم من يلجمهه العرق إلجاماً আমল অনুযায়ী প্রত্যেকে ঘামের মধ্যে নিমজ্জিত হবে। কারো ঘাম হবে টাখনু পর্যন্ত, কারো রান পর্যন্ত, কারো কোমর পর্যন্ত, কারো বা গলা পর্যন্ত হয়ে তাকে বেষ্টন করে ফেলবে। (সহিহ মুসলিম) অবশ্য সেখানেও থাকবে কতিপয় সৌভাগ্যবান যারা আল্লাহর রাজ আসন তথা আরশের ছায়াতলে বসার অনুমতি লাভ করবে। তারা-عن أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، قَالَ: سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ: الإِمَامُ الْعَادِلُ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ رَبِّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللهِ، اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ، فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ أَخْفَى حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ. সাত শ্রেণির মানুষ সেদিন আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয় পাবে যেদিন আল্লাহর তার ছায়া ছাড়া আর কারো ছায়া থাকবে না। ন্যায়পরায়ণ বাদশা, যে যুবক তার রবের ইবাদাতে তার যৌবনকাল কাটিয়ে দেয়, এমন মানুষ যার অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথেই লেগে থাকে, এমন দুই ব্যক্তি যারা কেবলই আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসে, এমন পুরুষ যাকে কোনো অভিজাত সুন্দরী আহ্বান করলে সে বলে- আমি আল্লাহকে ভয় করি, এমন দানকারী যার ডান হাতের দান বাম হাত টের পায় না। (বুখারি : কিতাবুজ জাকাত) ঐ দিন দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো এক ফিরিস্তা আগুনের কু-লী নিয়ে আসবে এবং মানুষের মাঝে সে লেলিহান শিখা নিক্ষেপ করবে। (http://mawdoo3.com ১৫/০৭/২০২১, আহওয়ালু ইয়াওমিল কিয়ামাহ) গোটা বিষয়টিকে একীভূত করে বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ড. সা’দ ইবনু আব্দুল্লাহ আল হামিদ তার ব্যক্তিগত ওয়েব পেজে উল্লেখ করেন- আখিরাত দিবসের ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ- يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ হে মানুষ তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো। নিশ্চয়ই কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী তার দুুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করে ফেলবে। আর মানুষকে তুমি নেশাগ্রস্তের মতো দেখবে। যদিও তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি বড়ই কঠিন। ২২: ১-২; অন্যত্র আল্লাহ বলেন- يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْمًا لَا يَجْزِي وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئًا إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ হে মানুষ তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর সেই দিনকে ভয় করো যেদিন পিতা সন্তানের কোনো উপকারে আসবে না। আর সন্তানও পিতার কোনো উপকারে আসবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। অতএব দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। আর সেও যেন তোমাদেরকেও আল্লাহর সম্পর্কে কোনো প্রতারণায় ফেলতে না পারে। ৩১: ৩৩; উপরের এ তিনটি আয়াতই আখিরাত দিবসের মোটামুটি অবস্থা, ভয়াবহতা, প্রত্যেকের মৈত্রীহীনতার এক সম্যক চিত্র পরিস্ফুট করে। সেইদিন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। পর্বতগুলো তুলার মতো ভেসে বেড়াবে। يَوْمَ تَكُونُ السَّمَاءُ كَالْمُهْلِ- وَتَكُونُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ সেদিন আকাশ ফুটন্ত তেলের মতো হবে। আর পর্বতসমূহ হবে ধুনো পশমের মতো। ৭০: ৮-৯; সেদিনের সবকিছু কঠিনতর হবে। ভীতিকর পরিস্থিতি প্রচ- আকার ধারণ করবে। সেদিন সকল বান্দার মাঝে ন্যায়বিচার কায়েম হবে।

সেদিন সবাই খালি পায়ে, খালি গায়ে, অপলক নেত্রে, নির্বাক হৃদয়ে, পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল মানব ও জিন চতুষ্পদ জন্তু একই মাঠে একত্রিত হবে। সেদিন কোনো আহ্বানকারী তাদেরকে শুনিয়ে দিবে। সেদিন সবাই তার ভাই থেকে পালাতে চাইবে, পালাতে চাইবে তার বাবা-মা থেকে। এমনকি তার স্ত্রী ও সন্তান থেকেও। সেদিন প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। فَإِذَا جَاءَتِ الصَّاخَّةُ- يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ- وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ- وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ- لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ যখন বিকট শব্দ এসে পড়বে। সেদিন মানুষ পালাবে তার ভাই থেকে। তার মাতা ও পিতা থেকে। তার স্ত্রী ও সন্তান থেকে। সেদিন প্রত্যেকেই কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। ৮০: ৩৩-৩৭; সেদিন আল্লাহ পৃথিবীকে তার হাতে মুষ্টিবদ্ধ করবেন। আকাশসমূহ ডান হাতে ভাঁজ করে নিবেন। এরপর বলবেন- আমিই আজ রাজাধিরাজ। কোথায় শক্তিমান, দাম্ভিক ও বেপরোয়াবাজরা? সেদিন তারা মহাবিপাকে পড়ে যাবে। এ বিপদ থেকে উদ্ধারের কোনো পথ তারা পাবে না। আবার এ বিপদ সহ্যও করতে পারবে না। মানুষেরা তখন বলতে থাকবে- তোমরা কি দেখছ না তোমরা এখন কোন বিপদে রয়েছ? তোমরা কি প্রত্যক্ষ করছ না তোমাদের বিপদ কতদূর পৌঁছে গেছে? এখন তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের কাছে কে সুপারিশ করবে? এবার তারা আদম (আ)-এর কাছে যাবে। আদম (আ) কৈফিয়ত পেশ করে বলবেন- তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা বরং নুহের (আ) কাছে যাও। তারা যাবে। তিনি আপত্তি পেশ করে বলবেন। তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা ইবরাহিমের কাছে যাও। তারা যাবে। তিনি কৌশলে এড়িয়ে যাবেন। বলবেন তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা মুসার কাছে যাও। এবার তারা মুসার কাছে যাবে। মুসা (আ)ও আগের মতোই আপত্তি পেশ করবেন। বলবেন- তোমরা ঈসার কাছে যাও। এবারে তারা ঈসা (আ)-এর কাছে যাবে। তিনিও অপারগতা প্রকাশ করবেন। বলবেন তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা বরং নবী মুহাম্মদ সা.-এর কাছে যাও। এবার তারা মুহাম্মদ সা.-এর কাছে যাবেন। তিনি সকল মানুষের ব্যাপারে সুপারিশ করবেন যেন তাদের সমস্যার সমাধান করা হয়। আর এই জায়গাটিই হলো তাকে দেয়া প্রতিশ্রুত মাকামে মাহমুদ। আল্লাহ বলেছেন- وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا রাত্রির নিকশতায় নফল সালাতে রত হও। আশা করা যায় তোমার রব তোমাকে মাকামে মাহমুদ দান করবেন। ১৭: ৭৯; এই দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর সৃষ্টির কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন। এদিনে ময়দানে তুলাদ- স্থাপন করা হবে। হাদিসে এসেছে-لا يوضع في الميزان يوم القيامة شيئا أثقل من خلق حسن আদালতে আখিরাতে মিজানে সচ্চরিত্র অপেক্ষা ভারী আর কিছু উঠানো হবে না। (মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস নং- ৪০৯৮) এই দিনেই দুনিয়ার জীবনের কাজ-কর্মের ফিরিস্তি সবাইকে দেওয়া হবে। মুমিনরা তাদের কর্ম ফিরিস্তি লাভ করবে ডান হাতে আর কাফিররা পাবে বাম হাতে বা পেছনের দিক হতে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ- فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا-وَيَنْقَلِبُ إِلَى أَهْلِهِ مَسْرُورًا- وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ وَرَاءَ ظَهْرِهِ- فَسَوْفَ يَدْعُو ثُبُورًا আর যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে অচিরেই তার হিসাব সহজতর হবে। সে তার স্বজনদের নিকট প্রফুল্লভাবে ফিরে যাবে। আর যাকে তার আমলনামা পিঠের পেছন দিক হতে দেওয়া হবে অচিরেই সে তার ধ্বংস ডেকে আনবে। ৮৪: ৭-১১; এই ডানহাত ও বামহাত হবে সেদিনের সফলতা ও বিফলতার প্রতীক। সেদিন জাহান্নামের উপরিভাগে স্থাপন করা হবে পুলসিরাত বা সড়কসেতু। সবাইকে সে সেতু অতিক্রম করতে হবে। আমলের জোর অনুযায়ী বিদ্যুৎ, বাতাস, পাখি, পদব্রজ শক্তিতে তা পারাপার হবে। হাদিসে এসেছে-وَيَضْرِبُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ الصِّرَاطَ بَيْنَ ظَهْرَانِي جَهَنَّمَ كَحَدِّ الشَّعْرِ، أَوْ كَعَقْدِ، أَوْ كَحَدِّ السَّيْفِ عَلَيْهِ كَلاَلِيبٌ وَخَطَاطِيفٌ وَحَسكٌ كَحَسَكِ السَّعْدَانِ وَهُوَ جِسْرٌ فَيَمُرُّونَ كَطَرْفِ الْبَصَرِ، أَوْ كَلَمْحِ الْبَصَرِ، أَوْ كَلَمْحِ الْبَرْقِ، أَوْ كَمَدِّ الرِّيحِ، أَوْ كَجِيَادِ الْخَيْلِ، أَوْ كَجِيَادِ الرِّكَابِ، أَوْ كَجِيَادِ الرِّجَالِ সেদিন আল্লাহ জাহান্নামের সামনে একটি পুল স্থাপন করবেন। যা হবে চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম, তরবারির চেয়েও ধারালো, যাতে থাকবে পেরেক, কীলক, বড়শির গিঁট। যা হবে সব দিক হতে কণ্টকময়। এই সেতু পার হবে কেউ চোখের পলকে, কেউ মুহূর্তে, কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ অশ^গতিতে, কেউ আরোহী গতিতে আবার কেউ পদব্রজের গতিতে। (কিতাবু আল-ফিতান, খ--৮, পৃষ্ঠা- ১৫২)

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির