post

ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের গুণাবলি

মোবারক হোসাইন

৩০ ডিসেম্বর ২০১৬
সারা জাহানের মালিক মহান আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দীন হলো ইসলাম। এ ইসলামকে তাঁর জমিনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুগে যুগে তিনি পাঠিয়েছিলেন আম্বিয়া আলাইহিস সালামগণকে। তারা এ দীনকে জগদ্বাসীর সামনে, সকল মতবাদ, ধর্ম, মত ইত্যাদির সামনে শ্রেষ্ঠরূপে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জগতের স্রষ্টা নির্দেশিত পথে আহবান করে গেছেন। আম্বিয়া আলাইহিস সালামগণই এ আন্দোলনের অগ্রসেনানী হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।  কুরআন পাকে ইরশাদ হয়েছে- অর্থাৎ, তিনি সেই আল্লাহ যিনি তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়েত ও সত্য দ্বীন দিয়ে, যেন তিনি অপরাপর সকল ধর্ম ও মতবাদের ওপর ইসলামকে বিজয়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। (সূরা আস-সফ : ৯) যুগে যুগে আগত এসব নবী-রাসূল ছিলেন জগতের শ্রেষ্ঠসন্তান। তাঁরাই ছিলেন স্ব-স্ব জামানার সর্বাধিক যোগ্য। কাজেই এখনও আমরা যারা আম্বিয়া আ:-এর উত্তরসূরি হিসেবে তাদের রেখে যাওয়া কাজে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে সৌভাগ্যবান হতে চাই, তাদেরকেও সমকালীন সকল যোগ্যতার মাপকাঠিতে অবশ্যই উত্তীর্ণ হতে হবে। এক্ষেত্রে ঈমানের মজবুতি, নিয়তের সঠিকতা এবং খুলুসিয়াতের পূর্ণতার সাথে সাথে দায়িত্বশীলকে মৌলিক বেশ কিছু গুণাবলি অর্জন করা প্রয়োজন। নিম্নে অতীব প্রয়োজনীয় কিছু গুণ আলোচনা করা হলো। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আলোচিত এসব গুণ ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি দায়িত্বশীলের জন্য অর্জন করা একান্ত জরুরি। ১. জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা : ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি দায়িত্বশীলকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। এটি করতে হবে মৌলিকভাবে দু’টি কারণে- প্রথমত, মহান আল্লাহর ঘোষণা- অর্থাৎ- হে নবী আপনি বলে দিন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে? (সূরা জুমার : ৯) দ্বিতীয়ত, একজন দায়িত্বশীলকে সাধারণত দু’ধরনের কাজ করতে হয়। এক. নিজ সংগঠনের আদর্শ বা ইসলামের সুমহান আদর্শকে অন্যের সামনে হেকমতপূর্ণ ভাষায়, সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। দুই. যারা এ আদর্শের বিরোধিতা করে কিংবা যেসব মতাদর্শের সাথে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, তাদেরকে সুন্দর ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় বুঝিয়ে দেয়া। কুরআন মাজিদের ভাষায়- হে নবী! আপনি লোকদেরকে আপনার প্রভুর পথে প্রজ্ঞাপূর্ণ, উত্তম উপদেশ এবং সুন্দর যুক্তির মাধ্যমে আহবান করুন। (সূরা নাহল : ১২৫) এক্ষেত্রে সাংগঠনিক জীবনে দায়িত্বশীলকে নিম্নের বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ জ্ঞানার্জন করতে হবে ক. ইসলাম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান : আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত এবং রাসূল সা: নির্দেশিত যে আদর্শ বা বিধানাবলি প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সে ইসলাম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। যে পথে অন্যদেরকে আহবান করব, আন্দোলন সংগ্রাম তথা সর্বোচ্চ কোরবানির মাধ্যমে যা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সে সম্পর্কে প্রথমে নিজেকেই পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানার্জন করতে হবে। যে সম্পর্কে জানা নেই, তা প্রতিষ্ঠা করা কিভাবে সম্ভব? এক অন্ধ আরেক অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না। কাজেই দায়িত্বশীলকে ইসলামী আকিদা, ইবাদতের পথ ও পদ্ধতি, ইসলামের সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, জীবন চলার পথের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জন করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে ভাসা-ভাসা জ্ঞান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপথগামী হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন, অর্থাৎ- নিশ্চয়ই আনুমানিক (ভাসা-ভাসা) জ্ঞান সত্যের ক্ষেত্রে কোনো উপকারে আসে না। (সূরা নাজম : ২৮) খ. নিজ পেশা বা কাজ সংক্রান্ত সার্বিক জ্ঞান: একজন দায়িত্বশীল ছাত্রকে ক্লাসের অন্য দশজনের চেয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে অধিক জ্ঞানার্জন করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক অন্যদের মতো কেবল সাধারণভাবে অধ্যয়ন করলেই চলবে না বরং তার আদর্শের পক্ষে যা কিছু পাওয়া যায় তা যথাযথভাবে আত্মস্থ করা চাই। তার সংগঠনের আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় এ পাঠ্যবইয়ের জ্ঞানকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর জন্য এর যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ও মনোযোগসহকারে অধ্যয়ন করতে হবে। দায়িত্বশীল অন্য কোনো পেশার হলে তার সে পেশা যেন দ্বীন বিজয়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে সে উদ্দেশ্যকে সামনে রাখতে হবে। সে জন্য স্ব-পেশা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও দক্ষতা তাকে অর্জন করতে হবে। গ. আরবি ভাষা জ্ঞান: পবিত্র কুরআন, হাদিসসহ ইসলামের মৌলিক গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায়। দায়িত্বশীল যেন বিভ্রান্তিতে না পড়ে কিংবা কেউ যেন তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলতে না পারে সে জন্য আরবি ভাষায় কমপক্ষে ন্যূনতম পারদর্শী হতে হবে। রাসূল সা: এরশাদ করেছেন আরবি ভাষাকে আমি তিন কারণে ভালোবাসি- এক. আমি আরবি ভাষাভাষী। দুই. পবিত্র কুরআনের ভাষা আরবি। তিন. জান্নাতবাসীদের ভাষা আরবি (তবরানী, আল-হাকীম ও বায়হাকী) ঘ. ইসলামের স্বর্ণালি যুগের ইতিহাস ঙ. অন্যান্য বিপ্লবের ইতিহাস: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত নানা বিপ্লবের সামগ্রিক ইতিহাস দায়িত্বশীলকে জানার চেষ্টা করতে হবে। এসব বিপ্লবের লক্ষ্য, টার্গেট ও ফলাফলের সাথে ইসলামের আদৌ কোনো সম্পর্ক থাক বা না থাক। বৈষয়িক যেকোনো বিপ্লব থেকেও শিক্ষণীয় বিষয়াবলি গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন- রুশ বিপ্লব ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ইরান বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব ও তৎকালীন বিশ্ব/আরব জাহানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ¬বিক পরিবর্তনের ইতিহাস ইত্যাদি। চ. চলমান দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গে (রাজনৈতিক ও অন্যান্য): ছ. বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার সম্পর্কিত জ্ঞান : বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার ইসলামের বিজয়ের পথে মুখ্য সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং এর চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবাধ ও সর্বোচ্চ ব্যবহার জানতে হবে এবং তা প্রয়োগ করতে হবে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মুসলমানদের হারানো নেতৃত্ব পুনঃ উদ্ধারের মানসিকতা নিয়ে দায়িত্বশীলকে কাজ করতে হবে। ইসলাম এ বিষয়টিতে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছে। যেমন- কুরআন পাকে ইরশাদ হয়েছে, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শয়ন অবস্থায় আল্লাহ পাকের জিকির করে এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বলে এসব কিছুই আপনি বৃথা সৃষ্টি করেননি.....(এরাই হলো বুদ্ধিমান)। (সূরা আলে ইমরান : ১৯১) জ. মনোবিজ্ঞান (Psychology)  সম্পর্কিত জ্ঞান: মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান দায়িত্বশীলকে অর্জন করতে হবে। কর্মীদের কথার ভঙ্গি, আচার-আচরণ, দৃষ্টি, চেহারার মলিনতা কিংবা হাস্যোজ্জ্বলতা, গতি-প্রকৃতি, শিষ্টাচার ইত্যাদি দেখে দায়িত্বশীলকে রোগ বা সমস্যা নির্ণয় করতে হয়। তাদের প্রত্যাশা ও চাহিদা দেখে তা পূরণ কিংবা তার অযৌক্তিকতা বুঝিয়ে দিতে হয়। মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত জ্ঞান এসব ক্ষেত্রে তাকে ব্যাপক সহযোগিতা করতে পারে। ২. পরিশুদ্ধ আত্মা ও উন্নত আমলের অধিকারী হওয়া : ক. সকল কাজের সফলতা-কিংবা বিফলতা নির্ভর করে আত্মার পরিশুদ্ধিতার ওপর। আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেন: অর্থাৎ- যে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করল সে সফলকাম আর যে আত্মাকে কলুষিত করল সে ব্যর্থ হলো। (সূরা আশ্ শামস : ৯-১০) রাসূল সা: ঘোষণা করেন: অর্থাৎ- মানবদেহে অবধারিতভাবে এক টুকরা গোশত রয়েছে, যখন সেটি পরিশুদ্ধ হয় তার সব কিছুই পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর যখন তা কলুষিত হয় তখন তার সব কিছুই কলুষিত, বিপথগামী ও বিনষ্ট হয়ে যায়। (শরহু রিসালাতে কিতাবুল ঈমান, আবু উবায়দুল্লাহ বিন সালাম, ১ম খ: পৃ: ১৫৯) খ. উন্নত আমল: ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের আমল হতে হবে সর্বোন্নত। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর রাসূলকে নির্দেশনা দিয়ে বলেন: অর্থাৎ- আপনি নিজেকে তাদের সঙ্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ডাকাডাকি করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার জিকির থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। (সূরা কাহাফ : ২৮) যে কোন সময় তার দ্বারা দ্বীনের বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। হতে পারে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন: অর্থাৎ- তোমরা ঐসব ব্যক্তির অনুসরণ কর যারা তোমাদের কাছে প্রতিদান কামনা করে না এবং তারা হেদায়েতপ্রাপ্ত। (সূরা ইয়াসিন : ২১) এ আয়াতে কারিমার মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালা দায়িত্বশীলদেরকে হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। এটা অর্জিত হতে পারে ঈমানী মজবুতি ও উন্নত আমলের মাধ্যমে। এ জন্য দায়িত্বশীলদের ফরজ ওয়াজিব, সুন্নতের পাশাপাশি নফল বা মুস্তাহাবের প্রতিও যতœবান হতে হবে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন: অর্থাৎ- (রাতের শেষ ভাগে) তাদের পার্শ্বসমূহ বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং পালনকর্তার আজাবের ভয়ে ও রহমতের আশায় তাকে ডাকাডাকি করতে থাকে। (সূরা সেজদাহ : ১৬) ৩. সাংগঠনিক দক্ষতা: সাংগঠনিক জীবনে ‘দক্ষতা’ একটি অপরিহার্য বিষয়। দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হলে সংগঠন যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগতভাবেও লাঞ্ছিত হতে হবে প্রতিটি পদে। অদক্ষ ব্যক্তি নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হলে সংগঠনে বিশৃঙ্খলা একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সে সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় না। এরা বিশৃঙ্খলা দূর করতে তো জানেই না বরং নিজেরাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে প্রতিনিয়ত। অদক্ষ নেতৃত্বের কারণে সাজানো গোছানো সুশৃঙ্খল একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সংগঠন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে খুব সহজেই। অযোগ্য ও অদক্ষ নেতৃত্বের প্রতি যেমন কেউ আস্থা রাখতে পারে না, ঠিক একইভাবে সংগঠনও তাদের কারণে সকলের আস্থা হারায়। এ জন্য অযোগ্য ও অদক্ষ নেতৃত্ব সংগঠনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। রাসূল সা: ঘোষণা করেন, অর্থাৎ- যখন অযোগ্য ব্যক্তিদেরকে তোমাদের নেতৃস্থানীয় করা হবে তখন তোমরা কেয়ামতের অপেক্ষা করতে থাক। (বুখারী শরীফ) কাজেই নেতৃত্বকে অবশ্যই দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মনে রাখার বিষয় হলো : মানুষ কিন্তু দক্ষ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না বরং দেখে, শুনে, কাজ করতে করতে মানুষ দক্ষতা অর্জন করে। তবে এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন হয় ব্যক্তির আগ্রহ, তার জানার, শেখার ও করার মানসিকতা। সাংগঠনিক দক্ষতার ক্ষেত্রে অতীব জরুরি বিষয়াবলি নিম্নে আলোচনা করা হলো। ক. উচ্চ মানসিকতা : সাংগঠনিক দক্ষতার ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়োজন দায়িত্বশীলের উচ্চ মানসিকতা। তার মাঝে অবশ্যই থাকতে হাবে সর্বজয়ী, আকাশছোঁয়া উচ্চাশা। দায়িত্বশীলকে কাজ করাতে হবে বিশ্বজয়ের নেশায়।  আল্লাহ তাঁর রাসূল সা:কে জানিয়ে দিয়েছেন: আমি আপনাকে বিশ্বজাহানের সকল মানুষের জন্য প্রেরণ করেছি। (সূরা সাবা : ২৮) খ. সাংগঠনিক প্রজ্ঞা: প্রজ্ঞা মহান আল্লাহ প্রদত্ত এক বড় নেয়ামত। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এটি যেমন প্রয়োজন তার চেয়ে শতগুণ বেশি প্রয়োজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির জন্য। কুরআন পাকে আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেছেন: অর্থাৎ- হে নবী আপনি বলে দিন; এটি আমার কর্তব্য যে আমি লোকদেরকে দূরদর্শিতার সাথে আল্লাহর দিকে আহবান করব। (সূরা ইউছুফ : ১০৮) মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন: অর্থাৎ- আমি যাকে ইচ্ছা প্রজ্ঞা দান করি। আর যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে তাকে মূলত অনেক কিছুই দেয়া হয়েছে। (সূরা বাকারা : ২৬৯) বিশেষ করে দায়িত্বশীলকে অবশ্যই তাকওয়া অর্জন করতে হবে। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেছেন: অর্থাৎ- হে ঈমানদারগণ যদি তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর তবে তোমাদেরকে ফোরকান (ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা নিরূপণকারী) নামক নেয়ামত দান করব। (সূরা আনফাল : ২৯) গ. সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার মানসিকতা ও যোগ্যতা: সাংগঠনিক শৃঙ্খলা হলো সংগঠনের প্রধানতম একটি মৌলিক উপাদান। শৃঙ্খলাবিহীন সংগঠনকে মূলত সংগঠনই বলা চলে না। এ শৃঙ্খলা বজায়ে রাখতে দায়িত্বশীলের ভূমিকাই মুখ্য। সেক্ষেত্রে দায়িত্বশীলকে কমপক্ষে নিম্নের গুণাবলিগুলো অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। আনুগত্য : ইসলামী আন্দোলনে ঊর্ধ্বতনদের আনুগত্য করা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে সামান্যতম শিথিলতা বরদাশতযোগ্য নয়। ব্যক্তিগত সকল কাজও মূল নেতৃত্বের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে। যত কষ্টই হোক সংগঠনের সিদ্ধান্তের বাইরে কাজ করলে সে আর যাই হোক ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা রাখে না। অন্যদেরকে পরিচালনার যোগ্যতা: অন্যদেরকে পরিচালনার যোগ্যতা না থাকলে সে নিজে কর্মী হতে পারে কিন্তু দায়িত্বশীল হতে পারে না। এটি দায়িত্বশীলের মৌলিক গুণ। তবে ইচ্ছে করলেই অপরকে পরিচালনা করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত জ্ঞান, আমল, দক্ষতা, ধৈর্য, সময়ানুবর্তিতা, ব্যক্তিগত কোরবানির দৃষ্টান্তসহ দায়িত্বশীলের অন্যান্য সকল গুণাবলি অর্জন করা। বসে বসে শুধু অন্যকে নির্দেশ করে সাথি ভাইদেরকে পরিচালনা করা যায় না। রাসূল সা: অন্যদেরকে জিহাদে নামিয়ে দিয়ে নিজে ঘরে বসে থাকেননি বরং নিজে সিপাহসালারের ভূমিকা পালন করেছেন। খন্দকের যুদ্ধের পূর্বে সেটি খনন করার সময় সাহাবায়ে কেরামগণ রা: না খেয়ে পেটে একটি পাথর বেঁধেছেন আর রাসূল সা: অধিক ক্ষুধার কারণে দু’টি পাথর বেঁধেছেন। তাইতো সাহাবায়ে কেরাম রা: প্রচন্ড ক্ষুদ-পিপাসায় কাজ করেছেন আর আনন্দে গেয়ে উঠেছেন: অর্থাৎ- আমরা মুহাম্মদের সা: হাতে বয়াত গ্রহণ করেছি, জিহাদের কঠিন ময়দানে সর্বদা তাঁর সাথেই অবস্থান করব। সাহাবায়ে কেরামের কণ্ঠে দৃঢ়তার সাথে এ ঘোষণা শুনে রাসূল সা:ও গেয়ে উঠলেন: অর্থাৎ- হে আল্লাহ আমরা ঘোষণা করছি পরকালের সুখ শান্তিই আসল সুখ-শান্তি। কাজেই আপনি আনসার ও মুহাজিরদেরকে ক্ষমা করে দিন। (বুখারী শরীফ) দাফতরিক শৃঙ্খলা : সংগঠনের দফতর সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন। এ যোগ্যতার অভাবে অনেক সময় সুষ্ঠুভাবে সংগঠন পরিচালনা করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দায়িত্বশীলকে জিম্মি হয়ে পড়তে হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আর্থিক লেনদেনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকলে সচ্ছভাবে অনেক কোরবানি করা সত্ত্বেও অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত অনেক বদনামের ভাগী হতে হয় দায়িত্বশীলকে। তাকে দাফতরিক গোছগাছ ও পরিপাটির প্রতি কোনক্রমেই উদাসীন হলে চলবে না। এতে সংগঠনের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণœ হয়। গ. সকল কাজে দৃঢ়তা ও স্থিতিশীলতা : মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর প্রিয় রাসূলকে নিজ কাজে অধিক দৃঢ় করার জন্য কুরআন পাকের বিভিন্ন জায়গায় নির্দেশমূলক ভাবে বলেছেন: অর্থাৎ- হে নবী আপনি যেভাবে নির্দেশিত হয়েছেন তার ওপর দৃঢ় মজবুত থাকুন এবং বিপথগামী হবেন না। (সূরা হুদ : ১১২) কাজের মধ্যে দৃঢ়তা ও স্থিতিশীলতা না থাকলে কোনো কাজই সুন্দর ও যথার্থ হয় না। সংগঠনের এ কাজটি আমাকে করতেই হবে, আমি কেন পারব না, প্রতিটি দায়িত্ব আমি পালন করবই ইনশাআল্লাহ এমন দৃঢ়তা এবং সিরিয়াসনেস না থাকলে তার দ্বারা সংগঠনে ভালো কিছু আশা করা যায় না। কাজটি যত গুরুত্বপূর্ণই হোক সময় হলে করলাম, না হলে দরকার নেই, শরীরটা ফুরফরে না হলে কাজে মনোনিবেশ হয় না, এমন ব্যক্তি আর যাই হোক দায়িত্বশীল সে হতেই পারে না। ঘ. দায়িত্বশীলের কাজের গতিশীলতা : দায়িত্বশীলের প্রতিটি কাজে গতিশীলতা থাকা অত্যাবশ্যকীয়। ঢিলেঢালা ও অলসতা ‘দায়িত্বশীল’ শব্দটির পরিপন্থী। দায়িত্বশীলের যদি ‘আঠারো মাসে বছর’ হয় তাহলে কর্মীদের হবে কত মাসে? সাংগঠনিক কাজ ছাড়াও ব্যক্তিগত সকল কাজের ক্ষেত্রেও গতিশীলতার পরিচয় দিতে হবে। তবে অতি তাড়াহুড়া বা অযথা তাড়াহুড়া করাও কাম্য নয়। সময় পাইনি তাই কাজটি করতে পারিনি এমন কথা খুব বেশি গ্রহণযোগ্য নয়। অলসতায় সময় না কাটিয়ে কিংবা অন্য আর পাঁচটি কাজ মনোযোগ দিয়ে দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করে এ কাজটিও করতে পারা দক্ষতার পরিচায়ক। সর্বদাই নিজেকে সকল কাজের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে । ঙ. সৃজনশীলতা: এটি দায়িত্বশীলের একটি অন্যতম মৌলিক গুণ। চ. নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির যোগ্যতা: ইসলামী আন্দোলনে কাজ করার সুযোগ পাওয়া অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। এ জন্য মহান রবের দরবারে কবুলিয়াতের বিষয় রয়েছে। দায়িত্বশীল হওয়ার ব্যাপারটা আরো উন্নততর। এসব সত্ত্বেও নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য দায়িত্বশীলকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। নতুন নেতৃত্ব গঠনের যাবতীয় পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি তা প্রয়োগও করা জানতে হবে। যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য রাসূল সা: দোয়া করেছিলেন অর্থাৎ- হে আল্লাহ তুমি ওমর ইবনুল খাত্তাব কিংবা আমর ইবনে হিশামকে ইসলামের ছায়াতলে এনে ইসলামকে শক্তিশালী কর। (বুখারী শরীফ) ৪. নম্র ও সদ্ব্যবহার: নম্র ও কোমল আচরণ: দায়িত্বশীলকে অবশ্যই পারস্পরিক নম্র ও কোমল আচরণ করতে হবে। সংগঠন বা সংঘবদ্ধ ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলের অন্যতম কাজ হলো, কর্মীদেরকে একে অন্যের সাথে জুড়ে দেয়া, নিজেদেরকে পারস্পরিক দৃঢ়, মজবুত বন্ধনে আবদ্ধ করা, সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করা। এ জন্য দায়িত্বশীলকে যা করতে হয় তাহলো : নিজের মধ্যে চৌম্বকত্ব সৃষ্টি করা, অন্যকে জড়িয়ে বা আটকে রাখার যোগ্যতা সৃষ্টি করা। এ ক্ষেত্রে একটি উত্তম উদাহরণ হলো : কাদামাটি আর শুকনা মাটি। কাদামাটির এ যোগ্যতা আছে যে সে অপর কিছু কাদামাটি এমনকি শুকনা মাটির টুকরাকেও অনায়াসে আটকে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে শুকনা মাটির কিন্তু এ যোগ্যতা বা ক্ষমতাটুকু নেই। তাইতো একজন দায়িত্বশীলকে অবশ্যই নিজেদের মাঝে পারস্পরিক নরম ও কোমল আচরণ করতে হবে। কথায় বলেও মুখে মধু মাখো তবে বিশ্বজয় করতে পারবে। কাজেই সকলের সাথে সুমিষ্ট ভাষায় কথা বলা, ছোট-বড় সকলকে আগে সালাম দেয়া, হাসিমুখে বিনিময় করা, এককথায় সর্বত্র সদাচরণের মাধ্যমে অপর ভাইয়ের হৃদয় জয় করার যোগ্যতা তাকে অর্জন করতে হবে। খ. অপরের প্রতি সদয় হওয়া: রাসূল সা: এরশাদ করেন : তোমাদের মাঝে সেই উত্তম যে মানুষের উপকার করে। (জামিউল আহাদিস, খ: ৩৪,পৃ: ৪৩০) তিনি অন্যত্র এরশাদ করেন : পৃথিবীবাসীর প্রতি সদয় হও তবে আসমানের অধিবাসীরা তোমাদের প্রতি সদয় হবেন। (আবু দাউদ, বায়হাকী) অন্যের প্রতি সদয় হওয়া, অপরের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো, সহপাঠী ও প্রতিবেশীর সমস্যা দূরকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা, অপর জাবালে নূর তথা হেরা গুহায় রাসূল সা:-এর নিকট প্রথম ওহি আসার পর এ অজানা অচেনা পরিস্থিতির আকস্মিকতায় তিনি ভীতসন্ত্রস্ত ও জ্বরাক্রন্ত হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় হজরত খাদিজা রা: অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রাসূল সা:কে  সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আল্লাহর কসম! আল্লাহ তা’আলা কখনও আপনাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অপরের বোঝা বহন করে তার বোঝাকে হাল্কা করেন, অভাবী লোকের প্রয়োজন মিটিয়ে থাকেন, মেহমানের খাতির-যতœ ও মেহমানদারি করে থাকেন এবং দ্বীনের পথে চলতে অন্যের বিপদ মুসিবতে সাহায্য করেন। (সহীহ বুখারী) সহকর্মী, সংগঠনের অধস্তন দায়িত্বশীল ও কর্মীদের প্রতি সদয় হওয়ার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন: অর্থাৎ- আপনার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হন। (সূরা আশ্ শুরা : ২১৫) গ. অপরের অধিকারকে প্রাধান্য দেয়া : দায়িত্বশীলের সদাচরণের মধ্যে একটি হলো নিজের স্বার্থ ও চাহিদাকে প্রাধান্য না দেয়া। স্বার্থবাদী আচরণের কিঞ্চিৎ বহিঃপ্রকাশও ঘটানো যাবে না। রাসূল সা: মদিনায় হিজরত করার পর আনসার সাহাবাগণ রা: ব্যাপকভাবে মুহাজির ভাইদেরকে সহযোহিগতা করেছিলেন। নিজের পছন্দের, ভালো ও সখের সম্পদটি মুহাজির ভাইকে দিয়ে নিজে অপেক্ষাকৃত খারাপটি গ্রহণ করেছিলেন কিংবা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন। প্রয়োজনে নিজেরা না খেয়ে কিংবা খাওয়ার ভান করে মুহাজির ভাইকে খাইয়েছেন। তাদের এ ত্যাগ-কোরবানি ও মধুর আচরণ আল্লাহ তা’আলার নিকট এতটাই পছন্দ হয়েছে যে তাঁদের এ গুণাবলি বর্ণনা করে তিনি আয়াতে কারিমা অবতীর্ণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে অর্থাৎ- তাঁরা নিজেদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অন্যকে নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়। (সূরা হাশর : ৯) দায়িত্বশীলগণ প্রতিনিয়ত একে অন্যের খোঁজ নেবেন। প্রয়োজনে নিজের স্বার্থকে অপরের তরে অকাতরে হাসিমুখে বিলিয়ে দিতে সদা সচেষ্ট থাকবেন। ৫. সাহসিকতা: ক. মাথা অবনত হবে কেবল আল্লাহরই জন্য। একজন দায়িত্বশীকে প্রচন্ড রকমের সৎসাহসের পরিচয় দিতে হবে। তাকে খেয়াল রাখতে হবে সে কেবল মহান সৃষ্টিকর্তা, বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ পাকেরই ইবাদত করে। কেবল তাকেই অবনত মস্তকে সিজ্দা করে। ফলে অন্য কোনো মাখলুকের সামনে চাই সে যত বড় ক্ষমতাধর কিংবা শক্তিশালীই হোক না কেন ন্যূনতম অবনত হওয়ার কোনো সুযোগ ইসলামই তাকে দেয়নি। দৃঢ়চিত্তে সত্য কথা বলতে সামান্যটুকু কুণ্ঠাবোধ করার সুযোগ দেয়া হয়নি। জালিম শাহিকে পরওয়া না করা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন: অর্থাৎ- হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং ন্যায্য কথাটি বল। তবে তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করবেন ও পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে। (সূরা আহজাব : ৭০-৭১) রাসূল সা: ইরশাদ করেন অর্থাৎ- জালিম শাহির সামনে সত্য কথা বলাই হলো উত্তম জিহাদ। (ফতহুল বারী, খ: ১৩, পৃ: ৫৮) খ. প্রজ্ঞার সাথে কাজ করা : লক্ষণীয় বিষয় হলো, সাহসিকতাপূর্ণ কথা বা কাজটি অবশ্যই হেকমত বা প্রজ্ঞা ও উত্তম ভাষায় হতে হবে। অন্যথায় কোনো কোনো সময় এ সাহসিকতা ক্ষতির মহা কারণ হয়ে যেতে পারে। গ. পরামর্শভিত্তিক কাজ করা: দায়িত্বশীলদের সকল কাজই হবে পরামর্শভিত্তিক। যথাযথ পরামর্শভিত্তিক কোনো কাজের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে তা বাস্তবায়নে নেমে পড়তে হবে তা যত বড় ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টসাধ্যই হোক না কেন। প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দৃঢ় থাকতে হবে। দীনের কাজে কাপুরুষতাপূর্ণ আচরণ কখনোই কাম্য নয়। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, অর্থাৎ- অতঃপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তখন আল্লাহ্ তা’আলার ওপর ভরসা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯) ৬. বাগ্মিতা বা দক্ষ বক্তা হওয়া: কেবল দাঈ-ইলাল্লাহ ও ইসলামী আন্দোলনের একজন দায়িত্বশীলের মাঝে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। সেসবের মধ্যে একটি হলো: ইসলামী আন্দোলনের সকল দায়িত্বশীলই দাঈ-ইলাল্লাহ। কিন্তু কেবল দাঈ-ইলাল্লাহ হলেই সে ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল হন না বা হতে পারেন না। দাঈ-ইলাল্লাহ এর কাজ নানাভাবে করা যায়। যেমন- কথার দ্বারা, লেখনীর দ্বারা, উত্তম ব্যবহারের দ্বারা ইত্যাদি। কিন্তু— ইসলামী আন্দোলনের একজন দায়িত্বশীলের মাঝে এসব মৌলিক গুণাবলির পাশাপাশি আরো অসংখ্য গুণ অর্জন করতে হয়। সকল আন্বিয়া আ:, তাঁদের খলিফাগণ, যুগে যুগে গোটা বিশ্বব্যাপী যাঁরা ইসলামের ধারক-বাহক ছিলেন, ইসলামের মহান নেতৃত্ব দিয়েছেন, ইসলামের সুমহান আওয়াজকে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা সকলেই ছিলেন দায়িত্বশীল, কেবল দাঈ-ইলাল্লাহ নয়। খ. বাতিলের মোকাবেলায়: অন্যায়-অসত্যের মোকাবেলায় বাগ্মিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কুরআন পাকে ইরশাদ হয়েছে: অর্থাৎ- তাদের সাথে উত্তম ভাষায় বিতর্ক করুন। (সূরা নাহল : ১২৫) গ. সুযোগ কাজে লাগানো: একজন দায়িত্বশীল অযথা মুখ ভার করে বসে থাকতে পারেন না। চলতে ফিরতে সুযোগ পেলেই দাওয়াত উপস্থাপনের চেষ্টা চালাতে হবে। ক্লাসে, ক্যাম্পাসে, জুমার পূর্বে, সভা-সমাবেশে সুযোগ পেলেই ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াতকে সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় গঠনমূলকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। শ্রোতাদের অবস্থা ও পরিবেশ বুঝে যথাযথ বক্তব্যটি স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করাটাই কাম্য। ইসলামী আন্দোলনের একজন দায়িত্বশীল হিসেবে মানবজাতির সার্বিক কল্যাণ আর মুক্তির জন্য সর্বদা দাওয়াতের ফিকির মাথায় নিয়ে চলতে হবে। গোটা উম্মতের জন্য নিজের মধ্যে ব্যথা আর জ্বালা-যাতনা সৃষ্টি করতে হবে। রাসূল সা:-এর মৌলিক দু’টি বৈশিষ্ট্য ছিলো: অর্থাৎ- রাসূলুল্লাহ সা: সর্বদাই চিন্তাগ্রস্ত এবং উম্মতের ফিকিরে মশগুল থাকতেন। তিনি স্বস্তিতে দীর্ঘ বিশ্রাম নিতেন না, দীর্ঘ সময় নিশ্চুপ থাকতেন, বিনা প্রয়োজনে কথা বলতেন না। (শামায়েলে তিরমিজি, পৃ: ১৩৪) ঘ. ভাষাগত দক্ষতা অর্জন: বক্তব্য উপস্থাপন, দাওয়াত পেশ কিংবা সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে ভাষাগত যোগ্যতা বা দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই বাংলাদেশের পরিবেশে মাতৃভাষা বাংলার পাশাপাশি কয়েকটি ভাষায়, বিশেষ করে আরবি/ইংরেজি ভাষায় দায়িত্বশীলের অবশ্যই দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন। দায়ীর জন্য আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা মোটেই প্রত্যাশিত ও সুখকর নয়। ৭. সময়ানুবর্তিতা: মানবজীবনের সংক্ষিপ্ত হায়াতে ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা অর্জনের জন্য সময়ানুবর্তিতা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন: ক. কোনো ক্ষেত্রেই সময় অপচয় করা যাবে না। প্রতিটি মুহূর্তকে অতি মূল্যবান মনে করতে হবে। রুটিনমাফিক জীবন পরিচালনার অভ্যাস করতে হবে। এক্ষেত্রে সংগঠনের দৈনন্দিন ব্যক্তিগত প্রতিবেদন মুখ্য সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। খ. আগামীকাল কী কাজ, রাতে ঘুমের পূর্বেই সিরিয়াল অনুযায়ী ডায়েরিতে তা লিখে নিতে হবে। যেন সকালে উঠে কাজের পরিকল্পনা করতে গিয়ে সময় নষ্ট না হয় কিংবা কাজ এলোমেলো হয়ে না যায়। গ. সংগঠনের সকল বৈঠক, প্রোগ্রামসহ সব ক্ষেত্রে যথাসময়ে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কার্যক্রম শেষ করার চেষ্টা করতে হবে। অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সম্ভব হলে কিছু পূর্বেই উপস্থিত হওয়া চাই। কোন অজুহাতেই যেন বিলম্ব না হয় সেদিকে খুব খেয়াল রাখতে হবে। ৮. প্রেরণা সৃষ্টির যোগ্যতা: যেকোন কাজের জন্য মানুষকে পেছন থেকে যে জিনিসটি উদ্বুদ্ধ করে, মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় তাকে বলা হয় ‘প্রেষণা’। আমরা যাকে বলি প্রেরণা। এটি অনেক কিছুর মাধ্যমেই হতে পারে। যেমন- শ্রমিক হাড়ভাঙা কষ্ট স্বীকার করে, চাকরিজীবী চাকরি করে, ব্যবসায়ী ব্যবসা করে, পেছনে প্রেরণা হলো শ্রম শেষে অর্থ পাবে। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! এসব নির্যাতন সহ্য করলে এর বিনিময়ে আমাদেরকে কী দেয়া হবে? রাসূল সা: বললেন, অর্থাৎ- আমার রবের রেসালাত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যে আমাকে আশ্রয় দেবে এবং সহযোগিতা করবে এর বিনিময়ে তাদেরকে পরকালে জান্নাত দেয়া হবে। সাহাবায়ে কেরাম রা: একবাক্যে বলে উঠলেন: আমাদেরকে জান্নাত দেয়া হবে! আপনি নির্দ্বিধায় চলে আসুন। আমরা জান্নাতের বিনিময়ে সব কিছু কোরবানি করতে রাজি আছি। পরকালে জান্নাত প্রাপ্তিই হলো সাহাবায়ে কেরামের ইসলামী আন্দোলনের পথে জীবন দেয়ার জন্য প্রেরণা। কাজেই মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.-এর সন্তুষ্টি অর্জন, মহান রবের খিলাফত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করে সৃষ্টির সেবা করার মহান দায়িত্ববোধকে যেন কোনো ধরনের হতাশা, নিরাশা, পিছুটান, দুনিয়ার মোহ, ব্যক্তিগত স্বার্থ ইসলামী আন্দোলনের কাউকে গ্রাস করতে না পারে, কাউকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে না পারে, এ পথ থেকে দূরে ঠেলে দিতে না পারে সে দিকে দায়িত্বশীলকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ৯. কর্মীদের মাঝে ইনসাফ কায়েম করা: ইসলামী আন্দোলন করার উদ্দেশ্যই হলো মহান রবের এ পৃথিবীর সর্বত্র ইনসাফ কায়েম করা। সেক্ষেত্রে দায়িত্বশীলকে প্রথমে নিজের আশপাশের যারা তাদের প্রতি ইনসাফ কায়েম করতে হবে। এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে : ক. সংগঠনের নীতিমালা বা নিয়ম-কানুন যথাযথ অনুসরণ করা: কর্মীদের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার প্রধান শর্তই হলো সংগঠনের নীতিমালা বা নিয়মকানুন যথাযথ অনুসরণ করা। সংগঠনের নীতিমালাকে পেছনে ঠেলে দিলে সেখানে ইনসাফহীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও বিশৃঙ্খলা অনেকটাই অবশ্যম্ভাবী। কারণ সংগঠনের নীতিমালা বা নিয়মকানুন করা হয় পরামর্শের ভিত্তিতে। এ কারণে এর মধ্যেই আল্লাহ পাকের রহমত পূর্ণ থাকে। এর বাইরে গেলেই সেটি হবে রহমতশূন্য। শত ভালো মনে হলেও বিশৃঙ্খলা থাকবে তার পদে পদে। আর একটি বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দিলে আরো দশটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। কাজেই নীতিমালা বা নিয়মবহির্ভূত কোনো কিছু কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। ১০. ইসলামী আন্দোলনে সর্বোচ্চ কোরবানির মানসিকতা রাখা: ক. সর্বোচ্চ কোরবানির মানসিকতা । খ. ইসলামী আন্দোলনকে প্রাধান্য দেয়া । গ. সংগঠনের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেয়া। ঘ. সংগঠনের সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ । ১১. মুয়ামেলাত : আমলিয়াতের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে আচার আচরণ তথা মুয়ামেলাত যা বিশেষভাবে হক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক্কের সাথে সম্পর্কিত। এ মুয়ামেলাত বিভিন্ন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির সাথে সম্পর্কিত। যেমন- ১. ব্যক্তিগত, ২. পারিবারিক ও আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্কিত, ৩. সাংগঠনিক, ৪. সামাজিক, ৫. প্রাতিষ্ঠানিক প্রভৃতি উপরিউক্ত সকল ক্ষেত্রের জন্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ম বিধান দেয়া হয়েছে সেসব নিয়ম বিধান যথাযথভাবে মেনেই আমাদেরকে মুয়ামেলাত  নিশ্চিত করার তাওফিক দিন। আমিন হ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির