post

ইসলামী আন্দোলন দেশে দেশে

০৪ মে ২০১১
মতিউর রহমান আকন্দ মিসর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হচ্ছে মিসর। ১০ লাখ বর্গকিলোমিটার মিসরীয় ভূখণ্ডে ৮ কোটি ৪৫ লাখ মানুষের অধিবাস। বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি হলো মিসরের পিরামিড, যা নীল বিধৌত জনপদের প্রাচীন সভ্যতার অতুলনীয় নিদর্শন। ভূমধ্য ও লোহিত সাগর সংযোজক সুয়েজ খালের সুবাদে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্ববহ ও ব্যস্ততম নৌরুট গেছে মিসরের মধ্য দিয়ে। এ কারণে দেশটির আন্তর্জাতিক গুরুত্ব অনেক। আজ থেকে দুই হাজার তিন শ’ বছর আগে গ্রিক ভূগোলবিদ হিরোডটাস মিসরকে অভিহিত করেছিলেন ‘নীল নদের দান’ বলে। আবহমানকাল থেকে বয়ে চলা এই নীলের স্বচ্ছ সুনীল সঞ্জীবনী স্রোতধারায় আজো স্নাত হয়ে চলেছে পুরনো সভ্যতার পরিচয়বাহী দেশ মিসর। হজরত ঈসা (আ)-এর জন্মের চার থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে মিসরে ফারাও বা ফেরাউনের শাসন চালু ছিল। পবিত্র কুরআনে হজরত মূসা (আ) প্রসঙ্গে ফেরাউন এবং তার অত্যাচারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কালক্রমে মিসরে দ্বীন ইসলামের আবির্ভাব ও বিকাশের শুরু সপ্তম শতাব্দীতে। হজরত মুহাম্মদ (সা) তাঁর জীবদ্দশায় ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে মিসরের শাসক মুকাওকাস ইবন ইয়ামিনকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা)-এর সময়ে মুসলিম সেনাপতি আমর ইবন আল আস ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে রোমক শাসককে পরাজিত করে মিসরকে মুসলিম শাসনাধীনে আনেন। মিসর আরবের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। উমাইয়া এবং আব্বাসীয় শাসনের পর ৯৬৯ সালে মিসরে ফাতিমী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বংশের প্রথম শাসক কায়রোতে রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করেন। ১১৭১ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ফাতিমী শাসন উচ্ছেদ করে মিসরের শাসনভার গ্রহণ করেন। এ সময় তৃতীয় ক্রুসেড সংঘটিত হয়। সুলতান সালাহ উদ্দিন ধর্মোন্মাদ খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে পবিত্র জেরুজালেমের ওপর মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। ত্রয়োদশ শতকে সুলতান সালাহউদ্দিন প্রতিষ্ঠিত আইয়ুবী বংশের অবসান ঘটে এবং মামলুক বংশ মতা দখল করে। এরা প্রায় ৩০০ বছর মিসর শাসন করার পর ষোড়শ শতকে তুর্কি সুলতান প্রথম সেলিম মিসর জয় করেন এবং মিসর উসমানী সাম্রাজ্যের অধীনে একটি প্রদেশে পরিণত হয়। আঠারো শতকের শেষ ভাগে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান মিসরে অভিযান পরিচালনা করেন। ১৭৭৮ সালে নেপোলিয়ান কায়রো অধিকার করেন। নেপোলিয়ান মিসর ত্যাগ করেন ১৭৯৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। ১৮০১ সালে ইংরেজ স্বারিত এক চুক্তির মাধ্যমে ফরাসি বাহিনী মিসর ত্যাগ করলে মিসরে ফরাসি শাসনের অবসান ঘটে। ১৯২২ সালে ইংরেজরা মিসরকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিলেও সেখানে রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করে যায়। শেষ রাজা ফারুকের সময় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন প্রশ্নে ইসরাইলের সাথে মিসরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিসরসহ আরব দেশগুলো এ যুদ্ধে পরাজিত হয়। ফলস্বরূপ ১৯৫২ সালে রাজা ফারুককে সামরিক অভ্যুত্থানে উৎখাত করা হয়। ১৯৫৩ সালে মতার মসনদে সমাসীন হন কর্নেল জামাল আব্দুন নাসের। ১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যু হয়। মতায় আসেন সা’দাত। ১৯৮১ সালে সা’দাত নিহত হলে প্রেসিডেন্ট হুসনি মোবারক তার স্থলাভিষিক্ত হন। এক টানা ২৯ বছর মিসর শাসন করার পর ২০১১ সালের ১১ ফেব্র“য়ারি প্রচণ্ড গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে প্রেসিডেন্ট পদবির অঘোষিত সম্রাট স্বৈরাচারী হুসনি মোবারকের। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে নির্লজ্জ দহরম মহরমের মাধ্যমে রাজা ফারুক ঐতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন ভূমি মিসরের মাটিতে কাব, থিয়েটার, নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করে অশ্লীলতা, ব্যভিচার ও নোংরামির প্লাবন বইয়ে দেয়। রাজা ফারুক শাসক হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসনযন্ত্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোই ছিল খ্রিষ্টান এবং বিদেশী ইংরেজদের দখলে। দেশের অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্তা ছিল ইহুদি ব্যবসায়ী চক্র। ইসলামের এই দুই প্রধান শত্র“র সম্মিলিত চক্রান্তে নৈশ কাব, রঙ্গমঞ্চ এবং প্রোগৃহের জাল বিস্তারের সুবাদে সাধারণ কফিখানাগুলো পর্যন্ত নৃত্য-গীতসহ ব্যভিচারের আড্ডাখানায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। চারদিকে এ অস্বাভাবিক অনাচারের প্লাবন দেখে যুবক হাসানুল বান্নার অনুভূতিপ্রবণ অন্তর দারুণভাবে আলোড়িত হয়ে গেল। ইসলামী ঐতিহ্যের সুপ্রাচীন লালনক্ষেত্র, অসংখ্য সাধক পুরুষের লীলাভূমি, পবিত্র আত্মার পদধূলিধন্য মিসরের মাটি থেকে ইহুদি-খ্রিষ্টান ষড়যন্ত্রকারীদের ছড়ানো ব্যাপক অনাচারের আবর্জনাগুলো কিভাবে দূর করা যায়Ñ এ চিন্তা তাঁকে অস্থির করে তুললো। হাসানুল বান্না তখন শেষ বর্ষের ছাত্র। তাঁকে থিসিসের যে বিষয় নির্ধারণ করে দেয়া হয় তার শিরোনাম ছিল “শিাজীবন শেষ করার পর তিনি কী করতে চান এবং এ জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন?” হাসানুল বান্না এর জবাবে লিখেন : “আমি দায়ী ও প্রশিক হতে চাই। দিনে বছরের অধিকাংশ সময় মিসরের নবপ্রজন্মকে প্রশিণ দেবো এবং রাতের বেলা ও ছুটির দিনগুলোতে ওদের অভিভাবকদেরকে দ্বীনের উদ্দেশ্য বোঝানোর চেষ্টা করবো। তাদেরকে জানাবো শান্তি ও সৌভাগ্যের উৎস কোথায় এবং জীবনের সুখ আর আনন্দ কিভাবে অর্জিত হবে। এ উদ্দেশ্যে সে পথই অবলম্বন করবো যা আমার সাধ্যের বাইরে নয়। বক্তৃতা, আলোচনা ও পারস্পরিক আলাপচারিতার দ্বারা পুস্তক-পুস্তিকা রচনার মাধ্যমে পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে। মোট কথা প্রতিটি আকর্ষণীয় হাতিয়ার দ্বারাই সাহায্য গ্রহণ করবো।”Ñ এই হলো সেই নওজোয়ানের জযবা যিনি গভীর সমুদ্রে নেমে কেবল নিজের পোশাক বাঁচানোর দৃঢ় ইচ্ছাই পোষণ করেননি, অপরের পোশাক রার চিন্তাও করেছেন। মুসলিম জনগণের ওপর ইহুদি খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত হামলার প্রেক্ষিতে উদ্ভূত সমস্যার বাস্তব মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে হাসান আল বান্না আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কর্মেক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায় কাজ শুরু করে মাত্র এক বছরের প্রচেষ্টায় ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে ছয়জন অনুগামী এবং কয়েকজন ছাত্র নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় হাসানুল বান্নার ক্ষুদ্র বাসভবনে একত্রিত হয়ে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য বহুল আলোচিত সংগঠন ‘ইখওয়ানুল মুসলেমুন’-এর ভিত্তি স্থাপন করেন। প্রাথমিক ৫টি বছর আলেকজান্দ্রিয়াতেই সংস্থার সদর দফতর চলতে থাকে। চারদিকে বিস্তৃত প্রতিকূল পরিবেশের বিভীষিকা অতিক্রম করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় কায়রো ছিল সর্বাপো সমস্যাজর্জরিত এলাকা। ৫ বছর কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে ১৯৩৩ সালে ইখওয়ানের সদর দফতর স্থানান্তর করা হয়। কায়রোর বর্ণাঢ্য পরিবেশে আল্লাহর কয়েকজন নিরীহ বান্দাহ অকুতোভয়ে দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। হাসানুল বান্নার স্বভাবসুলভ তেজোদীপ্ত বক্তৃতা আত্মবিস্মৃত মানুষকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। আত্মোপলব্ধির চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দলে দলে লোক এসে অন্দোলনের সাথে শরিক হতে থাকে। হাসানুল বান্নার মনোমুগ্ধকর, চিত্তাকর্ষক বক্তব্য অগ্নি¯ফুলিঙ্গের মতো অন্তরের গভীর থেকে উত্থিত প্রতিটি শব্দ দরদি অন্তর মাত্রকেই স্পর্শ করত। দীর্ঘ ২০ বছরকাল ইখওয়ানুল মুসলেমুনের মুরশিদে আম বা প্রধান হিসেবে হাসানুল বান্না মিসরবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তাঁর সে দাওয়াতের ঢেউ মিসরের সীমা অতিক্রম করে সমগ্র আরব জাহানে ছড়িয়ে পড়লো। যুবসমাজের মাঝে ইসলামের বিপ্লবী চেতনা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়লো যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যকেন্দ্র, অফিস-আদালত হতে তে-খামারে পর্যন্ত এ চিন্তার প্রভাব অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে ফুটে উঠতে লাগলো। বিশ বছরের কর্মতৎপরতায় ইখওয়ান প্রায় ২০ লাখ প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ এবং ২ হাজারের বেশি শাখা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়। দেশের বাইরে সুদান, সিরিয়া, ইরাক এমনকি সুদূর তুরস্ক পর্যন্ত ইখওয়ানের প্রভাব পরিলতি হতে থাকে। ১৯৩৬ সালের দিকে সর্বপ্রথম ইখওয়ানের তৎপরতা সরকারের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বান্না মতাসীন রাজা ও মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত চিঠি প্রেরণ করেন এবং তাদেরকে পাশ্চাত্য রীতি পরিহার করে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার আহ্বান জানান। ইখওয়ানের সামগ্রিক আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কার এবং ইসলামী ভাবধারায় তরুণ মানস গড়ে তোলার প্রয়াস ছিল অন্যতম প্রধান কর্মসূচি। এ কর্মসূচির আওতায় ইখওয়ান অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে। নারীদের জন্য পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কারিকুলাম তৈরি করে। ইখওয়ান ব্যাপক সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। সারাদেশের মসজিদগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। বেশ কিছু হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করে। নিজস্ব আদর্শ প্রচারের জন্য ইখওয়ান পত্রপত্রিকা, হ্যান্ডবিল, বুকলেট, ম্যাগাজিন ও প্রচারপত্রে কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতিসহ চিত্তাকর্ষক বক্তব্য তুলে ধরে। সমগ্র আরব বিশ্বে লাখ লাখ পাঠক তাদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়। ইখওয়ানের বৈপ্লবিক আন্দোলনের গতিধারা প্রত্য করে সাম্রাজ্যবাদীরা রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে ওঠে। তারা তৎপর হয়, সর্বশক্তি নিয়োগ করে ইখওয়ানের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য। ১৯৪৮ সালে রাজা ফারুক ইখওয়ানকে বেআইনি ঘোষণা করেন। এ সংগঠনের হাজার হাজার কর্মীকে কারান্তরালে নিপে করা হয়। বিপ্লবী হাসানুল বান্নাকে সরাসরি গ্রেফতার না করে তাঁকে দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার পৈশাচিক ষড়যন্ত্র আঁটা হলো। ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যার পর এক কর্মিসভায় বক্তৃতা দিয়ে ফেরার পথে তাঁর ট্যাক্সি ল্য করে দুর্বৃত্তরা উপর্যুপরি গুলিবর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়লেন মহান বিপ্লবীর নশ্বর দেহ। হাসপাতালে নেয়ার পূর্বে তাঁর শহীদি আত্মা পরম প্রিয় মাওলার সান্নিধ্যে পৌঁছে গেলো। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। শহীদ হাসানুল বান্নার শেষ পয়গাম ছিলÑ ‘‘আল্লাহর কুরআনকে জীবনের সর্বেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের কাফেলার বিরাম নেই।” ১৯৫৪ সালে নাসেরের জীবন নাশ সম্পর্কিত এক ঘটনায় ইখওয়ানকে জড়িত করে নির্মম নির্যাতন ও দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ইখওয়ানের হাজার হাজার কর্মীকে আবার গ্রেফতার করা হয়। অনেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। মুসলিম বিশ্বের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৯৫৬ সালে ৬ জন নেতাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। ১২ বছর পর্যন্ত ইখওয়ানের ওপর নির্যাতন চালানোর পর ১৯৬৬ সালে ইখওয়ানকে মিসরের মাটি থেকে নির্মূল করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট নাসের কর্তৃক গঠিত কমিটি একটি সুপারিশমালা পেশ করে। সার্বিক কল্যাণবহ একটি ইসলামী আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী কী জাতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, তার প্রমাণ হিসেবে উক্ত কমিটির সুপারিশগুলো উল্লেখ করা যেতে পরে : ১. দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সিলেবাস থেকে দীনিয়াত এবং ইসলামের ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে দূর করে দিয়ে পরিবর্তে সমাজতন্ত্রভিত্তিক একটি কারিকুলাম তৈরি করতে হবে। ২. দেশের জনগণের মন থেকে ধর্মীয় চেতনা ও প্রভাব দূর করার জন্য কমিউনিজমকে দেশের মধ্যে কাজ করার পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে ও ধর্মবিরোধী প্রচারণার ব্যাপারে পূর্ণ সরকারি সহযোগিতা দিতে হবে। ৩. ইখওয়ানের আদর্শভিত্তিক সমস্ত প্রচারণা ও কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল সকল আলেম ও ব্যক্তিকে এর থেকে দূরে সরিয়ে রাখা অথবা সমূলে ধ্বংস করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. ইখওয়ানের কর্মী এবং শুভাকাক্সীদেরকে অব্যাহত হয়রানি ও নির্যাতনের ওপর রাখতে হবে। তাদের সহায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং তাদের কাজ করার কোনো সুযোগ না দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। মিসর সরকারের হিংসাত্মক মনোভাবের শিকার হয়ে হাজার হাজার কর্মী কারাভ্যন্তরে নিক্ষিপ্ত হয় ও নির্মম নির্যাতনের যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট হয়। ১৯৬৬ সালের ২৬ শে আগস্ট ইখওয়ানের প্রখ্যাত নেতা সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। তার ভাই মুহাম্মদ কুতুব এবং ভগ্নি হামিদা কুতুবকে অজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। সাইয়েদ কুতুব কর্মজীবনে কিছুকাল অধ্যাপনার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। মিসরে ওই পদটিকে অত্যন্ত সম্মানজনক বিবেচনা করা হয়। আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি পড়াশোনার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প থেকে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। দুই বছরের কোর্স সম্পন্নকালে তিনি আমেরিকায় বস্তুবাদী সমাজের দুরবস্থা ল্য করেন। আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে ১৯৪৫ সালে তিনি ইখওয়ানুল মুসলেমুনের সদস্য হন। ১৯৫২ সালে তিনি ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত হন। পরিপূর্ণভাবে নিজেকে আন্দোলনের কাজে উৎসর্গ করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ইখওয়ান পরিচালিত সাময়িকী ইখওয়ানুল মুসলেমুন-এর সম্পাদক নির্বাচিত হন সাইয়েদ কুতুব। ছয় মাস পর কর্নেল নাসের সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। একটি বানোয়াট হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ইখওয়ানুল মুসলেমুনকে বেআইনি ঘোষণা করে দলের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত নেতাদের মধ্যে সাইয়েদ কুতবও ছিলেন।  গ্রেফতারের সময় তিনি ভীষণভাবে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। গ্রেফতারের পর তার হাতে-পায়ে শিকল পরানো হয়। প্রবল জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় তাকে পায়ে হেঁটে জেল পর্যন্ত যেতে বাধ্য করা হয়। পথে কয়েকবার বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি বলতেন, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ। জেলে ঢোকানোর সাথে সাথে তাকে মারপিট করা হয়। একটি প্রশিণপ্রাপ্ত কুকুরকে তার ওপর লেলিয়ে দেয়া হয়। তার গায়ে আগুনের ছেঁকা দেয়া হয়। ১৯৫৫ সালের ১৩ জুলাই তাকে ১৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। এক বছর পর নাসের সরকারের প থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়, তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে মার আবেদন করলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। এ প্রস্তাবের যে জবাব তিনি দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি বলেন : “আমি এ প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি যে, মজলুমকে জালিমের নিকট মার আবেদন জানাতে বলা হচ্ছে। আল্লাহর কসম! যদি মা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে, তবু আমি এরূপ শব্দ উচ্চারণ করতে রাজি নই। আমি আল্লাহর দরবারে এমন অবস্থায় হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর প্রতি এবং তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট।” পরবর্তীকালে যতবার তাকে মা প্রার্থনার কথা বলা হয় ততবারই তিনি বলেন, “যদি আমাকে যথার্থই অপরাধের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি এতে সন্তুষ্ট আছি। আর যদি বাতিল শক্তি আমাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে থাকে, তাহলে আমি কিছুতেই বাতিলের নিকট মা প্রার্থনা করবো না।” ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি ইরাকের প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম মিসর সফরকালে সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সুপারিশ করায় কর্নেল নাসের তাঁকে মুক্তি দিয়ে তাঁরই বাসভবনে অন্তরীণাবদ্ধ করেন। (চলবে) লেখক -সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির