post

ইসলামী রাজনীতির প্রাণপুরুষ অধ্যাপক গোলাম আযম রা হি মা হু ল্লা হ

আরিফুল ইসলাম সোহেল

২৭ জুলাই ২০২৩

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম একজন আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বর্ষীয়ান জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের উত্থান-পতনের প্রতিটি ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি। মূলত আল্লাহর জমিনে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়দ্বীপ্ত চেতনা নিয়ে নিজের জীবনকে বিনিয়োগ করেছিলেন অধ্যাপক আযম। এ সংগ্রামের পথ ধরেই তাঁকে মুখোমুখি হতে হয়েছে নিপীড়ন, অপবাদ আর অপ্রচারের।

তিনি সারাটি জীবন সকল জুলুম-নির্যাতন আর অপবাদ-অপপ্রচারকে প্রশান্ত হৃদয় আর দৃঢ়চেতা মন নিয়ে মাটি আর পাহাড়ের মতই সয়ে গেছেন। কখনোই ধৈর্যহারা হননি আল্লাহর দ্বীনের এই সাহসী সিপাহসালার। এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা, সুযোগ্য নেতৃত¦ এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান মানুষ যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁর নামটি।

জন্ম ও ব্যক্তিজীবন

অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর, বাংলা ১৩২৮ সালের ৫ অগ্রহায়ণ মঙ্গলবার ঢাকা শহরস্থ লক্ষীবাজারের বিখ্যাত দ্বীনি পরিবারে (শাহ সাহেবের বাড়ি) মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা গোলাম কবির, মাতা সাইয়্যেদা বেগম আশরাফুন্নিসা। পিতামহ মাওলানা আব্দুস সুবহান। অধ্যাপক গোলাম আযমের পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলাধীন বীরগাঁও গ্রামে। ছাত্রজীবনে বরাবর তিনি ছিলেন বোর্ডস্ট্যান্ড করা মেধাবী ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন অধ্যাপক গোলাম আযম। ১৯৫১ সালে সাইয়্যেদা আফিফা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ব্যক্তিজীবনে ৬ পুত্র সন্তানের জনক অধ্যাপক আযম। তাঁরা হলেন মামুন আযমী, আমীন আযমী, মোমেন আযমী, আমান আযমী, নোমান আযমী, সালমান আযমী। চতুর্থ পুত্র অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল আমান আযমীকে গুম করে রেখেছে সরকার।

রাজনৈতিক জীবন

এদেশের মাটি ও মানুষের সংগঠন, তৌহিদী জনতার প্রাণের স্পন্দন, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও অধ্যাপক গোলাম আযম একই সূত্রে গাঁথা দুটি নাম। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি তিনি। ১৯৫৫ সালে জামায়াতের রুকন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের পর ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব-পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। টানা ১২ বছরকাল নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তাঁর ওপর পূর্ব-পাকিস্তান জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও দৃঢ়তার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর বৈধ নাগরিকত্ব। এসময় তিনি আমীর থাকলেও ভারপ্রাপ্ত আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মরহুম আব্বাস আলী খান। নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার পর ২০০০ সাল পর্যন্ত আমীরের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকেন অধ্যাপক আযম, নিরলস ছুটে বেড়ান দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ২০০০ সালে সম্পূর্ণ কর্মক্ষম থাকা সত্বেও আমীরের দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী বর্ষীয়ান ও মজলুম জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম রাহিমাহুল্লাহ শুধুমাত্র ইসলামের পক্ষে ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক ভূমিকার কারণে বারবার গ্রেফতার ও কারানির্যাতিত হয়েছেন। গণতন্ত্র ও ইসলামের জন্য তাঁর সে কারানির্যাতনের ইতিহাস এবং ঘটনাপ্রবাহ দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তথা গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নিয়োজিত প্রতিটি জানবাজ কর্মী ও ব্যক্তিকে প্রেরণা যোগাবে। উজ্জীবিত হবে এদেশের কোটি তৌহিদী জনতা।

কেয়ারটেকার সরকারের রুপকার

অধ্যাপক গোলাম আযম ছিলেন কেয়ারটেকার সরকারের রুপকার। তার পক্ষ থেকে এই রুপরেখা ১৯৮০ সালে ৭ ডিসেম্বর রমনা গ্রিনে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আমীর মরহুম আব্বাস আলী খান জাতির সামনে সর্বপ্রথম ফর্মুলাসহ উপন্থাপন করেন। ১৯৯১ সালে ৫ম জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার গঠন করলে জুন মাসে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল ও সংসদীয় দলের নেতা শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী কেয়ারটেকার সরকারের রুপরেখা তুলে ধরে সংসদে পেশ করেন বিলটি।

অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৯৬ সালে বেগম জিয়ার সরকার জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে বহুল প্রতীক্ষিত কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানভুক্ত করে। কিন্তু জাতির বড় দুর্ভাগ্য! শেখ হাসিনার সরকার ২০১১ সালে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও স্থায়ী করার জন্য সংবিধান থেকে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এই কেয়ারটেকার সরকার পুনর্বহাল করার দাবীতে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধীদলগুলো আন্দোলন করে যাচ্ছে বর্তমানে। 

কারাবরণ 

অধ্যাপক গোলাম আযম বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথম সারির একজন প্রখ্যাত ও বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই শুধু নন, এদেশের ইসলামপ্রিয় গণমানুষের একান্ত প্রিয় মজলুম জননেতা ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রিয় রাহবার। এদেশের তৌহিদী জনতার হৃদয়ের স্পন্দন অধ্যাপক গোলাম আযম ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন; সকল জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বারবার গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ হয়েছেন। ১৯৪৮ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পক্ষে প্রচারণা ও জনমত তৈরির ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন তিনি। 

১৯৪৮ সালের শেষের দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে আসেন। ফজলুল হক মুসলিম হলের তদানীন্তন প্রভোক্ট ড. মাহমুদ হোসেনের পরামর্শে স্থির হয়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম গ্রাউন্ডে জনাব লিয়াকত আলী খানের যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে, তাতে বিশ্ববিদ্যালের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে ডাকসুর নির্বাচিত জিএস গোলাম আযম একটি মানপত্র পাঠ করবেন। সেই মানপত্রে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জোরালো দাবি সন্নিবেশিত থাকবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সিদ্ধান্ত অনুসারে ডাকসুর নির্বাচিত জিএস গোলাম আযম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে যে মানপত্র পাঠ করেন, তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালে উপস্থিত ছাত্র-জনতা তুমুল করতালির মাধ্যমে এ দাবির প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে দেশব্যাপী ছাত্র-গণআন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনাকালে তিনি গ্রেফতার হন এবং একমাস কারাবাস করেন। মূলত গোড়া থেকেই ভাষা আন্দোলনের স্থপতিদের একজন সহযোদ্ধা হিসেবে সক্রিয়ভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন অধ্যাপক গোলাম আযম।

১৯৫৫ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টায় কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত বাসভবন থেকে তথাকথিত জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। এর ফলে কলেজের ‘অধ্যাপক’ পদ  থেকে অব্যাহতি প্রদান করে কর্তৃপক্ষ। নেমে আসে তাঁর ওপর ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা। এরপরেও জেলখানায় তিনি ছিলেন দৃঢ়চিত্ত। কোনো উদ্বিগ্নতা তাঁর হৃদয়ে রেখাপাত করতে পারেনি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন- মুমিনের জীবনে হতাশা বলতে কিছু নেই। কেননা রিজিকের মালিক আল্লাহ। দ্বীনের পথে তাঁর সন্তুষ্টিই যার একমাত্র কাম্য, তাঁর আবার হতাশা কিসের! 

দেশ এবং ইসলামের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেন তিনি। আত্মগঠনের মাধ্যমে নিজেকে দ্বীনের মজবুত খাদেম হিসেবে প্রস্তুত করতে শুরু করেন অধ্যাপক গোলাম আযম। ঠিক এ সময় মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও রাজশাহী বিভাগীয় সংগঠক মুহতারাম ড. আসাদ গিলানী (তিনি জামায়াতে ইসলামীর ওপর থিসিস লিখে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেছিলেন) রংপুর কারাগারে তাঁর সাথে দেখা করে রুকনিয়াতের শপথ বাক্য পাঠ করান। 

রুকন হওয়ার পর নতুন জজবা নিয়ে দ্বীনি চেতনায় ভালোভাবেই জেলের বাকি দিনগুলো কাটান তিনি। অনুভব করেন- কলেজের অধ্যাপনা চলে গেলেও মহান আল্লাহ তাঁকে রুকনিয়াতের মতো মহামূল্যবান সম্পদ দান করেছেন। সুযোগ দিয়েছেন মহান আল্লাহর রহমতের বান্দাদের মাঝে সামিল হওয়ার জন্য বাইয়াত গ্রহণ করার। এটাই ছিল তখন তাঁর পরম সান্ত¡না! মৌলিক মানবাধিকারবিরোধী বৃটিশের কালো জননিরাপত্তা আইনে ১ মাস ২৬ দিন আটক থাকার পর ১৯৫৫ সালের ২ এপ্রিল আদালতের নির্দেশে মুক্তি পান তিনি। (চলবে)

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির