post

ইহুদীচক্রের কবলে মুসলিমবিশ্ব ফিলিস্তিনে মুসলমানদের রক্ত ইসরাইলের ধ্বংস নিশ্চিত করবে

১১ আগস্ট ২০১৪

মতিউর রহমান আকন্দ

Israilরহমত, বরকত, মাগফিরাতের মাস পবিত্র রমজানে বিশ্ব মুসলিম যখন সিয়াম সাধনারত, ঠিক সেই মুহূর্তে ইসরাইলি বিমান হামলায় মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে পবিত্র ফিলিস্তিন। রোজা শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আনন্দকে সামনে রেখে শিশু, কিশোর, তরুণদের মাঝে যখন উচ্ছ্বসিত পরিবেশ ঠিক তখনই সে আনন্দকে ম্লান করে দিয়ে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা তাদের সন্তানদের ক্ষতবিক্ষত লাশ নিয়ে দৌড়াচ্ছে হাসপাতালের দিকে। মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ফিলিস্তিনের আকাশকে ভারী করে তুলেছে। একই পরিবারের ১৮ জন সদস্য অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ হয়েছে। এ হামলা ২০১২ সালের ইসরাইলি হামলার চেয়েও বীভৎস। ইসরাইলের বর্বর হামলার শিকার হয়ে কোন মতে জীবন বাঁচাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মুসলমানদের। পুরো গাজা উপত্যকা এখন জ্বলছে। ঝরছে প্রাণ। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে নিরীহ নারী-পুরুষ আর নিষ্পাপ শিশুরা। তাদের ওপর ক্যান্সার বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। ঘরের কোণে মায়ের কোলে থাকা শিশুর প্রাণ যাচ্ছে আকাশ থেকে ফেলা বোমায়। বাবার হাত ধরে পথে নামা শিশুও মরছে একই ভাবে। অনেক আদরের ছোট্ট সোনার ছোট্ট শরীরটি সাদা কাপড়ে মুড়ে মা তুলে দিচ্ছেন বাবার হাতে দাফন করতে। চোখের পানি আর রক্তের বন্যায় একাকার হয়ে গেছে মুসলিম জনপদ গাজা। সেখানে শুধু কান্না আর কান্না। কখনো বা কাঁদার মতো কেউ থাকছে না। পরিবারের ছোট বড় সবাই মিলে চাপা পড়ছেন বিমান হামলায় ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসাবশেষের নিচে। ৭ জুলাই থেকে ইসরাইলের নৃশংস হামলায় নারী, শিশুসহ নিহতের সংখ্যা সহ¯্রাধিক। প্রতিদিনই হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে সারা বিশ্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাসী হামলা বন্ধের আহ্বান জানানো সত্ত্বেও ইসরাইল আন্তর্জাতিক সব আহ্বান উপেক্ষা করে হামলা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এক বিবৃতিতে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। পরিষদের ১৫ সদস্যের সবাই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। গাজায় ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে এই প্রথম নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হলো। গাজায় যে হামলা হয়েছে তা নৃশংস, অমানবিক ও মানবতাবিরোধী। সেখানে মানবিক বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি, বিশ্বসম্প্রদায়ের আহ্বান, কোন কিছুই আমলে নিচ্ছে না ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, ‘গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ প্রতিহত করা হবে। কোনো আন্তর্জাতিক চাপই আমাদেরকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে না।’ নেতানিয়াহুর এই দম্ভোক্তি শুধু ফিলিস্তিন নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য এক নির্মম উপহাস। দুর্ভাগ্য সৌদি আরবসহ আরববিশ্ব নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছে। যে মুসলিম জাতির বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় জালেমের অত্যাচার স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, নারী-শিশুর ওপর নির্যাতন, জুলুমের অবসান ঘটেছিল, যে মুসলিম সৈনিকের ঘোড়ার ক্ষুরের পদধ্বনি জালেমের দর্প ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল সেই মুসলিম জাতি আজ নির্বিকার। ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ আর গদি রক্ষার চিন্তায় তারা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিকে সন্তুষ্ট করার কাজেই নিয়োজিত। যার কারণে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই দম্ভোক্তি করার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছেন। নেতানিয়াহু ভালো করেই জানেন, যাদের পরিকল্পনা ও প্রশ্রয়ে ইসরাইল বেড়ে উঠেছে তাদের প্রশ্রয় এখনো অব্যাহত আছে। নেতানিয়াহুর যুদ্ধংদেহি মনোভাব অন্য যেকোনো সময়ের মতোই উগ্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ইসরাইলি বাহিনী ১১ জুলাই শুক্রবার রাতে গাজার ওপর মোট ৬০টি বিমান হামলা চালায়। ৭ তারিখ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত ১ হাজারেরও বেশি আক্রমণ চালানো হয়। এ হামলায় শিশুসহ বেসামরিক লোক অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হচ্ছে। ইসরাইলের হামলায় ফিলিস্তিনে মুসলমানদের রক্ত ঝরছে প্রায় ৬৬ বছর ধরে। মধ্যপ্রাচ্যের এই সঙ্কটের সমস্যা ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের জন্মমুহূর্ত থেকে। বিশ্ববাসী অবহিত আছে ১৯১৭ সালে খ্রিষ্টান ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জে এ বেলফোর এবং তদানীন্তনকালে ইহুদি সংঘের সভাপতি লর্ড অখচাইল্ড বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করে। ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং আমেরিকা ও রাশিয়ার সার্বিক সহায়তায় তখন থেকেই দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ইহুদিরা ফিলিস্তিনে গিয়ে ভিড় জমায় এবং ক্রমে সেখান থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করা হয়। ধীরে ধীরে ইহুদি-খ্রিষ্টান যৌথ প্রয়াসে ইহুদিরা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি অর্জন করতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে তেল আবিবকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় ইহুদিরা। এর পর হতেই ফিলিস্তিনিরা তাদের মাতৃভূমি ফিরে পাবার জন্য সংগ্রাম করে, রক্ত দেয়, নিপীড়িত হয়। কিন্তু আমেরিকা, রাশিয়া ও ব্রিটেনের সরাসরি হস্তক্ষেপ, আরব দেশগুলোর চরম দুর্বলতা ও ব্যর্থতার ফলে শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা কোন অধিকারই ফিরে পায়নি। ১৯৮৭ সাল থেকে পশ্চিমতীর ও গাজায় ‘ইন্তিফাদা’ আন্দোলন শুরু হলে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে উদ্বেগ শুরু হয়ে যায়। হামাস এবং হিজবুল্লাহ্র প্রচণ্ড প্রতিরোধে ইহুদি ইসরাইল এবং আমেরিকা দিশেহারা হয়ে পড়ে। আমেরিকা ও মিসরের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় নরওয়ের রাজধানী অসলোতে দীর্ঘ ৯ মাসে ১৪টি গোপন বৈঠকের মাধ্যমে পিএলও-ইসরাইল চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয় আমেরিকার নিউ ইয়র্কে। ১৯৮৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সম্পাদিত পিএলও-ইসরাইল চুক্তি মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে আরব বিশ্বের জন্য এক ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা সৃষ্টি করে। পিএলও-ইসরাইল চুক্তিটি হচ্ছে ইসরাইল ও আমেরিকার একটি গভীর ষড়যন্ত্রের প্রয়াস। তার সূত্র ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে একটি অপ্রতিরোধ্য চক্রান্তের জাল বিস্তার লাভ করেছে। আরবদের অনৈক্য এবং পারস্পরিক বিভেদ ও কলহ, ইসলামের অস্তিত্ব বিলুপ এবং ইহুদি-খ্রিষ্টান আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে ক্রমেই জোরদার করে তুলছে। আজ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের চক্রান্তে মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র ক্ষতবিক্ষত। রক্তক্ষয়, হত্যা, ধর্ষণ ও সীমাহীন নিপীড়নের মুখে মুসলমানদের জীবন ও অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ইহুদি চক্র আজ মুসলমানদের নানাভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। অথচ বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত মুসলিমবিশ্ব তার কিছুই করতে পারছে না। ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে ফিলিস্তিন। ভৌগোলিক দিক থেকে এটি একটি কৌশলগত অঞ্চল। স¤্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্টের শাসন আমলে ফিলিস্তিনকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায় ফ্রান্স। ফ্রান্সের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি টের পেয়ে ব্রিটেনও গ্রহণ করে এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার আওতায় সা¤্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় ঘনিষ্ঠতা। এরই ফরশ্রুতিতে দখল হয়ে যায় কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক ফিলিস্তিন। উসমানীয় সা¤্রাজ্যের পতনের পর বিশ্ব ইহুদিবাদ সংস্থা নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে। ইহুদিবাদের প্রতি ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের সমর্থনের ফলে ফিলিস্তিনে প্রথম ইহুদিবাদের সরকার গঠনের ক্ষেত্র তৈরি হয়। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনকে ভাগ করার ইশতেহার প্রকাশ করে। একাংশ দেয়া হয় ইহুদিবাদীদের। সেখানে তারা ইহুদি সরকার প্রতিষ্ঠা করে। অন্য অংশ দেয়া হয় ফিলিস্তিনিদের। কিন্তু বিশ্ব মোড়লদের ইহুদিপ্রীতির কারণে আজও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। দুই. ফিলিস্তিনে মুসলিম অধিবাসীদের বিতাড়ন ও ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা বহু দিনের ষড়যন্ত্র ও অব্যাহত প্রচেষ্টার ফসল। ১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সালাউদ্দিন খ্রিষ্টানদের কবল থেকে আল-আকসা মসজিদসহ সমগ্র জেরুসালেম উদ্ধার করেন। ক্রুসেডাররা ১২০২ সাল পর্যন্ত তা পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি তাতারদের অগ্রাভিযানে তারা উল্লসিত হয়ে ওঠে। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলমানদের আধিপত্য ধ্বংস হয়ে যাবে এটাই ছিল খ্রিষ্টানদের আশা। কিন্তু চেঙ্গিস ও তার বংশধরদের অভিযানের মুখে মুসলমানরা নির্মূল না হলে খ্রিষ্টানরা ইউরোপে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। গ্রিক স¤্রাট আলেক্সিয়ামের বিদুষী কন্যা এ্যানি বনের পত্রে সাগর পাড়ের বালুকারাশির সঙ্গে ক্রুসেডে সমবেত খ্রিষ্টান সৈন্যদের তুলনা করে বিস্ময়ভাবে লিখেছিলেন, “সমগ্র ইউরোপ যেন সমূলে উৎখাত হয়ে এশিয়ার ওপর আপতিত হলো।” ইসলামের অভ্যুদয় ও দ্রুত প্রসার খ্রিষ্টান জগতে ঈর্ষা ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। ইসলামের অনুসারী আরবরা মহাপরাক্রমশালী রোমানদের হটিয়ে দিয়ে একে একে তাদের সকল রাজ্য দখল করেছিল। নবম শতাব্দীতে উত্তর আফ্রিকার (মুর) মুসলমানরা স্পেন, পর্তুগাল ও ফ্রান্সের দক্ষিণাংশ দখল করে। এরপর ১৬’শ শতাব্দীতে তুর্কি মুসলমানরা রোমানদের শক্তিশালী ঘাঁটি কনস্টান্টিনোপল জয় করে এবং ক্রমে তারা মধ্য এশিয়া, তুর্কিস্তান বা তুরান থেকে গ্রিস, সাইপ্রাস, মাল্টা, আলবেনিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, যুগোশ্লাভিয়া ও হাঙ্গেরি পর্যন্ত স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করে। আর আফ্রিকার মিসর, সিরিয়া ও সুদান, পশ্চিম এশিয়ার হেজাজ, ইরাক, জর্ডান, ফিলিস্তিন, লিবিয়া ও লেবাননসহ গোটা আরব জাহান এবং এ দিকে ইরান, আফগানিস্তান ও ভারত তাদের অধিকারে আসে। এটাই খ্রিষ্টান জগতের ভীতির কারণ। বিশেষ করে তৃতীয় ক্রুসেড থেকে পরবর্তী কোন যুদ্ধেই তারা জয়লাভে সক্ষম হয়নি। সে সকল পরাজয়ের গ্লানি দূর করতে তাদের মনে প্রতিহিংসা বরাবরই কাজ করছিল। তাই তারা আরব ও তুর্কি মুসলমানদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য বিভিন্ন সময়ে কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। তাদের সে কাজে সহযোগিতা দেয় ফ্রান্স ও রাশিয়া। ১৯১৪ সালে সংঘটিত প্রথম মহাযুদ্ধ তাদের সে সুযোগকে ব্যাপকতর করে। সা¤্রাজ্যবাদী, মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে আরবরা তুর্কিদের বিরুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যদের সাহায্য করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের সে ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। পরাজিত ও বিতাড়িত তুর্কির জায়গায় যখন ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া জেঁকে বসে আরবের বুকে; তখন আরব, লোহিত ও ভূমধ্যসাগরের পানি বহুদূর গড়িয়ে গেছে। সমগ্র ইউরোপের অর্ধকোটি খ্রিষ্টান মিলে বহুকালব্যাপী যুদ্ধে যে জেরুসালেম অধিকার করতে পারেনি, ইংরেজরা পরবর্তী সময় তাই করতে সক্ষম হলো। প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ে জেরুসালেম ইংরেজদের অধিকারে আসে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ জেনারেল এলেনবাই সদম্ভে ঘোষণা করেন, “এতদিনে ক্রুসেডের পরিসমাপ্তি ঘটলো।” জেরুসালেমে ব্রিটিশ আধিপত্য অক্ষুণœ রাখার দুরভিসন্ধি জন্ম দিয়েছে ফিলিস্তিনির বুকে অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের। ফিলিস্তিনে ব্রিটেনের সা¤্রাজ্যবাদী শাসনকে জাতিসংঘের অনুমোদিত ম্যান্ডেটরি শাসন নামে বৈধ করে নেয়া হয়। ব্রিটেন জানতো, ম্যান্ডেটরি শাসন বেশি দিন চলতে পারে না। ইতোমধ্যেই মূল আরব রাষ্ট্রকে বিভক্ত করে জর্ডান ও ইরাক আরো দুটো রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটানো হয়। খোদ তুর্কির মাতৃভূমি বর্তমান তুরস্ক দখল করার জন্য ইংরেজরা লেলিয়ে দেয় তুর্কিদের চিরশত্রু গ্রিক ও সাইপ্রিয়টদের। মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুর্কিরা গ্রিক ও ইংরেজদের তাড়িয়ে দিয়ে দেশের আজাদি অক্ষুণœ রাখে। এভাবে চতুর ইংরেজ মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি ও অনৈক্যের বিজ বপন করার সাথে সাথে এবং তাদের ম্যান্ডেটরি শাসনের ছত্রছায়ায় ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে বিপুল সংখ্যক ইহুদি আমদানি করে ফিলিস্তিনে পুনর্বাসিত করে। ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার সময় ফিলিস্তিনে ইহুদি সংখ্যানুপাত ছিল শতকরা ৮ জন। এর মধ্যে বহিরাগত ইহুদির সংখ্যা ছিল শতকরা ৫ জন। বাকি ৯২ শতাংশই ছিল মুসলমান। ফিলিস্তিনের এই শতকরা ৯২ জন স্থানীয় অধিবাসীদেরকে অস্ত্রের বলে তাদের মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় সা¤্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার মুসলিমবিদ্বেষী রাষ্ট্র ইসরাইল। ফিলিস্তিনে ইহুদিরা কিন্তু ইসরাইল রাষ্ট্র চায়নি। তারা যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের সাথে শান্তিতে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া জানতো, সিরিয়া, এডেন, মিসর, সুয়েজ ও ফিলিস্তিনিদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলো থেকে একদিন তাদের চলে আসতে হবে। তাই তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে সা¤্রাজ্যবাদীদের স্বার্থের ঘাঁটি হিসেবে এমন একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দরকার যার ভূমি আরব কিন্তু অধিবাসীরা হবে ইউরোপ ও আমেরিকার নাগরিক। বলাবাহুল্য ইসরাইলের শতকরা ৯৭ ভাগ অধিবাসী বিদেশী ও বহিরাগত। আর স্থানীয় অধিবাসীরা অর্থাৎ মুসলমানরা আজ বিতাড়িত। সা¤্রাজ্যবাদী ইহুদিদের প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক জিওনবাদ মুসলমানদের বিতাড়নের কাজটি অত্যন্ত সার্থকভাবে সম্পন্ন করে। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইংরেজরা তাদের ম্যান্ডেটরি শাসনের অবসান ঘোষণা করে ফিলিস্তিন ত্যাগ করে যাবার সময় তাদের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ইহুদিদের হাতে দিয়ে যায়। ১৫ মে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বিশ্ববাসীকে জানায়। আর একই সঙ্গে অস্ত্রের বলে ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নারী নিপীড়ন অব্যাহতভাবে চালাতে থাকে। নিরস্ত্র, লাখ লাখ ফিলিস্তিনি সর্বস্ব হারিয়ে পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে প্রতিবেশী ইরাক, লেবানন ও জর্ডানসহ বহু আরব রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করে। সা¤্রাজ্যবাদী আমেরিকা জাপানের ওপর তার পারমাণবিক আঘাতের পরিণতির ভয় দেখায় আরব রাষ্ট্রগুলোকে। তারা যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধ বিরতির সুযোগে ব্যাপকভাবে জাহাজ বোঝাই হয়ে মার্কিন অস্ত্র আসতে থাকে ইসরাইলে। ১৯৫৬ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় ইসরাইল মিসরের ওপর হামলা চালায়। ১৯৬৭ সালে উসকানি দেয় আমেরিকা ও ব্রিটেন। ইসরাইল বিমান হামলা চালিয়ে মিসরের সিনাই ও গাজা এলাকা এবং জর্ডানের কাছ থেকে জেরুসালেম ও জর্ডান নদীর পশ্চিমতীর দখল করে নেয়। ১৯৭৩ সালে সিরিয়া গোলান মালভূমি দখল করে। ১৯৪৮ সাল থেকে পরবর্তী বছর সমূহে প্রথম ব্রিটেন ও ফ্রান্স, পরে ব্রিটেন ও আমেরিকা এবং সর্বশেষে আমেরিকার প্রত্যক্ষ সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিদ্যার জোরে আরব ভূমি থেকে মুসলমানদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করে। বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মুসলমান, শাহাদত যাদের কাম্য ছিল, ভিখারির সাজে যাদের খলিফারা প্রায় অর্ধেক বিশ্ব শাসন করে গেছেন তারা আজ কাপুরুষের মতো বিশ্বের দিকে দিকে মার খাচ্ছে। ভোগ বিলাসিতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা এলিয়ে দিয়ে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কথা বলে আত্মতুষ্টি লাভের চেষ্টায় মুসলমানরা নিরন্তর ব্যাপৃত। ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য বিপর্যয় বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। কেবল ফিলিস্তিন বা আরব নয় মুসলিম জাতি সামগ্রিকভাবেই আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার। মুসলিম জাতির ওপর বারবার ইহুদি, খ্রিষ্টানরা নৃশংস ও নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। সংঘবদ্ধভাবে মুসলমানরা তা প্রতিরোধের অর্থবহ কার্যকর ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেনি। আল-আকসা মসজিদের ওপর যখন বর্ণবাদী ইহুদিরা হামলা চালায় তার বিরুদ্ধে মৌখিক প্রতিবাদ ও নিন্দা প্রকাশ ছাড়া মুসলমানরা আর কিছুই করতে পারেনি। অনৈক্য, অবিশ্বাস আর পারস্পরিক হানাহানিতে আজ মুসলিমবিশ্ব শতধাবিভক্ত। এ সুযোগই নিচ্ছে খ্রিষ্টজগৎ ও ইহুদি শক্তি। একদা ক্রুসেডের মাধ্যমে খ্রিষ্টান জগতে ইসলাম সম্পর্কে যে বিষবাষ্প সঞ্চিত হয়েছিল তার তাপজ্বালা মুসলমানদের আজও সইতে হচ্ছে। তিন. ইহুদিরা ইসলাম, নবী এবং রাসূলদের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে আসছে। ইসলামকে সমূলে উৎপাটনের চক্রান্ত তাদের দীর্ঘদিনের। স্বয়ং নবী করিম (সা)কেও তারা নানভাবে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। রাসূল-ই-আকরাম (সা) মদিনা আগমনের পর পরই মদিনার স্থানীয়-অস্থানীয় সকল গোত্রের সঙ্গে পারস্পরিক সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়ে একটি কমন উম্মাহ্ গঠন করেছিলেন এবং সন্ধিতে আবদ্ধ সকল পক্ষকেই মুসলমানদের পক্ষ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা ও নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। মদিনার ইহুদিরাও ছিল এই সন্ধিচুক্তির অন্যতম শরিক। সন্ধিচুক্তি অনুসারে ইসলাম ও মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে কোন অন্তর্ঘাত ও নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হওয়া কিংবা ইসলাম বৈরী কোনো শক্তির সঙ্গে কোনরূপ যোগাযোগ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল এবং তা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন তারা শান্ত ও নিরপেক্ষ জীবন যাপন করলেও অল্পদিনের ভেতর তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয় এবং তাদের চিরাচরিত অন্তর্ঘাত ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক রূপ ফুটে ওঠে। একদিকে যেমন মদিনার মুনাফিকদের সঙ্গে হাত মিলায়, তেমনি অপরদিকে মক্কার কাফির কুরাইশদের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করে। এর পেছনে ইহুদিদের জাতিগত ঈর্ষা-বিদ্বেষ, সঙ্কীর্ণচিত্ততা, স্থবিরতা, জাতিবিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী তাদের বাতিল ও ভ্রান্ত ‘আকিদা-বিশ্বাস, জঘন্য চরিত্র ও নিকৃষ্টতম স্বভাব। কুরআনুল করীমের বিভিন্ন স্থানে যা পুনঃপুন উল্লেখ করা হয়েছে। নবীদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হওয়া, তাঁদের দাওয়াতি কাজে বাধাদান এমনকি তাঁদেরকে শহীদ করার মতো দুঃসাহসিক ধৃষ্টতা প্রদর্শন, হিংসা ও বিদ্রোহাত্মক আচরণ, আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ, সীমাহীন অর্থ লোলুপ মনোবৃত্তি, শোষণের হাতিয়ার নিষিদ্ধ সুদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ ও প্রীতি, অবৈধ সম্পত্তি অর্জন, জাগতিক স্বার্থে আসমানি গ্রন্থের বিকৃতি সাধন এবং জীবনের প্রতি অসীম মায়া ও মমত্ববোধ তাদের বংশগত ও জাতীয় বৈশিষ্ট্য। রাসূল-ই-আকরাম (সা) তাঁর দাওয়াত ও তাবলিগের বিভিন্ন পর্যায়ে ইহুদিদের এই জাতীয় চরিত্রের স্বরূপ উদঘাটন করলে তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সন্ধি শর্ত লংঘনপূর্বক প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য শত্রুতা সাধনে আত্মনিয়োগ করে। এমনকি তারা পৌত্তলিক কুরাইশদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরো একধাপ এগিয়ে দেয়। মদিনার ছোট বড় অনেক ইহুদি গোত্রের ভেতর বনি নাজির, বনি কায়নুকা, বনি মুস্তালিক ও বনি কুরায়জা ছিল প্রধান। একবার রাসূল (সা) কোন এক কার্যোপলক্ষে বনি নাজির পল্লীতে গেলে সেখানে বিশ্রামরত অবস্থায় তারা ওপর থেকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে নবীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। রাসূল (সা) তাদের কুমতলবের কথা অবগত হয়ে তাদেরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। এরপর খন্দক যুদ্ধের অন্যতম উসকানিদাতা ইহুদি কা‘ব বিন আশরাফকে তার অপকর্মের কঠোর শাস্তি দেন। খন্দক যুদ্ধে কুরাইশ কাফিরদের সহযোগী ও উসকানিদাতা বিশ্বাসঘাতক বনু কুরায়জাকে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দৃশ্যে অতঃপর মদিনার রাষ্ট্রীয় সীমান্তের মধ্যে ইহুদিদের এবং মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ বিন উবায় সলুলের মৃত্যুতে অপরাপর মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রে আপাতত কিছুটা ভাটা পরিলক্ষিত হয়। বনি মুস্তালিক এ সময় তাদের বিশ্বাস ভঙ্গের শাস্তি লাভ করে। বহিষ্কৃত অপরাপর ইহুদিরা খায়বারে গিয়ে তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখলে মহানবী (সা) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। এখানে তারা সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ভক্তের ছদ্মবেশে মহানবীকে (সা) দাওয়াত দিয়ে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করতে চেষ্টা করে। রাসূল (সা) একমাত্র বিষ প্রয়োগকারীকে শাস্তি দিয়ে অন্যদের ক্ষমা করে দেন। মহানবী (সা) তাদেরকে সাময়িকভাবে আরব ভূখণ্ডে বসবাস করার অনুমতি দিলেও অনতিবিলম্বেই সকল অমুসলিম জাতিগোষ্ঠীর হাত থেকে জাজিরাতুল আরবকে মুক্ত করার জন্য তার অন্তরঙ্গ সাহাবাদের নির্দেশ দিয়ে যান। ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের ধ্বংস সাধনে ইহুদি জাতি বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের যে জাল বিস্তার করেছিল তা আজও অব্যাহত রয়েছে। এই ইহুদিরাই রাসূল (সা)-এর রওযা-ই-আকদাস থেকে পবিত্র মরদেহ চুরির ঘৃণ্য প্রয়াস চালিয়েছে। ইসলাম ও নবীদের অবমাননা ইহুদিদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। আজও ইহুদিরা তাদের নবীবিদ্বেষী চরিত্র থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নাকুলা বাসিলে জনৈক ইহুদি নির্মাণ করে ‘ইনোসেন্স অব মুসলিমস’ শীর্ষক পবিত্র ইসলাম ও মহানবী (সা) অবমাননাকর চলচ্চিত্র। তাকে সহায়তা করেছে কুখ্যাত মার্কিন পাদরি টেরি জোন্স। ইহুদি ব্যবসায়ীদের অর্থানুকূল্যে ৫০ লাখ ডলার ব্যয়ে নির্মিত ছবিটি বেশ রহস্যজনক। এ চলচ্চিত্রে বিশ্বনবী মহানবী (সা) এর চরিত্রকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করা হয়েছে। এ ছায়াছবির মাধ্যমে তারা এ বার্তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে যে, মহানবী (সা)-এর কাছে কোন ওহি নাজিল হয়নি বা তার কাছে ওহি নাজিল হওয়ার দাবি মিথ্যা। এ ছাড়াও এ ছায়াছবিতে ইসলাম ধর্মকে বিশ্বসমাজের জন্য ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক ও মুসলমানদেরকে সেকেলে, উগ্র ও সহিংসতাকামী বলে তুলে ধরা হয়েছে। এই চলচ্চিত্র মুসলিমবিশ্বে বেশ খানিকটা স্থিতিশীল হয়ে আসা উত্তেজনাকর পরিস্থিতে উসকে দেয়ার জন্য করা হয়েছে। যারা এর পেছনে কাজ করেছেন তারা একটি পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই এটি করেছেন। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাস ও অসহিষ্ণুতাকে ইসলাম ও মুসলিমদের ভাবমর্যাদার সাথে একাকার করে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালানো হয়। এর পরবর্তী এক যুগে আফগানিস্তান দখল, ইরাকে অভিযানসহ আরো বিভিন্ন ঘটনা ঘটে, যার প্রভাব বিশ্ব পরিস্থিতিতে ব্যাপকভাবে পড়ে। ডেনমার্কের কার্টুন, যাজক জোন্সের পবিত্র কুরআন পোড়ানো হুমকি এবং সবশেষে সিনেমাটি তৈরির পেছনে মূল লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যকে। উসকানিমূলক ও ঘৃণা-বিদ্বেষপূর্ণ সিনেমা তৈরি করে সহিংসতা সৃষ্টি করে আগ্রাসনের পরিবেশ তৈরিই এর মূল টার্গেট। নাইন-ইলেভেনের পরে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জাতিকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচারণা নতুন করে শুরুর প্রেক্ষিত তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক কট্টরপন্থী ইহুদিদের দ্বারা। যুগ যুগ ধরে ইহুদি ও খ্রিষ্টান শক্তি ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর চতুর্মুখী যে হামলা চালিয়েছে, এ ছায়াছবি নির্মাণ তারই একটি অংশ মাত্র। ইহুদিবাদীরা এরপর হজরত ঈসা (আ) ও তার মায়ের অবমাননা করার দৃষ্টতা দেখায়। বায়তুল মোকাদ্দাস শহরে খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের একটি কেন্দ্রের প্রবেশপথে হজরত ঈসা (আ) ও তাঁর মা হজরত মরিয়ম (আ) বা পবিত্র মেরি সম্পর্কে হিব্রু ভাষায় অশালীন বক্তব্য লিখে তাঁদের অবমাননা করেছে ইহুদিবাদীরা। ইতালীয় ওয়েবসাইট ‘কাস্টেডিয়া টেররা সান্টা’ এই খবর দিয়েছে। ভ্যাটিকানের সঙ্গে সম্পর্কিত এই ওয়েবসাইট জানিয়েছে, মুসলমানদের প্রথম কিবলা অধ্যুষিত জেরুসালেম বা বায়তুল মোকাদ্দাস শহরের জিহুন বা জাযয়ান পাহাড়ে। ক্যাথলিকদের ধর্মকেন্দ্র ‘সানফ্রানসিসকো মনাস্টারি’র অন্যতম প্রবেশপথের দেয়ালে এই অপকর্ম করেছে ইহুদিবাদী দখলদাররা। ঈসা মসিহ বা হজরত ঈসা (আ)-এর জন্ম বৈধ ছিল কি না সেই প্রশ্ন করা হয়েছে ওই অশালীন দেয়াল-লিখনে। ইতালির আনসা বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, ফিলিস্তিনে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী একদল জঙ্গি ইহুদিবাদী খ্রিষ্ট ধর্ম ও খ্রিষ্টানদের পবিত্রতার প্রতি অবমাননাকর এসব অশ্লীল আচরণের জন্য দায়ী। এ ঘটনায় প্রমাণিত হলো যে, ইহুদিবাদীরা কেবল ইসলাম ও বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে না, ইহুদিবাদ প্রকৃত ইহুদি ধর্মসহ সকল ঐশী বা খোদায়ী ধর্মেরই বিরোধী। ইসলাম ধর্ম মহান আল্লাহর সব নবী-রাসূলকে শ্রদ্ধা করে এবং তাঁদেরকে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ ও একত্ববাদের প্রচারক হিসেবে মেনে নেয়াকে ঈমানের অপরিহার্য অংশ বলে মনে করে। এই ইহুদিরাই অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিন থেকে মুসলিম অধিবাসীদের যুগ যুগের পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে। আর তাদের সহযোগিতা দিয়েছে খ্রিষ্টানরা। এই খ্রিষ্টান বিশ্বই এককালে ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতকে সমূলে উৎখাতের নামে মুসলিম মধ্যপ্রাচ্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যারা স্পেনের আট শ’ বছরের মুসলিম হুকুমাতকে উৎখাত করে মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ-যুবা নির্বিচারে তলোয়ারের মুখে নিক্ষেপ করেছিল- অবশিষ্টদেরকে খ্রিষ্টান হতে বাধ্য করেছিল। তারাই ‘লরেন্স অব আরাবিয়া’র মাধ্যমে তুরস্কের ইসলামী খিলাফতের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে আরব জাতীয়তাবাদের ঢেউ তুলে বিদ্রোহের প্ররোচনা দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তারাই তুরস্ককে শত্রু পক্ষে যোগ দিতে বাধ্য করে। অবশেষে সেই অপরাধে বিশাল বিরাট তুর্কি খিলাফতকে টুকরো টুকরো করে দেয়। আজকের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, খ্রিষ্টান, ইহুদি এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, ব্রহ্মণ্যবাদী শক্তি একই উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে। পাশ্চাত্য খ্রিষ্টানদের কর্তৃক পরিচালিত ক্রুসেডকালীন সময়ে ক্রুসেডার বাহিনীকে প্যালেস্টাইন প্রবেশ করার পথপ্রদর্শক ছিল প্যালেস্টাইনি ইহুদিরা। একই সময়ে মুসলিমবিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অঞ্চল মিসরে সাবাপন্থীদের চক্রান্তের ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় সুন্নি মুসলিমবিরোধী উগ্রপন্থী ফাতেমীয় শিয়াদের শাসন। ক্রুসেডের বাহিনী যখন একের পর এক মুসলিম শহর জয় করে, লুণ্ঠন, ধ্বংস ও গণহত্যা চালিয়ে জেরুসালেমের উপকণ্ঠে হাজির হয় তখন তাদের প্রতিরোধে মুসলিম শক্তির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত মিসরের হস্তক্ষেপ একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের এ মহাদুর্যোগের সময় সাবাপন্থী শিয়াদের কারণে মিসরের কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। জেরুসালেমের পতনের দৃশ্য মিসরের শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত নিরুত্তাপ চিত্তে উপভোগ করে। ইবনে সাবা মুসলিম উম্মাহর বুকে সূক্ষ্মভাবে যে ধ্বংস ও বিভেদের বীজ রোপণ করেছিল তা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়ে আজ প্রকাণ্ড মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এর পরও ইহুদি চক্রান্ত থেমে নেই। মুসলিম উম্মাহ যাতে কখনো এ বিভেদ হানাহানি থেকে বের হতে না পারে সে জন্য নিত্যনতুন ইহুদি চক্রান্ত উদ্ভাবিত হচ্ছে। মুসলিম উম্মাহ যাতে আর কখনো ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে সে জন্য গঠিত হয়েছে ইহুদি সংগঠন। মুসলিম যুবশক্তিকে বিভ্রান্ত করার জন্য মুসলিম দেশসমূহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছদ্মবেশী ইহুদি ক্লাব, এনজিও, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি। এনজিওর মাধ্যমে মেয়েদেরকে ইসলামবিদ্বেষী করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার নামে তারা রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সমাজ সবকিছু ডিকটেট করেছে। প্রেস আর প্রচারণার হাতিয়ারকে তারা ব্যবহার করছে অত্যন্ত সুকৌশলে। কোনো দেশে কোনো লক্ষ্যে বিপ্লব ঘটানোর পূর্বশর্ত হলো মানুষের মস্তিষ্কে বিপ্লব ঘটানো। আর এ বিপ্লব ঘটানোর প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে সাহিত্য। এ উদ্দেশ্যে আধুনিক যুগে বিশ্ব মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য ইহুদি কবি, লেখকরা চরিত্র ধ্বংসকারী সাহিত্য রচনায় অধিক মনোযাগী হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে চিন্তার জগতে আঘাত হানার মাধ্যমে চিন্তার বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি তৈরির উদ্দেশ্যে তারা গড়ে তুলেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাদের গবেষণাকর্ম প্রচারের জন্য গড়ে তুলেছে শক্তিশালী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়া। বিশ্বের অত্যাধুনিক ইলেক্ট্রনিকস প্রচার মিডিয়া স্থাপন করে অবিরত মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যক্তিত্ব যারা সমাজকে পরিচালিত করে তারা তাদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব স্থাপন করা ইহুদিদের মূলকথা। আর এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় সাধনই ইহুদিদের মূল তৎপরতা। মুসলিমবিশ্বে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে প্রতিভাবান ও ইসলামদরদি মুসলিম নেতাদের হত্যা, উদীয়মান মুসলিম শক্তিকে ধ্বংস করা ও ইসলামী আন্দোলনকে দমন করার জন্য এরা পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের মদদে মধ্যপ্রাচ্যে কায়েম করেছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল ও এর গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হাজারো সমস্যা সৃষ্টি ও তা জিইয়ে রেখে আরব মুসলমানদের উত্থানকে ঠেকিয়ে রাখতে চাইছে। আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে এ রাষ্ট্রটি বারবার আবরদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে বিস্তীর্ণ আরব ভূমি দখল করেছে। মিসর, উগান্ডা, তিউনিসিয়া, জর্ডান, লেবাননে হাজারো সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। ১৯৮১ সালে ইরাকের পারমাণবিক প্রকল্পে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেয়, প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্থানের আশঙ্কায়। মুসলিম জাতির প্রাণপ্রিয় নেতা শাহ ফয়সালকে হত্যার পেছনে রয়েছে ইহুদি চক্রান্ত। মোসাদের হাতেই খুন হন ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের সাবেক প্রধান ইয়াসির আরাফাতের সহযোগী আবু জিহাদ ওরফে খলিল আল ওয়াজির। ১৯৮৮ সালে তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে ইসরাইল কমান্ডো অভিযান চালিয়ে আবু জিহাদকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পর ইসরাইলি দৈনিক ইয়েদিউথ আহারোনোত ১ নভেম্বর ’১২ তে প্রকাশিত এক খবরে আবুজিহাদকে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে। এ হত্যাকাণ্ডের সাথে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাক এবং উপপ্রধানমন্ত্রী মোশে ইয়ালোন জড়িত ছিল। তিউনিসে পিএলওর সদর দফতরে অভিযান চালিয়ে আবুজিহাদকে হত্যা করা হয়। চকলেটের বাক্সে লুকানো সাইলেন্সারযুক্ত বন্দুক দিয়ে আবু জিহাদের মাথায় গুলি করা হয়। আবু জিহাদকে তার স্ত্রীর সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। আবু জিহাদ পিএলওর দ্বিতীয় প্রধান ছিলেন। ইহুদি সংস্থা মোসাদ সারা বিশ্বে মুসলমানদের হত্যা করার জন্য মুসলিম বিরোধী শক্তিগুলোকে ট্রেনিং দিচ্ছে। কাশ্মিরে মুজাহিদ দমনে মোসাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে এবং ভারতীয় বাহিনীকে ট্রেনিং দিচ্ছে। বার্মায় রোহিঙ্গা বিতাড়নে বর্মী বাহিনীকে ট্রেনিং দিচ্ছে মোসাদ। সারা বিশ্বের যেখানেই ইসলামী আন্দোলন সেখানেই ইহুদিদের চরেরা উপস্থিত হচ্ছে। ইসরাইলি গোয়েন্দা মোসাদ মিসর থেকে ‘ঐতিহাসিক দলিল’ চুরি করে পাচারের সময় মিসরের পুলিশের হাতে তা ধরা পড়ে। ঘটনাটি ঘটে ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে। গোটা মুসলিমবিশ্বে আজ ইহুদিবাদের জাল ছড়িয়ে পড়েছে। বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, আরববাদ প্রভৃতি বিভ্রান্তির মাধ্যমে তারা মুসলিমবিশ্বকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যকে বিনষ্ট করে এবং তা অব্যাহত রাখার জন্য হাজারো চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিহাস এ কথারই সাক্ষ্য দেয় যে নিজেদের হীন স্বার্থ ও বর্ণবাদী চেতনার কারণেই ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে সৃষ্টি হয় এক অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। যে শক্তি তাদের সৃষ্টি করেছে সেই শক্তিরই প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এখনো তারা টিকে আছে। ফলে ভূমিপুত্র নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর জুলুম, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড চালিয়ে গেলেও ইসরাইল সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে না কেউ। ইসরাইলি আগ্রাসন ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যখন বিশ্ববাসী কিছুটা সরব হয় তখন কাগজে বক্তব্য প্রদান করে থাকে জাতিসংঘসহ পাশ্চাত্য শক্তি। গত ৬৬ বছর ধরেই প্রহসনমূলক এমন কর্মকাণ্ড দেখে আসছে বিশ্ববাসী। মজলুম, ফিলিস্তিনিরা আত্মরক্ষার্থে কিছু করলেই বিশ্ব মোড়লদের চোখে তা হয়ে ওঠে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আর ইসরাইলের নৃশংস রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যেন তারা দেখেও দেখতে পাচ্ছে না।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির