post

একাত্তর নিয়ে কিছু কথা

এবনে গোলাম সামাদ

১৪ ডিসেম্বর ২০২০

১৯৭১-এ পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত জিতেছিল। হেরেছিল সাবেক পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। আমরা সাধারণভাবে এইটাই জানি। কিন্তু নেপথ্যে ঘটেছিল অনেক ঘটনা। যার অনেক কিছুই আসেনি সাধারণ আলোচনায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়েছিল সপ্তম নৌবহর (Time, 17 July 1972. P- 6)। কেন সে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল তা নিয়ে হয়নি যথেষ্ট আলোচনা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠায় বলে বদলে যেতে পেরেছিল যুদ্ধের চরিত্র। ঠিক হয়েছিল, বন্দি পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ভারতে। তারপর তাদের দেয়া হবে মুক্তি। অন্যদিকে পাকিস্তানে যে ২৪ হাজার বাংলাভাষী সৈন্য আছে তাদের দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে বাংলাদেশে। পাকিস্তানে থাকা এইসব সৈন্যরা ছিলেন বিশেষভাবেই ভারতবিরোধী। প্রধানত এদের সমর্থনেই পরে ঘটতে পেরেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫-ই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থান। যাতে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সমর্থন। মার্কিন সমর্থন ছাড়া ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটতে পারত না। মার্কিন চাপে দ্রুত শেষ হয়েছিল ১৯৭১-এর যুদ্ধ। যুদ্ধ সমাপ্তির পর জগজিৎ সিং অরোরা বলেছিলেন, মেঘনা ও মধুমতি নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থান করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আরও কয়েক মাস যুদ্ধ করতে পারত।

তাই সাবেক পাকিস্তানের সমরশক্তি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, এরকম ভাববার কোন কারণ নাই। অন্যদিকে বিশ^ব্যাংকের হিসাব অনুসারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া শরণার্থীর সংখ্যার দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৯০ লক্ষ। এর মধ্যে মুসলিম শরণার্থী ছিল, কারও কারও মতে, ২০ লক্ষের কাছাকাছি। এই শরণার্থীরা ভারতীয় অর্থনীতির ওপর সৃষ্টি করেছিল বিরাট চাপ। ভারত তাই চেয়েছিল দ্রুত যুদ্ধাবসান। এসব কিছু মিলিয়েই ভাবা উচিত ১৯৭১-এর যুদ্ধ সম্পর্কে। ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের ছিল বিশেষ মৈত্রী চুক্তি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন চাচ্ছিল না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়াতে। সোভিয়েত ইউনিয়নও চাচ্ছিল যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি। তাই ১৪ দিনের মধ্যেই শেষ হয়েছিল ১৯৭১-এর পাক-ভারত যুদ্ধ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে হয় সিমলা চুক্তি। এই চুক্তি অনুসারে সব যুদ্ধ-বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এই সম্মেলনে ডাকা হয়নি বাংলাদেশকে। সিমলা চুক্তি হবার পর যে যুক্ত ইস্তেহার প্রকাশিত হয়, তাতে ১৯৭১-এর যুদ্ধকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বলা হয়নি; বলা হয়েছে পাক-ভারত যুদ্ধ। এই যুক্ত ইস্তেহারে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, যুদ্ধের মাধ্যমে নয় পাক-ভারত সব সমস্যার সমাধানের জন্য করতে হবে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা। প্রশ্ন থাকে, সিমলা সম্মেলনে বাংলাদেশকে কেন ডাকা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশের কোন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে দর্শক হিসাবেও ছিলেন না উপস্থিত।

১৯৭১ সালে ভারতে গড়া হয়েছিল একাধিক বাহিনী। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ছাত্রদের নিয়ে গড়া হয়েছিল মুজিব বাহিনী। যার আরেক নাম ছিল, বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স। সংক্ষেপে বি.এল.এফ। অন্যদিকে আবার গড়া হয়েছিল বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী গড়া হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে যেসব সৈনিক ভারতে গিয়েছিলেন তাদের এবং ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) এবং পুলিশ বাহিনী থেকে যেসব লোক ভারতে গিয়েছিলেন তাদেরকে নিয়ে। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধে মুজিব বাহিনী এবং মুক্তি বাহিনীকে অংশ নিতে দেয়া হয়নি। ভারত যুদ্ধ করেছে কেবল তার পেশাদার সৈনিকদের দ্বারা পাকিস্তানের পেশাদার সৈনিকদের সঙ্গে। সে যুদ্ধকে সীমিত রাখতে চেয়েছে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসাবে। পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ডের সেনাপতি এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন ভারতের পূর্ব কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। এখানে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয় নি মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি উসমানীকে। অথচ তাঁকে উপস্থিত থাকতে দেওয়া একান্তভাবেই উচিত ছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সেনানায়ক হিসাবে। ঘটনাটি এখনও থেকে গিয়েছে অব্যাখ্যাত। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জাপান হারে। জাপানকে পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের কাছে। কিন্তু পাক বাহিনীকে করতে হয়নি। একমাত্র ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাক-বাহিনী করেছিল আত্মসমর্পণ। এই সবই ঘটেছিল মার্কিন পরিকল্পনা অনুসারে।

কলকাতায় যেয়ে আমি কোন একজন সাংবাদিকের কাছে শুনেছিলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারতের তদানীন্তন আসাম প্রদেশকে নিয়ে ‘বাসাম’ নামে একটি কনফেডারেশন করতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা চেয়েছিল বলেই সমর্থন জানিয়েছিল মেজর জিয়াউর রহমানকে। তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করে বাসাম গড়া হবে। জিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এই আশ^াস পেয়েই করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। কিন্তু যে কারণেই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাসাম গড়তে শেষ পর্যন্ত অগ্রসর হয়নি। জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসকে বিদ্রোহী হতে উৎসাহ দিয়েছিল। প্রধানত ইপিআর-এর বিদ্রোহ রেখেছিল চট্টগ্রামে জিয়া সরকারকে বেশ ক’দিন টিকিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তারা যুদ্ধে হেরে যায়। অধিকাংশ ইপিআর সদস্যদের নিয়ে কলকাতায় গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। এই মুক্তি বাহিনীতে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির থেকে পালিয়ে এসে যোগ দেন কর্নেল রশিদ ও ফারুক। রশিদ ও ফারুক এক সময় ছিলেন পাকিস্তানের কাকুলে অবস্থিত সেনাবাহিনীর স্কুলে ছাত্র। এই সময় জিয়াউর রহমান ছিলেন এই স্কুলে একজন শিক্ষক। রশিদ ও ফারুককে জিয়া তাই চিনতেন।

১৯৭১ সালের এক পর্যায়ে চেষ্টা চলে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা শান্তিপূর্ণ সমাধান করবার। ড. কামাল হোসেন ও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারি ড. হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যে এই নিয়ে আলোচনা হয় পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে নাথিয়াগলি নামক স্থানে। ড. কামাল হোসেন একটি বার্তা পাঠান খন্দকার মুস্তাক আহমদের কাছে, কলকাতায় নিযুক্ত মার্কিন কনসালের মাধ্যমে। যাতে খন্দকার মুস্তাক আহমদকে বলা হয়, আওয়ামী লীগের কলকাতায় এসে অবস্থানরত এমএনএদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় যেতে এবং ঢাকায় পাক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে। কিন্তু ভারত এটা হতে দেয় না। কিসিঞ্জারের সঙ্গে কামাল হোসেনের বৈঠকের খবর প্রকাশিত হয় কলকাতার The States Man পত্রিকার ১৯৭১ সালের ১১-ই জুলাই সংখ্যায়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা ‘যুগান্তর’ নামক পত্রিকায় ১১-ই জুলাই খবর প্রকাশিত হয়, জুলফিকার আলী ভুট্টু তেহরানে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এই জন্য হওয়া দরকার আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা। কিন্তু এই আলোচনা হতে পারে না ভারতের জন্য। যেসব এমএনএ ও আওয়ামী লীগ নেতা কলকাতা থেকে ঢাকায় আসতে চান, তাদের নজরবন্দী করে রাখে ভারত সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও চান না এ রকম শান্তিপূর্ণ উপায়ে কোন সমাধানে আসতে। তিনি বলেন, এর ফলে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে না। অনেক কিছুই ঘটেছিল ১৯৭১ সালে। যা এখনও আলোচিত হয় না। সাবেক পাকিস্তান ছিল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভারত পেরেছিল একে খণ্ডিত করতে। সে হয়তো ভেবেছিল বাংলাদেশ হয়ে উঠবে তার একটা উপগ্রহ রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ তা হয়নি।

লেখক : বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির