post

ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে নিপীড়নমূলক শাসন

৩১ অক্টোবর ২০১২

আসিফ মাহমুদ

মহাজোট সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনে দেশ এখন বিপর্যয়ের শেষ কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। সুশাসন নির্বাসনে গেছে। দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ ও নিপীড়ন হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের পর মহাজোট সরকার প্রথমেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান বদলে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। আদালতকে ব্যবহার করে সংবিধান সংশোধনের এসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। সরকারের মেয়াদ যত ফুরিয়ে যাচ্ছে সেই পরিকল্পনা আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। প্রথমে ’৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও চেতনার পরিপন্থী সংশোধনীগুলো আনা হয়েছিলো। বাংলাদেশকে ভারতের প্রভাব বলয়ে থাকা একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসাবে দাঁড় করানোর জন্য সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি থেকে বাদ দেয়া হয়। রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করার ধারাটিও সংবিধান থেকে বাদ দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় কাঠামো বদলে ফেলার পর সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাতিল করে দলীয় নিজেদের অধীনে নির্বাচনের বিধান সংযোজন করা হয়। যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বাইরে রেখে মহাজোটের শরিকদের নিয়ে একটি নির্বাচনের আয়োজন করা। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত করা। সরকারের এই একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যারাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল যেমন আছে তেমনি নাগরিক সমাজ বা সমাজে প্রভাব আছে এমন বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও সরকারের রোষানল থেকে বাদ পড়ছে না। সরকার প্রথমে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার কৌশল গ্রহণ করে। এ জন্য যুদ্ধাপরাধের মামলার নামে সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রধান সংগঠিত শক্তি জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের কারাগারে ঢোকানো হয়। দেশে ও বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ একটি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের শাস্তি দেয়ার আয়োজন চলছে। বিচারের রায় কী হবে কবে হবে তাও মন্ত্রীরা আগাম বলে দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় বিচার প্রক্রিয়াটি সরকারের পরিকল্পনা মাফিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের সাথে সাথে জামায়াত ও শিবিরের শত শত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্য মামলা দিয়ে সাংগঠনিক কাজ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালানো হয়। অসংখ্য নেতাকর্মীদের জেলে পাঠানো ও পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল মোকাবেলার সরকারের প্রধান কৌশল হচ্ছে মামলা ও গ্রেফতার। বিরোধী দলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। জরুরি সরকারের সময় দুই নেত্রীর ওপর যেসব মামলা দেয়া হয়েছিলো প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসে নিজের মামলা তুলে নিয়েছেন কিন্তু বিরোধী দলীয় নেত্রীর মামলা চলছে। অথচ বিরোধীদলীয় নেত্রীর চেয়েও তার বিরুদ্ধে আরো বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ছিলো। এখন বিরোধীদলীয় নেত্রীর অসুস্থ দুই পুত্রকে কার্যত নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। তারা যাতে দেশে এসে সক্রিয় হতে না পারে সে জন্য একাধিক মামলা চলছে। প্রতিহিংসার রাজনীতির এক ভয়ঙ্কর নজির স্থাপন করা হয়েছে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে তার বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার মাধ্যমে। বিরোধী দলের প্রথম সারির ১৮ জন নেতাকে এক সাথে কারাগারে পাঠানোর ঘটনাও এ দেশে আগে কেউ দেখায়নি। এমনকি এরশাদ আমলেও এক সাথে এত নেতাকর্মীকে কারাগারে যেতে হয়নি। গাড়ি পোড়ানোর মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ বিরোধী দলীয় জোটের প্রথম সারির সব নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিলো। এরপরও প্রধানমন্ত্রী বলছেন আওয়ামী লীগ যদি প্রতিহিংসাপরায়ণ হতো তাহলে বিএনপির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেতো না। প্রধানমন্ত্রী সত্যি কথা বলেছেন প্রতিহিংসাপরায়ণ বিরোধী দলের যে অবস্থা তাতে হয়তো রাস্তাঘাটে শুধু তাদের লাশ পাওয়া যেতো। অবশ্য রাজনৈতিক নেতাদের গুম ও গুপ্ত হত্যার ঘটনাও এ সরকারের আমলে চালু হয়েছে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর কোনো সন্ধান নেই। ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী ছাত্রনেতার আজো কোনো হদিস পাওয়া গেলো না। বিরোধী দলের সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল করতে এভাবে আরো অনেক নেতাকে গুম করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে সরকার বিরোধী যে কোনো আন্দেলনমুক্ত করার জন্য নানা কৌশল নেয়া হয়েছে। হত্যা, গুপ্ত হত্যা ও গ্রেফতার ছাড়াও কার্যত সারা দেশে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রকাশ্য রাজপথে রাজনৈতিক কর্মীদের বুকের ওপর পুলিশ চেপে বসেছে। রাজনৈতিক নেতাদের বাসায় গিয়ে তাদের স্ত্রী পুত্র পরিজনের হামলা পুলিশ ও র‌্যাব হামলা চালাচ্ছে। রাজধানীর শাহজাহান পুরে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের বাসায় র‌্যাব নারী ও বাসার কর্মচারীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতের অফিস কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ইসলামপন্থী দলগুলোর যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিকে এখন জঙ্গি কর্মকাণ্ড হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারছে না। ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিপীড়নের মাধ্যমে সরকার এই বার্তা দিতে যাচ্ছে যে ইসলামপন্থীদের মোকাবেলার জন্য ক্ষমতাসীনদের বিকল্প কিছু নেই। তাদের এ ধরনের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য শুধু নয় ক্ষমতাসীনদের জন্য কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে রামুর ঘটনা তার প্রমাণ। বাংলাদেশে জঙ্গি ও রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করেছে এমন নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দিয়ে বৌদ্ধবসতিতে হামলা চালানো হয়েছিলো। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো বৌদ্ধ বিহার। যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই হামলায় অংশ নিয়েছে এ কারণে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিলো দর্শক। ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই ঘটনার সাথে বিএনপি ও জামায়াতকে দায়ী করলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও তদন্তে বেরিয়ে আসে ক্ষমতাসীন দলের ইন্ধনে এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। ফলে সরকারের জঙ্গি প্রচারণা যেমন ব্যর্থ হয় তেমনি আন্তর্জাতিক মহল থেকেও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এভাবে ন্যক্কারজনক পন্থায় সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমনের চেষ্টার পাশাপাশি পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে এখন সভা সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। শিক্ষকদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। এর আগে শিক্ষকদের আন্দোলনে অসুস্থ হয়ে একজন শিক্ষক নিহত হয়েছেন। সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ক্ষুদ্র বামপন্থী দলগুলোর মিছিল সমাবেশে একই কায়দায় পুলিশ নির্যাতন চালাচ্ছে। ভিন্নমত বা ক্ষমতাসীন দলের বাইরে আর কোনো রাজনৈতিক তৎপরতাকে বন্ধের চেষ্টা করছে সরকার। বিরোধী রাজনৈতিক দল দমনের নামে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। সশস্ত্র সন্ত্রাসী এই সংগঠনটিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই সংগঠনের ক্যাডাররা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে পুলিশের সাথে বিরোধী ছাত্রসংগঠনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের পাহাড়ায় এরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বেতন ভাতা বাড়ানোর প্রতিবাদে বাম ছাত্র সংগঠনের মিছিলে নারী কর্মীদের ওপর হামলা ও লাঞ্ছনা চালিয়েছে। দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের কারণে একাধিকবার বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদালয়কে অর্থ আয়ের ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। টেন্ডারবাজি নিয়োগ বাণিজ্যের নামে প্রশাসনের সাথে আঁতাত গড়ে তুলেছে। আর এই অবৈধ আয়কে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে। রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একাধিক ছাত্র নিহত হয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এসব ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দমন পীড়নের মাধ্যমে বিরোধী দলকে দুর্বল করে ফ্যাসিবাদী শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থতা, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের ফলে দেশের মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অপর দিকে সরকার সরাসরি জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কোনোভাবেই বিজয়ী হওয়া সম্ভব হবে না। শুধু তাই নয়, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি থেকে স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা যেভাবে দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন তাতে জনরোষের শিকার হতে পারেন। এ কারণে সরকার যেনতেন উপায়ে একটি নির্বাচন দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে চাইছে। এরপর নিপীড়ন আরো তীব্র করে স্বৈরশাসকদের মতো যত দিন সম্ভব ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী সব জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া স্বৈরশাসকদের শেষ পরিণতি হয় চরম অবমাননাকর। সম্প্রতি আরব বিশ্বের তিন স্বৈরশাসক বেন আলী, হোসনী মোবারক আর গাদ্দাফির পরিণতি আমরা দেখেছি। বাংলাদেশেও জনমতকে উপেক্ষা করে ’৭২ সালের একদলীয় শাসনের সমাপ্তি ঘটেছে দুঃখজনক রক্তাক্ত পরিণতির মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবেন এমনটা আশা করা যায় না। কোনো একনায়ক ও স্বৈরশাসক ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে সরকারের একদলীয় শাসন কায়েমের যে প্রচেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোকে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে নিপীড়নমূলক শাসন যত দীর্ঘস্থায়ী হবে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি ও সার্বভৌমত্ব ততটাই হুমকির মুখে পড়বে। সাধারণ মানুষের জীবন যাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে থাকবে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির