post

ঘুম আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত

উম্মে নাজিয়া

০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮
ঘুুম হলো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক বিশেষ নেয়ামত যা কোরআন এবং আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত। এটি মানুষের খুব গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক প্রয়োজন। ঘুমের মাধ্যমে শরীরের অনেক প্রক্রিয়া রিকন্সট্র্রাকশন হয়। এর মাধ্যমে শক্তি অর্জন হয়, ব্রেন হরমোন যেমন এপিনিফেরিন, সেরিটোনিন এবং গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হয়, ফলে পরদিন মানুষ কাজ করার শক্তি পায়। ঘুম নার্ভাস সিস্টেমকে উন্নত করে, শরীরের ক্ষয়পূরণ করে এবং শরীরকে শক্তিশালী করে। ঘুমের ফলে আমাদের স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়। ঘুম উদ্বিগ্নতা কমায় যে কারণে অসুস্থ এবং প্রচণ্ড ব্যথা বা কষ্ট হলে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়, যাতে করে তার কষ্ট কমে যায়। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে ঘুমের তারতম্যের কারণে অবসন্নতা, মুটিয়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হজমের গোলমাল, মেজাজের ভারসাম্যহীনতা, নার্ভাস হওয়া, হার্টের সমস্যা প্রভৃতি দেখা যায়। পবিত্র কোরআন শরীফের বিভিন্ন সূরাতে ঘুম সম্পর্কে আয়াত রয়েছে : সূরা আল ফুুরকান-৪৭, সূরা নাবা-৯, সূরা আরাফ-৯৭, সূরা কালাম-১৯, আস- সাফ্ফাত-১০২, সূরা আনফাল-৪ ইত্যাদি। পবিত্র হাদীস শরীফে আছে দুই রাকাত ফজরের নামাজ আল্লাহপাকের কাছে পুরো পৃথিবীর চেয়ে বেশি পছন্দের। ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত আছে নবী করিম (সা.) পবিত্র সকালের জন্য প্রাচুর্য দান করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। আমাদের পূর্বপুরুষরা সকালে ঘুম থেকে উঠতেন এবং সকাল সকাল এশার নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। সকালে মানুষের মন মননশীলতা উন্নত থাকে ফলে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করা যায়। ভালো স্বাস্থ্য আল্লাহপাকের রহমত এবং সেই স্বাস্থ্য রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। প্রতিদিন অন্ধকার হওয়ার পর একটি ছোট গ্রন্থি থেকে মেলাটোনিন নামক একপ্রকার পদার্থ উৎপন্ন হয় যা ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে, অন্ধকার ছাড়া এটি কাজ করতে পারে না। কোন মানুষ রাতে বেশি সময় আলোতে থাকলে তার ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। হে বস্ত্রাবৃত, রাতের উঠে দাঁড়াও কিছু অংশ বাদ দিয়ে। অর্ধ রাত বা একটু কম বা বেশি আর কোরআন আবৃত্তি কর থেমে থেমে। (সূরা মুজাম্মিল : ১-৪) রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ প্রতিষ্ঠা কর, এটা তোমার জন্য নফল কাজ সম্ভবত তোমার পালনকর্তা তোমাকে প্রশংসিত স্থানে পৌঁছিয়ে দেবেন। (সূরা বনি ইসরাইল : ৭৯) উপরের আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় একটানা ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর তথ্যও সঠিক নয়। আমরা যদি রাত ৯টার মধ্যে ঘুমাই তাহলে ভোর ৪টায় উঠলে ৭ ঘণ্টা ঘুম হবে। এর পর তাহাজ্জুতসহ ফজরের নামাজ পড়ে আবার কিছুক্ষণ ঘুমানো সম্ভব। তাহাজ্জুত না পড়লে ১০টায় ঘুমালে ৫টায় উঠলে পুরো ৭ ঘণ্টা ঘুম হবে। এরপর ফজর পড়ে, কোরআন হাদীস পড়ে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইশরাকের নামাজ পড়ে আমরা লেখাপড়া সংসারের কাজসহ সব কিছু দ্রুত শেষ করে ফেলতে পারি। হাদীসে আছে, এ উম্মতের জন্য সকালের কাজে সবচেয়ে বেশি বরকত রয়েছে। এবং এ কাজের মাধ্যমে তারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই কল্যাণ লাভ করবে। ইদানীং আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের দেখি তারা রাতে খাবার খায় রাত ১০-১১টায়, ঘুমায় ১২টার পর। অনেক সময় আমার মতো কেউ তাদের বাসায় গেলে অসুবিধায় পড়ে যায়। ওনারা অবাক হয়ে বলেন তুমি ৯-১০টায় ঘুমাও আমরা তো ঐ সময় রাতের খাবারই খাই না। আজকাল কেউ এত তাড়াতাড়ি ঘুমায়? আমি বলতে বাধ্য হই আমি আজকের মানুষও আবার একজন মুসলিমও। আমি মনে করি একজন মুসলিম চাঁদে থাকলেও সে তার গাইড লাইন কোরআন হাদীস অনুসরণ করবে অন্য কিছু নয়। এখানে তার বেশি আধুনিক হওয়ার সুযোগ নেই, যদি সে তা করে তাহলে নিজের সর্বনাশ নিজেই করবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাকই সকল কিছুর স্রষ্ঠা এবং নিয়ন্ত্রণকারী, সৃষ্টি কখনও স্রষ্ঠার চেয়ে বুদ্ধিমান হতে পারে না। আর আমাদের সামনে আছেন আমাদের প্রিয় নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.); তার জীবন আমাদের জন্য দিকনির্দেশনা। তিনি যেভাবে চলেছেন, ঘুমিয়েছেন, তার চেয়ে আর কে বেশি স্মার্ট হতে পারে এ পৃথিবীতে? বর্তমানে আমাদের সমাজে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে তো কথাই নাই। মানুষ এখন আগের মতো মানুষের সঙ্গে মিশে না, এমনকি ঈদের দিনেও অল্প সময়ের জন্য বের হওয়া ছাড়া বাকি সময়ে নাগরিক জীবনে অভ্যস্তরা ঘরে বসে টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখে সময় কাটায়। রাত জেগে টিভি, ফেসবুক, ই-মেইল বিভিন্ন গেমস, পর্নোগ্রাফিসহ হাজারো নেশার উপকরণ। ফলে সে সামাজিক গণ্ডি থেকে অনেক দূরে একাকী জীবন যাপন করছে। রাত জেগে এসব ব্যবহারের ফলে তার মধ্যে অবসাদ এবং হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। আল্লাহর সঙ্গে যদি বান্দার সম্পর্ক না থাকে তাহলে আত্মা মৃত হয়ে যায় ফলে সে জীবনের ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার মধ্যে অসামাজিক কার্যকলাপ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, সে যেকোনো কাজ করতে পারে এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও তার বাড়তে থাকে। ইসলামী জীবন বিধান, সৃষ্টিকর্তার অপার রহমত, যে মানুষ ইসলামের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী চলবে সে দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হবে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে রাতে উঠে ইবাদত করা আজ মানুষের কাছে কাল্পনিক মনে হয়। আমেরিকার ঘুম বিশেষজ্ঞ উৎ. ঈযধৎষবং ঈুবরংষবৎ বলেছেন, ঘুম হচ্ছে সবচেয়ে ভালো এবং উপকারী ঔষধ। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো উচিত এবং দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণ ঘুমানো উচিত। তার মতে সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পরেই মানুষের ঘুমের হরমোনগুলো কাজ শুরু করে। রাতের প্রথম অংশে না ঘুমালে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বিষন্নতাসহ নানা রোগ ব্যাধি সৃষ্টি হয়। রাতের প্রথম অংশে ঘুমালে এসব অসুখ দানা বাঁধতে পারে না। মনোবিজ্ঞানী ঔবধহ গ. ঞবিহমব তার গবেষণালব্ধ প্রবন্ধে বর্তমান সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। একটানা ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে এ কথা একদম ঠিক নয়। ঘুম নির্ভর করে এর গভীরতার ওপর। সঠিকভাবে ৫-৬ ঘণ্টা ঘুমালেই যথেষ্ট। ইউএসএ, ভার্জিনিয়ার টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রজার ইকরিক তার ১৬ বছরের গবেষণালব্ধ অঃ ফধু’ং পষড়ংব, ঘরমযঃ রহ ঞরসবং ঢ়ধংঃ বইতে লিখেছেন : অতীত কালে মানুষেরা প্রকৃতির সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ত এবং প্রকৃতির সঙ্গে জেগে উঠত। মাঝখানে উঠে কিছু সময় ইবাদত করে কিছুক্ষণ ঘুমাতো এবং সকালে কাজের জন্য বেরিয়ে পড়ত। এ ব্যাপারে লেখক ৫০০ ঐতিহাসিক রেফারেন্স দেন। কিন্তু মানুষের এই সুন্দর নিয়ম ধ্বংস হয় ১৭ শতাব্দীর শেষের দিকে, যখন শিল্পবিপ্লব শুরু হয়। ১৯২০ সালের দিকে এসে শহরের মানুষ তাদের সুস্থ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘুমের কথা একেবারে ভুলেই গেল। বিবিসি এর একটি আর্টিকেলে ঘুমের বিষয়গুলো বিস্তারিত এসেছে। শিল্প বিপ্লবের পর মানবজাতির ঘুমের রুটিন ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হয়েছে। ফলে ইউরোপসহ বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এখন অ-প্রাকৃতিক এবং অস্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। রাতের প্রথম অংশ ঘুমাতে না পারলে ঘুমের চাহিদা বেড়ে যায়। রাতের প্রথম অংশের ৪-৫ ঘণ্টা ঘুম আর শেষের দিকের ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমের সমান। ঘুমের মধ্যে মানুষ শরীরের পার্শ্ব পরিবর্তন করে থাকে, সূরা কাহাফে আল্লাহপাক গুহাবাসীদের পার্শ্ব পরিবর্তন করে দেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান বলে একই পাশে থাকলে শরীরের রক্ত চলাচলে সমস্যা হয়। ঘুমে শরীর থেকে আত্মা পৃথক হয়ে যায় কিন্তু পুরোপুরি নয়, চেতনা বিলুপ্ত হয় কিন্তু প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলি সচল থাকে যেমন হার্টবিট, শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্ত চলাচল ইত্যাদি। পবিত্র কোরআন শরীফে ঘুম বিষয়ে যে সমস্ত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানে ঐ সমস্ত শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা একই। পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি নিদ্রা যান না তন্দ্রা তাকে স্পর্শ করে না। এর অর্থ এই দাঁড়ায় মানুষ যখন গভীর ঘুমে নিদ্রা যায় তখন সে পার্থিব সবকিছু ভুলে যায় কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তার সৃষ্টির কোন বিষয় কখনও ভুলে যান না বা উনার সঙ্গে কোন সময়ই তার সৃষ্টির সম্পর্ক ছিন্ন হয় না। ঘুমানোর আগে কাপড় পরিবর্তন করা ঘুমানোর সময় ঢিলেঢালা পোশাক পরা উত্তম। যাতে শরীরের রক্ত চলাচল ঠিক থাকে। নবীজি (সা) সব সময় ঢিলেঢালা পোশাক পরতেন যাকে তহবন্দ বলে। এখন অনেক ডাক্তার ঘুমানোর সময় হালকা ঢিলা পোশাক পরতে বলেন, স্লিপিং গাউন পরাটা এখন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুমানোর আগে বিছানা ঝাড়া ইসলাম ১৪০০ বছর পূর্বে এ শিক্ষা দিয়েছে, বিছানাতে অনেক সময় পোকা-মাকড় কিংবা ক্ষতিকর জিনিস থাকতে পারে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ওজুর সঙ্গে ঘুমান বিজ্ঞান: ইয়োগা বিশেষজ্ঞগণ বলছেন হাত, চোখ, মুখ, পা এবং জেনিটাল ঘুমের পূর্বে ভালোভাবে ধুয়ে ঘুমালে গভীর এবং প্রশান্তির ঘুম হয়। আলহামদুলিল্লাহ, ইসলাম এ বিষয় আমাদের কত আগেই শিখিয়াছে। এশার নামাজের পূর্বে ঘুমালে সে সবসময় ঘুম ঘুম ভাবে থাকে এবং রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে হাত ধৌত করা হাদীসে বেশি পানিতে হাত রাখার পূর্বে হাত ধুয়ে নিতে বলা হয়েছে, কেননা তুমি জান না হাত সারারাত কী করেছে। বিজ্ঞানও বলে, সারারাত রোগ জীবাণু হাতে জমা হয় সুতরাং হাত না ধুয়ে কোন কিছুতে হাত বাধা ঠিক নয়। ঘুমানোর বিছানা যদি কোনো সুস্থ ব্যক্তি নরম বিছানায় ঘুমায়, তাহলে এটি তার স্পাইনাল কর্ডের জন্য ক্ষতিকর। ছোট বাচ্চাদের হাড় নরম থাকে, তারা যদি নরম বিছানা ব্যবহৃত করে তাহলে তাদের হাড়ে সমস্যা হতে পারে এবং সারা জীবন এ সমস্যায় তারা কষ্ট পাবে। নবীজীর বিছানা ছিল পশুর চামড়ার তৈরি এবং তার মধ্যে খেজুরের পাতা দিয়ে ভরা। তিনি ইশার নামাজের পর পর ঘুমিয়ে যেতেন এবং সকাল হওয়ার পূর্বেই শয্যা ত্যাগ করতেন। আর অধিকাংশ রাত্রিতে মধ্য রাত্রিতে ঘুম থেকে উঠে এবাদত করতেন। ইমাম শাফেয়ী (রহ) চার ধরনের ঘুমের কথা বলেছেন : ১. পিঠ বিছানার সঙ্গে লাগিয়ে সোজা হয়ে ঘুমান- নবীজি এভাবে ঘুমাতেন। ২. ডান দিকে কাত হয়ে ঘুমান যা আমাদের জন্য বলা হয়েছে। ৩. বাম দিকে কাত হয়ে ঘুমান-যা শাসকগণ ঘুমাতেন, কারণ তাদের রাজ্য পরিচালনা করার যোগ্যতার জন্য খুব গভীর ঘুম ঘুমাতে হতো। ৪. উপুড় হয়ে ঘুমান-যাকে শয়তানের ঘুম বলা হয়। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন যারা আসর নামাজের পর ঘুমাবে তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা নষ্ট করবে। বিজ্ঞানের সূত্র মতে আসরের নামাজের পর বিভিন্ন রশ্মি বিকিরণ হয়ে থাকে যা মানুষের হার্ট ও মনের ওপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু আমাদের অনেকেই আসরের পরে ঘুমিয়ে থাকেন যা মোটেই ঠিক নয়। ঘুম মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের জীবন ও ধর্ম পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। আমরা ইসলামী বিধি অনুযায়ী ঘুমিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ পেতে পারি। লেখক : বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির