আমাদের জাতীয় জীবনের অনন্য সাধারণ একটি দিবস- সাতই নভেম্বর, মহান বিপ্লব ও সংহতি দিবস। এ মহান বিপ্লবের চেতনা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার রক্ষাকবচ, আমাদের প্রেরণার উৎস। এ বিপ্লব হয়েছিল দেশ বাঁচাতে, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সমুন্নত করতে সর্বোপরি দেশের জনগণকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় পরিচয় সুনির্ধারিত হয়েছে। বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান নির্ধারণ করেছে নভেম্বর বিপ্লব। এই স্বতন্ত্রতা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় পরিমণ্ডলেই লক্ষণীয়। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই তার স্বাধীন অস্তিত্বের বিরুদ্ধে আধিপত্যবাদী অপশক্তি এবং তাদের দেশীয় তাঁবেদার গোষ্ঠী যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এদেশের দেশপ্রেমিক সিপাহি-জনতা ঐক্য গড়ে তার উচিত জবাব দিয়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে একটি অদূরদর্শী, অদক্ষ শাসনের কবলে পড়ে এ দেশ ও জনগণ চরম বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মোকাবেলা করে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ফলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে। একদলীয় বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। প্রচারমাধ্যম, বিচার বিভাগ সবকিছুর স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। শাসকচক্রের ব্যর্থতার পর ব্যর্থতায় দেশ বহির্বিশ্বে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত হয়েছিল। এমনি এক পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক মর্মন্তুদ ও শোকাবহ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন সাধিত হয়। আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়। জাতীয় জীবনের সেই যুগসন্ধিক্ষণে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যখন বিপন্ন অবস্থায় উপনীত হয় ঠিক এমনি মুহূর্তে ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ও সংহতি দিবসের মাধ্যমে এদেশের আকাশের কালো মেঘটি অনেকাংশে কেটে যায়। এ বিপ্লবে কে নেতৃত্ব দেয় বা কার পতন ঘটে সেটা বড় কথা নয়, এ ঘটনায় সমগ্র জাতি এক হতে পেরেছিল নিজেদের স্বকীয়তা আর স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে এটাই বড় অর্জন। তবে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে ‘সৈনিক ও অফিসার হত্যা দিবস’ নাম দিয়ে ৭ নভেম্বরের ছুটিকে বাতিল করেছে। আসলে জাতিকে বিভক্ত রেখে ফায়দা লুটতেই নভেম্বর বিপ্লবকে অস্বীকার করা হয়। সাত নভেম্বরের বড় প্রাপ্তি হলো শহীদ জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব। ১৯৭১ এর মত জাতির এ ক্রান্তিকালেও শহীদ জিয়া এগিয়ে এসেছিলেন দেশকে সংকট মুক্ত করতে। তবে উভয় ঘটনায় পার্থক্য হলো- একাত্তরে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে আর পঁচাত্তরে সিপাহি-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে তাঁকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে তাঁর ওপর ন্যস্ত করেছিল দেশ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষণজন্মা স্টেটসম্যানদেরই একজন ছিলেন এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষই পেরেছেন জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে স্টেটসম্যান হবার গৌরব অর্জন করতে। তাদের ছোঁয়ায় ঘুমন্ত, হতাশাগ্রস্ত, সমস্যাপীড়িত জাতি জেগে ওঠে, নতুন উদ্যমে শুরু হয় সবকিছু । শত সমস্যা মোকাবেলা করে জাতি তখন এগিয়ে যাবার প্রেরণা পায়। এক কথায় জাতিকে এই মহান ব্যক্তিরা স্বপ্ন দেখাতে পারেন। যে স্বপ্ন বুকে ধারণ করে সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে একটি জাতি এগিয়ে যায় সম্মুখপানে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা দিক থেকে বিপর্যস্ত, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যাপ্রাপ্ত একটি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য আশীর্বাদ হয়েই তিনি এসেছিলেন। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার স্টেটসম্যান মাহাথির মুহাম্মদের কয়েক বছর আগেই ‘‘বাংলাদেশের মাহাথির’’ শহীদ জিয়ার আবির্ভাব ঘটেছিল। স্টেটসম্যানসুলভ দূরদৃষ্টি নিয়ে তিনি এঁকে ফেলেছিলেন এদেশের উন্নয়নের রূপকল্প। সমগ্র জাতির প্রাণে সৃষ্টি করেছিলেন এক অন্যরকম স্পন্দন। জাতিগঠনের এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে নেমে পড়েছিলেন। রাষ্ট্রের এমন কোন সেক্টর ছিল না যেটাতে তিনি তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারেননি। সাত নভেম্বরের চেতনাই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। আজ আবারো আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী এ দেশ-জাতির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি এখন যুক্ত হয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এর মোকাবেলায় নতুন প্রজন্মকে সাত নভেম্বরের চেতনায় গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় বেঈমানদের মোকাবেল্য়া নতুন করে শপথ নিতে হবে। নভেম্বর বিপ্লব আমাদের যে জাতিসত্তা বিনির্মাণের যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল তাকে ধারণ করতে হবে। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আমাদেরকে বুঝতে হবে, জাতি হিসেবে তবেই আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।
লেখক : অধ্যাপক, রাবি; সদস্যসচিব, শত নাগরিক, রাজশাহী
আপনার মন্তব্য লিখুন