post

জ্ঞান কখন শক্তি? । হুসনে মোবারক

২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

জ্ঞান কখন শক্তি? । হুসনে মোবারক‘জ্ঞানই শক্তি’। কিন্তু জ্ঞান কখন শক্তি? কতটুটু জ্ঞান হলে এটাকে শক্তি বলা যায়? অথবা কোন ধরনের জ্ঞান শক্তি? একজন মানুষ কতটুকু শিক্ষিত হলে তাকে জ্ঞানী বলা যায়? এসব নানা প্রশ্ন আমার মনে আজকাল ঘুরপাক করে। বিসিএস ক্যাডার একজন জ্ঞানীর কলমের খোঁচায় যখন সাধারণ মানুষের কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যায়- তখন তার এই জ্ঞানকে কী বলবেন? জ্ঞান কি মানুষকে সবসময়ই সঠিক পথ দেখায় নাকি মন্দ পথও দেখায়? তাহলে যে ধরনের জ্ঞান মন্দটা করতে শেখায় সেটা কি জ্ঞান? দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে সব অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করছে- তাদের প্রায় সবাই জ্ঞানী, শিক্ষিত অপরাধী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত ঋণখেলাপি সবাই শিক্ষিত জ্ঞানী। শেয়ারবাজারের কোটি কোটি টাকা যারা লোপাট করেছে তারাও শিক্ষিত, জ্ঞানী। সাম্প্রতিক পৃথিবীর তাবৎ অপরাধ যাদের মাধ্যমে সংঘটিত হচ্ছে তাদের প্রায় একশো ভাগই জ্ঞানী, শিক্ষিত ভদ্রলোক বলা যায়। তাহলে জ্ঞান কি দিচ্ছে পৃথিবীকে! আমাদের আজকের আলোচনা সেই ‘জ্ঞান’ নিয়ে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো জ্ঞানকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংজ্ঞায়িত করেন ‘প্রমাণিত সত্য বিশ্বাস’ বলে, যদিও এই সংজ্ঞায় অনেক বিশ্লেষক, দার্শনিক একমত নন। তার মতে প্রমাণিত, সত্য, বিশ্বাস এই তিনের সমন্বয় জ্ঞান। শুধু সত্য হলে হবে না; ভিত্তি থাকতে হবে এবং এতে বিশ্বাসও শর্ত। তাহলে প্রায়োগিক জ্ঞানই কি শক্তি! হয়তো বলা যায়- জ্ঞান তখনই শক্তি, যখন এটাকে সুনির্দিষ্ট, সুশৃঙ্খলভাবে কল্যাণকর কোন কর্মে পরিণত করা যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞানকে কাজে পরিণত করা না যায় ততক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই। জ্ঞান থাকলে তা কাজে দেবেই- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর সুফল পাওয়া যাবেই। পৃথিবীতে বিগত একশ বছর বা এরও পূর্ব পর্যন্ত যত জ্ঞানী-গুণী, মনীষী জন্ম নিয়েছেন এবং খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের কজনেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো বা ক’জনেরই প্রাইমারি, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছে। সক্রেটিস, শেকসপিয়র, নেপোলিয়ন, প্লেটো হতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত এবং এর পরেও এমন বহু বিখ্যাত ব্যক্তি আছেন যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম ছিল। তাই বলে কি তারা অশিক্ষিত ছিলেন? তারা কি বিখ্যাত হন নি। হ্যাঁ তারাও জ্ঞানী ছিলেন- তাদের জ্ঞান মানুষের কল্যাণে, সৃষ্টির কল্যাণে নিবেদিত ছিলো। শেকস্পিয়র সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রিধারী নন, টমাস আলভা এডিসন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েননি, উইলভিল রাইট আর অরভিল রাইট ভ্রাতৃদ্বয় অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েননি কিন্তু তাদের আবিষ্কার সারা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। তার মানে এই নয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো মূল্য নেই। আমি মনে করি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একটা পদ্ধতি যা মানুষ তার নিজের জন্য তৈরি করে নিয়েছে। মানুষের চিন্তাশক্তির যে ক্ষমতা তা পৃথিবীর তাবৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঊর্ধ্বে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদের চিন্তার দিকনির্দেশনা দেয় আর চিন্তা করতে সাহায্য করে। শিক্ষকেরা শিখেছেন যে, কিভাবে শিক্ষাকে শিখাতে হয়। কিন্তু তারা শিক্ষাকে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়াটা কি, সেটা কতটুকু শেখাচ্ছেন? কোর্স কারিকুলাম শেষ করাই শিক্ষা? এই শিক্ষা-দীক্ষা আমাদের কতদূর নিয়ে যাবে, কতটুকু মানুষ বানাবে উন্নত চিন্তাশক্তির বিকাশ ছাড়া? একটা সময়ের পরিক্রমায় পদ্ধতিগত শিক্ষা চালু করে বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে বিশ্ব। জাপানে বাথরুম কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, খাওয়ার আগে পরে কিভাবে হাত ধৌত করতে হয় এগুলো শিখানো হয় প্রাইমারি স্কুলে। গত দুই বছর আগে কলকাতার একটি প্রাইমারি স্কুলেও আমি দেখেছিলাম বেসিন কিভাবে ব্যবহার করতে হয় এটা শিখাচ্ছে স্কুলে। বিগত বেশ কয়েকটি ওয়ার্ল্ডকাপে জাপানিদের খেলার সময় দেখা গেছে জাপানিরা স্টেডিয়ামের যে প্রান্তে বসেছে সেখানে খেলা শেষে পরিচ্ছন্ন কর্মীদের আর পরিষ্কার করতে হয়নি। নিজেদের ফেলা উচ্ছিষ্ট নিজেরাই কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে জাপানিরা। এই শিক্ষা জাপানিরা কোথায় পেলো। নিশ্চয়ই স্কুলে। স্কুলের আঙিনা, ক্লাসরুম, নিজের পড়ার কক্ষ, বিছানা ইত্যাদি নিত্যকার জীবনাচার স্কুল থেকেই শিখছে। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসিক হলগেুলোর অবস্থা দেখলে ধারণাই বদলে যাবে যে এখানে বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশুনা করে। হ্যাঁ মেধাবী তো অবশ্যই! মেধা না থাকলে তো তারা সেখানে সুযোগ পেতেন না। কিন্তু সেই মেধাটা কিসের মেধা? পুঁথিগত মেধা শুধুমাত্র। জীবনাচারের মেধা না, নৈতিকতার মেধা না। যার কারণে শহরের বাসাবাড়িতে ব্যাচেলর ভাড়া দিতে চায় না কেউ। কারণ, ব্যাচেলর বাসা মানে নোংরা, অপরিচ্ছন্ন। অথচ এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, ব্যাচেলর মেসে যারা থাকেন তারাই একদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, পাবলিক সার্ভিসের বড় বড় কর্তা হবেন এবং দেশ পরিচালান করবেন। এরিস্টটল ভাষায় ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা।’ তাহলে অসুস্থ পরিবেশে শিক্ষিত, জ্ঞানী একটি জনগোষ্ঠী কি করে সুস্থভাবে একটি দেশ পরিচালনা করবে! এখনকার সমাজে শিক্ষকদের ছাত্র-ছাত্রীরা সম্মান করে না, কারণ- পিতা-মাতারা তাদের সন্তানদের শিক্ষকের গুরুত্ব বোঝান না আর শিক্ষকরা নিজেরাও ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে নিজেদের তুলে ধরছেন অন্যভাবে। তারা সম্মানের চেয়ে অর্থ আয় করার মেশিন মনে করেন ছাত্রছাত্রীদের। সুতরাং ছাত্র-ছাত্রীরাও তাই শিখছে। নৈতিকতার জ্ঞান, সম্মানবোধের জ্ঞান, মমত্ববোধের জ্ঞান, মনুষ্যত্ববোধের জ্ঞান আমরা কোথায় পাবো? নিশ্চয়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার এবং গুরুজনদের কাছ থেকে। কিন্তু সেই গুরুজন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা পরিবার শিক্ষার কথা বলছে শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য, ভালো থাকার জন্য, প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য। সক্রেটিসের মতে ‘শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।’ হ্যাঁ, প্রশ্নটা এখানেই, আমাদের বর্তমান সমাজ বা রাষ্ট্রের শিক্ষিত বা জ্ঞানী মানুষদের দ্বারা কতটুকু মিথ্যা প্রতিহত হচ্ছে আর কতটুকু সত্যের বিকাশ ঘটছে নাকি তার উল্টোটা- সমাজে যতটুকু অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, বিনাশ ঘটছে তার জন্য শিক্ষিতরাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। ‘শিক্ষা হলো তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’ এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। প্রাগৈতিহাসিক কালে শিক্ষা শুরু হয়েছিলেন বয়স্ক ব্যক্তিদের দ্বারা যুবকদের সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য। এটা মূলত মৌখিকভাবে ও অনুকরণের দিকটাই প্রাধান্য ছিলো। গল্প-বলার মাধ্যমে জ্ঞান, শ্রদ্ধাবোধ, স্নেহ, ভালোবাসা, মূল্যবোধ এবং দক্ষতা এক প্রজন্ম থেকে তার পরের প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে। এখানে বিষয়টা পরিষ্কার। শিক্ষার মূলে ছিলো জ্ঞানার্জন। ন্যায়বোধের জ্ঞানার্জন, মানুষের অধিকারের জ্ঞানার্জন, সত্য-মিথ্যার জ্ঞানার্জন, অপরের কল্যাণ কামনার জ্ঞানার্জন, অপরাধবোধ থেকে বেঁচে থাকার জ্ঞানার্জন, ব্যাংক থেকে জনগণের টাকা মেরে না খাওয়ার জ্ঞানার্জন ইত্যাদি। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে- এই জ্ঞানী মানুষ (?) যে হারে বাড়ছে ভালো মানুষ কি সে হারে বাড়ছে? মানবিক নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষা কুশিক্ষার নামান্তর, যা মানুষকে পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নামিয়ে ফেলে। আর মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষা মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রাখে। শিক্ষার জন্য শিক্ষা মানুষকে মনুষ্যত্ব নিয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করে না। যে শিক্ষা মানুষের জীবনবোধের সঙ্গে নৈতিকতার সমন্বয় সাধন করে তাই নৈতিক শিক্ষা। নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের মাঝে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। নৈতিকতার স্বরূপ প্রকাশিত হয় সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শবাদী মনোভাব প্রভৃতি গুণের সমাবেশের মাধ্যমে। আমাদের মহৎ, সৎ ও সুন্দর জীবন-যাপনের জন্য নৈতিক শিক্ষা অপরিহার্য। ভাববার বিষয় হলো বর্তমান শিক্ষা কাঠামোয় কতটুকু নৈতিকতার সম্পৃক্ততা আছে (!) মানুষের বড় সম্পদ হলো মূল্যবোধ। নৈতিক শিক্ষা নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম দেয়। প্রকৃতিলব্ধ জ্ঞানের সাথে অর্জিত জ্ঞানের সুসমন্বয়ই নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের মূল ভিত্তি। মনুষ্যত্ব অর্জনের অন্যতম নিয়ামক হলো নৈতিক শিক্ষা। মানুষের জীবনের যাবতীয় কল্যাণকর, শুভবুদ্ধি ও শুভচিন্তা এবং তার বিপরীত বুদ্ধি ও চিন্তা বিচারের আপেক্ষিক মানদণ্ডই হলো নৈতিক মূল্যবোধ। নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের জীবন ব্যবস্থা ও জীবন পদ্ধতিকে সুন্দরভাবে, নির্মলভাবে পরিচালনার অনুসরণযোগ্য কিছু আচরণ। শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বিজ্ঞলোকদের আরেকটি মত হলো, ‘শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত ছাত্রের চরিত্রগঠন।’ তবে শিক্ষার লক্ষ্য সম্বন্ধে বর্তমান যুগে আরেকটি মত প্রচলিত আছে- সংসারের চাকা ঘুরানো। আমাদের পিতা-মাতা আমাদের পেছনে শিক্ষার জন্য অর্থ খরচ করেন অর্থ উপার্জনের জন্য। ‘আমি আমার সন্তানের পেছনে টাকা খরচ করছি কারণ সে বড় হয়ে টাকা উপার্জন করবে’ এটাই এখন আমাদের লক্ষ্য। ‘টাকায় টাকা আনে।’ সেটা যে পথেই হোক। যার কারণে সমাজে সম্মান প্রতিপত্তি নির্ণয় হয় কার সন্তান কত টাকা মাসিক আয় করে তার ওপর। শিক্ষা সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। সভ্যতার অণু-পরমাণুগুলো বিশ্লেষণ করতে শেখায়। শিক্ষাই মানুষকে বন্য জীবন থেকে সভ্যতার আলোয় ফিরিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা ছিলো না বলেই পোশাকের গুরুত্ব হয়তো তাদের কাছে ছিলো না যারা বনে বসবাস করতো এক সময়। সেই বন-জঙ্গল থেকে শিক্ষা, জ্ঞানই আস্তে আস্তে তাকে সভ্য করে তুলেছে এবং সেই জ্ঞানের সাথে অবশ্যই মূল্যবোধ ছিলো- ছিলো পরোপকারের ভাবনা, কল্যাণের মনোভাব। মেরুদণ্ডহীন হয়ে বাঁচার শখ বা স্বাদ কারো নেই। শিক্ষাই মানুষকে মানুষ হিসেবে তৈরি করে। বিশেষ করে সমাজে সবাই ঘাড় উঁচু করে, মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচতে চায়। আমরা অনেকেই ‘শিক্ষিত’ বলে গর্ব করি, কিন্তু শিক্ষার আসল রূপ কী হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে আমরা অবগত নই। সে জন্যই আমাদের মধ্যে এডুকেশন পদ্ধতি, আবার কেউ কেউ ইনস্টিটিউশন পদ্ধতি অবলম্বন করি। নিজের মেরুদণ্ডকে সোজা ও সুদৃঢ়রূপে গড়ে তুলতে আমরা জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় ওই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে ব্যয় করি। এরপর নানা কষ্টে অর্জিত শিক্ষাকে পদে পদে তার সত্যতা প্রমাণের জন্য অগ্নিপরীক্ষা দিই। এখনকার ছোট ছোট শিশুরাও ভালো করে বুঝে নিয়েছে, টাকা হলে বাঁকাপথে সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। নইলে পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবে কেন(?) পরীক্ষা পাস আর ক্যারিয়ার ভালো করার জন্যই আজকে যত জ্ঞানার্জন। তাহলে শিক্ষায়, জ্ঞানার্জনে মানুষের প্রতি সম্মান, ভালোবাস, শ্রদ্ধা আসবে কোত্থেকে। আজকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষিত ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বাজেটের ভাগ দিতে ভিসি যখন বাধ্য হয় তখন ভাবাই যায় সেই ছাত্ররা প্রশাসন বা রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের কি অবস্থা হবে। প্রায় প্রতিদিনই এখন শিক্ষা সম্পর্কিত নানা কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশিত হয়। ইনস্টিটিউশন পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে মুখস্থবিদ্যার প্রচলন বাড়ছে। ছাত্ররাও মুখস্থবিদ্যার আশ্রয়ে শিক্ষালাভ করে এবং এভাবেই গড়ে ওঠে এটা পরনির্ভরশীল শিক্ষাধারা। এতে মস্তিষ্কের সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ হয় না। এই পদ্ধতি হচ্ছে চাকরিমুখী। ছাত্রদের প্রবণতা থাকে লেখাপড়া শেষ করে কিভাবে শুধুমাত্র একটা ভালো চাকরি পাবে, অর্থাৎ একটা অর্থ রোজগারের যন্ত্রে পরিণত হবে। এর ফলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা ও স্বার্থপরতা নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে। আমাদের জানা দরকার, এডুকেশন পদ্ধতি মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটায়, মানুষের চেতনার মানকে উন্নত করে, সৃষ্টিশীল চিন্তাধারাকে উজ্জীবিত করে, মানুষকে নতুন কিছু তৈরি করতে সাহায্য করে। মানবিক মূল্যবোধ তৈরি না হলে কল্যাণকর চিন্তাও আসবে না, আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতাই কেবল বাড়তে থাকবে। তাহলে এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের দেশে কি বিভিন্ন বিষয়ে যারা সাফল্য পাচ্ছে তারা নিজেদের চেষ্টায়, নিজেদের ক্ষমতায় পাচ্ছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি এ সমস্ত বিষয়ে অধিক মানুষের সাফল্যে সাহায্য করে, মানবিক মূল্যবোধকে বাড়িয়ে তোলে, ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটায়। শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিতেই মানুষের মূল্যবোধ ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। মানুষ আর মানুষের কথা ভাবে না। তাই ফুটপাথে একটা অসুস্থ মানুষকে মরতে দেখেও আমরা সহযোগিতার হাত বাড়াই না, পাশ কাটিয়ে চলে যাই। কেন এমন হচ্ছে? এই নেতিবাচক শিক্ষা কখনো প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। শুধু বড় বড় ডিগ্রি পেলেই প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায় না। শিক্ষার সঙ্গে থাকতে হবে সংস্কৃতি, রুচিবোধ, মানবতাবোধ। শিক্ষার জ্যোতি সমাজ ও দেশের মঙ্গল ঘটায়, মানুষের মঙ্গল করে, মানুষের কল্যাণ সাধিত করে। মনুষ্যত্বববোধ, মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মনুষ্যত্বের কার্যকর উপস্থিতির মধ্যেই ‘মানুষ’ এর প্রকাশ। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যবহার, হাসিরহস্য, একটুখানি সহায়তা, একটু স্নেহের বাক্য, অসহায়ের প্রতি একটুখানি দয়া প্রদর্শন, একটুখানি নম্রতা, একটুখানি সৌজন্যতাই মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। ‘মানুষ’ জন্মগত ভাবে ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে ভালোকে বেছে নেবে বিবেকের দ্বারা, প্রথার দ্বারা নয় এই হচ্ছে মনুষ্যত্ব।’ শিক্ষার সাথে মনুষ্যত্বের সম্পর্ক নিবিড়। শিক্ষা হচ্ছে মানুষের সার্বিক বিকাশের পথ। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ মুক্ত চিন্তার, মুক্তবুদ্ধির এবং নিজেকে প্রকাশের সর্বোত্তম সুযোগ লাভ করে মনুষ্যত্বের চর্চার পথ সুগম, সুন্দর ও পরিশুদ্ধ করে। নৈতিক আদর্শ সংবলিত সমাজে কোনো অনাচার থাকে না। ঘুষ, দুর্নীতি, বঞ্চনা, শোষণ, স্বার্থপরতা এসব থেকে সমাজ মুক্ত থাকলেই তাতে নৈতিকতার আদর্শ প্রতিফলিত হয়। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ মানুষকে মনের দিক দিয়ে সম্পদশালী করে তার মনে প্রশান্তি এনে দেয়। যার বলে বলীয়ান হয়ে একজন মানুষ হয়ে ওঠে সকল প্রকার কলুষমুক্ত। সে সত্যকে সত্য বলে চিনতে পারে, মিথ্যাকে মিথ্যা বলে স্বীকৃতি দেয় যা নৈতিক মূল্যবোধেরই ফল। কাজেই মানুষের আত্মিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ একান্ত জরুরি। সেই মূল্যবোধের শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে। একটি শিশুকে মূল্যবোধ শিখাতে হয় নানাভাবে। সালাম দেওয়া, বিদায়ের সময় মহৎ কামনা করা, ধন্যবাদ জানানো, মিথ্যা না বলা ইত্যাদির মাধ্যমে একটি শিশুকে শিখাতে হয়। পরিবারে যে শিক্ষা শিশু গ্রহণ করতে থাকে তা পরবর্তীতে পূর্ণতা পায় স্কুলে গিয়ে। শিশু শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়ার প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে চলতে থাকে। সত্যবাদিতা, দেশপ্রেম, দয়া, ক্ষমা, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ, মানবতাবোধ ইত্যাদির শিক্ষা শিশুরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। যে শিক্ষা মানুষের বুদ্ধির বিকাশ বা হৃদয়বৃত্তির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় না সেই শিক্ষা শিক্ষা নয়। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়লেও সে নৈতিক শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ হয়। নৈতিকতার অভাবে শিক্ষা গ্রহণ করেও নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে ছোট থেকে বড় পর্যন্ত সবাই। আমাদের সমাজের মানুষ নৈতিক শিক্ষার অভাবে নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। চারদিকে কেবল ঠকানোর প্রতিযোগিতা। অন্যায় করে কে কত বড় হতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় উন্মাদ হয়ে ছুটছে সবাই। মানুষ নিষ্পাপ হয়ে পৃথিবীতে আসে। এরপর পরিবেশ তথা গোটা জীবন এই পৃথিবীতে শিক্ষা গ্রহণ করে। যদি মিথ্যাচার, আদর্শহীনতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, ঘুষ, জালিয়াতি, রাহাজানি প্রভৃতি সমাজবিরোধী কার্যকলাপে নিমজ্জিত থাকে তবে মানুষের উন্নতির পরিবর্তে অধঃপতনই ঘটবে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার যেমন আশা করা যায় না আবার ছোটরাও অনেক সময় ভালো কিছু গ্রহণ করতে নারাজ। ঘরে-বাইরে আজ মানুষের দৈন্যের চিত্র। দেখা যায় বড়রা শিক্ষা বলতে বোঝেন পরীক্ষা ও ‘এ’ প্লাস এবং জীবনের উন্নতি বলতে বোঝেন টাকা ও প্রতিপত্তি। ফলে শিক্ষার মধ্যে শিক্ষার্থীরা খুঁজে পায় না কোনো মহত্তর জীবনবোধ। মানুষের শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের সাথে মানবজাতি, আকাশ, পানি ও স্থলের সকল প্রাণী ও গোটা পথিবীর সার্বিক কল্যাণ-অকল্যাণের প্রশ্ন জড়িত। মানুষকে ভালোবাসা, কারো দুঃখে ব্যথিত হওয়া, সুখে আনন্দিত হওয়া। সমাজসেবামূলক কাজে সম্পৃক্ততা, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও সম্মান, পারস্পরিক সহযোগিতা ইত্যাদির ভালো-কল্যাণময় গুণের সমারোহেই জ্ঞান হতে পারে শক্তি, এবং মহাশক্তি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির