post

তারুণ্যের বিদ্রোহ ও বিভ্রান্তি

হাসান রুমী

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
তারুণ্যের বিদ্রোহ চিরদিন নতুনকে আহ্বান করে। আবার এ বিদ্রোহ যদি যথার্থ না হয় তবে তা-ই বিভ্রান্তি। এমন বিদ্রোহ আর বিভ্রান্তি নিয়েই তারুণ্যের পৃথিবী। কখনো আকাশ স্পর্শ করার স্পর্ধা। কখনো পাতালের রহস্য উন্মোচনের সাধ। আবার কখনো আকাশ-পাতাল মথিত করার দুঃসাধ্য অভিযানÑ এই নিয়েই তারুণ্যের পথ চলা। যে কারণে বলা যায়Ñ তারুণ্য এক আশ্চর্য শক্তির নাম। যে শক্তি পরোয়া করে না কোন নির্দিষ্ট বন্ধন। মানে না সীমানার কোনো পরিধি। বাঁধন ছিন্ন করা যেনো তারুণ্যের কর্তব্যেরই অংশ। কর্তব্যই বটে। একই সাথে দায়িত্বও। দায়িত্ব এ কারণে তারুণ্য যদি বাঁধন ছিন্ন করার যোগ্যতা না রাখে তবে তো নতুনত্বের জন্মই হবে না। হবে না নতুন কোনো সৃষ্টির সূচনা। নতুন উৎসব নতুন সৌন্দর্য এবং নতুন আনন্দ এসব তো তারুণ্যেরই মুখাপেক্ষী। তারুণ্যই বদল করে বার্ধক্যের মুখ। বার্ট্রান্ড রাসেল এ কারণেই বলেছেনÑ ‘বৃদ্ধদের চেয়ে তরুণদের জীবনের মূল্যই অধিক।’ এর মানে বৃদ্ধের জীবনের মূল্য নেইÑ তা কিন্তু নয়। আছে। তবে তারুণ্যের জীবন নতুন দিগন্ত উন্মোচনের জীবন। যার জন্য এর মূল্যও বেশি। জীবন মানেই গুরত্বপূর্ণ এক সম্ভাবনার নাম। কিন্তু সম্ভাবনা শব্দটি জড়িয়ে আছে তারুণ্যের শরীরময়। তারুণ্যের বুক থাকে আশ্চর্য আনন্দে ভরা। পৃথিবীর যে কোনো কাজ, সৃষ্টিতে এবং অগ্রগতিতে নতুন গতি রচনা করে তারুণ্যই। জর্জ বার্নার্ড শ’কে এখানে স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছেনÑ ‘নতুন কিছু করাই তারুণ্যের ধর্ম।’ এ কথা অতি সত্য। অতি মূল্যবানও। জগতের সকল নতুন কাজের সূচনা ও অগ্রগতির সাথে জড়িয়ে আছে তারুণ্যের উষ্ণতা। যারা জানে জীবন মানেই এগিয়ে চলা। এগিয়ে যাওয়া। অগ্রগতির আনন্দকে উন্মোচন করা। তারা তারুণ্যকেই স্মরণ করে। করবে আজীবন। করবে কারণ তারুণ্যের চোখে থাকে স্বপ্নের পৃথিবী। থাকে সম্ভাবনার নতুন আকাশ। যে আকাশ জাগায় আশার আলো। যে আলো আনে সাফল্যের আশ্চর্য সুদিন। যে সুদিনের প্রত্যাশা করে প্রতিটি মানুষের মন। যেহেতু তারুণ্য নতুন দিনের স্বপ্ন আঁকে। যেহেতু নতুন গতির সূচনা করে। সে কারণে তাকে কখনো কখনো হতে হয় বিদ্রোহী। এ বিদ্রোহ প্রচলিত সমাজ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে। বিদ্যমান রীতি-নীতি ও রসমের বিরুদ্ধে। মন্থরতা ও ম্রিয়মাণতার বিরুদ্ধে। সমাজের অন্যায় অবিচার অব্যবস্থাপনা ও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে তারুণ্যই দাঁড়িয়ে যায়। দাঁড়াতে হয়। দাঁড়ায় তারা। যে সমাজে তারুণ্য উদাসীন হয় সে সমাজের অগ্রগতি থাকে না। থাকে না নতুন সৃষ্টির উচ্ছ্বাস। যেখানে নতুন আনন্দ নেই সেখানে জীবনের সৌন্দর্য নেই। সৌন্দর্যের অভাব মানেই অজ্ঞানতা। অজ্ঞানতাই অপসংস্কৃতির জন্ম দেয়। সংস্কৃতির অভাব অথবা অপসংস্কৃতি দুটোই যে কোন জাতিকে নিঃশেষ করে দেয়। সংস্কৃতির অভাব থেকেই অবিচারের জন্ম হয়। অবিচার থেকেই শুরু হয় নৈরাজ্য। যেখানে নৈরাজ্য থাকে সেখানে কোনো কিছুতেই সুস্থতা আশা করা যায় না। আর অসুস্থতা যে কোনো জাতির জন্যই ধ্বংসের কারণ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হয়। সমাজ অসুস্থ হলে তারুণ্য সুস্থ থাকে না। থাকতে পারে না। তারুণ্যও যদি অসুস্থতায় ডুবে যায়। তবে কে রক্ষা করে সমাজ সংসার। কে রক্ষা করে জাতির মূল্যবোধ। অথচ মূল্যবোধ রক্ষার বাইরে গেলে অথবা অরক্ষিত হলে জাতির আর কোনো নৈতিক ভিত্তি রচিত হতে পারে না। হয় না। সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি সবইতো তারুণ্যের শক্তিতে গতিপ্রাপ্ত হয়। শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো খানিকটা সত্য। সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা তারুণ্যের মুখাপেক্ষী একথা কবি আল মাহমুদ প্রায়ই বলেন। বলেন তার দীর্ঘ জীবন থেকে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে। বলেন তার তারুণ্যের আশ্চর্য শক্তি থেকে। তারুণ্য মানে কম বয়সের কেউ শুধু তা নয়। কিংবা তরতাজা শরীরের অধিকারী তাও নয়। তারুণ্যতো মনেরই ব্যাপার। মনের গহিন থেকে তারুণ্যের উদ্ভাস উচ্চকিত হয়। একজন বৃদ্ধও তারুণ্যের শক্তিতে বলীয়ান হতে পারেন। পারেন নতুন নির্মাণের প্রতিনিধি। তারুণ্যের জয় চিরদিন। চির সুন্দরের প্রতিনিধি তারা। তারা জাগ্রত চিত্তের সৈনিক। তবে আমাদের সমাজে সাধারণত যুবক মুখগুলোই তারুণ্যের প্রতিভূ হিসেবে পরিচিত। তরুণদেরই বলা হয় আগামীর আশা-ভরসার স্থল। নতুন করে দেখার নতুন করে লেখার শক্তি তরুণদের থাকে একথা অস্বীকার করে লাভ নেই। কেনোইবা অস্বীকার করবে! বাঁধভাঙা জোয়ারের উচ্ছ্বাসতো তারুণ্যের বুকের সমুদ্রেই জাগে। যে সমুদ্র ধারণ করে নতুন জোয়ারের ঢেউ। ঢেউ তো লাগে। লাগে বুকে। চোখে। অন্তরে। অন্তরের নিভৃত নিলয়ে। এ ঢেউ আমাদের জাগায়। আমাদের আপ্লুত করে। আমাদের প্রাণিত করে। উজ্জীবিত করে। প্রেরণা জোগায় এগিয়ে যাওয়ার আনন্দের দিকে। এগিয়ে যাই আমরা। যেতে হয়। যেতে হয় কারণ তারুণ্যের সৌন্দর্য থেকে মুখে ফিরিয়ে থাকা যায় না। যায় না তারুণ্যকে অস্বীকার করা। সব অস্বীকারতো সব সময় কল্যাণ বয়ে আনে না। সব অস্বীকার সৃষ্টির অগ্রগতিতে কাজ করে না। সুতরাং তারুণ্যকে অস্বীকার করার যত যুক্তিই থাকুক না কেন তাকে অন্তত মানা যায় না। এটাই তারুণ্যের বিদ্রোহ। এটাই তারুণ্যের গতি। এটাই তারুণ্যের প্রবাহ। তারুণ্যের বিদ্রোহ না থকলে সমাজ বন্ধ্যা হয়ে যায়। সৃষ্টির আনন্দ নিঃশেষ হয়ে যায়। অগ্রগতির চাকা থেমে যায়। খেলে না নতুন কোন দরোজার খিল। তাই বলি তারুণ্য আমাদের অহঙ্কার। আমাদের অলঙ্কার। আমাদের নতুন পথের দিশারি। নতুন আনন্দের সঙ্গী। এবং নতুন সুন্দরের প্রতিনিধি। জীবন ও জগতের রহস্য উন্মোচনে তারুণ্যের বিকল্প নেই। তার বিকল্প থাকলে বলতে হবে তারুণ্যের বিকল্প তারুণ্যই। তবে বিদ্রোহ মানে ঔদ্ধত্য নয়। বিদ্রোহ মানে নয় সীমা লংঘন করা। যারা ঔদ্ধত্য যারা সীমা লংঘনকারী এবং যারা বেয়াদব তারাতো সৃষ্টিশীলতার শালীনতা অতিক্রম করে। আর অশালীন বিষয়তো শিল্প হতে পারে না। এটাই তারুণ্যের বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তিতে ডুবে গেলে তার কোনো রক্ষা নেই। তার সম্ভাবনা রহিত হয়ে যায়। সে পুড়ে যায় বিভ্রান্তির অনলে। অতীতকে অস্বীকার করা চলে না। ঐতিহ্যের প্রতি অবহেলা চলার নয়। যারা একদা তারুণ্যে টগবগ ছিল। যারা অবদান রেখেছে সমাজের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা দেখাতেই হবে। দেখাতে হয়। না দেখালে সমাজ শিল্প সাহিত্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। এ নৈরাজ্য কে ঠেকায়। না, ঠেকানোর কেউ থাকে না। পৃথিবীর কোনো বিদ্রোহই শ্লীল বিষয়ের প্রতি অশ্লীল হতে শেখায়নি। কোন বিদ্রোহই ঐতিহ্যকে মথিত করেনি। তারুণ্যের বিদ্রোহও তা করে না। যদি করা হয় তাকে বিদ্রোহ বলা যায় না। তাকে বলতে হবে অসদাচরণ। কিংবা মূর্খের অহঙ্কার। এ অহঙ্কারই তারুণ্যের বিভ্রান্তি। মূর্খের অহঙ্কার বড়ই বেমানান। বড়ই অসুন্দর। এমন অসুন্দর তারুণ্যের ধর্ম হতে পারে না। আমাদের তারুণ্য কিন্তু সত্যিকারার্থে বিদ্রোহী হতে শেখেনি। বরং কোথাও কোথাও শিখেছে ঔদ্ধত্যের ভাষা। এক ধরনের অস্বীকারের প্রবণতা। যে অস্বীকার সব কিছুকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের অশ্লীলতায় ঠেলে দেয়। সাহিত্যে এ নৈরাজ্য আশ্চর্যজনক ভাবে মাথা তুলে আছে। লেখাপড়ার প্রতি অনীহা। ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞা। সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের প্রতি উদাসীন এসবই রপ্ত করেছে আমাদের তারুণ্য। অগ্রজ কবিদের প্রতি অসম্মান দেখানোর প্রবণতা আমাদের তরুণদের ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কি লিখেছেন! অথবা নজরুল পাঠযোগ্য নয়। এমন উদ্ভট উক্তিও শুনতে হয়। কারো কিছুই লেখা হয়নি, হচ্ছে না। কেবল আমিই সেরা। আমার কবিতাই নতুন জনমের স্বাদে সিক্তÑ এসব মেধাহীন উচ্চারণে আমাদের কবিতার জগৎ এখন শোরগোলপূর্ণ। যারা বা যে সব তরুণ এমন উচ্চারণ করে তাদের কোথাও কিন্তু পরিচিতি নেই। নেই কোন মর্যাদার আসন। নিজেদের কবিতা নিজেরাই পড়ে। পড়ে আর তালিয়া বাজায়। এই বুঝি সেরা কবিতাটি হয়ে গেলো। সমস্ত অতীতকে মিথ্যে করেই যেনো তারা দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারুণ্যের এমন উচ্চারণ অতিকথন ছাড়া আর কী হতে পারে। হ্যাঁ সব তরুণ এ পথের পথিক নয়। যারা জানে শিক্ষার মর্ম কি এবং জানে কবিতার ইতিহাস ঐতিহ্য তারা অগ্রজের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে উচ্চকণ্ঠ। তারা কোনোভাবেই হীনম্মন্যতায় ভোগে না। তারা নির্মাণ করে সীমানার নতুন প্রাচীর। নির্মাণ করে নতুন ধারার আনন্দ। তারা চেনে বিদ্রোহ আর বিভ্রান্তির দাগ। তারা বিদ্রোহী সুন্দরের পক্ষে। তারা বিদ্রোহী নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যে। মূর্খের অহঙ্কার থেকে তারা মুক্ত। তারা বিদ্রোহকে কখনো বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ডোবায় না। তারা জানে তারুণ্য দ্বিধাহীন। কিন্তু অজ্ঞানতার ঔদ্ধত্য তাদের টলায় না। তারা মুক্তির আনন্দে বিভোর এক নতুন পৃথিবীর উদ্গাতা। লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির