post

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন জনদাবি, সংসদ ও সংবিধান

১৮ নভেম্বর ২০১২

রাফিউল ইসলাম

দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১১ সালের ১০ মে সংক্ষিপ্ত আদেশে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করলে বর্তমান সরকার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে একই বছরের ৩০ জুন সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে। পঞ্চদশ সংশোধনী কার্যকর-পূর্ববর্তী সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে যে বিধান ছিল তাতে বলা ছিল- মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আদালতের রায়ে ১৯তম প্রধান বিচারপতি তার অংশে নির্বাচিত ব্যক্তি সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথা উল্লেখ করায় যে মৌলিক প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে তা হলো- সংসদ ভেঙে দেয়া হলে প্রধানমন্ত্রীর সংসদ সদস্যপদ থাকে কিনা? আর সেক্ষেত্রে তিনি নির্বাচিত না অনির্বাচিত? রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির অংশের মর্মানুযায়ী, নির্বাচিত ব্যক্তি সমন্বয়ে সংসদ ভেঙে দেয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হলে তাতে অব্যবহিত পূর্বের প্রধানমন্ত্রী বা অব্যবহিত পূর্বের কোনো সংসদ সদস্যকে ওই সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া সংবিধানের বিধানাবলীর ব্যত্যয়ে আদালতের রায়ের আলোচনা ও নির্দেশনার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে সংসদের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? তাই দলীয় বা নির্দলীয় যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হোক না কেন, সে দায়িত্ব সংসদকেই পালন করতে হবে। আর আদালতের আলোচনা ও নির্দেশনাকে অবলম্বন করে সংবিধান সংশোধন ছাড়া যদি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তাতে যে শুধু সংসদের মর্যাদার হানি ঘটবে তা নয়, সংসদে নিষ্পন্ন বিষয় আদালতে নিয়ে আসার পথ আগামীতে আরও প্রশস্ত হবে। বিতর্কিত সাবেক প্রধান বিচারপতির প্রশ্নবিদ্ধ রায় ২০১০ সালে ১৮তম প্রধান বিচারপতির অবসর-পরবর্তী ১৯তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্ন দেখা দিলে দু’জন জ্যেষ্ঠ ও সার্বিক বিবেচনায় উৎকৃষ্ট বিচারককে অতিক্রান্ত করে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার ব্যাপ্তিকাল ছিল প্রায় ৮ মাস। প্রধান বিচারপতি পদে আসীন থাকাবস্থায় তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দেন। ওই মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত মামলাদ্বয়ের আপিল শুনানি। এ দু’টি আপিল মামলার মধ্যে প্রথমোক্তটির ক্ষেত্রে তিনি পদে বহাল থাকাকালীন সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রদান করেন এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে পদে বহাল থাকাকালীন পূর্ণাঙ্গ আদেশ তদকর্তৃক প্রদান করা হয়। প্রথমোক্তটির সংক্ষিপ্ত আদেশে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তাই বেআইনি, তবে পরবর্তী দুটি নির্বাচন সংসদের অভিপ্রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। দ্বিতীয় আপিলটিতে সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেন যে, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত ক্রান্তিকালীন বিধান বলতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালকে বোঝাবে। এ সময়কালের বাইরের কোনো সময়কে ক্রান্তিকালীন সময় বলা যাবে না এবং বলা হয়ে থাকলেও তা অকার্যকর হবে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর সংক্ষিপ্ত আদেশটি প্রদান করা হয় ১০ মে, ২০১১ এবং অতঃপর ওই বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি ১৭ মে, ২০১১ অবসর গ্রহণ করেন। তিনি অবসর গ্রহণ-পরবর্তী গত ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২ ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত তার ৩৪২ পৃষ্ঠা সংবলিত রায়ে অবসর গ্রহণের ১৬ মাসেরও অধিক সময় পর স্বাক্ষর করেন। এখন প্রশ্নÑ উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি বা বিচারক অবসর গ্রহণ-পরবর্তী রায় লিখতে ও রায়ে স্বাক্ষর করতে পারেন কি না? ১৯তম প্রধান বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে শপথ গ্রহণ করাকালীন সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্পষ্টত শপথ গ্রহণ করাকালীন অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তিনি ব্যক্ত করেছেন যে, তিনি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। পরবর্তীকালে তৎকর্তৃক সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা তার স্বপঠিত শপথের সংরক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, তা ভেবে দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। উচ্চ আদালতের বিচারপতি বা বিচারকরা সাংবিধানিক পদধারী হিসেবে শপথ ও সংবিধানের ৯৬ নং অনুচ্ছেদের অনুবলে প্রস্তুতকৃত আচরণবিধি দ্বারা পরিচালিত। উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি বা বিচারক বিচারপতি বা বিচারক পদে নিয়োগ-পরবর্তী শপথ গ্রহণ ব্যতিরেকে পদে আসীন হন না এবং যে তারিখে তিনি বিচারপতি বা বিচারকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন সে তারিখ থেকে তিনি স্বপঠিত শপথ থেকে অবমুক্ত হয়ে যান। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জনগুরুত্বপূর্ণ যে কোনো বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের মতামত গ্রহণ করতে পারেন। সুপ্রিমকোর্টের এ মতামত পরামর্শের অন্তর্ভুক্ত। সাবেক প্রধান বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ রায় অবলোকনে দেখা যায়, তিনি তার রায়ে অযাচিতভাবে নির্বাচিত ব্যক্তি সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তার এ পরামর্শদান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ দ্বারা অনুমোদিত কিনা তা-ও পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। তাছাড়া বিশেষভাবে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন যে, জনগণ সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে নির্বাচিত করে থাকে। সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা থাকলে তা নিরসন উচ্চ আদালতের বিচারকদের কাজ। এ কাজ করতে গিয়ে বিচারকদের আইন প্রণয়ন বিষয়ে পরামর্শ বা মতামত প্রদান জনগণের প্রত্যাশার বিপরীত। একটি পর্যালোচনা উপরোক্ত বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানসহ দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি, সুপ্রিমকোর্ট হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ রুল এবং দেওয়ানি আদেশ ও কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আইন বা বিধি-বিধানের কোথাও উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি বা বিচারককে অবসর গ্রহণ-পরবর্তী পূর্বে শ্রুত বা পূর্বে আংশিক প্রদত্ত মামলার রায় বা পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার সমর্থনে ক্ষমতা প্রদানপূর্বক কোনো অধিকার দেয়া হয়নি। আর অধিকার দেয়া না হয়ে থাকলে আইনের অবস্থান দাঁড়ায় অবসর গ্রহণ-পরবর্তী কোনো বিচারপতি বা বিচারক কর্মে বহাল থাকাকালীন শ্রুত বা আংশিক প্রদত্ত কোনো মামলার রায় বা পূর্ণাঙ্গ রায় লিখলে এবং তাতে স্বাক্ষর প্রদান করলে তা হবে আইনের পরিপন্থী। তাছাড়া উপরোক্ত আইন ও বিধানাবলীতে রায় ঘোষণা বিষয়ে স্পষ্টত যে কথাগুলো বলা হয়েছে তার মর্মার্থ হলো, আদালত মামলার শুনানি সমাপ্ত হওয়ার পর তৎক্ষণাৎ অথবা অন্য কোনো ভবিষ্যৎ দিনে পক্ষগণ অথবা তাদের আইনজীবীদের জ্ঞাতকরণপূর্বক প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করবেন এবং রায় ঘোষণাকালে বিচারক তাতে স্বাক্ষর ও তারিখ দেবেন। একবার স্বাক্ষরিত হলে করণিক বা গাণিতিক ভুল অথবা আকস্মিক ফসকান (অপপরফবহঃধষ ংষরঢ়) বা বিচ্যুতি (ঙসরংংরড়হ) ছাড়া রায়ের অপর কিছু সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। পূর্ণাঙ্গ রায় দৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, আপিল বিভাগের একজন বিচরপতি ও ৬ জন বিচারক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত আপিল মামলার শুনানি গ্রহণ করেন এবং পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও তাতে স্বাক্ষর করার সময় একজন বিচারপতি অবসরে ছিলেন এবং একজন বিচারপতি ও পাঁচজন বিচারক নিজ নিজ পদে বহাল ছিলেন। অবসরে যাওয়া বিচারপতিসহ কর্মরত প্রধান বিচারপতি এবং দু’জন বিচারক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সন্নিবেশিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বেআইনি ঘোষণা করেন। অপরদিকে দু’জন বিচারক এটিকে সংবিধানসম্মত ঘোষণা করেন এবং একজন বিচারক সংবিধানসম্মত ঘোষণা করে এ বিষয়ে বিজ্ঞচিত সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার সংসদের ওপর ছেড়ে দেন। যেহেতু পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও রায়ে স্বাক্ষরকালীন সাবেক প্রধান বিচারপতি পদে বহাল ছিলেন না তাই আইনের দৃষ্টিতে তিনি যে রায় প্রদান করেছেন তা এখতিয়ারবিহীন ও মূল্যহীন। এ বাস্তবতায় ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায়টি ৩ : ৩ এর বিভক্ত রায়। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে আপিল আদালতের বিচারকরা সমভাবে বিভক্ত হলে যে বিধান অনুসৃত হয় তাতে বলা হয়েছেÑ অভিমত প্রদানের ক্ষেত্রে আপিল আদালতের বিচারকগণ সমভাগে বিভক্ত হলে মামলার ওপর তাদের অভিমতসহ একই আদালতের অপর বিচারকের সম্মুখে মামলাটি উপস্থাপিত হবে এবং উক্ত বিচারক তার বিবেচনায় যথাযথ শুনানি গ্রহণের পর স্বীয় অভিমত প্রদান করবেন এবং রায় বা আদেশ উক্ত অভিমতের আলোকে প্রণীত হবে। দেওয়ানি আপিলের ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধিতে বলা হয়েছে, ভিন্নমত লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং যেক্ষেত্রে আপিলটি একাধিক বিচারক কর্তৃক শ্রুত হয়, সেক্ষেত্রে কোনো একজন বিচারক আদালতের রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে থাকলে আপিলে যে সিদ্ধান্ত বা আদেশ প্রদান উচিত বলে তিনি মনে করেন, তা লিখিতভাবে বিবৃত করবেন এবং এর ওপর তিনি তার যুক্তিও বিবৃত করবেন। অপর এক বিধিতে বলা হয়েছে, ভিন্নমত পোষণকারী বিচারকের রায়ের ডিক্রিতে স্বাক্ষরের প্রয়োজন নেই। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত আপিল মামলাটির সঙ্গে ডিক্রি কার্যকরণের বিষয় সম্পৃক্ত না থাকায় ভিন্নমত পোষণকারীদের রায়ের ডিক্রিতে স্বাক্ষর করা বা না করার বিষয়টি এখানে অপ্রাসঙ্গিক। স্পষ্টত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে আপিল বিভাগের রায়টি সংবিধান ও অন্যান্য আইন এবং বিধি-বিধানের আলোকে সমভাবে বিভক্ত গণ্য হওয়ায় আপিল বিভাগে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর শুনানির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন বিচারক না থেকে থাকলে সংবিধানের ৯৮ নং অনুচ্ছেদের আলোকে হাইকোর্ট বিভাগের কোনো বিচারককে যে কোনো অস্থায়ী মেয়াদের জন্য আপিল বিভাগে আসন গ্রহণের ব্যবস্থা করে শুনানি অন্তে তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন তার আলোকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায়ের ফলাফল নির্ণীত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ফ্ল্যাশব্যাক ১৯তম সাবেক প্রধান বিচারপতির প্রদত্ত রায়ে দেখা যায়, তিনি তার রায়ে আইন, বিধি-বিধান ও নীতি-নৈতিকতাকে উপেক্ষা করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ১/১১-এর জরুরি সরকারের কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়েছেন। এখন প্রশ্নÑ এ বৈধতার জন্য কি কোনো আবেদন ছিল? এ বিষয়ে কি কোনো শুনানি হয়েছে? আবেদন না থেকে থাকলে এবং শুনানি না হয়ে থাকলে কেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সংসদের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে জনগণের শেষ ভরসাস্থল খ্যাত সর্বোচ্চ আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন? এখানে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হলো- রিট দায়েরের সময় ১/১১-এর অস্তিত্ব ছিল না। তাই রিটে সে বিষয়ের প্রতিকার চাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। রিটে যে বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই সে বিষয়টি কী করে ১৯তম সাবেক প্রধান বিচারপতির রায়ের আলোচনায় স্থান পেল? এমনকি আপিল বিভাগে শুনানি গ্রহণকালীন এ বিষয় এ্যামিকাস কিউরি বা রাষ্ট্রপক্ষের কেউ কোনো আলোচনা করেছেন সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। রিট দায়ের ও নিষ্পত্তি পর্যন্ত যে শিশুর জন্ম হয়নি সে কী করে আলোচনায় এলো? যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের অনভিপ্রেত আলোচনা দুঃখজনক ও দুরভিসন্ধিমূলক যা শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের দৃষ্টিতে গুরুতর অসদাচরণের শামিল। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক প্রধান বিচারপতি স্বাক্ষরযুক্ত লিখিত রায় জমা দিয়ে তা ফেরত নিয়ে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে পুনঃদাখিল করেছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের দৃষ্টিতে এ ধরনের পরিবর্তন ও পরিমার্জন অসততা, অন্যায় ও প্রতারণা। এক্ষেত্রে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাকে বিচারের আওতায় আনা হলে ভবিষ্যতে আশা করা যায় জাতিকে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না। ১৯তম সাবেক প্রধান বিচারপতি পদে বহাল থাকাকালীন তার কার্যকলাপ প্রধান বিচারপতি দূরের কথা, উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের কাছ থেকে প্রত্যাশিত কার্যকলাপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তিনি প্রধান বিচারপতি পদে বহাল থাকাকালীন কী করে ট্রুথ কমিশনের কাছে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার চেক জালিয়াতি সংক্রান্ত মামলার রায়ের দিন ঢাকা জেলা জজ আদালতসহ সিএমএম আদালত আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে তাকে মামলা থেকে খালাসের ব্যবস্থাসহ নথি থেকে জালিয়াত সংক্রান্ত চেকটি গায়েব করার সুযোগ করে দেন? এই একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে তার এবং তার ভ্রাতার দুর্নীতির শিকড় কত গভীরে প্রবিষ্ট তা বের হয়ে আসবে। সংসদের সার্বভৌমত্ব সংসদের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত এবং কোনো দেশে এটি বিতর্কিত নয়। সংসদ জনগণের সমার্থক, পরিপূরক নয়। সংসদ সরাসরি জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে। দেশের সর্বোচ্চ আইন ‘সংবিধান’ সংসদের সৃষ্টি। সৃষ্টি কখনও স্রষ্টার চেয়ে বড় হতে পারে না। যেমনÑ আমাদের এ পৃথিবীসহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামিন। এ মহান স্রষ্টার যে কোনো সৃষ্টিকে তাঁর চেয়ে বড় ভাবার অবকাশ আছে কি? উচ্চ আদালত সংবিধানের সৃষ্টি। তাই সংবিধানের ঊর্ধ্বে নয়। উচ্চ আদালতের ক্ষমতা সংসদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধান ও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংসদ ও জনগণ একই সত্তা। তাই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনে সংসদ পরিচালিত হয়। সংবিধান ও সাংবিধানিক আইন দ্বারা সংসদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। জনগণের ক্ষমতার যেমন সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তেমনি সংসদের ক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু এ সীমাবদ্ধতা সংসদের ক্ষমতার ওপর সংসদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট অপর কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব অনুমোদন করে না। সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট বিগত ১ হাজার বছরের ক্রমবিকাশমান সংসদীয় আইন দ্বারা পরিচালিত। বস্তুত সংবিধান ও সংসদীয় আইনের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। লিখিত সংবিধানের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আইন একটি পুস্তকে লিপিবদ্ধ, অপরদিকে অলিখিত সংবিধানের ক্ষেত্রে এটি একাধিক পুস্তকে লিপিবদ্ধ। তাই সংবিধান লিখিত বা অলিখিত যা-ই হোক না কেন, সংসদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে উভয়ের অবস্থানে কোনো ভিন্নতা নেই। সংবিধানের ব্যাখ্যা বিষয়ে হ্যালসবারি ও ম্যাক্সওয়েলের ভাষ্য অনুযায়ী, এক্ষেত্রে সংসদের অভিপ্রায়ই মুখ্য এবং অভিপ্রায়কে কেন্দ্র করে যে কোনো অস্পষ্টতা থাকলে আদালত তা দূরীভূত করতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও আদালতের ব্যাখ্যা গ্রহণ ও বর্জন সংসদের অভিপ্রায়ের ওপরই নির্ভর করে। আদালত কর্তৃক সংসদ প্রণীত কোনো আইনের ব্যাখ্যা কখনও সংসদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার প্রাধান্যকে ক্ষুণœ করে না। আইন প্রণয়ন ও আইনের ব্যাখ্যা প্রদান বিষয়ে সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে স্বীকৃত। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের ক্ষমতা সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি অঙ্গ নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন হলেও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রত্যেক সংসদ সদস্য বিশেষভাবে নিজ নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণ এবং সাধারণভাবে দেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন আমাদের মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় অভিব্যক্ত করা হয়েছে যে, আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা করে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। এ অভিব্যক্তির প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করি সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৭(১)-এ, যেখানে বলা হয়েছেÑ ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এ সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে।’ সংসদের সার্বভৌমত্ব জনগণের সমার্থক এবং সে দৃষ্টিকোণ থেকে সংসদ জনগণের ইচ্ছার প্রকৃত প্রতিফলনে স্বীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে। তাই সংসদের সার্বভৌমত্ব জনগণের গৌরব। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাস্তবতা সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে ’৭২-এর সংবিধানে পর্যায়ক্রমিকভাবে ১২৩(৩) (ক) ও (খ)-তে বলা ছিল, (৩) সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে (ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে, ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে; এবং (খ) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। পরে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে বিধান প্রণয়ন করা হয় যে, মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৭২-পরবর্তী ৭ম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত মূল সংবিধানে সংসদ নির্বাচন বিষয়ে অনুচ্ছেদ নং ১২৩(৩) (ক)-তে বর্ণিত বিধানাবলি অনুসরণপূর্বক নির্বাচন অনুষ্ঠানের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। প্রথম সংসদ পাকিস্তানের সামরিক আইন কাঠামোর আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে জাতি ও প্রাদেশিক পরিষদ সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী এ সংসদের নামকরণ করা হয়েছিল গণপরিষদ (ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু)। সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর এ সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। উল্লেখ্য, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংসদ মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ভেঙে দেয়া হয়েছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে মূল ৭২’র সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১২৩(৩) (ক) ও (খ)-তে বর্ণিত বিধানাবলি পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে ৭২’র মূল সংবিধানের ৬৬ নং অনুচ্ছেদে যেসব যোগ্যতার কথা উল্লেখ ছিল তা হলÑ ১. তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং তার বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হতে হবে। এর পাশাপাশি বলা হয়েছেÑ ২. একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না, যদি (ক) কোন উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করেন; (খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি লাভ না করে থাকেন; (গ) তিনি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন ২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তি লাভের পর ৫ বছরকাল অতিবাহিত না হয়ে থাকে; (ঙ) তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যে কোন অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে থাকেন এবং (চ) তিনি আইনের দ্বারা বা অধীন অনুরূপ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮ সালের দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশ নং ৪-এর দ্বারা ৬৬ নং অনুচ্ছেদে (ঘঘ) উপদফা এবং (২ক) দফা সন্নিবেশ করা হয়। (ঘঘ) উপদফা দ্বারা নির্ধারণ করা হয়েছে, একজন ব্যক্তি ৬৬ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত পূর্বোল্লিখিত অযোগ্যতার অতিরিক্ত আইনের দ্বারা পদধারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না এমন পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কোন লাভজনক পদে যদি অধিষ্ঠিত থাকেন, সেক্ষেত্রে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না। অনুচ্ছেদ নং ৬৬-এর (২ক) দফায় বলা হয়েছে, এ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে কোন ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী হওয়ার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলে গণ্য হবেন না। স্পষ্টত ৬৬ নং অনুচ্ছেদে (ঘঘ) উপদফা সন্নিবেশনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর পাশাপাশি দফা (২ক) সন্নিবেশনের মাধ্যমে কতিপয় পদধারী যেমন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী প্রভৃতিদের অযোগ্যতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়টির আক্ষরিক অর্থ হলÑ উপরোক্ত পদধারীরা প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও এ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে তারা প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত আছেন বলে গণ্য হবেন না অর্থাৎ এসব পদধারীকে পদে বহাল থাকাবস্থায় সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন বা সংসদের কোন সদস্যপদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য যোগ্য করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদের ব্যাখ্যা সংবিধান বা অন্য কোন আইনে দেয়া হয়নি। সাধারণ অর্থে প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদ বলতে এমন সব পদধারীকে বোঝায় যারা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা ও সম্মানী গ্রহণ করে থাকেন। এ অর্থে সব গণকর্মচারী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত মর্মে গণ্য। দণ্ডবিধি, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭, ফৌজদারি সংশোধন আইন ১৯৫৮ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কমিশনার, পৌরসভার চেয়ারম্যান ও কমিশনার এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা গণকর্মচারী। সংসদ সদস্যরা প্রজাতন্ত্রের গণকর্মচারীদের মতো রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পদে বহাল থাকাবস্থায় বেতন ও ভাতাদি প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। সে অর্থে একজন সংসদ সদস্যের পদ প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদ। সংবিধানের ৬৬ নং অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যের আবরণে কতিপয় পদধারীকে পদে বহাল থাকাবস্থায় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য যোগ্য ঘোষণা করা হলেও একজন সংসদ সদস্যকে শুধু সংসদ সদস্য হিসেবে সে যোগ্যতার আওতায় আনা হয়নি। বর্তমান ৯ম সংসদে যাদের অবস্থান সংসদ সদস্য হিসেবে, তারা সংবিধানের ১২৩(৩) (ক) এ বর্ণিত বিধানের আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে স্পষ্টত নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এক্ষেত্রে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য যোগ্য করতে হলে অবশ্যই ৬৬ নং অনুচ্ছেদের (২ক) উপদফায় অপরাপর পদধারীদের সঙ্গে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধনী আনা আবশ্যক। পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংসদ ভেঙে দেয়ার পর রাজা বা রানী অথবা রাষ্ট্রপতি অব্যবহিত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভাকে সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে নিয়মমাফিক দৈনন্দিন কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে বলেন। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে যেসব জটিলতা দেখা দেবে তা হলÑ প্রথমত, বিদ্যমান সংসদ সদস্য নির্বাচনে বিজয়ী হতে না পারলে দেখা যাবে একই সময়ে একই আসন হতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ২ জন; দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তারা নির্বিঘেœ ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন কিনা সে বিষয়ে অনেকেরই আশঙ্কা রয়েছে; তৃতীয়ত, নির্বাচনে পরাভূত ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে কিভাবে এর সমাধান করা হবে; চতুর্থত, রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে থাকলে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যে কোনো বিবদমান পরিস্থিতিতে তার পক্ষে ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ কতটুকু সম্ভব; পঞ্চমত, ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশন যে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে সে নিশ্চয়তা কোথায়?; ষষ্ঠত, ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়োগপ্রাপ্ত বিভিন্ন বাহিনী প্রধান এবং মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ তত্ত্বাবধায়ক ও থানা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা কিরূপে নিশ্চিত করা হবে এবং সপ্তমত, মন্ত্রিসভার যেসব সদস্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কী কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেক্ষাপট গণতান্ত্রিক দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার (ওহঃবৎরস এড়াবৎহসবহঃ) এর ধারণা বা বাস্তবতা নতুন কিছু নয়Ñ তবে নতুন হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নামক প্রতিষ্ঠানটি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যেই নির্বাচিত সরকার আস্থা ভোটে হেরে গেলে অথবা অন্য যে কোনো যৌক্তিক কারণে সরকার পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপ্রধান এ পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং পদত্যাগকারী সরকার প্রধানকে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ পরবর্তী সরকার গঠন পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের জন্য অনুরোধ করেন। পদত্যাগকারী এ সরকার হন তখন দেখাশোনা করার সরকার। এ সরকারের আকৃতি হয় ছোট, ক্ষমতা থাকে সীমিত, প্রধান ক্ষমতা থাকে মূলত রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে। পদত্যাগকারী এ সরকার রাষ্ট্রপ্রধানের প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেন, বর্জনও করতে পারেন। সাধারণত বর্জনের প্রশ্ন আসে যদি নির্বাচনী আইনে বলা হয়ে থাকে যে, তত্ত্বাবধায়ক অবস্থায় কেউ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতসহ অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারণা ও যাত্রা বেশি দিনের নয়। এ ব্যবস্থাটি ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক মর্যাদা লাভ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের সাথে স্থান করে নেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার গঠন করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ছিল ঐ সময়ে সংসদে বিপক্ষীয় দল। বিপক্ষ বা বিরোধী দলের (ঙঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ চধৎঃু) আইনগত অধিকার আছে সরকারের সমালোচনা করার বা বিরোধিতা করার। আওয়ামী লীগও ঘোষণা দিয়েই তা করেছিল। বিএনপিকে ভোট কারচুপির সরকারও বলে আসছিল। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মাগুরা জেলায় একটি উপ-নির্বাচনে সরকারি দল বিএনপি’র প্রার্থী উইন করাকে বিপক্ষ দল সরকারি দলের ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলে তদানীন্তন বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি আর হবেও না ঘোষণা করে তারা আর এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দেয় এবং ১৯৮৩ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক প্রদত্ত ও প্রস্তাবিত যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার রূপ ও প্রস্তাব দেয়া হয় সে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি জানায় আওয়ামী লীগও। ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম প্রদত্ত এ ধারণাটিই জামায়াতে ইসলামীর তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খানই প্রথম জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সামনে তা পেশ করেন। যেহেতু দাবিটি ছিল জামায়াতে ইসলামীর, আর একে বরণ করলো ঐ সময়ের প্রধান বিরোধী দল, অতএব, জামায়াতের পক্ষে পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না বরং আওয়ামী লীগের সাথে সমন্বয় রেখে এ দাবির পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে এবং তার সরকারের সামগ্রিকভাবে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে কঠোর এবং রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার এ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের ৫৮ নং অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগ এরপর বলতে লাগলো যে, শেখ হাসিনাই এর রূপককার এবং বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে এ বিষয়ে মডেল হয়ে থাকবে। সেই একই আওয়ামী লীগ ১৫ বছরের ব্যবধানে এসে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনীত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার সুযোগ খুঁজছে। আওয়ামী লীগের অবস্থান সংবিধান ব্যাপারে গঠিত সংসদীয় কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার সুপারিশ করেছিল। একইভাবে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণী-পেশার সংগঠন এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু বলা যায় প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। পরে যদিও এজন্য কোর্টের রায়ের দোহাই দেয়া হয়। ১৮ দলীয় জোটের প্রতিক্রিয়া পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পর্কে ১৮ দলীয় জোটের অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া আদালতের রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, নৈতিকতাবিরোধী, অগ্রহণযোগ্য, পক্ষপাতদুষ্ট ও বাতিলযোগ্য। প্রকাশ্য আদালতে দেয়া সংক্ষিপ্ত ও ষোলো মাস পর দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে অসঙ্গতি তুলে ধরে বেগম জিয়া বলেন, এ রায় বিচারিক অসদাচরণ। একজন বিচারক অবসর নিলে তিনি আর আদালতে বসতে পারেন না। একইভাবে রায়ে সই করতে পারেন না। কিন্তু সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তাই করেছেন। তাই এ রায় অগ্রণযোগ্য। দু’ধরনের রায় দিয়ে বিচারপতি খায়রুল হক বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, গত ১০ মে আদালতে যে রায় দেয়া হয়েছিল, সেখানে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন বিচারপতিদের বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে নির্দলীয় সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা। এমন গরমিল নজিরবিহীন এবং হীন রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয়েছে। এছাড়া তিনি একে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের হুবহু প্রতিধ্বনি হিসেবে উল্লেখ করেন। খালেদা জিয়া আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এই রায়ের ফলে দেশে অনভিপ্রেত অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এবং রাজনৈতিক সঙ্কট আরো বৃদ্ধি পাবে। আইনবিদদের অভিমত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সাথে শর্ত জুড়ে দেয়াকে বেআইনি বলে মনে করেন বিশিষ্ট আইনজীবীরা। তাদের মতে, সংক্ষিপ্ত রায়ে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতে পারে বলে বলা হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত থাকবে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত রায়ের শব্দগুলো পূর্ণাঙ্গ রায়ে নেই। বর্তমান মন্ত্রিসভার সংক্ষিপ্ত আকারে নির্বাচনকালে দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত রায়ে এ ধরণের কিছু ছিল না। ফলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আগে দেয়া সংক্ষিপ্ত রায় থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে। এটি বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী। রায় সংশোধনের ক্ষমতা কোনো বিচারপতির নেই। কথায় আছে, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’। একবার রায়ে স্বাক্ষরের পর আবার তা পরিবর্তন করা যায় না। এটি এখতিয়ারবহির্ভূত। সমাধানে করণীয় বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যেখানে পারস্পরিক অনাস্থা ও চরম বৈরি সম্পর্ক বিদ্যমান, সেখানে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন পক্ষপাতদুষ্ট হতে বাধ্য। বর্তমান সরকারের এ অবস্থান তাই সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছেই অগ্রহণযোগ্য, শুধু বিরোধী দলগুলোই নয় বুদ্ধিজীবীমহলও সরকারের এ অবস্থানের ঘোর বিরোধী। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে, এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হতে পারে এর জন্য কার্যকর টনিক। একে সংবিধানসম্মত করার ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দল আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য উপায় খুঁজে নিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির