post

দ্বিধাহীন নির্ভেজাল আনুগত্যই সাফল্যের চাবিকাঠি

মো: আতিকুর রহমান

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫
ইসলামী সংগঠনের শৃঙ্খলার মূল উপাদান হচ্ছে আনুগত্য। আনুগত্যই সংগঠনের চালিকাশক্তি বা প্রাণশক্তির ভূমিকা পালন করে থাকে। যে সংগঠনে আনুগত্য নেই, সে সংগঠনে শৃঙ্খলা নেই। আর শৃঙ্খলা যদি না থাকে, তাহলে সংগঠনে বহু লোকের ভিড় জমলেও এর কোনো মূল্য হয় না, যেমনি মূল্য নেই প্রাণহীন একটি সুন্দর সুঠাম দেহের। ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জন্য ইসলামী আইন ও সংবিধানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের যে সকল লোককে ইসলামী নেতৃত্বের বিশিষ্ট গুণাবলির পরিপ্রেক্ষিতে উন্নতমানের ইলম ও তাকওয়ার অধিকারী হওয়ার কারণে নেতৃত্বের পদে নির্বাচন করা হয়, সৎকর্মসমূহে তাঁদের আনুগত্য করা শরিয়তের অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ও ওয়াজিবসমূহের অন্তর্ভুক্ত। আনুগত্য কী আনুগত্য শব্দটি বাংলা। এর আরবি হচ্ছে এতায়াত; এর বিপরীত হলো মাছিয়াত বা এছইয়ান। যার দ্বারা নাফরমানি করা, হুকুম অমান্য করা বোঝায়। আনুগত্য শব্দটি অনুগত হওয়া, মান্য করা, মেনে চলা, স্বতঃস্ফূর্ত অনুসরণ, আদেশ-নিষেধ পালন করা, অক্ষরে অক্ষরে পালন করা, মাথা পেতে নেয়া, কথা মত চলা প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া আনুগত্য শব্দটি তিনটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়- ১.    সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া ২.    কোরবানি করা। যেমন- মতের কোরবানি, অর্থের কোরবানি, সময়ের, কোরবানি শ্রমের কোরবানি, আরাম-আয়েশের কোরবানি। কোরবানি করার মানসিকতা থাকলেই সঠিকভাবে আনুগত্য করা যায়। ৩.    উচ্চতর শক্তি বা ব্যক্তির আদেশ মানা। পরিভাষায় আল্লাহ ও রাসূল (সা)কে নিরঙ্কুশ মেনে নিয়ে ইসলামী সংগঠনের যাবতীয় মারুফ কাজে নিজের মতামতকে কোরবানি করে দিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মেনে চলাকে আনুগত্য বলে। প্রকৃত আনুগত্য বা প্রকৃত এতায়াত হলো সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর যাবতীয় হুকুম আহকাম মেনে চলা। আনুগত্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ১. আনুগত্য করা ফরজ, আল্লাহর নির্দেশ আল্লাহ বলেন ‘হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং সেসব লোকেরও যারা তোমাদের মধ্যে সামগ্রিক দায়িত্বসম্পন্ন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো ব্যাপারে মতবিরোধের সৃষ্টি হয় তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাক। এটাই সঠিক কর্মনীতি এবং পরিণতির দিক দিয়েও এটাই উত্তম। (সূরা আন নিসা : ৫৯) এ তিন ধরনের আনুগত্য হচ্ছে ওয়াজিব। এর মধ্য থেকে কোন একটির আনুগত্য পরিহার করলে মুসলমান ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ২. আনুগত্য আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার উপায় আল কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে- “হে নবী! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ কর তবে আমার আনুগত্য কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন, আল্লাহ পাক ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (সূরা আলে ইমরান : ৩১) ৩. আনুগত্য আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত লোকদের সঙ্গী বানায় আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে সে ঐসব লোকদের সঙ্গী হবে যাদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন।        (সূরা নিসা : ৬৯) ৪. আনুগত্য ঈমানের অপরিহার্য দাবি আল কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে, ঈমানদার লোকদের বক্তব্য তো এই যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ডাকা হবে এ জন্য যে, রাসূল (সা) তাদের মামলা-মোকদ্দমার ফয়সালা করে দেবেন, তখন তারা বলে আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। (সূরা নূর : ৫১) ৫. আনুগত্য হেদায়েতপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত আল্লাহ বলেন, যদি তোমরা রাসূলের আনুগত্য কর তাহলে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে। আর রাসূলের দায়িত্ব হলো শুধুমাত্র দ্বীনের দাওয়াত সুস্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়া। (সূরা নূর : ৫৪) ৬. আনুগত্য মুমিনের সফলতার হাতিয়ার আল্লাহর ঘোষণা- ঐসব লোকেরাই সফলকাম যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে এবং আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর নাফরমানি থেকে দূরে থাকে। (সূরা নূর : ৫২) ৭. আনুগত্য হচ্ছে জান্নাতপ্রাপ্তির অন্যতম উপায় হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করলো সে জান্নাতে প্রবেশ করলো, আর যে ব্যক্তি আমার বিরোধিতা করলো সে আমাকে অস্বীকার করলো। (বুখারী) ৮. আমীরের আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য পরিপূর্ণ হয় হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা) বলেছেন, যে আমার এতায়াত বা আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে আমার হুকুম অমান্য করল, সে আল্লাহর হুকুমই অমান্য করল। অনুরূপভাবে যে আমীরের আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। আর যে আমীরের আদেশ অমান্য করল, সে প্রকৃতপক্ষে আমারই আদেশ অমান্য করল। (বুখারী ও মুসলিম)। ৯. আনুগত্য সাংগঠনিক শৃঙ্খলার ভিত্তি হযরত ওমর ফারুক (রা) বলেন, সংগঠন ব্যতীত ইসলাম নেই, আর নেতৃত্ব ব্যতীত সংগঠন নেই এবং আনুগত্য ব্যতীত নেতৃত্ব নেই। (আসার) হযরত হারিছ আল আশয়ারী (রা) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা) আমাদেরকে যে ৫টি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন সেখানে জামায়াতবদ্ধ বা ইসলামী সংগঠনে সম্পৃক্ত হওয়ার পাশাপাশি নেতার কথা শোনা ও আনুগত্য করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। (আহমদ, তিরমিজি) ১০. জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্য নেতৃত্বের আনুগত্য আবশ্যক হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা)কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্যকে অস্বীকার করত ইসলামী সংগঠন পরিত্যাগ করল এবং সে অবস্থায় মারা গেল, সে জাহেলিয়াতে আচ্ছন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল। (মুসলিম) ১১. শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য রাসূল (সা) বলেছেন, দলছুট একটি বকরীকে শিকার একটি বাঘের জন্য যেমন সহজ তেমনি সহজ, সংগঠনের বাইরে থাকা একজন মুমিনকে শয়তান নিজের শিকারে পরিণত করা। আনুগত্যের ভিত্তি আনুগত্যের ভিত্তি হলো ঈমান। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং সেসব লোকেরও যারা তোমাদের মধ্যে সামগ্রিক দায়িত্বসম্পন্ন। (সূরা নিসা : ৫৯) যার ঈমান যত পরিচ্ছন্ন ও নির্ভেজাল তার আনুগত্য তত পরিচ্ছন্ন ও নির্ভেজাল। অন্য কথায়, যার আনুগত্য যত পরিচ্ছন্ন ও মজবুত, বুঝতে হবে তার ঈমান ততটা সুন্দর ও মজবুত। ঈমানের মজবুতির ওপরই মূলত আনুগত্যের মজবুতি নির্ভর করে। আনুগত্যের নিয়ম ১. আনুগত্য হতে হবে মনের ভক্তি-শ্রদ্ধা, পূর্ণ আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা সহকারে। আনুগত্য বিষয়টির সাথে স্বতঃস্ফূর্ততা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিপদে পড়ে বা পরিস্থিতির কারণে মনের বিরুদ্ধে আনুগত্য করা উচিত নয়। আল কুরআনে রাসূল (সা)কে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি তা থেকে মুখ ফিরাল, তা যাই হোক না কেন, আমি আপনাকে তাদের ওপর পাহারাদার বানিয়ে প্রেরণ করিনি। (সূরা আন নিসা : ৮০) ২. কোন প্রকারের কৃত্রিমতা বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সঙ্কোচ-সংশয়ের কোন ছাপ বা পরশ এতে থাকতে পারবে না। আল্লাহ বলেন, আপনার রবের কসম! তারা কখনও ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপারে একমাত্র আপনাকেই ফয়সালাদানকারী হিসেবে গ্রহণ করবে, অতঃপর আপনার দেয়া সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের মনে দ্বিধা-সংশয় থাকবে না এবং ঐ সিদ্ধান্ত সর্বোত্তম উপায়ে মাথা পেতে নেবে।                      (সূরা আন নিসা : ৬৫)। মনে রাখতে হবে আনুগত্যের ক্ষেত্রে কৃত্রিমতা মুনাফিকের পর্যায়ে পড়ে যেতে পারে। আল্লাহ বলেন, বলে দিন হে নবী! কসম খেয়ে আনুগত্য প্রমাণের তো কোনো প্রয়োজন নেই। আনুগত্যের ব্যাপারটা তো খুবই পরিচিত ব্যাপার। সন্দেহ নেই, আল্লাহ তোমাদের আমল সম্পর্কে অবগত আছেন। (সূরা নূর : ৫৩) ৩. ব্যক্তির পরিবর্তনের কারণে আনুগত্য ব্যবস্থাকে মেনে চলার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার পরিবর্তন আসতে পারে না। কোনো আন্দোলনের ব্যাপকতর অবস্থায় দায়িত্ব গ্রহণকারী একটি বড় দলের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কতক উচ্চমানের, কতক নিম্নমানের, কেউ বর্তমান যুগের বিশেষ বিষয়সমূহে অধিক পারদর্শী, কেউ প্রথম যুগের অবস্থা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন, কেউ নির্দেশনাবলির বাহ্যিক বিষয়সমূহ সম্পর্কে অধিক অবগত, আবার কেউ নির্দেশনাবলির অভ্যন্তরীণ তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী, কারো নিকট আন্দোলনের একটি দিক অধিক গুরুত্বপূর্ণ, আবার কারো নিকট অন্য একটি দিক গুরুত্বের অধিকারী। আবার এমনও হতে পারে যে, কারোর মেজাজ একটু কঠোর, কারো কোমল, কেউ অত্যধিক নিঃসঙ্কোচ ভাবকে পছন্দ করেন আবার কেউ একটু গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যবহারে অভ্যস্ত, কেউ অত্যধিক বাকপটুতাকে পছন্দ করেন, আবার কেউ নীরবে কাজ করার পক্ষপাতী। এ ছাড়াও পোশাক-পরিচ্ছদ, খানা-পিনা, চলা-ফেরা, ওঠাবসা প্রভৃতি। এসব ব্যাপারে ব্যক্তির রুচি ভিন্নতর হতে পারে। ব্যক্তিগত রুচি, প্রকৃতি ও প্রবণতা একটি দলীয় ব্যবস্থার সামগ্রিক নীতির ঐক্য সত্ত্বেও একটি বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত নিজের কাজ করে থাকে। এই পার্থক্য ও বিভিন্নতার কারণে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অবস্থার মধ্যে এমন কোন পার্থক্য সূচিত হয় না, যার ফলে তাঁদের আনুগত্যের অধিকারের মধ্যে কম-বেশি করা যেতে পারে এবং তাঁদের মধ্যে কোনো রদবদল হলে লোকেরা অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হতে পারে যে, অমুক ব্যক্তির মধ্যে যে রুচি ও মননশীলতা ছিল তা অমুক ব্যক্তির মধ্যে নেই কেন? কোন এক ধরনের ব্যবহার ও কর্মপদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার পর যদি কোনো রদবদল অনুষ্ঠিত হয় তাহলে মনের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয় এবং কর্মের গতি মন্থর হয়ে পড়ে। এই অনাসৃষ্টির দুয়ার বন্ধ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) হেদায়েত দিয়েছিলেন যে, একজন নাককাটা হাবশিকেও যদি তোমাদের ইমাম করা হয় তাহলে তাঁর নির্দেশ শ্রবণ করো এবং তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য করো। এ ক্ষেত্রে তাঁর চেহারা সুরত লেবাস-পোশাক রুচি প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করো না। দায়িত্বশীলদের ব্যক্তিগত রুচি, প্রকৃতি সকল দিক দিয়ে অনুগতদের চাহিদানুযায়ী হবে, এ বিষয়টির ওপর শরিয়ত আনুগত্যকে নির্ভরশীল করেনি। ইসলামী আন্দোলন ব্যক্তিকেন্দ্রিক আবর্তিত হয় না। বরং এ আন্দোলন এক সময় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নেতৃত্বে চলতে থাকে এবং অন্য সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর নেতৃত্বে। কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ১৪৪ নম্বর আয়াত “মুহাম্মদ (সা) একজন রাসূল মাত্র ছিলেন। তাঁর পূর্বে আরও বহু রাসূল অতিক্রান্ত হয়েছেন, যদি তিনি মারা যান বা নিহত হন তাহলে কি আবার তোমরা পেছনের দিকে ফিরে যাবে?” এরপর হযরত উমর (রা)-এর মতো কঠোর হৃদয়ের ব্যক্তি নেতৃত্ব লাভ করেন। অতঃপর হযরত উসমান (রা)-এর মতো কোমল হৃদয়ের সহনশীল ব্যক্তি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর হযরত আলী (রা) তাঁর বিশেষ গুণাবলিসহ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন। এই সমস্ত হাতবদলের মধ্যে অবশ্যই আনুগত্য ব্যবস্থার অপরিহার্যতা বহাল থাকে এবং এ ব্যবস্থা ভঙ্গ করা হামেশা কবিরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত থাকে। মনে রাখতে হবে, আমাদেরকে ব্যক্তিত্বকে সম্মুখে রেখে শৃঙ্খলার আনুগত্য করার জন্য নয় বরং শরিয়ত বিভিন্ন দায়িত্বকে যে মর্যাদা দান করেছে তাকে সম্মুখে রেখে শৃঙ্খলার আনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কাজেই প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিদিন ব্যক্তি বদল হতে থাকলেও, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) আমাদের ওপর দায়িত্বশীলদের যে সকল অধিকার দান করেছেন পূর্ণ সততার সাথে আমাদের সেগুলো আদায় করা উচিত।     (চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান) ৪. দায়িত্বশীল পছন্দ-অপছন্দের ওপর আনুগত্য নির্ভর করে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানের ওপর নেতার আদেশ শোনা ও মানা অপরিহার্য কর্তব্য। চাই সে আদেশ তার পছন্দনীয় হোক, আর অপছন্দনীয় হোক। তবে হ্যাঁ, যদি আল্লাহর নাফরমানিমূলক কোন কাজের নির্দেশ হয় তবে সেই নির্দেশ শোনা ও মানার কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী ও মুসলিম) ৫. সুদিনে-দুর্দিনে, খুশি-বেজার সকল অবস্থায় আনুগত্য অত্যাবশ্যক। হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা) বলেছেন, সুদিনে ও দুর্দিনে, সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে এবং তোমার অধিকার খর্ব হওয়ার ক্ষেত্রেও (বা তোমার ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়া হলেও) দায়িত্বশীলের নির্দেশ শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা তোমার জন্য অপরিহার্য। (মুসলিম) ৬. প্রাপ্য অধিকার না পেলেও আনুগত্য করতে হবে। হযরত সালামা ইবনে ইয়াজিদ আল জুফি (রা) রাসূল (সা)কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী! আমাদের ওপর যদি এরূপ শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হয় যারা তাদের অধিকার আমাদের নিকট থেকে পুরোপুরি দাবি করবে, কিন্তু আমাদের প্রাপ্য অধিকারে বাধা দেবে, তখন আমাদের জন্য আপনার নির্দেশ কী? এটা শুনে রাসূল (সা) তার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সালামা পুনরায় জিজ্ঞেস করলে রাসূল (সা) বলেন, তোমরা শ্রবণ করবে ও আনুগত্য করে যাবে। কারণ তাদের (পাপের) বোঝা তাদের ওপর, আর তোমাদের বোঝা তোমাদের ওপর। (মুসলিম) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা) বলেছেন, আমার পরে তোমরা অধিকার হরণ ও বহু অপছন্দনীয় জিনিসের সম্মুখীন হবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে তার জন্য আপনার নির্দেশ কী? তিনি বলেন, এরূপ অবস্থায় তোমরা তোমাদের নিকট প্রাপ্য দাবি যথারীতি পরিশোধ করবে এবং তোমাদের প্রাপ্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে। (বুখারী ও মুসলিম) ৭. নেতার মধ্যে অপ্রীতিকর কিছু দেখলে ধৈর্য ধারণ করতে হবে । ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা) বলেছেন, তোমাদের কেউ যদি তার নেতার মধ্যে কোন রূপ অপ্রীতিকর বিষয় লক্ষ্য করে, তাহলে সে যেন ধৈর্য ধারণ করে। কারণ যে ইসলামী রাষ্ট্রশক্তি থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে যায়, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করে। (বুখারী ও মুসলিম) সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী দল ও সংগঠনের পরিচালক ও নেতৃবৃন্দ সাধারণ দুনিয়াপরস্ত রাজনৈতিক দলসমূহের সভাপতি, সহসভাপতি ও তাঁদের উপদেষ্টাগণের সমপর্যায়ভুক্ত নন। বরং এখানে পরিচালকবৃন্দ ও কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্যগণ একটি বিশেষ দ্বীনি শরিয়তভিত্তিক মর্যাদার অধিকারী। তাঁদের অধিকার ও কর্তব্যসমূহও সাময়িক সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে নয় বরং দ্বীন ও শরিয়তের ভিত্তিতে নির্ধারিত। এ কারণে তাঁদের আনুগত্যের ব্যাপারটি ঠিক সাধারণ রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবৃন্দের আনুগত্যের সমপর্যায়ভুক্ত নয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরায়ে নূরের মাধ্যমে ইসলামের বিজয়ের যে শুভসংবাদ, বিশ্বজোড়া খেলাফতের যে ওয়াদা দেয়া হয়েছে তার আগে ঈমানদারদের যে পরিচয় দেয়া হয়েছে, তাতে আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখাবার কথাই উল্লিখিত হয়েছে। বলা হয়েছে, মুমিনদের একমাত্র পরিচয় হলো যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ থেকে কোনো ফরমান শুনার জন্য ডাকা হয় তখন তাদের মুখ থেকে মাত্র দু’টি শব্দই উচ্চারিত হয়। একটা হলো, আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম; দ্বিতীয়টা হলো, মাথা পেতে এই নির্দেশ মেনে নিলাম। এইরূপ দ্বিধাহীন নির্ভেজাল আনুগত্যই সাফল্যের চাবিকাঠি। কাদের বা কিসের আনুগত্য করব? ১.    আল্লাহ, রাসূল ও দায়িত্বশীলের ২.    সংবিধান, ঐতিহ্য ও কর্মনীতির ৩.    দায়িত্বশীলের পক্ষ থেকে দেয়া চিঠি, সার্কুলার ও ঘোষণার ৪.    সাংগঠনিক নিয়ম-শৃঙ্খলার ও সিদ্ধান্তের সাংগঠনিক নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সিদ্ধান্ত পালনের কতিপয় দিক ১.    সভায় উপস্থিতির যা সময় নির্ধারণ করা হয় তা যথাযথভাবে মেনে চলা। ২.    সভায় ছুটি ব্যতীত অনুপস্থিত না থাকা ৩.    সংগঠন থেকে প্রদত্ত অর্পিত দায়িত্ব পালন করা কষ্টকর হলেও তা মেনে নেয়া। ৪.    ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সংগঠনের স্বার্থকে বেশি মূল্যায়ন করা ৫.    পরামর্শ গ্রহণের পর কৃত সিদ্ধান্ত নিজের চিন্তার বিপরীত হলেও সিদ্ধান্তের আনুগত্য করা। সংগঠনের সিদ্ধান্ত ও নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যাপারে আরো স্বচ্ছ ধারণা অর্জনের জন্য হযরত কাআব ইবনে মালিক (রা) বর্ণিত হাদিসটি অধ্যয়ন করা যেতে পারে। যাতে তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ না করা সাহাবীদের সাথে রাসূল (সা) এর আচরণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আনুগত্যকারীর বৈশিষ্ট্য ১.    নির্দেশকৃত বিষয় মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা। দায়িত্বশীলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত তা মৌখিক হোক অথবা লিখিত হোক, আসার সাথে সাথে মনোযোগ দিয়ে তা জানার ও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য হৃদয় দিয়ে উপলব্ধির চেষ্টা করতে হবে। কোথাও কোনো ব্যাপারে অস্পষ্টতা থাকলে বা বুঝে না এলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে অস্পষ্টতা দূর করে সঠিক বুঝ নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। ২.    দায়িত্বশীলের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের সাথে আনুগত্য করা ৩.    ভালোবাসা, দরদ ও আন্তরিকতা পোষণ করা। ৪.    স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনুগত্য করার মানসিকতা তৈরি করা। ৫.    কৃত্রিমতা ও আনুষ্ঠানিকতা পরিহার করা ৬.    আনুগত্য করতে গিয়ে যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকা। ৭.    বিপদে পড়ে বা আবেগতাড়িত হয়ে নয়, বুঝে শুনে পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে আনুগত্য করা। ৮.    ওজর পেশ করার মানসিকতা পরিহার করা। আল কুরআনে ওজর পেশ করে কোনো নির্দেশ পালন থেকে অব্যাহতি চাওয়াকে ঈমানের পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যত্র যদিও অনুমতি প্রার্থনার সুযোগ দেয়া হয়েছে বটে কিন্তু আলোচনার ধরন-প্রকৃতি ভালোভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করলে দেখা যায়, অনুমতি চাওয়াকে অপছন্দ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে, তারা কখনো আল্লাহর পথে জানমাল দিয়ে জিহাদ করা থেকে আপনার কাছে অব্যাহতি চাইবে না। (সূরা তাওবা ৪৪) অপর দিকে সূরা নূরের ৬২ নম্বর আয়াতের শেষদিকে বলা হয়েছে, তারা যখন কোনো ব্যাপারে অনুমতি কামনা করে তাহলে তাদের মধ্য থেকে যাকে চান অনুমতি দিতে পারেন এবং লোকদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল ও দয়ালু। ওজর পেশের সঠিক পদ্ধতি হলো, ব্যক্তি নিজে এই ওজরের কারণে কাজ না করার ফয়সালা নেবে না। বরং শুধু সমস্যাটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত যাই আসুক শরিয়তবিরোধী না হলে তাতেই কল্যাণ আছে, এই আস্থা রাখা। ৯.    দায়িত্বশীলদের সামনে, সংগঠনের অনুষ্ঠানে খুব আনুগত্যশীল পরিচয় না দিয়ে বরং সকল অবস্থায় কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় আন্তরিকতার সাথে আনুগত্য করা জরুরি। আনুগত্যের ক্ষেত্রে বর্জনীয় ১.    খিটখিটে মেজাজ পরিত্যাগ করা। দায়িত্বশীলের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশ এসে গেলে তা মনঃপূত না হলে বা কষ্টদায়ক অনুভূত হলে অথবা নিজের জন্য ক্ষতিকর মনে হলে তখন কারো কারো মেজাজ এতটা অস্বাভাবিক হয়ে যায়, যেমনটি পরিলক্ষিত হয় ফুটন্ত তেলে পানির ফোঁটা পড়লে। আবার কারো কারো মেজাজে এর বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে না বটে, কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাঙের মতো ফুলতে থাকে। যার ফলে সংগঠনের কাজে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। জান্নাতপ্রত্যাশী একজন মুমিনকে এ অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ২.    তর্ক-বিতর্ক পরিহার করা। রাসূল (সা) বলেছেন- যারা নির্দেশ দেওয়ার অধিকার রাখে তাদের সাথে বিতর্কে জড়াবে না। (বুখারী ও মুসলিম)। ৩.    সংবাদদাতার কাছে রাগ প্রকাশ করা যাবে না। আনুগত্যের সীমা ১. সৎ কাজে আনুগত্য, অসৎ কাজে নয়। ইসলাম কখনো অন্ধ আনুগত্যের দাবি করে না। ইসলাম কেবল ‘সৎকর্মের’ ক্ষেত্রে আনুগত্য চেয়েছে। ‘সৎকমের্র’ সীমার বাইরে ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে : “গুনাহ ও আল্লাহ নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনমূলক কাজে পরস্পরের সহযোগী হয়ো না।” (সূরা মায়েদা : ২) হযরত আলী (রা) বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, গোনাহের কাজে কোনো আনুগত্য নেই। আনুগত্য শুধু নেক কাজের ব্যাপারে। (বুখারী ও মুসলিম) রাসূল (সা) আরো বলেন, গুনাহর নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নেতার নির্দেশ শ্রবণ ও পালন প্রত্যেকের জন্য অবশ্য কর্তব্য। গুনাহর নির্দেশ দেয়া হলে আনুগত্য পাওয়ার অধিকার তার নেই। (বুখারী) ইসলামী দল ও সংগঠনের অভ্যন্তরীণ তাগিদেই তার সদস্যবৃন্দকে দলীয় কার্যাবলির প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে এবং দলের পরিচালকগণকে সৎকর্মের সীমার বাইরে কদম রাখা থেকে বিরত রাখতে হবে। এ সম্পর্কে হযরত ওমর (রা) বলেছেন, ‘বন্ধুগণ! তোমাদের কেউ যদি আমার নীতি বা কাজে বক্র দেখে তাহলে আমার এই বক্রতাকে সোজা করে দেয়া তার কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে।’ এই প্রসঙ্গে কোনো খুঁটিনাটি ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দিলে, তা দূর করার জন্য তাকে পেশ করার, সে সম্পর্কে আলোচনা করার এবং সন্তোষজনক প্রত্যুত্তর না পেলে তার ওপর অবিচল থাকার শরিয়তভিত্তিক অধিকারও দলের সদস্যবর্গের আছে। কিন্তু পরিচালকবৃন্দের পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত কার্যকরী হয়, একমাত্র তারই আনুগত্য করতে হবে। আমার মতের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো কেন? এবং আমি যে দৃষ্টিতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি সে দৃষ্টিতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়নি, নিছক এতটুকু কারণে আনুগত্য অস্বীকার করা যেতে পারে না। আনুগত্যের শৃঙ্খলা একমাত্র তখনই ছিন্ন করা যেতে পারে যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ভাষায় ইসলামের পথ ছেড়ে পরিষ্কারভাবে অন্য পথ অবলম্বিত হয়। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে হক পথে রাখার জন্য তাঁদের সমালোচনা করাও কর্মীদের একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু অন্যান্য দলে সন্দেহ ও সংশয়ের ভিত্তিতে সমালোচনা করার নীতি স্বীকৃত হলেও ইসলামী দলের জন্য এ নীতি অনৈসলামিক বলে বিবেচিত হয়। ইসলামী দলে সমালোচনা হয় সুধারণার ভিত্তিতে। এখানে আপত্তি ও অভিযোগের পরিবর্তে কল্যাণকামিতা ও সৎপরামর্শের সুর ধ্বনিত হয়। অন্যায় সমালোচনার একটি বড় আলামত হচ্ছে এই যে, তা আনুগত্যের পথে বাধা সৃষ্টি করে। কোন ব্যক্তি এ পথে পা বাড়ানোর পর প্রকাশ্য অন্যায় আচরণে লিপ্ত হয়। কাজেই আনুগত্য ও সমালোচনার পৃথক পৃথক সীমানা রয়েছে এবং নিজেদের সীমানার মধ্যেই তাদের অবস্থান করা উচিত। আল্লাহর নাফরমানি ছাড়া আর কোনো বস্তু আনুগত্যকে খতম করতে পারে না। (চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান) ২. সীমালঙ্ঘনমূলক কাজে আনুগত্য না করা। রাসূল (সা) বলেছেন- স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। (বুখারী) ৩. দায়িত্বশীল সরাসরি কুরআন-সুন্নাহর বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত আনুগত্য লঙ্ঘন করা যাবে না। যতক্ষণ নেতৃবৃন্দ কুরআন ও সুন্নাহর পথ থেকে প্রকাশ্যভাবে সরে না দাঁড়ান ততক্ষণ তাঁদের নির্দেশ লঙ্ঘন করা অথবা সানন্দে ও সাগ্রহে তাঁদের আনুগত্য করার পরিবর্তে অসন্তুষ্টচিত্তে আনুগত্য করা, অথবা তাঁদের কল্যাণ কামনা করার পরিবর্তে তাঁদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ করা, তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা, তাঁদের গিবত করা, তাঁদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টি করা, তাঁদেরকে যথার্থ অবস্থা ও ঘটনাবলি সম্পর্কে অবগত না করা, সঠিক পথে চলার জন্য নির্ভুল পরামর্শ দানের ব্যাপারে কার্পণ্য করা এবং তাঁদের গোপন কথাসমূহ প্রকাশ করে বেড়ানো কবিরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত হবে। এগুলো এমন পর্যায়ের কবিরা গুনাহ যে, এগুলোর কারণে ইবাদত-বন্দেগি অনুষ্ঠান ও সাধারণ চরিত্র সংশোধন সত্ত্বেও মানুষের আখেরাত বিনষ্ট হতে পারে। এই ভয়াবহ অবস্থা মানুষকে মুনাফেকির পর্যায়ে নামিয়ে দিতে পারে। তাই ইসলামী দল ও সংগঠনের মধ্যে অবস্থানকারীদের আনুগত্যের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। (চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান) আনুগত্য না করার কারণ কী বা কিসে আনুগত্য নষ্ট করে? ১. আখেরাতের জবাবদিহির অনুভূতির অভাব এবং আখেরাতের জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয়ার মনোভাবই আনুগত্যহীনতার প্রধানতম কারণ। আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদার লোকেরা! তোমাদের কী হয়েছে যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে বের হতে বলা হলো তোমরা মাটি কামড়িয়ে পড়ে থাকলে? তোমরা কী আখেরাতের মোকাবেলায় দুনিয়ার জীবনকেই পছন্দ করে নিলে? যদি এমনই হয়ে থাকে তাহলে জেনে নিও, দুনিয়ার এসব বিষয়সামগ্রী আখেরাতে অতি তুচ্ছ ও নগণ্য হিসেবে পাবে। (সূরা আত তাওবা : ৩৮) বরং তোমরা তো দুনিয়ার এই পার্থিব জীবনকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাক। অথচ আখেরাতের জীবনই উত্তম ও স্থায়ী। (আল আ’লা : ১৬-১৭) তোমাদেরকে বেশি বেশি করে দুনিয়া ভোগ করার প্রবণতা এবং একে অপরকে এই ব্যাপারে ডিঙিয়ে যাওয়ার মানসিকতা গাফিলতির মধ্যে নিমজ্জিত করে রেখেছে। (সূরা আত তাকাসুর : ১) ২. গর্ব, অহঙ্কার, আত্মপূজা ও আত্মম্ভরিতা। গর্ব-অহঙ্কার মূলত ইবলিসি চরিত্র। ইবলিস আল্লাহর হুকুম পালনে ব্যর্থ হলো অহঙ্কারের কারণে। আল কুরআনের ঘোষণা, আল্লাহ কখনো অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা লোকমান : ১৮) হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, আল্লাহ বলেন, অহঙ্কার তো আমার চাদর (একমাত্র আমার জন্যেই শোভনীয়)। যে অহঙ্কার করে, সে প্রকৃতপক্ষে আমার চাদর নিয়েই টানাটানি করতে ব্যর্থ প্রয়াস পায়। মানুষের দুর্বলতার এই ছিদ্রপথ বেয়ে ইবলিস সুযোগ গ্রহণ করে, তার মনে আবার হাজারো প্রশ্ন তুলে দেয়- সিদ্ধান্ত কে দিল? হুকুম আবার কার মানব? আমি কী, আর সে কে? এই অবস্থায় মানুষের উচিত ইবলিসের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া, তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা। এটা একটা রোগ মনে করে, ইবলিসি প্রতারণা মনে করে কেউ যদি কাতরকণ্ঠে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় তাহলে আল্লাহ সে ফরিয়াদ শুনে থাকেন, তাঁর বিপন্ন বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন। আল্লাহ পাকের ঘোষণা, যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো উসকানি অনুভব কর, তাহলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা কর। তিনি তো অবশ্য সব কিছু শোনেন এবং জানেন। (সূরা হা-মিম আস সাজদা : ৩৬) ৩. হিংসা-বিদ্বেষ করা। নবী করীম (সা) এ মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কেননা আগুন যেমনিভাবে লাকড়িকে খেয়ে ফেলে, হিংসা তেমনিভাবে নেকি ও পুণ্য খেয়ে ফেলে।’ (বুখারী) ৪. হৃদয়ের বক্রতা যা সাধারণত সৃষ্টি হয়ে থাকে দায়িত্ব এড়ানোর কৌশলস্বরূপ নানারূপ জটিল-কুটিল প্রশ্ন তোলার বা সৃষ্টির মাধ্যমে। যেমনিভাবে হযরত মূসা (আ)কে তার কওমের লোকেরা করেছিল। (সূরা আস সফ : ৫) ৫. অন্তরের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয়-সন্দেহের প্রবণতা। সাধারণত এই মানসিকতা জন্ম লাভ করে লাভ-ক্ষতির জাগতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও হিসাব-নিকাশের প্রবণতা থেকেই, যা পরিণামে আনুগত্যহীনতা জন্ম দিয়ে থাকে। (সূরা আল হাদিদ : ১৩-১৪) ৬. সিনিয়রিটি-জুনিয়রিটি মনোভাব এ মনোভাবটি শয়তানের আরেক চক্রান্তের নাম। এ সমস্যার খলনায়ক হলো শয়তান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউ কারো সিনিয়র হলে, সংগঠনে যোগদানের দিক থেকে সিনিয়র হলে, ডিগ্রি নেয়ার দিক থেকে সিনিয়র হলে, বয়সের দিক থেকে সিনিয়র হলে, দায়িত্বপালনের দিক থেকে এককালে সিনিয়র থাকলে, কোন জায়গায়, প্রতিষ্ঠানে বা দেশে অবস্থানের দিক থেকে সিনিয়র হলে, অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ব্যক্তিটি দায়িত্বশীল হলে সিনিয়র ব্যক্তিদের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। অথচ রাসূলে করীম (সা) ১৭-১৮ বছরের যুবক উসামা (রা)কে এক যুদ্ধের সেনাপতি বানিয়ে হযরত আবু বকর (রা) হযরত ওমর (রা)সহ বড় বড় সাহাবীকে তাঁর অধীনে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়েছেন। কই সেদিন তো সিনিয়র সাহাবীগণ কোনো প্রশ্ন তুলেননি। বরং আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে গেছেন। ৭. নেতৃত্বের অভিলাষ বা পদের প্রতি লোভ পদের প্রতি লোভী ব্যক্তি আনুগত্য করার ক্ষেত্রে ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি পরোক্ষভাবে নেতৃত্বের পদে আসীন হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করে, যা তার কথাবার্তায়, আচার-আচরণে ও সমালোচনায় বোঝা যায়। রাসূল (সা) বলেছেন, আল্লাহর শপথ! আমরা এমন কোনো লোকের ওপর এই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করবো না, যে এর প্রার্থী হয়, অথবা এর আকাক্সক্ষা পোষণ করে। (বুখারী ও মুসলিম) এ ব্যাপারে সতর্ক করে রাসূল (সা) আরো বলেন, হে আবদুর রহমান ইবনে সামুরাহ! নেতৃত্বের পদপ্রার্থী হয়ো না। কারণ প্রার্থী না হয়ে নেতৃত্ব প্রদত্ত হলে তুমি এ ব্যাপারে সহযোগিতা পাবে। আর প্রার্থী হয়ে নেতৃত্ব পদ পেলে তোমার ওপর যাবতীয় দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হবে।     (বুখারী ও মুসলিম) ৮. দায়িত্বশীল পছন্দ না হওয়া অনেকে পছন্দ-অপছন্দের মাপকাঠিতে আনুগত্য করতে চায় যা ইসলামী শরিয়তে নাজায়েজ। কে দায়িত্বশীল, দেখতে কেমন, কতটুকুন লেখাপড়া জানে, যোগ্যতা কতটুকু, বক্তা হিসেবে কেমন, কোন পরিবারের, চেহারা-সুরত কেমন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কেমন, কোন এলাকার- এই জাতীয় বিষয়গুলো সামনে রেখে যারা দায়িত্বশীলের আনুগত্য করতে চায়, তাদের এ আনুগত্যের কোনো মূল্য আল্লাহ ও রাসূলের কাছে নেই। ৯. সন্দেহ প্রবণতা দায়িত্বশীলের ব্যাপারে যদি কেউ সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেন তাহলে ঐ ব্যক্তির পক্ষে আনুগত্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর সন্দেহ প্রবণতা সৃষ্টি করা হচ্ছে শয়তানের কাজ। রাসূল (সা) বলেছেন, সাবধান! সন্দেহ প্রবণতা থেকে বেঁচে থাক। সন্দেহ প্রবণতা বা ধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা কথা।       (বুখারী ও মুসলিম) ১০. মতামতের কোরবানি করতে না পারা। ১১. নিজেকে অতীব যোগ্য মনে করা ১২. সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী মনমানসিকতা ১৩. মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্ন ১৪. দায়িত্বশীলের সাথে সম্পর্কের তিক্ততা ১৫. মেজাজের ভারসাম্যহীনতা ১৬. মানোন্নয়নে বিলম্ব হওয়া। অনুসরণীয় আনুগত্যের কতিপয় দৃষ্টান্ত ১. আনুগত্যের ব্যাপারে সর্বাগ্রে হযরত আবু বকর (রা)-এর নাম উল্লেখ করা যায়। যিনি রাসূল (সা)-এর পক্ষ থেকে হিজরতের ইঙ্গিত পেয়ে দীর্ঘ ছয় মাস ধরে দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে রাসূলের অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন। ২. হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) হযরত ওমর ফারুক (রা) এর নির্দেশ পেয়ে যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় সেনাপতির শিরস্ত্রাণ খুলে নতুন সেনাপতির মাথায় পরিয়ে দিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন। সেই দিন আমীরের নির্দেশ মেনে নিতে মুসলিম জাহানের প্রধান সেনানায়ক খালিদ (রা) কোন রিয়্যালিটি বা বাস্তবতার কথা বলেননি বা প্রশ্নের অবতারণাও করেননি বরং দ্বিধাহীনচিত্তে নেতার আনুগত্য করেন। ৩. হযরত আবু জান্দাল (রা) মক্কার কুরাইশদের দ্বারা নির্যাতিত অবস্থায় শিকল নিয়ে হুদায়বিয়ার সন্ধিস্থলে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর নবী ও তাঁর সাহাবীদের নিকট আশ্রয় চেয়েছিলেন। রাসূল (সা) সন্ধি রক্ষার খাতিরে হযরত আবু জান্দাল (রা)কে আবারো মক্কায় ফেরত যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবু জান্দাল (রা) ও উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে মনের কষ্ট চাপা দিয়ে সে দিন রাসূল (সা)-এর নির্দেশ মেনে নিয়েছিলেন। আনুগত্যহীনতার পরিণাম ১. কিয়ামতের দিন আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো দলিল থাকবে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) রাসূলে পাক (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় কিংবা আনুগত্যের বন্ধন থেকে হাত খুলে নেয় সে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, (নিজেকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার জন্য) নিজের আত্মপক্ষ সমর্থনে তার বলার কিছুই থাকবে না। আর যে ব্যক্তি বাইয়াত ছাড়া মারা যাবে তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। (মুসলিম)। ২. আনুগত্য প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে হেদায়েত লাভের আল্লাহপ্রদত্ত তৌফিক থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা রাসূলের আনুগত্য কর, তাহলে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে। আর আমার রাসূলের দায়িত্ব তো শুধুমাত্র দীনের দাওয়াত সুস্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়া।’ (সূরা আন নূর : ৫৪) ৩. আনুগত্যহীনতা সমস্ত নেক আমলকে বরবাদ করে দেয়। আল কুরআন ঘোষণা করেছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের অনুসরণ কর আর নিজেদের আমল বিনষ্ট করো না।’ (সূরা মুহাম্মদ : ৩৩) নবী (সা)-এর পেছনে জামায়াতের সাথে নামাজ পড়েছে তারাই যখন যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ অমান্য করল, তাদের সমস্ত আমল ধুলায় মিশে গেল। আল্লাহ তাদেরকে মুনাফিক নামে ঘোষণা করলেন। ৪. আনুগত্যহীনতা জামায়াত ত্যাগের শামিল এবং এর পরিণাম হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। রাসূল (সা) বলেছেন, যে আনুগত্যের গন্ডি থেকে বের হয়ে যায় এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অতঃপর মৃত্যুবরণ করে, তার মৃত্যু হয় জাহেলিয়াতের মৃত্যু (মুসলিম) ৫. আনুগত্যহীনতা জামায়াত ত্যাগের শামিল। রাসূল (সা) বলেছেন, যদি কেউ তার আমীরের মধ্যে অপছন্দনীয় কোন কাজ দেখতে পায় তাহলে যেন সবর করে। (আনুগত্য পরিহার না করে)। কেননা যে ইসলামী কর্তৃপক্ষের আনুগত্য থেকে এক বিঘত পরিমাণ সরে যায় বা বের হয়ে যায়, তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। রাসূলুল্লাহ (সা) এ কথাও বলেছেন যে, আমীরের এই আনুগত্যের এই দাবিকে যারা অস্বীকার করবে, তারা বিপুল তাকওয়ার অধিকারী হলেও আখেরাতে তাদের সাফল্যের কোনো সম্ভাবনা নেই। ৬. সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা হবে। সংগঠনের মজবুতি নষ্ট হবে। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ভালোবাসেন যারা সীসাঢালা প্রাচীরের মতো অটল থেকে সুশৃঙ্খলভাবে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে।           (সূরা সফ : ৪) আনুগত্যের পরিবেশ সৃষ্টিতে দায়িত্বশীলদের ভূমিকা জনশক্তিকে আনুগত্যের বলয়ে রাখতে দায়িত্বশীলদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি : ১.    সর্বপর্যায়ের জনশক্তির সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করা।              ( সূরা আন নাহল : ৯০) ২.    জনশক্তিকে কুরআন সুন্নাহ থেকে সংগঠন বুঝতে প্রেরণা দেয়া।   (সূরা যুমার : ৯) ৩.    জনশক্তির প্রতি নম্র, কোমল ও রহমদিল হওয়া।                  (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯) ৪.    জনশক্তির দোষ-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা।                   (সূরা আশ শূরা : ৪৩) ৫.    পরামর্শভিত্তিক সংগঠন পরিচালনা করা। (সূরা আশ শূরা : ৩৮) আনুগত্যের পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী তার লেখা ‘ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন’ বইয়ে তিনটি উপকরণের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এগুলোকে রূহানি উপকরণ বলেও উল্লেখ করেছন। যার ফলে আনুগত্যের ক্ষেত্রে রূহানি পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে থাকে। ১. সর্বপর্যায়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিগতভাবে এবং সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে। এই পথে উন্নতির জন্য প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনার সাথে এই আনুগত্যের মান বাড়ানোর চেষ্টা করবে। ২. কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় বডির সিদ্ধান্তের প্রতি নিষ্ঠার সাথে শ্রদ্ধা পোষণ করবে। অত্যন্ত যতœসহকারে তা বাস্তবায়নের প্রয়াস চালাবে। আর অধস্তন সংগঠনের নেতৃত্বের দায়িত্বে যারা থাকবে তাদের ঊর্ধ্বতন সংগঠনের, ঊর্ধ্বতন নেতার আনুগত্যের ব্যাপারে আদর্শ স্থাপনের প্রয়াস পেতে হবে। ৩. যাদের সাথে নিয়ে সংগঠন পরিচালনা করা হচ্ছে, যাদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়, তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করা অভ্যাসে পরিণত হতে হবে। এ ছাড়া নেতৃত্বে যারা থাকবে বা সংগঠন যারা পরিচালনা করবে, তাদেরকে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কয়েকটি ব্যাপারে অগ্রগামী হতে হবে। নিজস্ব সহকর্মী, সাথী-সঙ্গীর গন্ডি পেরিয়ে সাধারণ মানুষও তাদের এই অগ্রগামী ভূমিকা বাস্তবে উপলব্ধি করবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা স্বীকারও করবে। ১.    ঈমানী শক্তি ও ঈমানের দাবি পূরণের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ২.    ঈমানী শক্তি অর্জন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ৩.    আমল, আখলাক ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ৪.    সাংগঠনিক যোগ্যতা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ৫.    মাঠে-ময়দানের কর্মতৎপরতা ও ত্যাগ, কোরবানি ও ঝুঁকি নেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী। উল্লিখিত পাঁচটি ব্যাপারে কোনো নেতা বা পরিচালক অগ্রগামী হলে তার প্রতি কর্মী তথা সাধারণ মানুষের মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভক্তি শ্রদ্ধা সৃষ্টি হতে বাধ্য। এই ভক্তি শ্রদ্ধার সাথে দ্বীনি আবেগ জড়িত হওয়াটাও একান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। নেতা এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারলেই কর্মীরা তাকে প্রাণঢালা ভালোবাসা, তার জন্যে প্রাণ খুলে দোয়া করে। তার কথায় সাড়া দিতে গিয়ে যে কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হয় দ্বিধাহীনচিত্তে। আসলে আনুগত্যের সুন্দর শৃঙ্খল সংগঠনের মাঝে সীসাঢালা প্রাচীর তৈরি করে এবং সংগঠনের অভ্যন্তরে জান্নাতি পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আনুগত্যের সঠিক স্পিরিট বুঝে সে আলোকে আন্দোলনে ভূমিকা রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির