post

নামাজ কেন শ্রেষ্ঠ ইবাদত

জাফর আহমাদ

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

আল্লাহর তামাম সৃষ্টির মধ্যে মানুষের মর্যাদা সর্বোচ্চ। কারণ মানুষ তার মর্যাদার প্রতীক মাথা আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে নত করে না। আল্লাহ ছাড়া নিজের কপাল ও নাক অন্য কারো সামনে লুটিয়ে দেয় না। মানুষের মাথা, কপাল, কান ও নাককে মান-ইজ্জত ও মর্যাদার প্রতীক মনে করা হয়। যেমন আমাদের সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত কিছু উক্তি এ রকম শোনা যায় যে, মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির বেলায় ‘লোকটি সমাজ ও বংশের মাথা, অপমানিত হলে ‘তার জন্য লোকটির মাথা হেঁট হয়ে গেছে’ অথবা সম্ভ্রমহানি হলে ‘মাথা কাটা গেছে’ কেহ পরাজিত হলে ‘শেষ পর্যন্ত লোকটি নাকে খত দিতে হলো, অহংবোধ থাকলে ‘লোকটি নাক উঁচু করে চলে’ মর্যাদা হানি হলে ‘লোকটির কপাল পুড়েছে’ ইত্যাদি। মর্যাদার এ কয়টি প্রতীককে মর্যাদাবান ব্যক্তিরা সর্বস্ব দিয়ে হলেও মর্যাদার হানি হতে দেয় না। যেমন বলা হয় ‘জান দিয়েগা মগর শির নেহি দিয়েগা।’ যেহেতু মানুষ আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার কোন ব্যক্তি বা অন্যান্য সৃষ্টি জীবের সামনে এগুলোকে নত করে দেয় না, সে জন্যই মানুষের এত মর্যাদা। অবশ্য যারা নিজের পরিচয় জানতে পারেনি বা নিজের মর্যাদা সম্পর্কে বেখেয়াল, একমাত্র তারাই আল্লাহ তা’আলার অন্যান্য সৃষ্টির সামনে নিজের মস্তক অবনত করে দেয়। অথচ এগুলোও তার মতোই আল্লাহর সৃষ্টিকুলের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের উপকারের জন্য তার অনুগত করে সৃষ্টি করা হয়েছে। পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু আল্লাহর কাছে মাথা নত করে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন- “আকাশ ও জমিনে যা কিছু আছে, সবাই আল্লাহর সেজদা করে।” (সূরা রা’আদ : ১৫) আল্লাহর দেয়া ইবাদাতগুলোর মধ্যে নামাজ শ্রেষ্ঠ ইবাদত। কারণ মানুষ নামাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সামনে আপাদমস্তক অবনত করে দেয় এবং তাঁরই শাহি দরবারে গোটা অবয়বই লুটিয়ে দেয়। সৃষ্টির সার্থকতা এখানেই পরিস্ফুট হয় বিধায় মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীবে পরিণত হয়েছে। অপর দিকে যেহেতু একমাত্র নামাজের মাধ্যমেই এর প্রতিফলন ঘটে অর্থাৎ একমাত্র নামাজের মাধ্যমেই মানুষ তার মর্যাদার সকল প্রতীককে আল্লাহর সামনে বিনা দ্বিধায় নত করে দেয়, সে জন্য অন্যান্য ইবাদাতের তুলনায় নামাজ শ্রেষ্ঠ ইবাদাতে পরিণত হয়েছে। আল-কুরআনের কোন কোন স্থানে শুধুমাত্র রুকু ও সেজদাকেই নামাজ বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন- “তুমি সেজদা করো এবং (তোমার রবের) নৈকট্য অর্জন করো।” (সূরা আলাক : ১৯) আল্লাহ আরো বলেন- “তোমরা রুকু করো এবং সেজদা করো।” (সূরা হজ : ৭২) দু’টি আয়াতেই সেজদা করা মানে নামাজ পড়া। আমরা নিয়মিত যে স্থানটিতে সালাত আদায় করে থাকি সেটিকে মসজিদ তথা সেজদার স্থান বলা হয়। অর্থাৎ মাথা অবনত করার স্থান। অথচ সালাতের স্থান হিসাবে এর নাম মুসল্লাহ প্রচলিত হতে পারতো। প্রকৃত পক্ষে গোটা নামাজে সেজদা এমন একটি কর্ম যার মাধ্যমে মানুষ তার সকল প্রকার অহংবোধ, অথবা সব মর্যাদা, আভিজাত্য, আমিত্ব, গর্ব-অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, মান-অভিমানকে এক পেশে ঠেলে দিয়ে সারা জাহানের প্রভু, পরম দয়ালু মনিব, সার্বভৌম ক্ষমতার নিরঙ্কুশ মালিক, পরাক্রমশালী রাজাধিরাজ, ইজ্জত-অপমানের একমাত্র মালিকের সামনে মর্যাদার প্রতীক তথা মাথা, কপাল ও নাক মাটিতে লুটিয়ে দেয়। আনুগত্যের এ সুন্দর দৃশ্যটি নামাজ ব্যতীত অন্য কোন ইবাদাতে সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয় না। এমনকি নামাজের অন্যান্য কর্মেও সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় না বিধায় নামাজ শ্রেষ্ঠ ইবাদাতে পরিণত হয়েছে। সেজদার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ রাবুল আলামিনের সমীপে আরজ করি “তুমি সকল প্রকার দুর্বলতা, অক্ষমতা, অপারগতা, অংশীদারিত্ব থেকে পবিত্র। আমি দুনিয়ার সকল কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র তোমারই সামনে আমার সকল কিছু উৎসর্গ করে দিয়ে আমি তোমার মহানত্ব ও সর্বশ্রেষ্ঠত্বের পবিত্রতা ঘোষণা করছি।” সেজদার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সবচেয়ে নিকটে চলে যায়। এর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর রহমতের সব চাইতে নিকটবর্তী হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তুমি সেজদা করো এবং (তোমার রবের) নৈকট্য অর্জন করো।” (সূরা আলাক : ১৯) এ কারণে রাসূল (সা.) একাকী নামাজ পড়ার সময় দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত সিজদায় পড়ে থাকতেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদিসে উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে : “বান্দা সিজদায় থাকা অবস্থায় তার রবের সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী হয়।” (সহীহ মুসলিম) সর্বোপরি ইসলামের গোটা রূপটিই এখানে দৃশ্যমান হয়। ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ। সেজদা হলো এ আত্মসমর্পণের বাস্তবরূপ। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক হলো মনিব-গোলাম। মনিব- গোলামের এ সম্পর্কের বাস্তবরূপ দেখার জন্য সেজদাই হলো উপযুক্ত কর্ম। কপাল-নাক মাটিতে রেখে গোটা দেহ সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে দিয়ে গোলাম তার মহান মনিবের নিকট ধরনা দেয়ার এ সত্যিই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয় আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই গোলামি করো এবং আমার কথা সর্বদা মনে রাখার জন্য নামাজ কায়েম কর।” (সূরা ত্বাহা : ১৪) এ আয়াতটিতে প্রথমেই আল্লাহর উলুহিয়াত ও উবুদিয়াত এর সার্বক্ষণিক স্মরণ রাখার জন্য নামাজের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত : আল্লাহকে ইলাহ তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে এ কথা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় যে, মানুষ আল্লাহকে মালিকরূপে মেনে নিয়েছে, আজীবন তাঁর আবদ বা বান্দাহ্ বা গোলাম হয়ে থাকবে। আর উবুদিয়াতের বাস্তব প্রতিফলন বা প্রদর্শনী বা গোলাম হিসেবে বেঁচে থাকার নামই সালাত। সালাতের মধ্যে রুকু ও সেজদাই সবচেয়ে বেশি উবুদিয়াতের প্রতিফলন ঘটায়। নামাজের মাধ্যমে আনুগত্যের এ প্রশিক্ষণ ব্যক্তির সালাতের বাইরের সকল প্রকার কাজকে ইসলামের আলোকে সুসংহত করে। একজন ব্যক্তি ঈমান গ্রহণ করে ইসলামের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করার পর পরই তার প্রথম ও প্রধান বাধ্যতামূলক কাজ হলো নামাজ আদায় করা। ঈমান গ্রহণের পর যে নামাজই সামনে আসবে তা তাকে আদায় করতে হবে। দুনিয়ার যাবতীয় কাজ আল্লাহর বান্দাহ্ হিসাবে করতে হবে। এ অনূভূতিকে বারবার জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে তুলবে নামাজ। আল্লাহ তা’আলা বলেন : “নামাজ আদায় করার পর জমিনে ছড়িয়ে পড়ো আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে ব্যাপৃত হও এবং আল্লাহকে খুব স্মরণ করো। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (সূরা জুমা : ১০) নামাজ প্রতিদিন ধনী-দরিদ্র, রাজা-ফকির সকলকে একই সত্তার সামনে নিজের নাক-কপাল ও মাথা লুটিয়ে দিয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। সকলেই এখানে একই কায়দায় নিজেদের সকল প্রকার গর্ব-অহংকার, আভিজাত্য ও মর্যাদার উঁচু-নিচুকে সমান করে একই রাজাধিরাজের কাছে ধরনা দিয়ে থাকে। যে রাজাধিরাজ কোন ব্যক্তির প্রভাব প্রতিপত্তি, বিশেষ মর্যাদা ও উঁচু-নিচুর শ্রেণীবিন্যাস করেন না। এবং তাঁকেও কোন ব্যক্তি কখনো তার বিশেষ মর্যাদার প্রভাবে প্রভাবিত করতে পারেন না। কুরআন ও হাদিসে নামাজের কথা এত বেশি উদ্ধৃত হয়েছে যা অন্য কোন ইবাদতের বেলায় দেখা যায় না। রাসূল (সা.) বলেছেন, “সালাত মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে।” যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন- “তারা যদি কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করে খাঁটিভাবে ঈমান আনে এবং নামাজ কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই হিসাবে গণ্য হবে।” (সূরা তাওবা : ১১) এ নামাজের কথা বলে বলে নবী আকরাম (সা.) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সুতরাং নামাজের অন্যান্য আহকামসহ বিশেষ করে রুকু ও সেজদার সময় যদি আমরা মনে রাখতে পারি যে, আমরা কার সামনে এ মর্যাদার প্রতীককে লুটিয়ে দিচ্ছি। তাহলে আমাদের নামাজের সার্থকতা সর্বকাজে প্রতিফলিত হবে। লেখক : ইসলামী গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির