post

পরাভূত হতে না চাইলে রাগ নিয়ন্ত্রণ ও ক্রোধ দমন করুন

মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত

১৩ অক্টোবর ২০১৬
জীবন চলার পথে মানুষকে অনেক নেতিবাচক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কেউ পারেন না। যারা পারেন তারা কাজের সফলতা নিয়ে ঘরে ফিরেন। আর যারা পারেন না তারা জীবনযুদ্ধে পরাভূত হন। মানুষের যেসব নেতিবাচক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো রাগ নিয়ন্ত্রণ ও ক্রোধকে দমন করা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে অনেক মানুষই এই রাগ ও ক্রোধ নামক বিধ্বংসী ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণ কিংবা দমন করতে পারেন না। ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’- যারা প্রসিদ্ধ এই স্লোগানে বিশ্বাস করেন তারাও রাগ করেন। হেরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করেন। তারা যেমন রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তেমনি পারেন না ক্রোধকে দমন করতে। ছাত্রজীবন কি চাকরিজীবন, অ্যাকাডেমিক ব্যস্ততা কি পারিবারিক, সামাজিক কিংবা সাংগঠনিক ব্যস্ততা- এসবের মাঝে যারা রাগ ও ক্রোধের মতো মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত তারা কোনোভাবেই সফল হন না কিংবা সফলতার কাছে গিয়েও তাদের অর্জন ফসকে যায়। মানবতার মহান শিক্ষক রাসূলে আকরাম সা:ও রাগ বর্জন করার নসিহত করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করিম সা:-এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অল্প কথায় কিছু নসিহত করুন। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, রাগ বর্জন করো। সাহাবি কয়েকবার বললেন, আরও নসিহত করুন। প্রত্যেকবারই রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, রাগ বর্জন করো। (বোখারি) রাগ এবং ক্রোধ দু’টি পরস্পরের পরিপূরক। বলা যায় মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। রাগ হলো ক্রোধের প্রাথমিক অবস্থা। এটি মানুষের এক সহজাত অনুভূতি। মানুষের জীবনে উত্থান-পতনের সাথে সাথে এক ধরনের মনোস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো চাপ ক্ষণস্থায়ী, কোনটা বা একটু দীর্ঘস্থায়ী হয়। চাপ যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, যখন মানুষের চাওয়া পাওয়া আর তার নিজের মতো করে এগোয় না, তখন তার মধ্যে এক ধরনের নৈরাশ্য সৃষ্টি হয়। সময়ের সাথে সাথে নৈরাশ্য কেটে কিছু কিছু মানসিক ক্ষত সেরে ওঠে বা ব্যক্তি আত্মসংযমবলে ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক হয়ে কিছু বিষয় নিজেই সামলে নেয়। তবে যখন মানুষ ব্যর্থ হয় তথা এই নৈরাশ্য কিংবা মনোস্তাত্ত্বিক সমস্যা জীবনের অন্যান্য সাধারণ কর্মকাণ্ডের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারে বা বিভিন্ন ধরনের বাধার সম্মুখীন হয় তখন তার মাঝে রাগ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। রাগ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশের আরো কিছু কারণ আছে। মানুষ যখন হতাশা, অসন্তুষ্টি, অপছন্দ বা কোনোরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয় বা কোনো ভীতিকর অবস্থায় পড়ে তখনও রাগ-ক্রোধের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও মানুষ যখন কোনো কারণে দুঃখ পায় কিংবা একাকিত্বে ভোগে তখন একেকজন একেকভাবে তার রাগকে প্রকাশ করে। রাগ মানুষের শরীরে এক ধরনের এডরিনালাইন হরমোন নিঃসরণ করে, যার ফলে পেশিসমূহে উত্তেজনা, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি ও ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক সমস্যা-সঙ্কট ও ঝগড়া-বিবাদ, মাদকাসক্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অন্যায়-অবিচার-জুলুম, প্রিয়জন দ্বারা কটাক্ষের শিকার, প্রতিহিংসা, আত্মসম্মানে আঘাত ইত্যাদি কারণেও ব্যক্তির মানসিক চাপ এবং ক্ষেত্রবিশেষে মনোস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা বাড়ে, যার ফলে রাগ বা ক্রোধের সৃষ্টি হয়। মুক্ত বিশ্বকোষ ডরশরঢ়বফরধতে রাগ বা ক্রোধ সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ “অহমবৎ ড়ৎ ৎিধঃয রং ধহ রহঃবহংব বসড়ঃরড়হধষ ৎবংঢ়ড়হংব. ওঃ রং ধহ বসড়ঃরড়হ ঃযধঃ রহাড়ষাবং ধ ংঃৎড়হম ঁহপড়সভড়ৎঃধনষব ধহফ বসড়ঃরড়হধষ ৎবংঢ়ড়হংব ঃড় ধ ঢ়বৎপবরাবফ ঢ়ৎড়াড়পধঃরড়হ যঁৎঃ ড়ৎ ঃযৎবধঃ.” মানুষের জীবনে রাগ অতি স্বাভাবিক এক অনুভূতি। তবে সমস্যা তখনই যখন মানুষ তা যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে না পারে। একজন ব্যক্তি ততখানি সফল যতখানি সুচারুরূপে তিনি জীবনের নানা নেতিবাচক দিকগুলো ঠাণ্ডা মাথায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আমরা যখন রেগে যাই তখন পূর্বাপর চিন্তা না করেই উদ্ভট কিছু বলে ফেলি বা করে ফেলি। এর মাশুল গুনতে হয় পরে অনুশোচনা করে বা সুযোগ হাতছাড়া করে। নিজের জীবন অনুসন্ধান করলে হয়তো দেখতে পাবো আমাদের জীবনের অনেক সুযোগ নষ্টের পেছনে রয়েছে এই রাগ ও ক্রোধ। সাফল্যের অন্তরায় হিসেবে রাগ ও ক্রোধকে সাফল্য পাওয়া শ্রেষ্ঠ মানুষেরা সবসময়ই শনাক্ত ও দায়ী করেছেন। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, রাগের মাথায় কিছু করলে তার ফল কখনই ভালো হয় না। কাজের ক্ষেত্রে নিজের পক্ষ থেকে স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ক্রোধ সংবরণ করতে হবে। আপনি যদি দায়িত্বশীল কিংবা কর্তব্যশীল হোন তাহলে তা আরো বেশি জরুরি। কারণ অধস্তনকে পরিচালনা করতে গিয়ে রাগ কিংবা ক্রোধের কারণে আপনিই যদি পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেন তাহলে পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে আপনি যেই আস্থার জায়গায় অবস্থান করছেন তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ক্রোধ সংবরণ করা সম্পর্কে বিজ্ঞানময়গ্রন্থ আল কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগ সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরই ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ১৩৪) রাগ-ক্রোধ পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট করে। পরিবারের সদস্য, বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশী বা যেকোনো মানুষই একজন রাগীকে এড়িয়ে চলতে চায় এবং তাকে কেউ পছন্দও করে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাগ-ক্রোধ লালনকারী ব্যক্তির সঙ্গে অন্যদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কারণ রাগী ব্যক্তির সামনে কেউ মন খুলে কথা বলতে চায় না, এমনকি যুক্তিতর্কেও লিপ্ত হতে চায় না। এটা পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য ইতিবাচক নয়। যারা কর্তৃত্বশীল বা দায়িত্বশীল তারা রাগ এবং ক্রোধের মাধ্যমে সমাজ সংগঠন পরিচালনা করতে গেলে অধীনস্থরা আস্থা হারিয়ে আশপাশ থেকে সরে যায়, ফলে তা হিতে বিপরীত হয়, সৃষ্টি হয় সম্পর্কের টানাপড়েন। ব্যক্তিকে মনে রাখতে হবে তার বয়স, যোগ্যতা, পেশা, জ্ঞান, গরিমা, পারিবারিক শিক্ষা, সাংগঠনিক স্ট্যাটাস- সবকিছুর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার রাগ বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম বা পথটি। এটি ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে চরমভাবে প্রভাবান্বিত করে। ক্রোধোন্মাদ ব্যক্তি বা রাগে পাগল বা অন্ধ হয়ে অপ্রকৃতিস্থ কাজকর্ম করে ফেলা মানুষটি নিজেকে যতই ভালোমানুষ দাবি করুন না কেন সমাজ, সংগঠন কিংবা পরিবারে তাকে সকলে একটু হলেও হেয় চোখেই দেখে থাকে। ব্যক্তি তার নিজের অজান্তেই আশপাশ মানুষের কাছে নেতিবাচক বা অপছন্দনীয় ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। রাসূল সা: সব মানুষকে আপন করেছিলেন রাগের পরিবর্তে কোমল হৃদয়ের অধিকারী হওয়ায়। এ প্রসঙ্গে কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, (হে রাসূল) আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলেন। যদি আপনি রূঢ় কঠোর-চিত্ত হতেন তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং আপনি তাদেরকে মাফ করুন আর তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ১৫৯) পারস্পরিক সম্পর্কের মাঝে রাগান্বিত হওয়ার একটা ঘটনা হাদিসে বর্ণিত আছে। সোলাইমান ইবন সুরাদ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি নবী সা:-এর সঙ্গে বসা ছিলাম। তখন দু’জন লোক পরস্পর গালমন্দ করছিল। তাদের একজন অপর জনকে এত রাগান্বিত হয়ে গালি দিচ্ছিল যে, তাদের একজনের চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল এবং তার রগগুলো ফুলে গিয়েছিল। তখন নবী সা: বললেন, আমি একটি কালেমা জানি, যদি এ লোকটি তা পড়ত, তাহলে তার ক্রোধ চলে যেত।’ (তিনি বললেন) সে যদি ‘আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তনির রাজিম’ পড়তো। আমি শয়তান হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। (বুখারি) এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক কুরআনে বলেন, ‘যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো উসকানি তোমাকে পায় তাহলে আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তনির রাজিম পড়ো।’ (সূরা হা-মিম সাজদা : ৩৬) অধিক রাগ মানুষকে পাপের পথে পরিচালিত করে। এটি ব্যক্তিগঠন, আত্মশুদ্ধি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জনের ক্ষেত্রে এক বিরাট অন্তরায়। এটি একজন সত্যিকার মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। কারণ ক্রোধ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে মন্ত্রণার অংশ হিসেবে। আপনাকে একটু রাগিয়ে দিতে পারলে, আপনার ক্রোধকে একটু উথলে দিতে পারলেই শয়তান দূর থেকে দেখে এই ভেবে হাসে যে, আপনাকে অন্তত সে বিপথে নেয়ার জন্য সফল হয়েছে। রাগ বা ক্রোধকে দমন করে সহনশীলতা, কোমলতা, ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটা ব্যক্তির এক মহৎ গুণ। মহান আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকি লোকদের প্রশংসা করে তাদের গুণ তুলে ধরে বলেছেন, (মুত্তাকিতো তারাই) যখন তারা ক্রোধান্বিত হয় তখন তারা মাফ করে দেয়। (সূরা শুয়া’রা, আয়াত : ৩৭) অধিক রাগ মানুষকে পাপের পথে পরিচালিত করে বলেই রাসূল সা: রাগ বা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন। রাসূল সা: বলেছেন- ক্রোধের সর্বোচ্চ চিকিৎসা হলো অজু করা। কারণ রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। আর শয়তানকে সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন দ্বারা। আর আগুনকে পানি দিয়েই নিভানো যায়, শীতল করা যায়। তাই আমাদের কেউ যদি রাগান্বিত হয়ে পড়ে তখন যেন সে অজু করে নেয়। (আবু দাউদ) রাগ নিয়ন্ত্রণের আরো একটি পদ্ধতি রাসূল সা: বর্ণনা করেছেন। রাসূল সা: বলেছেন- তোমাদের কারো যখন রাগ আসে তখন সে দাঁড়ানো থাকলে যেন বসে পড়ে। এভাবে যদি তার রাগ প্রশমিত হয়ে যায় তাহলে ভালো। অন্যথায় সে যেন শুয়ে পড়ে। (আহমদ) রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম্নোক্ত কিছু পদ্ধতিও অনুসরণ করা যেতে পারে। রাগের উৎস থেকে কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরে থাকা। অযথা রেগে না গিয়ে চিন্তা করা কিভাবে সমস্যাটাকে সমাধান করা যায়। যার কারণে রাগ সৃষ্টি হয়ে দ্রোহের আগুন জ্বলছে তাকে ক্ষমা করে দেয়া। এটা দু’জনের জন্যই ভালো ফল নিয়ে আসবে। যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করা যে রেগে গেলে শুধু নিজেরই ক্ষতি হবে, তার কোনো ক্ষতি হবে না। এতে আপনা আপনি রাগ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ ছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় রাগের আসল কারণ অন্তর্গত হীনম্মন্যতা। নিজের দুর্বলতাকেই মানুষ ঢাকার চেষ্টা করে দুর্ব্যবহার বা রাগারাগির মধ্য দিয়ে। তাই খুঁজে দেখুন আপনার মধ্যে কোনো হীনম্মন্যতা আছে কি না। রাগ বা ক্রোধ ঈমানের বড় শত্রু। আবার ক্রোধ যেমনিভাবে মানুষের ঈমান ও আত্মার শত্রু তেমনিভাবে অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ জীবনেরও বড় শত্রু। ক্রোধের কারণে মানুষের পশুসুলভ আত্মা সক্রিয় হয়। চেহারা বিবর্ণ হয়, মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। যার কারণে অনায়াসে মুখে অশ্লীল কথা, অঙ্গে অশ্লীল ভঙ্গি প্রকাশ পায়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘ঈমান পূর্ণ করার চারটা আমল, যা কিছু মানুষকে দেবো আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য যা কিছু নেবো আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য। যাকে ভালোবাসব আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসব। যার প্রতি রাগ করব তাও আল্লাহকে খুশি করার জন্য।’ (তিরমিজি) “যুদ্ধে তুমুল লড়াই চলছে। বীরকেশরী হজরত আলী রা: কাফের এক সৈন্যকে কাবু করে তার বুকের ওপর চড়ে বসলেন। তরবারির আঘাতে যখনই তাকে হত্যা করতে যাবেন তখনই কাফের সৈন্যটি হজরত আলী রা:-এর মুখে থুতু মারল। তৎক্ষণাৎ হজরত আলী রা: তার বুকের ওপর থেকে সরে গিয়ে তাকে ছেড়ে দিলেন। আশ্চর্য হয়ে কাফের জিজ্ঞাসা করল, হাতের মুঠোয় পেয়েও কেন তাকে হত্যা করা হলো না। হজরত আলী রা: বললেন, আমি যখন তোমাকে হত্যা করতে যাচ্ছিলাম তখন তা ছিল স্রেফ ইসলামের খাতিরে। কিন্তু যখন তুমি আমাকে থুতু নিক্ষেপ করলে তখন তোমার ব্যবহারে আমি ক্রুদ্ধ হয়েছি। তখন তোমাকে হত্যা করা হলে তা আমার ক্রোধের কারণেই হত্যা করা হবে। তাই আমি তোমাকে ছেড়ে দিলাম। আলীর এই মহানুভবতার কথায় সৈন্যটি তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করল। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রাগ ঈমানকে এমনভাবে ধ্বংস করে যেমন পিপুল গাছের তিক্ত রস মধুকে বিনষ্ট করে।’ রাসূল সা: আরো বলেছেন, যে ক্রোধকে বাধা দেয় আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তার আজাবকে বাধা দেবেন। হজরত ইবনে ওমর রা: বলেন, আমি রাসূল সা:কে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে আমার রাগ থেকে কিসে রক্ষা করবে? তিনি বললেন, তুমি নিজে রাগান্বিত হয়ো না। মানুষের জীবনে রাগ থাকতে পারবে না বিষয়টি কিন্তু এমন নয় বরং রাগ বা ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এটিই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা ছাড়া যার মধ্যে রাগ বলতে কিছু নেই তার মধ্যে তেজস্বিতাও নেই। রাগ বা ক্রোধ মানুষের মাঝে থাকবেই, তাকে শুধু নিয়ন্ত্রণ করতে পারাই মূল সার্থকতা ও সফলতা। হাসতে সবাই পছন্দ করে। হাসা যেমন একটি মানবিক আচরণ, রাগ তার বিপরীত হলেও এটাকে অমানবিক আচরণ বলার সুযোগ নেই, এটিও মানবিক আচরণের মধ্যে পড়ে। বরং এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তবে রাগ যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে ক্রোধে পরিণত হয় তখনই কেবল তাকে অমানবিক আচরণ বলা হয়ে থাকে। কারণ তা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের মাঝে এমনও কেউ আছেন যারা কারণে অকারণে হঠাৎ রেগে যান। হঠাৎ রেগে যাওয়া একটি মানসিক সমস্যাও বটে। মানসিক সমস্যা বর্তমান আধুনিক সমাজের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। আমাদের সমাজ যত উন্নত হচ্ছে, মানসিক সমস্যার পরিমাণও তত বাড়ছে। রাগ এমন একটি মানসিক সমস্যা যা কারো বেলায় প্রকট আকার ধারণ করে। তখন রাগকে শুধুমাত্র রাগ কিংবা ক্রোধের মধ্যেই চিহ্নিত করা যায় না, তখন সেটাকে পাগলামি হিসেবেই আমরা ধরে নিই। এই পাগলামি থেকে বেঁচে থাকার জন্যও আমাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ জরুরি। ক্রোধ যিনি দমন করতে পারেন, রাগ যিনি নিয়ন্ত্রণ করে চেপে যেতে পারেন, তিনিই আসলে প্রকৃত বীর। রাগ কিংবা ক্রোধ সংবরণ করতে পারা সহজ কোনো বিষয় নয়। এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা বিজয়ী বীরের বীরত্বের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ঐ ব্যক্তি বীর নয় যে অন্যকে ধরাশায়ী করে বরং সে-ই প্রকৃত বীর যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। (বোখারি ও মুসলিম) কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে রাগ না করে কি সবসময়ই থাকা যায়? অথবা কেউ যদি বলেন, আমি না হয় রাগ না করে ক্রোধকে দমন করেই থাকলাম কিন্তু কেউ যদি আমাকে উদ্দেশ করে অহেতুক গালিগালাজ করে, মা-বাবা তুলে গালি দেয়, তখনও কি সত্যিই নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? হ্যাঁ আসলেই সম্ভব! এরকম উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও রাগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকা যায়। ধরুন কেউ আপনার বিরুদ্ধে অহেতুক ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করল। আপনার বাবা-মা- বোনকে নিয়ে যাচ্ছেতাই বলল। আপনি চুপচাপ শুনে গেলেন কিছুই বললেন না। অনেকক্ষণ গালিগালাজ করা ব্যক্তিটির কী অবস্থা হবে একটু ভাবুনতো। গালিবাজ লোকটি আপনাকে উত্তেজিত ও রাগান্বিত করতে চেয়েছিল। সে চাইছিল আপনার মাঝে ক্রোধের বিচ্ছুরণ ঘটুক। কিন্তু আপনি কিছুই বললেন না। ফলে তার উদ্দেশ্যই নস্যাৎ হয়ে গেল। সে আপনাকে যে গালিগুলো দিলো আপনি তার কিছুই নিলেন না, গায়েও মাখলেন না। ফলে তার নোংরা গালিগুলো তার দিকেই ফিরে গেল, তার গায়ে মাখামাখি হয়ে তার কাছেই থাকল। বস্তুত আপনার মা-বাবা-বোনকে গালি দিয়ে সে নিজেকেই অপমানিত করল। সে গালিগালাজ করে আপনার শান্তি নষ্ট করতে এসেছিল, আপনি গালির জবাব দেয়ার অর্থই হচ্ছে তার উদ্দেশ্যকে সফল করা। তার চেয়ে কিছুক্ষণ তার গালিগালাজ শোনার পর আপনি যদি বিনয়ের সাথে বলেন, ‘ভাই আপনি অনেক দয়ালু। অনেক পরিশ্রম করে কিছু আমাকে দিলেন। কিন্তু এগুলো রাখার কোনো জায়গা আমার কাছে নেই। আমি কিছুই নিলাম না। এগুলো আপনারই থাক; এ কথা বলার পর দেখবেন, গালিবাজটি দাঁত কামড়ে চলে যাচ্ছে। তার গালিগালাজ যে আপনার ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারলো না, এটাই তার পরাজয়। আর এ পরাজয়ের যন্ত্রণা হয়তো অনেক দিন সে বয়ে বেড়াবে। সে এসেছিল আপনার শান্তি নষ্ট করতে, কিন্তু শান্ত থেকে ক্রোধ দমন করে আপনি তাকেই পরাভূত করলেন। রাগের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে বিরত থাকতে হজরত আলী রা: নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাগান্বিত অবস্থায় চারটি কাজ থেকে বিরত থাকো : ১. সিদ্ধান্ত গ্রহণ ২. শপথ গ্রহণ ৩. শাস্তি প্রদান ও ৪. আদেশ প্রদান। রাগ করে কি আসলে কোনো উদ্দেশ্য হাসিল হয়? না হয় না। বরং কিছু কৌশল অবলম্বন করলে রাগ থেকেও বাঁচা যায়, উদ্দেশ্যও হাসিল হয় এবং সফলতাও ধরা দেয়। যেমন কেউ যদি আপনাকে ঠকানোর চেষ্টা করে। রেগে না গিয়ে ঘটনা থেকে আপনি শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হয়ে যান। আপনার ওপর যদি অন্যায় অবিচার করে। মনে রাখুন, একা প্রতিবাদ করা অর্থহীন। সকলের অন্যায়ের মুখে দুর্বল এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। অন্যায়ের প্রতিকার করার মতো শক্তি এবং সঙ্ঘবদ্ধতা অর্জন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, ধৈর্য ধারণ করুন। কোনো কাজের স্বীকৃতি না পেলে স্বীকৃতির প্রত্যাশা না করে কাজ করে যান। কাজই তার প্রতিদান দেবে। বিদ্রুপ করলে, রেগে গিয়ে আপনি কি তার উদ্দেশ্যকেই সার্থক করছেন না? নিজের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে তুলে দিয়ে কেন হাসির পাত্র হবেন? উল্টো আপনি স্বাভাবিক থাকুন, স্মিত হাসুন। সে ভড়কে যাবে। মানসিক চাপ থাকলে, রেগে গেলে চাপ বাড়বে বৈ কমবে না। তাতে কাজের মান আরো খারাপ হবে। সময় লাগবে বেশি। বরং এই চাপকে দেখুন সুযোগ হিসেবে নিজের দক্ষতাকে আরো বাড়িয়ে নেয়া এবং আরো যোগ্য হওয়ার জন্য। পরিস্থিতি নাজুক হলে আসল কৌশল হলো মাথা ঠাণ্ডা রাখা। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারা। আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করলে, যৌক্তিক জবাব তুলে ধরুন। যুক্তিসঙ্গত কথা বুঝতে না চাইলে, উত্তেজিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। যে ভাষায় বললে অপরপক্ষ বুঝবে তাকে সে ভাষায়ই বোঝান। প্রয়োজনে সময় নিন। লেখক : সম্পাদক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির