post

পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য রাখতে হবে

সামছুল আরেফীন

৩০ মে ২০১৮
৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ দূষণের হাত থেকে এ বিশ্বকে বাঁচানোর অঙ্গীকার নিয়ে প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে প্রতি বছর সারা বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে এ দিবস পালন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে পরিবেশ নিয়ে চলছে নয়-ছয়। পরিবেশ সংরক্ষণ যেখানে প্রাধান্য পাওয়ার কথা, সেখানে পরিবেশ ধ্বংসেরই আয়োজন চলছে। দেশী বিদেশী আপত্তির মধ্যেই সুন্দরবনের কাছে নির্মিত হচ্ছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যত উন্নত প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হোক সেটি সুন্দরবনের ক্ষতি মোকাবেলায় যথেষ্ট হবে না। সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। তার মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে। এ দিকে গাছ, পাহাড় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করলেও, সমানে তা উজাড় করে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন আর প্রচুর পরিমাণ ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নিষ্কাশনের ফলে দিন দিন পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং জলবায়ুর। যার ফলাফল স্বরূপ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ তলিয়ে যেতে পারে ভারতের পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছুটা জায়গা, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ আর শ্রীলংকাসহ পৃথিবীর নিম্নভূমির দেশসমূহ। পরিবেশ রক্ষায় তথা পৃথিবী রক্ষায় আজ প্রয়োজন সচেতন উদ্যোগের। যার যত টুকু সাধ্য তত টুকু দিয়েই চেষ্টা করা দরকার পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য রাখার। আমাদের সাধ্যের মধ্যে আছে এমন অনেক বিষয়ই রয়েছে। যেমন-১) গাছপালা নিধন না করা আর অন্যকে নিধনে নিরুৎসাহিত করা এবং নিজে বেশি করে গাছ লাগানো আর অন্যকে গাছ লাগানোয় উৎসাহিত করা। ২) গাড়ির ক্ষতিকর/ কালো ধোঁয়া বন্ধ রাখার চেষ্টা করা এবং অন্যকে এ ব্যাপারে সচেতন করা। ৩) পাহাড় কাটা বন্ধ রাখা এবং এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করা। ৪) ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলা এবং বর্জ্য পদার্থ যেখানে সেখানে নিষ্কাশিত না করা। ৫) বাড়ির ফ্রিজটি সময় সময় সার্ভিসিং করিয়ে নেয়া। এ রকম আরও অনেক বিষয় যা পরিবেশ/পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর সেগুলো বন্ধ করা বা বন্ধ করার জন্য জনগণকে সচেতন করার শপথ নেয়ার অনুপ্রেরণা দেয় এই দিনটি। পরিবেশবাদীদের মতে, বাংলাদেশের প্রকৃতির অন্যতম উপাদান বন ও বন্যপ্রাণী। বিভিন্ন অঞ্চলের বন ও বন্যপ্রাণী মিলে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের প্রতিবেশ ব্যবস্থা। গড়ে উঠেছে প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। বন ও বন্যপ্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর নেমে আসে বিপর্যয়। প্রকৃতিতে এদের ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে প্রতিনিয়ত বন ও বন্যপ্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। বন ধ্বংস, অবৈধ বন্যপ্রাণী শিকার, দারিদ্র্য, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্প কারখানার দূষণে বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। বনভূমি উজাড়ের পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর দাবদাহে যতটা পরিবেশের ক্ষতি হয় তার চেয়ে শতগুণ বেশি হয় মানবসৃষ্ট কারণে। প্রকৃতির ওপর দায়বোধ, সচেতনতা আর সর্বগ্রাসী মুনাফার লোভে মানুষ নিজের জীবনকে বিষিয়ে তুলছেন পরিবেশ ধ্বংস করে। পানি দূষণ দেশের নদী দূষণের কারণ শিল্প-কারখানার বর্জ্য। দেশের বড় ও মাঝারি ধরনের প্রায় ৮ হাজার শিল্প-কারখানা মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ঘোড়াশাল প্রভৃতি এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোর মারাত্মক ক্ষতিকর বর্জ্য পার্শ্ববর্তী নদীগুলোতে নিঃসরণ করছে। এসব এলাকার খাল-বিল-নদী মারাত্মক দূষণের শিকার। দূষণকারী শিল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে চামড়াশিল্প, ওষুধশিল্প, রাসায়নিক সার কারখানা, টেক্সাইল, ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, রঙ-কাগজ শিল্প প্রভৃতি। ভরাট হয়ে যাচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী পুকুরও। বর্জ্য অবস্থাপনা ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে বলা হয় ঢাকার অভ্যন্তরের ৪৩টি খালের সীমানা খাতা-কলমে থাকলেও বাস্তবে এদের অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে অস্তিত্ব বাঁচাতে লড়ছে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা। একদিকে অবৈধ স্থাপনা, অন্যদিকে কলকারখানার দূষিত উপাদান ও সোয়া কোটি নগরবাসীর বর্জ্য নদীর মৃত্যু ঘটাচ্ছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রায় প্রতিটিই মানুষের আক্রমণের শিকার। দখল, ভরাট, আবর্জনায় নদীগুলো হারিয়েছে গতির ছন্দ। বায়ুদূষণ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী বায়ুদূষণের দিক দিয়েও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। দূষণ নির্ণয়ের ইনডিকেটর হিসেবে বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম ২.৫ নিয়মিত পরিমাপ করা হয়। অ্যামোনিয়া, কার্বন নাইট্রেট ও সালফেটের ক্ষুদ্রকণা সমন্বয়ে গঠিত পিএম ২.৫। বাতাসে এ পিএম ২.৫-এর পরিমাণ উচ্চমাত্রায় থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর ক্ষতিকর প্রভাবে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, উচ্চরক্তচাপ, অবসাদ, ফুসফুসে প্রদাহ ইত্যাদি সমস্যা প্রকট হচ্ছে। শব্দদূষণ রাজধানীর শব্দদূষণের মাত্রাও অসহনীয়। সর্বত্রই শব্দদূষণ সবচেয়ে বেশি মাত্রার শব্দ। গবেষণার তথ্য মতে, রাজধানীর বিমানবন্দরের মূল সড়কে দিনে শব্দের মাত্রা ১১৬ ডেসিবেল; স্বাভাবিক হওয়া উচিত ৭৫ ডেসিবেল। গোটা রাজধানীতেই শব্দদূষণের সহনীয় মাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দ্বিগুণ বেশি শব্দদূষণ হচ্ছে। শহরে শব্দদূষণের প্রধান কারণ, যানবাহনের জোরালো হর্ন, ইঞ্জিনের ও নির্মাণকাজের শব্দ এবং ভবন ভাঙার শব্দ। শব্দদূষণের কারণে দেখা দিচ্ছে বধিরতা, স্নায়ুবিক রোগ ও মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ। গাছকে রক্ষা করতে হবে একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে, তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়। ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক একটি বৃক্ষের অবদানকে আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান, ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার। (সূত্র : ইন্ডিয়ান বায়োলজিস্ট, ভলিউম-১১, সংখ্যা ১-২)। টি এম দাসের হিসাবে, ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষ বছরে প্রায় ২১ লাখ টাকার অক্সিজেন সরবরাহ করে। বছরে প্রাণিসম্পদের জন্য প্রোটিন জোগায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার, মাটি ক্ষয়রোধ ও মাটির উর্বরতা বাড়ায় ২১ লাখ টাকার, পানি পরিশোধন ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে ২১ লাখ টাকার এবং বায়ুদূষণ রোধ করে প্রায় ৪২ লাখ টাকার। গাছবিহীন এক মুহূর্তও আমরা কল্পনা করতে পারি না। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, ধর্ম, বিশ্বাস, রীতি, শাস্ত্র-পুরাণ, নীতিকথা, প্রথা, বাণিজ্য, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, উৎসব, পার্বণ, শিল্প-সংস্কৃতি, আশ্রয়, প্রশান্তি যাপিত জীবনের সবকিছুই গাছকে ঘিরে, গাছ নিয়ে। সুন্দরবনের কাছে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে উদ্বেগ কেন? সরকারি হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা থেকে প্রকল্পের দূরত্ব ৬৯ কিলোমিটার। সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাটের রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছে। দু’টি ইউনিটে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন অনেকে। অন্য দিকে সরকার এবং বাংলাদেশ ভারত যৌথ কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ হবে সামান্য যা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না। সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা ১৪ কিলোমিটার দূরে। সরকারি হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা থেকে প্রকল্পের দূরত্ব ৬৯ কিলোমিটার। সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সুন্দরবনের নিকটে থাকার কারণেই রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে তাদের আপত্তি। তিনি বলেন, এই ইকো সিস্টেম যদি নষ্ট হয় কোনো কারণে এবং সেটা দেখা যায় না, সেটা বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারেন। যে কারণে ওয়ার্ল্ড হেরিটেইজ বিশেষজ্ঞ দিয়ে এটাকে মূল্যায়ন করতে ইউনেস্কো গুরুত্ব দিয়েছে। যদি কোনো কারণে বিঘ্ন হয় তাহলে দেখা যায় সেই পরিবেশে হয়তো বাঘ বেঁচে থাকতে পারবে না, সেই পরিবেশে হয়তো কুমির বেঁচে থাকতে পারবে না তিনি মনে করেন, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যত উন্নত প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হোক সেটি সুন্দরবনের ক্ষতি মোকাবেলায় যথেষ্ট হবে না। আর এ প্রকল্পের জন্য পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ প্রতিবেদনটিও বিশেষজ্ঞমহলে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তিনি বলেন, যে সিম্যুলেশন রেজাল্ট দেখানো হয়েছে ওই রেজাল্ট যে বাস্তবে কার্যকর বা বাস্তবসম্মত সেটাও তারা প্রমাণ দেখাতে পারেনি। একটা অংক করে তার রেজাল্ট পাওয়া গেলে সেই রেজাল্ট যে বাস্তবে প্রমাণসিদ্ধ বা বাস্তবে যে যথোপযুক্ত সেটা যতক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণিত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেই রেজাল্টের ভিত্তিতে কোনো ডিজাইন কোনো ড্রইং ইম্পলিমেন্টেশনে যাওয়া যায় না। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতিদিন প্রয়োজন হবে ১২ হাজার টন কয়লা। সুন্দরবনের ভেতর নদীপথে এই কয়লা পরিবহন এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনাও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। জীববৈচিত্র্য গবেষক ডক্টর আনিসুজ্জামান খানের মতে, সুন্দরবনের টিকে থাকার বিশেষ শক্তি আছে কিন্তু বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে যেটি দরকার, সেটি হচ্ছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেইজ সাইট তার যে ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান সেটা ডেভেলপ করা। রামসার সাইট তার ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী আরেকটা ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান এবং ওয়াইল্ড লাইফ স্যানচুয়ারি যেটা বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ অ্যাক্ট তার আলোকে এই ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি করা এবং ইমপ্লিমেন্ট করা। তাহলেই এই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য লংটার্মে সাসটেইন করবে। অসম চুক্তি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২০১ কোটি ডলার। এর ৭০ শতাংশ ব্যাংক ঋণ নেয়া হবে (৭০ ভাগ ঋণের সুদ টানা এবং ঋণ পরিশোধ করার দায়িত্ব যৌথ কোম্পানির কিন্তু জামিনদার বাংলাদেশের)। ১৫ শতাংশ অর্থ দেবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং বাকি ১৫ শতাংশ দেবে ভারতের এনটিপিসি। ওই প্রকল্পের জন্য পুরো জমি, অবকাঠামোগত বিভিন্ন কিছু, সব সরবরাহ করবে বাংলাদেশ। অথচ শেষ বিচারে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির পরিচালনার দায়িত্ব চলে যাবে ভারতের হাতে! মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে তারা হয়ে যাবে হর্তাকর্তা! তা ছাড়া এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনতে হবে পিডিবিকে! আর যে নিট লাভ হবে, তার অর্ধেক নিয়ে নেবে ভারত! চুক্তি অনুযায়ী কয়লা আমদানির দায়িত্ব এবং ক্ষয়ক্ষতির দায়ও বাংলাদেশের! এমন অসম চুক্তির মানে কী, তা জানতে চায় দেশপ্রেমিক জনতাসহ বোদ্ধা মহল। এ দিকে, দেশীয় কোম্পানি ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর পিডিবির ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৫২২ মেগাওয়াটের একটি হবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায়। এ ছাড়া খুলনার লবণচরা ও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ২৮৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। সেখানে বলা আছে মাওয়া থেকে কিনবে ৪ টাকা প্রতি ইউনিট। আর লবণচরা ও আনোয়ারার কেন্দ্র থেকে কিনবে ৩ টাকা ৮০ পয়সা করে। কিন্তু রামপালের কেন্দ্র থেকে কিনতে হবে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা করে! কারণ এনটিপিসি ও পিডিবি ইতোমধ্যেই প্রতি টন ১৪৫ ডলার করে কয়লা আমদানি চূড়ান্ত করে ফেলেছে। দেশী বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার আপত্তি ও উদ্বেগ সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিপদ নিশ্চিত জেনেই রামসার ও ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে একাধিক বার চিঠি দিয়েছে। সুন্দরবনের পাশে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউনেস্কো সরকারকে প্রথম চিঠি দেয় ২০১৩ সালের ২২ মে। ওই বছর ১৫ অক্টোবর সরকারের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) রিপোর্ট ইউনেস্কোর হাতে পৌঁছে। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর ইউনেস্কো ইআইএ রিপোর্টের ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা উল্লেখ করে সরকারকে চিঠি পাঠায়। সরকারের মতামত ইউনেস্কোর কাছে পৌঁছাতে লাগে ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল। এর মধ্যে ইউনেস্কো সুন্দরবনের পাশে একই স্থানে আরেকটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (ওরিয়ন গ্রুপের ৫৬৫ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র) পরিকল্পনার কথা জানতে পারে। ইউনেস্কো এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল সরকারকে আবার চিঠি দেয়। ইউনেস্কোর ৩৮ ও ৩৯তম অধিবেশনে সুন্দরবনের পাশে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল এবং অন্যান্য দূষণকারী কারখানার ব্যাপারে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম ইসলামকে বলা হয় ফিতরাত বা স্বভাবগত বা প্রকৃতির ধর্ম। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ মূলত সামাজিক জীব। মানুষকে ঘিরেই পরিবেশ-প্রকৃতি ও সমাজের সৃষ্টি। আর পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে ইসলামের পরিবেশগত চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। লন্ডনের ইসলামিক কালচারাল সেন্টার থেকে প্রকাশিত, ‘দি ইসলামিক কোয়ার্টারলি’ পত্রিকার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর সাইয়্যেদ নাসের হোসাইন, ‘ইসলাম অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ক্রাইসিস’ নামক এক প্রবন্ধে বলেন, ‘পরিবেশ সঙ্কট’ আধুনিক মানুষের প্রকৃতিকে আধ্যাত্মিক নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচনা করারই ফল।’ কুরআনে আল্লাহপাক নিজেকে আল্ মুহিত বলে ঘোষণা করেছেন। আল্ মুহিত হিসাবে আল্লাহকে স্মরণ করার অর্থ হচ্ছে প্রকৃতির পবিত্রতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। প্রকৃতির বাস্তবতাকে আল্লাহর নিদর্শন হিসাবে দেখা এবং সচেতন থাকা। তার মতে, ‘প্রাকৃতিক পরিবেশ-সংক্রান্ত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ঐশী পরিবেশ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের এক অনস্বীকার্য স্থায়ী সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ পরিবেশকে ভালো ও উন্নত রেখে কিভাবে উত্তম জীবনধারণ ও কল্যাণ অর্জন করা যায়, তার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা)। তিনি পরিবেশের প্রতি ছিলেন খুবই যত্নবান। পরিবেশ সংরক্ষণের মূর্তপ্রতীক ছিলেন মহানবী (সা)। বিশেষ করে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় মহানবী (সা) যে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন দুনিয়ার ইতিহাসে তা বিরল। আমরা সবাই জানি, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে দুনিয়াজুড়ে আজ সম্মিলিত রব উঠেছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে এ বিষয়ে নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনা এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের অদূরদর্শিতা ও অমানবিক আচরণে প্রকৃতিতে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে তা তাবৎ বিশ্বের মানুষের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ফলে বায়ুতে বেড়েছে দূষণ, বেড়েছে তাপমাত্রা, বৃদ্ধি পেয়েছে রোগ-শোক এবং প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগ। এসব বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য বিজ্ঞানীরা বনরক্ষা এবং বৃক্ষরোপণকে অন্যতম উপায় বলে মত দিয়েছেন। অথচ ইসলামে নবী মুহাম্মদ (সা) বৃক্ষ ও বনরক্ষার তাগিদ দিয়েছেন সেই চৌদ্দ শ’ বছর আগে। বৃক্ষ নষ্ট না করার জন্য তিনি মানুষকে সুন্দর উপদেশ দিয়েছেন। পরিবেশ রক্ষায় তথা পৃথিবীর সুরক্ষায় আজ প্রয়োজন সচেতন উদ্যোগের। যার যতটুকু সাধ্য ততটুুকু দিয়েই চেষ্টা করা দরকার পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য রাখার। পৃথিবীর জন্য যা ক্ষতিকর সেগুলো বন্ধ করা বা বন্ধ করার জন্য জনগণকে সচেতন করার শপথ নেয়ার অনুপ্রেরণা হোক এই দিনে। লেখক : সাংবাদিক , কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির