post

প্রতিবাদী হতে হবে, তবে পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নয়

০৪ অক্টোবর ২০১২

মাসুদ মজুমদার শয়তানের কাজ মানুষকে প্রতারণায় ফেলে বিপথগামী করা। মানুষ-শয়তানও এ কাজে পারদর্শী। তা ছাড়া অসৎ কাজে উসকানি দেয়ার জন্য একটি মহল সব যুগেই প্রস্তুত থাকে। বিশ্বরাজনীতিকে উত্তপ্ত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী চক্র এই অপকর্মটি প্রায়ই করে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার জন্য কখনো কখনো তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশকে বাছাই করা হয়। কখনো বা বর্ণবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া হয়। আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে ফায়দা তোলার একটা নিন্দনীয় কাজও সহজেই করা হয়। যখন থেকে মুসলমানেরা মাথা তুলে দাঁড়াতে সচেষ্ট, তখন থেকে মুসলমানেরা সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদী শক্তির টার্গেট হয়ে যায়। এমনভাবে উত্ত্যক্ত করা হয়, যাতে উসকানির প্রেক্ষিত সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ মুসলমানেরা যাতে সংযম হারাতে বাধ্য হয়, তার ব্যবস্থা করা হয়। অসংযমী মানুষ কিছু বাড়াবাড়ি করে ফেলতে পারে। তখনই হিংস্র নেকড়ের মতো সাম্রাজ্যবাদ ও পরাশক্তি হামলে পড়ে টুঁটি চেপে ধরার মওকা পেয়ে যায়। টুইন টাওয়ার ধ্বংস তেমনি একটি বাহানা সৃষ্টি করে দিয়েছিল। চাপিয়ে দেয়া ইরাক যুদ্ধ তেমনি আরেকটি উপমা।  ইরান-ইরাক যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়াও ছিল সেই ষড়যন্ত্রের অংশ। ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখলও ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। আফগানিস্তানকে পোড়ামাটির জনপদ বানানো হলো একই ধরনের ব্লেম গেইমের মাধ্যমে। লিবিয়াও ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা মতো। মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তনে মার্কিন-ইসরাইলি ইন্ধন ছিল, তবে জনগণ তাদের বিজয় হাইজ্যাক করার ব্যাপারে সচেতন থাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল শত ভাগ সুফল ঘরে তুলতে পারেনি। এখন নতুন পরিকল্পনা প্রয়োজন। নতুন করে একটি ষড়যন্ত্র নাটক মঞ্চায়নও জরুরি। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে জনমতকে তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য একটা ইস্যু চাই। লিবিয়া, মিসর, তিউনিশিয়া ও তুরস্ককে ভিন্ন আঙ্গিকে অস্থির করে নিয়ন্ত্রণও একটি উদ্দেশ্য হতে পারে। তাই নিউ ইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্রে বিমান হামলার ১১তম বার্ষিকীর প্রাক্কালেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-কে অবমাননা করে নির্মিত হলো উদ্দেশ্যমূলক ছায়াছবি। সেই উদ্ভট ও বিকৃত মনের বিকারগ্রস্ত পরিচালকের  চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে মিসরের রাজধানী কায়রো এবং লিবিয়ার বেনগাজিতে ভয়াবহ বিক্ষোভ হলো। বেনগাজিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ চারজন নিহত হলেন। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক রবার্ট ফিস্ক প্রশ্ন তুলেছেন, নাইন-ইলেভেনের সাথে মিল রেখে ওই চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেয়া হলো কোন হিসাব সামনে রেখে? এ প্রশ্ন শুধু ফিস্কের নয়, বিশ্ববাসীর। সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী কাজ করেন এটা ঠিক, তবে এবারের চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে সেই ছকেই এত সরলীকরণ করে বোঝা সম্ভব নয়। এর নেপথ্যে আরো কোনো গভীর ষড়যন্ত্র থাকা অসম্ভব নয়। মহানবী সা:-কে নিয়ে কার্টুন আঁকা, তারপর যুক্তরাষ্ট্রের এক পাদ্রি এবং আফগানিস্তানে মার্কিন ঘাঁটিতে কুরআন পোড়ানোর ক্ষোভ এখনো প্রশমিত হয়নি। এসব ঘটনার পর এবার ‘সন্ত্রাসী’ পোশাক পরা কল্পিত মরুভূমির ভিডিও প্রকাশ করা হলো । শুনেছি ওই বিকারগ্রস্ত উন্মাদ প্রকৃতির চলচ্চিত্রকার আত্মগোপন করেছেন। কিন্তু তিনি বা তার মদদদাতারা যা চেয়েছিলেন, তা তো পেয়েই গেলেন। মুসলিম বিক্ষোভকারীদের হাতে এক রাষ্ট্রদূত শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেলেন, আর এতে ইসলামকে সহিংস ধর্ম বলে যে প্রচারণা চালানো হয়, তা প্রমাণ  করার সুযোগ মিলে গেল। অখ্যাত চলচ্চিত্রকার বোধকরি এটাই চেয়েছিলেন। তার প্রভু এবং পৃষ্ঠপোষকদেরও ভিন্ন লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয় না। উসকানিদাতারা নিশ্চিত করেই জানত, তাদের ওই চলচ্চিত্রের কারণে মুসলিমবিশ্বে ও মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়বে। যা ঘটেছে সেটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিন্দনীয় হলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে এটা কারো অজানা নয়। নবীর নামে কলঙ্ক লেপন বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলমান মেনে নেবে না, তারা উত্তেজিত হবেই, আর এর ফলে একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, এটা বোঝার জন্য অনেক বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। এখন এর সাথে জড়িয়ে দেয়া হবে মুসলিম, ইসলাম এবং ধর্মবিশ্বাসের স্পর্শকাতরতাকে। দেখানো হবে মৌলবাদের কল্পিত ভূত। জঙ্গিবাদের সস্তা অভিযোগ তো আছেই। এর আগে ডেনিশ এক কার্টুনিস্ট যখন অখ্যাত একটি পত্রিকায় হজরত মুহাম্মদ সা:-কে পাগড়িতে বোমাবহনকারী বানিয়ে কার্টুন প্রকাশ করল, তখন বৈরুতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। পশ্চিমা বিশ্ব প্রতিবাদ করল না, উল্টো প্রতিবাদী মুসলমানকে দুষল। টেক্সাসের এক যাজক যখন বিকৃতমনা সেজে হাস্যকরভাবে ‘কুরআনের মৃত্যুদণ্ড’ দিলেন, তখন আফগানিস্তানে ক্ষোভের সৃষ্টি হলো, তার পরও পশ্চিমারা তালেবান মুসলমানদের কটাক্ষ করল, যাজকের নিন্দা করল না। আফগানিস্তানের বাগরামে মার্কিন কর্মকর্তারা ঠাণ্ডা মাথায় পবিত্র কুরআনের কয়েকটি পৃষ্ঠা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন, কৈফিয়ত দিয়েছিলেন দুর্ঘটনা বলে। এবার মহানবীকে নিয়ে আপত্তিকর ও ধৃষ্ঠতাপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো ন্যক্কারজনক কাজটা করল শুধু উত্ত্যক্ত করার জন্য নয়, উত্তেজিত করে ষড়যন্ত্রে ফেলার জন্য। এ ধরনের ছবি ও কার্টুন প্রকাশ ও প্রচার করা নিঃসন্দেহে উসকানিমূলক সন্ত্রাসী কাজ। এমন কাজ তারা হরদম করেই যাচ্ছে। আগেও ইহুদি ও খ্রিষ্টান কার্টুনিস্টরা মহানবীকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন আঁকত। আর এতে মুসলমানেরা ক্ষুব্ধ হতো। কিছু অঘটন ঘটে যেত। সেটাই কাজে লাগাত ক্রুসেডাররা। ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টির কারণে শুধু মুসলমানেরাই ক্ষুব্ধ হয় না, প্যারিসের সিনেমা হলে যখন যিশুখ্রিষ্টের এক নারীর প্রেমে পড়া কাহিনী বানিয়ে ছবি দেখানো হচ্ছিল, তখন ওই প্রেক্ষাগৃহটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় এক দর্শক নিহতও হয়েছিলেন। সেই হামলাকারী ছিল একজন খ্রিষ্টান। তাদের নবীর অবমাননা কিন্তু তারাও বরদাশত করেনি। মুসলমানেরা কি ইহুদি-খ্রিষ্টানদের নবীকে নিয়ে বিদ্রƒপ করে? না। বরং হজরত মুসা ও ঈসা আ:-কে নিজেদের নবী মনে করাকে ঈমানের অংশ ভাবে। মুসলমানেরা যিশুখ্রিষ্ট অর্থাৎ হজরত ঈসা আ: ও হজরত মুসা আ:-কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে, এটা করে ঈমানের তাগিদে, তাদেরও নবী হিসেবে মানে কুরআনের নির্দেশনা মানার জন্যই। মহানবীর অনুসরণের জন্যই। এ মানার মধ্যে কোনো খাদ নেই, কারণ এটি ইসলামের বিশ্বাসেরই অংশ। এখন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও ইহুদিরা ভাবে  মুসলিমদের সহজেই উত্তেজিত করা যায়। ভারতে দাঙ্গা ও মিয়ানমারে হত্যা-উৎসব তার প্রমাণ। মুসলমানদের সংহত ও সংযত হওয়া উচিত। বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে পাতা ফাঁদে পা দেয়ার আগে বুঝতে চেষ্টা করা উচিতÑ এটা ষড়যন্ত্র না উসকানি। প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে। সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধও করতে হবে। তবে অপরিণামদর্শী হওয়া উচিত হবে না। শত্রুরা ইস্যু চাচ্ছে। তাদের হাতে নতুন ইস্যু তুলে দেয়া ঠিক হবে না। তারা আবার ক্রুসেডের জন্য প্রেক্ষিত সৃষ্টি করছে। আর চাচ্ছে উদীয়মান ইসলামি শক্তির পুনর্জাগরণ ঠেকিয়ে দিতে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যে পরিবর্তনের সুবাতাস প্রবাহিত হতে শুরু করেছেÑ তা রোধ করে দেয়াও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। তা ছাড়া পূর্বাপর ইহুদি ষড়যন্ত্র তো আছেই। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, ইসরাইল বর্ণবাদী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রটির জন্মই আজন্ম পাপ। ইসরাইলিরা অন্য ধর্মাবলম্বী ও জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করাকে ন্যায়সঙ্গত ভাবে। ধর্ম হিসেবে ইহুদি ধর্মের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকাটাকেই আমরা কল্যাণ বিবেচনা করি। তা ছাড়া সাধারণ ইহুদিদের প্রতিও আমরা অভিযোগের অঙ্গুলি তুলতে চাই না। তবে ইহুদিবাদী ধর্মান্ধ উগ্র গোষ্ঠীটি পৃথিবীর অনেক অপকর্মের হোতা। পবিত্র কুরআন এদের বিভ্রান্ত ও অভিশপ্ত জাতি হিসেবে উল্লেখ করেছে। খ্রিষ্টানদের সম্পর্কে বলা হয়েছে অপেক্ষাকৃত কাছের। খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের আগ্রাসী ও অধিপত্যবাদী পররাষ্ট্রনীতির জন্য যা না নিন্দিত ও ঘৃণিত, তার চেয়ে হাজার গুণ নিন্দিত ও ঘৃণিত ইহুদিবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও আশকারা দেয়ার জন্য। পৃথিবীর বিষবৃক্ষ ও মধ্যপ্রাচ্যের দুষ্ট ক্ষত হিসেবে পরিচিত ইসরাইলিরা নিজস্ব ক্ষমতার জোরে টিকে নেই, নিজস্ব অর্থ বল, সেনা বল কিংবা কূটনৈতিক পারদর্শিতার জন্যও এতটা বাড়াবাড়ি করছে না। তারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টিকিয়ে রেখেছে বলেই। তারা পৃষ্ঠপোষকতা করছে জেনেই ইসরাইল ঔদ্ধত্য দেখাতে পারছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ এবং সেই নীতি বাস্তবায়নে ইহুদিবাদী লবির ভূমিকা প্রত্যক্ষ। তারাই আমেরিকাকে যুদ্ধবাদী হতে ইন্ধন জোগায়। অর্থ জোগায়। প্রভাব খাটিয়ে আগ্রাসী হতে উসকানি দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকেরা নিজ দেশে কতটা নন্দিত সেটা ভিন্ন প্রশ্ন; কিন্তু বিশ্বজুড়ে তারা খলনায়ক হিসেবে পরিচিতি পান শুধু ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল ও উগ্র ইহুদিবাদীদের সব নেতিবাচক কর্ম সমর্থন করেন বলে। আমরা প্রতিবাদী হতে বলি, কিন্তু ষড়যন্ত্রে পা দিতে নিরুৎসাহিত করি। আমরা ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করারও পক্ষে, কিন্তু অসংযমী হয়ে রাষ্ট্রদূত হত্যার মতো হঠকারী হওয়াকে সমর্থন করি না। ইসলাম কোনো ভালো কাজকে খারাপ পদ্ধতিতে করার জন্য অনুমোদন দেয় না। তাই বলে ঈমান বন্ধক রেখে বোবা শয়তান হতেও বলে না। পৃথিবীতে অনেক নাস্তিক আল্লাহ মানে না, রাসূল মানে না। তাদের হেদায়েতের মালিক আল্লাহ। তবে যারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদের প্রতিহত করা মুসলমানদের জরুরি কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনে কোনো বাধা ও প্রতিবন্ধকতা না মানা এক বিষয়, অসঙ্গত আচরণ ভিন্ন বিষয়। আমরা বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। ধার্মিক হতে বলি, ধর্মান্ধ হতে নয়। সম্প্রদায়চেতনা জাগ্রত রাখতে বলি, সাম্প্রদায়িক হতে নয়। পশ্চিমারা মতের স্বাধীনতার দোহাই দেয় শুধু মুসলমানদের বেলায়। নিজেদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কোনো সমালোচনা সহ্য করে না। ব্লাসফেমি আইন তার প্রমাণ। তাই প্রতিবাদী মুসলমানদের প্রতি অনুরোধ থাকবেÑ আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ দেখাতে গিয়ে কুরআন-সুন্নাহর মৌল শিক্ষা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। সেই শিক্ষা ভুলে গেলে শুধু সত্য থেকে বিচ্যুতির প্রশ্ন উঠবে না, শত্রুদের ফাঁদে পা দিয়ে বিপদও ডেকে আনা হবে। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির