post

প্রত্যাশিত নেতৃত্ব নেতৃত্বের ধরন, প্রকৃতি ও অত্যাবশ্যকীয় গুণাবলি

শাহ মো: মাহফুজুল হক

২৪ এপ্রিল ২০১৭
Leader বা Responsible person শব্দটির বাংলা হচ্ছে নেতা, পরিচালক, দায়িত্বশীল। আরবিতে বলা হয় খলিফা, ইমাম বা আমির। নেতৃত্ব ছাড়া কোনো জাতি, দেশ এমনকি কোনো সংগঠনও চলতে পারে না। জাতির উত্থান পতন অনেকাংশে নির্ভর করে নেতৃত্বের ওপর। ইসলামী সংগঠন নেতা বা দায়িত্বশীল ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। ইসলামী সংগঠনের অনেক বিষয় নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। নেতৃত্বের সংজ্ঞা নেতৃত্বকে কোন একটি বাক্যে সংজ্ঞায়িত করা খুব কঠিন। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে নেতৃত্বকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। অধ্যাপক ওয়ারেন বেনিস বলেছেন, নেতৃত্ব হচ্ছে নিজেকে জানা, দক্ষ যোগাযোগ, পারস্পরিক আস্থা ও প্রয়োজনীয় কাজের মাধ্যমে সহযোগীদের কাছে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা।’ পরিস্থিতি জয় করার সামর্থ্যকেই নেতৃত্ব বলে। বলা হয় তিনিই নেতা যিনি পথ জানেন, অনুসরণ করেন ও দেখান। ইসলামী নেতৃত্ব ইসলামী নেতৃত্ব তিনটি শব্দের মর্মার্থের ধারক-বাহক। ১.    খলিফা বা প্রতিনিধি : খলিফাতুল্লাহ, খলিফাতুর রাসূল (সা), খলিফাতুল মুসলেমিন। ২.    ইমাম : যিনি সামনে চলেন, নির্দেশ দেন এবং নিজে সবার আগে বাস্তবায়ন করেন। ৩.    আমির : যিনি আদেশ দেন। আদেশ দানের অধিকার একমাত্র আল্লাহর। আমির আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ প্রদান করেন। নেতৃত্বের তত্ত্বগত ধারণা (Leadership Theories) নেতৃত্বের মহৎ ব্যক্তি তত্ত্ব (Great Man Theories) : নেতা হচ্ছেন সেই সকল ব্যতিক্রমী ব্যক্তি যারা জন্মগতভাবে নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন, যাদের জন্মই হয় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। অর্জিত নেতৃত্ব (Trait Theories) : নেতৃত্ব সব সময় জন্মগত নয় বরং অর্জন করারও বিষয়। নেতার নেতৃত্ব এমন কতগুলো গুণাবলি যা পরিমাপ করা যায় না যেমন মাপা যায় না সৎগুণাবলি। নেতৃত্বের ব্যবহারিক তত্ত্ব (Functional Theories) : নেতার নেতৃত্ব ব্যক্তি, দল ও কাজ এই তিনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। নেতাকে ব্যক্তির আচরণ, অনুভূতি, প্রশিক্ষণ ও ধারাবাহিক পেশাগত উন্নতির প্রতি লক্ষ রাখতে হয়। কাজের লক্ষ্য নির্ধারণ, উপযুক্ত কৌশল উদ্ভাবন ও সামগ্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি নজর দিতে হয়। সকলকে নিয়ে কাজ করার জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ, সম্পর্ক উন্নয়ন ও টিম স্পিরিট তৈরিতে মনোযোগী হতে হয়। নেতৃত্বের আচরণগত তত্ত্ব (Behaviourist Theories) : নেতার আচরণ তার দক্ষতাকে ফুটিয়ে তোলে। বিভিন্ন রকম আচরণ বিভিন্ন রকম নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে। যেমন একনায়কোচিত, গণতান্ত্রিক, উৎসাহমূলক আচরণ ইত্যাদি। নেতৃত্বের ধরন/প্রকারভেদ অবাধ স্বাধীন নেতৃত্ব ((Laissez-Faire/ Accommodating) ) : অবাধ স্বাধীন নেতৃত্বে নেতার ভূমিকা জোরালো থাকে না। এ ধরনের নেতৃত্বে নেতা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধীনস্থদের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। অনেকটা নিয়মরক্ষার নেতৃত্ব বলা যায়। লক্ষ্য অর্জনে এ ধরনের নেতৃত্বের কার্যকারিতা খুবই কম। একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্ব (Autocratic Leadership) : একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্ব হলো নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী নেতৃত্ব। এ নেতৃত্বের কোন কাজকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। এখানে নেতার কথাই চূড়ান্ত। এ ধরনের নেতৃত্বের উপকারিতার চেয়ে অপকারিতাই বেশি। প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্ব (Participative/ Democratic) : প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্বে পরামর্শ দেয়া ও নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে মূল নেতার কাছ থেকেই। এ নেতৃত্বে অধিকাংশের অংশগ্রহণ থাকায় লক্ষ্য অর্জনে স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা পাওয়া যায়। নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্ব (Transactional) : এই সিস্টেমে নেতা ও কর্মী সকলে মিলে লক্ষ্য নির্ধারণ করে নেতার নেতৃত্ব মেনে চলতে একমত হন। এখানে নেতা কাজের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও তদারকির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়া অধীনস্থদের কর্মের ওপর ভিত্তি করে নেতা তার সদস্যদেরকে পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত করেন। চলমান কাজের গতি ধরে রাখা এবং খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্ব অধিক কার্যকর। ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব (Charismatic/ Transformational) : ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব নির্ভর করে দ্রুত ও আকর্ষণ সৃষ্টিকারী যোগাযোগের ওপর। নেতার ব্যক্তিত্ব ও কথা কর্মীদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে যার ফলে ব্যক্তির উৎপাদনক্ষমতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। নেতা এক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নির্ধারণ করে সবাইকে সম্পৃক্ত করে দৃঢ় প্রত্যয়ে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যান। এ ছাড়াও নেতৃত্বকে সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, ধর্মীয় ইত্যাদি দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগ করা যায়। নেতৃত্বের গুরুত্ব যেকোনো আন্দোলন ও সংগঠনে নেতৃত্বই প্রধান ভধপঃড়ৎ হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় নবী-রাসূলরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দ্বীন ইসলামের প্রচার প্রসার ও বিজয়ে ভূমিকা রেখেছেন। নবী-রাসূলগণ ছাড়াও অনেক ইসলামী ব্যক্তিত্ব সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। যেমন তারিক বিন জিয়াদের স্পেন বিজয়, সালাহউদ্দিন আইয়্যুবীর ফিলিস্তিন বিজয়, মুহাম্মদ বিন কাশেমের সিন্ধু বিজয়, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয় ইত্যাদি। আমরা যদি নিকট অতীতের দিকে তাকাই তবে দেখবো পৃথিবীতে সংঘটিত বিপ্লবগুলো নেতৃত্বকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এবং পূর্ণতা পেয়েছে। যেমন লেনিনের রুশ বিপ্লব, মাও সেতুংয়ের চীন বিপ্লব, জিন্নাহর পাকিস্তান আন্দোলন, ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কিউবা বিপ্লব, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ, আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইরান বিপ্লব ইত্যাদি। এ ছাড়া মাওলানা মওদূদী, হাসানুল বান্না, বদিউজ্জামান নুরসির ইসলামী আন্দোলন, উমর মুখতাদির-এর সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, ন্যালসন ম্যান্ডেলার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, আবরাহাম লিংকনের দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনও নেতৃত্বকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। ইসলামী সংগঠনে নেতৃত্ব অনেক বেশি গুরুত্বের দাবিদার। কারণ ইসলামী আদর্শ বা জীবনব্যবস্থা মূলত নেতৃত্বকেন্দ্রিক। আনুগত্যের যে কাঠামো আল কোরআন ঘোষণা করেছে তাতেও নেতৃত্বকে মুখ্য ভূমিকায় রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং সেই সব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্বসম্পন্ন।’ (সূরা আন নিসা : ৫৯) নেতৃত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেন, ‘মাত্র তিনজন কোথাও ভ্রমণে বের হলেও একজনকে নেতা বানিয়ে নাও।’ ইসলামে নেতৃত্বে গুরুত্ব কতখানি তা বুঝা যায় এই ঘটনার মাধ্যমে যে রাসূলে পাকের (সা) ইন্তেকালের পর তার কাফন, জানাজা ও দাফনের কাজ সমাধা করার আগেই মুসলিম মিল্লাতের জন্য ইমাম নিযুক্ত করাকে সাহাবীরা সর্বসম্মতভাবে জরুরি মনে করেছেন। মানব প্রকৃতির এটা একটা স্বাভাবিক প্রবণতা যে, সে তার চেয়ে বড়, উন্নত বা উত্তম কারো অনুসরণ করতে চায়। ইসলাম মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা আদর্শ। তাই মানবজাতিকে ইসলামের পথে চলার জন্য রাসূল (সা)-এর নবুওয়তি জীবনের শুরুতে আবু বকর (রা), উমর (রা), উসমান (রা) ও আলী (রা)-এর মত অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য কিছু ব্যক্তি সৃষ্টিকে ইসলাম প্রাধান্য দিয়েছে। নেতা বা দায়িত্বশীলের গুণাবলি ১. ঈমান ও তাকওয়ার দিক থেকে অগ্রগামী একজন দায়িত্বশীল নেতৃত্বকে অবশ্যই ঈমানের যাবতীয় বিষয়ে নিঃসংশয় ও মজবুত ঈমানের অধিকারী হতে হবে। সেই সাথে হতে হবে তাকওয়ার দিক দিয়ে অগ্রগামী। আল্লাহর কাছে সে-ই সম্মানিত যে তাঁকে ভয় করে (৪৯:১৩)। সুতরাং আল্লাহকে তেমনিভাবে ভয় কর যেমনটি ভয় করা উচিত (০৩:১০২)। গোপন ও প্রকাশ্য সর্বাবস্থায় তাঁকে ভয় করা ঈমানের দাবি। হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা) বলেছেন, ছোটখাটো গুনাহের ব্যাপারেও সতর্ক হও কেননা তার জন্যও জবাবদিহি করতে হবে। হযরত রাসূল (সা) থেকে হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, আল্লাহ তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে তাকাবেন না, বরং তোমাদের অন্তকরণ ও কাজের দিকে তাকাবেন। তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে চরিত্রের দিক থেকে উত্তম (হাদিস)। সকল কাজের সফলতা-কিংবা বিফলতা নির্ভর করে আত্মার পরিশুদ্ধিতার ওপর। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, যে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করল সে সফলকাম আর যে আত্মাকে কলুষিত করল সে ব্যর্থ হলো। (সূরা আশ্ শামস : ৯-১০) রাসূল (সা) ঘোষণা করেন, মানবদেহে এক টুকরো গোশত রয়েছে। যখন সেটি পরিশুদ্ধ হয় তার সব কিছুই পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর যখন তা কলুষিত হয় তখন তার সব কিছুই কলুষিত, বিপথগামী ও বিনষ্ট হয়ে যায়। (শরহু রিসালাতে কিতাবুল ঈমান) ২. উন্নত আমল ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের আমল হতে হবে সর্বোন্নত। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন, তোমরা ঐসব ব্যক্তির অনুসরণ কর যারা তোমাদের কাছে প্রতিদান কামনা করে না এবং তারা হেদায়েতপ্রাপ্ত। (সূরা ইয়াসিন : ২১) এ আয়াতে কারিমার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দায়িত্বশীলদেরকে হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। এটা অর্জিত হতে পারে ঈমানী মজবুতি ও উন্নত আমলের মাধ্যমে। এ জন্য দায়িত্বশীলদের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতের পাশাপাশি নফল বা মুস্তাহাবের প্রতিও যতœবান হতে হবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, (রাতের শেষ ভাগে) তাদের পার্শ্বসমূহ বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং পালনকর্তার আজাবের ভয়ে ও রহমতের আশায় তাকে ডাকাডাকি করতে থাকে। (সূরা আস সিজদাহ : ১৬) সূরায়ে ফাতহের শেষ দিকে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর সাথীদের অর্থাৎ নেতা ও কর্মীদের কয়েকটি বিশেষ গুণের বর্ণনা করেছেন। ‘...মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সাথী-সঙ্গীগণ কাফেরদের মোকাবিলায় কঠোর এবং পরস্পরের প্রতি রহমদিল। যখনই তাদের দেখতে পাবে তারা হয় রুকু, সেজদা বা আল্লাহর ফজল এবং রেজামন্দি তালাশে নিয়োজিত আছে। তাদের চেহারায় সেজদার ছাপ বিদ্যমান যা দ্বারা তাদের সহজেই চেনা যায়। (আল ফাতহ : ২৮-২৯) একজন যোগ্য সংগঠকের ব্যবহার অবশ্যই সুন্দর হতে হবে। তিনি কখনো রুক্ষভাষী হবেন না। তাঁর আচরণ রূঢ় হবে না। বরং তাঁর আচরণ কর্মীদেরকে চুম্বকের মতো কাছে টেনে নিয়ে আসার মতো মধুর হওয়া চাই। দায়িত্বশীলদের অবশ্যই কথা-কাজের মিল থাকতে হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুমিনগণ! তোমরা যা কর না, তা কেন বল? তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক। (সূরা আস্ সফ-২-৩) ৩. সত্যবাদিতা ও উন্নত নৈতিকতা মিথ্যা হচ্ছে সকল পাপের জননী। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বাতিল শক্তির জয়জয়কার অবস্থা দেখে বিভ্রান্ত হয়ে অনেকের মধ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যেতে পারে। ইসলামী নেতৃত্ব কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে না। লুকোচুরি খেলে ঊর্ধ্বতন ও অধীনস্থদের ধোঁকা দিতে পারেন না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সহিত মিশ্রিত করিও না এবং জানিয়া শুনিয়া সত্য গোপন করিও না।’ (সূরা বাকারা : ৪২) ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক।’ (সূরা আত-তাওবা : ১১৯) সত্যবাদীদের বলা হয় সাদেকিন। এর অর্থ যারা বোধ ও বিশ্বাসে সত্যবাদী, কাজে সত্যবাদী এবং লেনদেন, বেচাকেনাসহ সকল ক্ষেত্রে সত্যাশ্রয়ী। সত্যবাদী ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহতায়ালা জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন। ‘আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকার করবে। তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে যার তলদেশে প্রবাহিত হবে নদী। তারা তাতেই থাকবে চিরকাল।’ (সূরা আল মায়িদা : ১১৯) কাজেই কঠিন বিপদে কিংবা লোভে পড়ে বা কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য কখনই সত্যবাদিতা ও উন্নত নৈতিকতা থেকে দূরে সরে যাওয়া যাবে না। ৪. জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলকে অবশ্যই জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। জ্ঞান এক মহাশক্তিশালী রসদ। এ সম্পদ যদি হেদায়েতের পথে ব্যবহার হয় আল্লাহ তা’য়ালা তার সেই জ্ঞানী বান্দাকে এর প্রতিদান দেন চমৎকারভাবে। হাদিসে  জ্ঞান অন্বেষণকারীর মর্যাদার বর্ণনা এসেছে, “হজরত আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন- যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে, আল্লাহ তা’য়ালা তার বেহেশতের পথ সহজ ও সুগম করে দেবেন। আর ফেরেশতাগণ ইলম অর্জনকারীর সন্তুষ্টির জন্য নিজের পাখা বিছিয়ে দেয়। আলিম ব্যক্তির জন্য আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সকলেই মাগফিরাতের দোয়া করে, এমনকি পানির ভেতরের মাছও। আর আবিদের ওপর আলিম ব্যক্তির মর্যাদা হচ্ছে সমগ্র তারাকাজির ওপর পূর্ণিমা রাত্রের চাঁদের যে মর্যাদা। অবশ্য আলিমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ তাঁদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে দিরহাম ও দিনার রেখে যাননি; তবে তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ইলম রেখে গেছেন। কাজেই যে ব্যক্তি তা আহরণ করল সে ব্যক্তি বিপুল অংশ লাভ করল। (তিরমিযি) উপরিউক্ত হাদিস বর্ণনার উদ্দেশ্য এই যে জ্ঞানী হতে হলে জ্ঞান অন্বেষণের তীব্র বাসনা থাকতে হয়। এক্ষেত্রে চার ধরনের জ্ঞান অর্জন অপরিহার্য। ক. আদর্শিক জ্ঞান : আল কুরআনে প্রথম নাজিলকৃত আয়াতে পড়ার কথা বলা হয়েছে, “পড় তোমরা প্রতিপালকের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আলাক : প্রথম আয়াত) এ থেকে বুঝা যায় যে জ্ঞান অর্জন করা সকলের ওপর ফরজ। সেক্ষেত্রে জ্ঞান এমন হতে হবে যাতে ¯্রষ্টাকে চেনা যায়। দায়িত্বশীলকে অবশ্যি ইসলামের আকিদা বিশ্বাসকে জাহেলি চিন্তা কল্পনা ও ইসলামী কর্মপদ্ধতিকে জাহেলিয়াতের নীতিপদ্ধতি থেকে আলাদা করে জানতে হবে এবং জীবনের বিভিন্ন বিভাগে ইসলাম মানুষকে কোন পথ দেখিয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হতে হবে। ইসলামের আলোকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যাবলির সমাধান করতে হবে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা ও শিল্পকে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে বিন্যস্ত করতে হবে। আধুনিক চিন্তা ও কর্মের ত্রুটিপূর্ণ অংশকে ত্রুটিহীন অংশ থেকে আলাদা করার মত সমালোচনার যোগ্যতা তাদের মধ্যে থাকতে হবে। এই গুণ অর্জন করার জন্য সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ অর্থসহ কমপক্ষে তিনবার তেলাওয়াত, নিয়মিত কুরআনের তাফসির অধ্যয়ন করা, একবার সিহাসিত্তার সকল হাদিস, যে কোন ৩টা সিরাত গ্রন্থ ও ইসলামী সাহিত্য ভালোভাবে পড়া দরকার। এতে করে আদর্শিক জ্ঞানের মজবুত ভিত্তি তৈরি হবে। এর পাশাপাশি অনলাইনে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ড. জাকির নায়েক, নোমান আলী খান, ড. ইয়াসির কাদরি, তারেক রমাদান প্রমুখ স্কলারের আলোচনা শোনা দরকার। খ. একাডেমিক জ্ঞান: আদর্শিক জ্ঞানের পাশাপাশি নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই স্ব স্ব একাডেমিক অঙ্গনে পারদর্শী হতে হবে। যার একাডেমিক ক্যারিয়ার যত উজ্জ্বল তার জন্য দাওয়াতি কাজ করা তত সহজ। বর্তমানে আমাদের সেক্টরভিত্তিক এক্সপার্ট বা আইকন লোকের অভাব রয়েছে। তাই আমাদেরকে নিজেদের ও জনশক্তিদের একাডেমিক ক্যারিয়ারের ব্যাপারে আরো সচেতন ও সচেষ্ট হওয়া উচিত। নচেৎ জনগণের ম্যান্ডেট পেলেও মিসরের মত দেশ পরিচালনা করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। এজন্য আউটপুট পরিকল্পনার আলোকে দায়িত্বশীলদের নিজেদের ও জনশক্তিদের পেশাগত লক্ষ্য নির্ধারণ করা দরকার। সে লক্ষ্য অর্জনে নিবিড় তত্ত্বাবধান ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের ও জনশক্তিদের গড়ে তোলা প্রয়োজন। গ. ভাষাগত জ্ঞান: বিশ^ায়ন বা মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে সংগঠন, দেশ, জাতি, বা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ও আরবিসহ কমপক্ষে ৪-৫টি ভাষায় পারদর্শী হতে হবে। বিশেষ করে ইংরেজি ও আরবি ভাষায় পারদর্শিতা ছাড়া বর্তমান সময়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া খুবই কঠিন। এছাড়া শেখার ক্ষেত্রে চায়নিজ ও হিন্দি ভাষা অগ্রাধিকার পাবে। ২০১৫ সালে তুরস্কে অনুষ্ঠিত সারা বিশ্বের ইসলামী ছাত্রসংগঠনগুলোর সম্মেলনসহ ৩টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে আমার এই উপলব্ধি খুবই প্রকট হয়েছে। তুরস্কে সম্মেলনের ফাঁকে আমরা মরোক্কো ও আলজেরিয়ার কিছু ভাইয়ের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসতে গিয়ে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। কারণ দেখলাম আমরা যা কিছু ইংরেজি পারি তারা তা পারে না আবার তারা আরবি পারে কিন্তু আমরা তা পারি না। এতে করে সালাম ও কুশল বিনিময় ছাড়া আর তেমন কিছুই করা গেল না। তাই আরবি ও ইংরেজি যে কোন একটি ভাষায় এক্সপার্ট হওয়া আমাদের দায়িত্বশীল ও সদস্যদের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে উদীয়মান বিশ্ব পরাশক্তি চীন, জাপান ও ভারতের ভাষাগুলো আমাদের গুরুত্ব দিয়ে শেখা উচিত। ঘ. সমসাময়িক জ্ঞান : দায়িত্বশীলকে একাডেমিক ও আদর্শিক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি চলমান বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে হবে। ঘটনাবহুল বিশ্বের সকল খবরা-খবর, বিজ্ঞানের অতিপ্রয়োজনীয় জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন অবশ্যই জরুরি। দৈনিক পত্রিকা, সাময়িকী নিয়মিত পড়তে হবে। রেডিও টেলিভিশনে খবর দেখতে হবে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া যেমন আল জাজিরা, বিবিসি, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সৌদি গেজেট ইত্যাদিতে প্রকাশিত নিউজ জানতে হবে। ৫. সাহসিকতা সাহসিকতা নেতৃত্বের মুকুটস্বরূপ। ভীরু ও কাপুরুষ লোকদের পক্ষে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়। বিশ্বের ইতিহাস তো বটেই ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই যে সাহসিকতা ও নেতৃত্ব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। হযরত মুহাম্মদ (সা), উমর (রা), হযরত আলী (রা), হযরত খালেদ সাইফুল্লাহ (রা) স্পেন বিজয়ী সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদ, ভারত বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাশেম, ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি, সালাহউদ্দিন আইয়্যুবী সকলেই ছিলেন সাহসিকতার প্রতীক। আর বিজয়ের মুকুট তারাই পরেছেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত উমর ফারুক (রা)-এর ঘোষণা দিয়ে বায়তুল্লাহতে গিয়ে প্রকাশ্য সালাত আদায়, হিজরতের সময় মক্কার কাফের সর্দারদের প্রতি ওপেন চ্যালেঞ্জ ইসলামের বিজয়কে অনেক বেশি ত্বরান্বিত করেছিল। সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েফ এরদোগান সেনা অভ্যুত্থানের মুখে জীবন রক্ষার্থে পালিয়ে না গিয়ে ফেসবুক লাইভে জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়ে নিজে রাস্তায় নেমে প্রমাণ করে দিয়েছেন নেতৃত্বের জন্য সাহসিকতা কত বড় আশীর্বাদ। ৬. সৃজনশীলতা পুরনো পথে সবাই হাঁটতে পারে কিন্তু নতুন পথে হাঁটার জন্য চাই প্রতিভা ও মননশীলতা। দিন যত যাচ্ছে বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির ততবেশি উন্নয়ন হচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষের চিন্তা চেতনা, চাহিদা ও রুচিবোধ। বাড়ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জ। এরকম পরিস্থিতিতে আমাদেরকে চিন্তা, গবেষণা ও নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবনের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। দাওয়াতি কাজের নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ, দাওয়াতি উপকরণ তৈরি, সংগঠন সম্প্রসারণ-মজবুতি অর্জন, জনশক্তির মানোন্নয়ন-মান সংরক্ষণ, আউটপুট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং অনাগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আরো বেশি সৃজনশীল হতে হবে। কাজের একটা পথ ও ক্ষেত্র বন্ধ হয়ে গেলে আরো ১০টি পথ ও ক্ষেত্র উদ্ভাবন করতে হবে। একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘বিখ্যাত ব্যক্তিরা ভিন্ন কোন কাজ করে না বরং একই কাজ ভিন্নভাবে করে।’ তাই বর্তমান এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমরা দেখতে পাই যে সকল শাখা বা দায়িত্বশীলরা কাজের নতুন নতুন কৌশল বা পন্থা উদ্ভাবন করতে পারেন তারাই সবকিছু অব্যাহত রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন। ৭. আত্মবিশ্বাস আত্মবিশ্বাস নেতৃত্বকে তার লক্ষ্য অর্জনে চলার পথকে সহজ করে দেয় এবং অবিচল রাখে। হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জীবন থেকে আমরা দেখতে পাই যে তার জন্মের ছয় মাস পূর্বে তার বাবা মারা গিয়েছিলেন, জন্মের ছয় বছর পর মাকে হারিয়েছেন, আট বছর পর হারিয়েছেন দাদাকে। এভাবে একের পর এক চাচা আবু তালেব, স্ত্রী খাদিজা ও প্রিয় সন্তানদের হারিয়েছেন কিন্তু বিচলিত হননি। এত কিছুর পরও আরবের আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের পথে তিনি আত্মবিশ্বাসী ও অবিচল ছিলেন এবং তা বাস্তব রূপ দান করেছিলেন। এছাড়াও আমরা দেখি যে কাঠুরিয়ার ছেলে আবরাহাম লিংকন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন যা প্রচণ্ড আত্মবিশ^াসের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। দরিদ্রতার কারণে তিনি মাত্র ১৮ মাস প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পেরেছিলেন। তিনি নিজে নিজে বই পড়ে আইনজীবী হয়েছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে বারবার তিনি পরাজিত হলেও হতাশ হননি। মহৎ ব্যক্তিদের জীবনে এমন উদাহরণ প্রচুর। কেউ যখন তাদের বিশ্বাস করতে পারতো না বা হেসে উড়িয়ে দিত তখনও তারা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য টানা লেগে থাকতেন। ৮. পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত পড়াশোনা, পারিবারিক ও সামাজিক কাজের পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। ভারসাম্যপূর্ণ জীবন পরিচালনার জন্য এক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রম ও কষ্টসহিষ্ণু হওয়ার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আমাদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন শহীদ আবদুল মালেক। যিনি সারাদিন শত ব্যস্ততা ও কঠোর পরিশ্রমের পরও রাতে প্রয়োজনীয় একাডেমিক পড়াশোনা শেষ না করে বিছানায় যেতেন না। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু এক মানুষের উদাহরণ। তিনি নিজ হাতে খাল কেটেছেন এবং গ্রামাঞ্চলে নিজে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে উন্নয়নকাজ উদ্বোধন ও তদারকি করেছেন। এমনও হতো যে তার সাথে দীর্ঘ পথ হেঁটে অনেকে ক্লান্ত হয়ে যেত। কিন্তু তিনি সবার আগে দৃঢ় পায়ে পথ চলতেন। ৯. সবাইকে কাজে লাগানোর যোগ্যতা সংগঠনের কর্মীরা এক ধরনের কাঁচামাল। এদের মাঝে সুপ্ত থাকে অনেক সম্ভাবনা। কর্মীদের নানামুখী প্রতিভা বিকাশের কর্মকৌশল উদ্ভাবন করা সংগঠকেরই কাজ। সংগঠক ভালোভাবে কর্মীদের স্টাডি করবেন। কারা ময়দানের কাজে বেশি উপযুক্ত হবে তা বুঝে তাদেরকে চিহ্নিত করবেন। কর্মীদেরকে ভালো সংগঠক, ভালো লেখক, ভালো বক্তা, ভালো সমাজকর্মী এবং ভালো জননেতারূপে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। একটি আদর্শবাদী রাষ্ট্রগঠন ও পরিচালনার জন্য উন্নত মানের রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, প্রশাসক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, আইনবিদ, সাহিত্যিক, কূটনীতিবিদ, বিজ্ঞানী ইত্যাদি প্রয়োজন। একজন সংগঠককে বুঝতে হবে তাঁর কর্মীবাহিনীর প্রতিভাবান ব্যক্তিদের কে কোন ময়দানের জন্য বেশি উপযুক্ত। যারা যেই ময়দানের উপযুক্ত সুদূরপ্রসারী চিন্তা নিয়ে তাদেরকে সেই ময়দানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা সংগঠকেরই কাজ। এজন্য প্রয়োজন জনশক্তির মান, আগ্রহ, উৎসাহ, অঃঃরঃঁফব, গবহঃধষরঃু, ঊীঢ়বপঃধঃরড়হ, বিচক্ষণতা, সবকিছুর ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা, মূল্যায়ন ও তত্ত্বাবধান। ১০. বাগ্মিতা বা প্রেরণাদায়ক বক্তৃতা আকর্ষণীয় ও প্রেরণাদায়ক বক্তৃতা দানের যোগ্যতাও নেতৃত্বের একটি অনেক বড় গুণ। একজন যোগ্য সংগঠককে অবশ্যই সুবক্তা হতে হবে। বক্তৃতা-ভাষণের মাধ্যমেই তিনি আদর্শের বিভিন্ন দিক, আন্দোলনের গুরুত্ব এবং সংগঠনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য জনগণের সামনে তুলে ধরবেন। তাঁর বক্তৃতার ভাষা হতে হবে সহজবোধ্য। এতে থাকতে হবে বলিষ্ঠতা এবং কর্মীদের উদ্দীপিত করার ক্ষমতা। একজন বক্তাকে সুন্দর উপস্থাপনা, আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, প্রোগ্রামের ধরন, শ্রোতাদের মন মানসিকতা ও উপযোগিতার বিষয় খেয়াল করা, পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এর পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ বক্তাদের বক্তব্য শোনা ও অনুশীলন করা প্রয়োজন। যেমন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, শেখ মুজিবুর রহমান, বারাক ওবামা, ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ইত্যাদি। ১১ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার/প্রভাবিত করার ক্ষমতা আন্দোলনের কর্মীদেরকে নানামুখী কাজ-কর্ম করতে হয়। এইসব কাজ যেমনি দাবি করে সময়, তেমনি পরিশ্রম। আবার আদর্শিক আন্দোলনের পথ মোটেই ফুলবিছানো নয়। এই পথে আছে নানা বাধা-বিপত্তি। তদুপরি কর্মীদের অনেকেরই বড়ো বড়ো ব্যক্তিগত সমস্যা থাকে যা তাদেরকে হতোদ্যম করে ফেলতে পারে। যাবতীয় কাঠিন্য বরদাশত এবং সমস্যা ও বাধা উপেক্ষা করে আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালাবার মন-মানসিকতা সজীব রাখার জন্য নেতৃত্বকে ভূমিকা পালন করতে হয়। আদর্শিক জ্ঞান বিতরণ, সদালাপ, অমায়িক ব্যবহার এবং উন্নত চরিত্রের প্রভাব দিয়েই কেবল নেতৃত্ব এই ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারেন। ১২. বিভিন্ন কাজের ভারসাম্য সংরক্ষণ সংগঠনের আদর্শিক কনসেপ্টগুলো সাধারণের কাছে ছড়িয়ে দেয়া সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটানোর কাজ, জনশক্তির মানোন্নয়ন, সমাজসেবা ও সংস্কারমূলক কাজ, সংগঠনের গণভিত্তি রচনার কাজ, জনগণের নেতৃত্ব দান- এই ধরনের বহুমুখী কাজ একটি সংগঠনকে আঞ্জাম দিতে হয়। এই কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য পুরো জনশক্তিকে মাঠে ময়দানে নিয়োজিত করতে হয়। সংগঠক লক্ষ রাখবেন যাতে এক প্রকারের কাজের আধিক্য অপরাপর কাজগুলোকে গুরুত্বহীন না করে ফেলে। কোন এক সময় কোন এক ধরনের কাজ বেশি গুরুত্ব পেয়ে যাওয়াতে অপর কোন একটি কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে দেখলে পরবর্তী সময়ে সেই কাজটির ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সামগ্রিকভাবে কাজের ভারসাম্য রক্ষা করা একজন সুযোগ্য সংগঠকের পক্ষেই সম্ভব। ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা, সময় সচেতনতা, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করার প্রবণতা, কাজের Priorityএর আলোকে বিন্যাস, প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে Deep sense এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দায়িত্বশীলকে স্বচ্ছ চিন্তা ও জবাবদিহিতার মানসিকতা সম্পন্ন হতে হবে। সকল বিতর্ক ও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে হবে। রাসূল (সা)-এর জীবনী থেকে আমরা দেখতে পাই এক রাতে তিনি যখন আয়েশা (রা) এর সাথে অবকাশ সময় কাটাচ্ছিলেন এই সময় পাশ দিয়ে একজন সাহাবী চলে যাচ্ছিলেন। তখন রাসূল (সা) তাকে ডাকলেন এবং পরিচয় করিয়ে দিলেন; উনি হচ্ছেন তোমাদের মা আয়েশা (রা)। আবার আমরা দেখতে পাই উমর ফারুক (রা) যখন গনিমতের মাল থেকে প্রাপ্ত কাপড় দিয়ে জামা তৈরি করে সেই জামা গায়ে দিয়ে মিম্বারে খুতবা দেয়ার জন্য দাঁড়ালেন তখন সামনে থেকে একজন সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন, হে ওমর! আমরা যে জামা-কাপড় পেলাম তা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ জামা হলো না কিন্তু আপনার হলো কি করে? আগে সেই প্রশ্নের জবাব দিন তারপর খুতবা দিন। তখন পাশ থেকে ওমর (রা) এর ছেলে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আমার অংশটুকু বাবাকে দিয়ে তার জন্য জামা সেলাই করে দিয়েছি। এরকম কঠোর জবাবদিহিতার পরও উমর ফারুক (রা) প্রশ্নকারীর ওপর রাগ করেননি বরং খুশি হয়েছেন। এর চেয়ে বড় accountability বা জবাবদিহি করার মানসিকতা আর কী হতে পারে? ১৪. ধৈর্য ও সহনশীলতা ধৈর্য ও সহনশীলতা নেতৃত্বের জন্য ২টি অপরিহার্য গুণ। Hot temperatured ও অসহিষ্ণু স্বভাবের লোকজন নেতৃত্ব দিতে পারে না। নেতৃত্বকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়, নিতে হয় অনেক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই সকল সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় যার মাথা যতো ঠাণ্ডা থাকে তিনি তত ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই জন্য ডেল কার্নেগির একটা উক্তি হচ্ছে, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে দায়ীর গুণাবলি হিসেবে ধৈর্যকে এবং এটা আল্লাহর একটা নেয়ামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ‘সমান নয় ভাল ও মন্দ। জওয়াবে তাই বলুন যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সাথে যে ব্যক্তির শুত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। এ চরিত্র তারাই লাভ করে, যারা সবর করে এবং এ চরিত্রের অধিকারী তারাই হয়, যারা অত্যন্ত ভাগ্যবান।’ (সূরা হামীম আস সাজদা : ৩৪-৩৫) ১৫. আস্থাশীল নেতাকে হতে হবে বটগাছের মত জনশক্তির আস্থার প্রতীক। তাকে হতে হবে বটগাছের মত ভাল খারাপ, সুসময়-দুঃসময় সকল পরিস্থিতিতে তিনি হবেন সকলের জন্য আশ্রয়স্থল। গানের ভাষায়, ‘যার কাছে সবকিছু প্রাণ খুলে বলা যায়, হওয়া যায় আশ্বস্ত। তার নাম আহম্মদ, বড়ই বিশ্বস্ত।’ ১৬. বহির্মুখিতা ও সামাজিকতা নেতৃত্বকে অবশ্যয়ই Extroverted ও সামাজিক হতে হবে। অন্তর্মুখী ও অসামাজিক লোক নেতৃত্ব দিতে পারে না। নেতৃত্বকে সবসময় তার চারপাশের মানুষ ও তার নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখতে হয়। প্রাণ খুলে মিশতে হয়। মন খুলে কথা বলতে হয়। যে ব্যক্তি যতবেশি সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারে, বুকে জড়িয়ে ধরতে পারে, ধনী-গরিব নির্বিশেষে হাত মিলাতে পারে সে ততবেশি জনপ্রিয় দায়িত্বশীল বা নেতা হতে পারেন। আর এ জন্যই রাসূল (সা) বলেছেন হাসিমুখে কথা বলা সদকা। জামায়াতের বর্তমান আমির মকবুল আহমাদ, সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী, সাতক্ষীরার সাবেক আমির আব্দুল খালেক যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ১৭. ন্যায়পরায়ণতা বা নিরপেক্ষতা ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল হিসাবে আমরা যখন কোন পরামর্শ দেই, কোন ব্যক্তির ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেই, কাউকে দায়িত্বশীল হিসাবে তৈরি করি তখন আমাদের উচিত আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করা যে আমি যা করছি আমি কি তা সকল রাগ, ক্ষোভ, আঞ্চলিকতা ও ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করছি নাকি এখানে অন্য কোন উদ্দেশ্য রয়েছে। ন্যায়পরায়ণতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারলে জনশক্তির স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য ও সহযোগিতা পাওয়া যায় যা একজন দায়িত্বশীলের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। হযরত উমর (রা) তার ছেলে আবু শামাকে মদ্যপানের অপরাধে নিজ হাতে বেত্রাঘাতের শাস্তি প্রদান করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ধরনের ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। ১৮. উচ্চাশা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল বা কঠিন হোক না কেন, বাতিলের দাপট যতই ভয়াবহ ও স্থায়ী হোক না কেন নেতৃত্বকে কখনো হতাশ হওয়া কিংবা জনশক্তির সামনে হতাশা প্রকাশ করা যাবে না। হিজরতের সময় সুরাকা ইবনে নওফেলসহ মক্কার কাফিররা  পেছনে ধাওয়া করতে করতে খুব কাছে চলে আসায় হযরত আবু বকর (রা) যখন কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠলেন তখনও রাসূল (সা) সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘লা তাহজান ইন্নাল্লাহা মাআনা’। খন্দকের যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসূল (সা) যখন সাহাবীদেরকে নিয়ে মদিনার চারপার্শ্বে পরিখা খনন করছিলেন তখন হঠাৎ করে একটা বড় পাথর পড়ল যা কেউ ভাঙতে পারছিল না তখন সাহাবীরা রাসূল (সা)কে ডাকলেন। পাথরে আঘাত করার পর ঐ পাথর থেকে অগ্নি বিচ্ছুরিত হয়ে পড়লে রাসূল (সা) বললেন, ‘রুম বিজয় হবে, পারস্য বিজয় হবে’। তিনি এই আশাবাদ তখন প্রকাশ করলেন যখন তিনিসহ সাহাবীরা উপবাস অবস্থায় পেটে কোমরবন্ধনী বেঁধে মদিনা রক্ষা করার জন্য পরিখা খনন করছিলেন। এর চেয়ে বড় আশাবাদী নেতা পাওয়া দুষ্কর। ১৯. সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা দায়িত্বশীলদেরকে দৈনন্দিন কাজে নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি নিতে হয় অনেক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় দায়িত্বশীলকে হতে হয় দৃঢ় ও বিচক্ষণ। দায়িত্বশীলকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিভিন্ন দিক যাচাই বাছাই এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও অভিজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে দৃঢ় কদমে এগিয়ে যেতে হয়। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে যবংরঃধঃরড়হ ভববষ করা কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বারবার পরিবর্তন করলে নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ২০. পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা/অভিযোজন ক্ষমতা দায়িত্বশীলদের অবশ্যই পরিস্থিতি বুঝার ও পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। আল্লাহর রাসূল (সা)-এর মাক্কী জীবনে সাহাবীরা বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও যুদ্ধের বা পাল্টা আঘাতের অনুমতি দেননি। আবার মদিনায় হিযরত করার পর কাফেরদের আক্রমণের মুখে রুখে দাঁড়িয়েছেন বা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। মক্কার ধৈর্যশীল ব্যক্তিরা পরবর্তীতে জীবনের মায়া না করে যুদ্ধের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। একের পর এক শরিয়তের বিধান আসতে থাকে এবং সাহাবীরা তা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেন। বহুদিনের অভ্যাস মুহূর্তের মধ্যে ত্যাগ করেন। ২১. পরোপকারী যদিও বলা হয় নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো বোকামি। কিন্তু ইসলামের ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। নিজে না খেয়ে অপরকে খেতে দেয়া শুধু নয়, জীবন সায়াহ্নেও সাহাবীরা অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে পর্যন্ত ঢলে পড়েছেন। মুতার যুদ্ধে পানি পানি করে চিৎকার এবং পানি আসার পর একে অপরকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন অনেকেই। আবু বকর (রা)-এর শাসনামলে স্বয়ং খলিফা কর্তৃক নির্জন পাহাড়ে অবস্থানরত নিঃস্ব বৃদ্ধা মহিলার বাড়ির গাভীর দুধ দোহনসহ সকল কাজকর্ম সম্পাদন করা পরোপকারের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ২২. তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পারদর্শিতা বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচারণার কাজ করা হয়। সমমনা মানুষকে সংগঠিত করা হয়। প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে হচ্ছে। ছোট পরিসর থেকে বড় সব ক্ষেত্রেই তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া যেন কিছুই করা সম্ভব নয়। বর্তমান সময়ে অনেক আন্দোলন সংগ্রামের সফলতার মূলে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। যেমন আরব বসন্ত বা বাংলাদেশের শাহবাগ ও হেফাজত আন্দোলন ইত্যাদি। ২৩. সময়ানুবর্তিতা সময় সচেতনতা ও সময়ানুবর্তিতা যোগ্য দায়িত্বশীলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সময়ানুবর্তিতা বলতে- সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা বা অল্প সময়ে অধিক কাজ করা বা সময়ের কাজ সময়ে করাকে বুঝায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমনÑ রাতে ঘুমানোর আগে বা ফজরের পরে সারাদিনের কাজের শিডিউল করে কাজ করা, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা, মেস বা বাসায় অযথা আড্ডা থেকে বিরত থাকা, কারো সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে শিডিউল নিয়ে যাওয়া, অবসর সময়কে কাজে লাগানো (কুরআন তেলাওয়াত, বই পড়া, শব্দার্থ মুখস্থ করা)। ২৪. ত্যাগ কুরবানিতে অগ্রগামী যে কোন পর্যায়ে দায়িত্বশীলদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়। ত্যাগ কুরবানির ক্ষেত্রেও দায়িত্বশীলদের সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং সর্বোচ্চ কুরবানির জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হযরত ইবরাহিম (আ)-এর কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা নিয়েছেন। আবার খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু হিসেবে ঘোষণা করে মুসলিম জাতির পিতা বানিয়ে সর্বোচ্চ মর্যাদাও দিয়েছেন। সমাবেশে সন্ত্রাসীরা গুলি করা শুরু করলে মাওলানা মওদূদী ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকলেন। অন্যরা যখন তাকে বলল মাওলানা আপনি বসে পড়েন তখন তিনি বলেছিলেন, আমি বসে পড়লে দাঁড়িয়ে থাকবে কে? সাবেক আমিরে জামায়াত শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের হাসি মুখে ফাঁসির রশি বরণ ত্যাগ কুরবানির ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দের অগ্রগামিতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ২৫. শৃঙ্খলা বিধানের যোগ্যতা শক্তিশালী সংগঠন মানেই সুশৃঙ্খল সংগঠন। আর শৃঙ্খলার মূল উপাদান হচ্ছে আনুগত্য। আনুগত্য সম্পর্কে আল-কুরআন এবং আল-হাদিস যেইসব পথনির্দেশ পেশ করেছে সেইগুলো সম্পর্কে কর্মীবাহিনীকে ওয়াকিফহাল করে তোলা এবং এই বিষয়ে কর্মীদেরকে সদাজাগ্রত রাখা সংগঠকেরই কাজ। সংগঠনের সকল পর্যায়ে আনুগত্যের রুহানি পরিবেশ, নিয়মশৃঙ্খলা বিধান ও অভ্যন্তরীণ জান্নাতি পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারা নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান গুণ। এই ক্ষেত্রে নেতৃত্বের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে সকল পর্যায়ে close monitoring ও শৃঙ্খলাবিরোধী কোন পরিবেশ যাতে তৈরি না হয় তা নিশ্চিত করা। নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলার ক্ষেত্রে কোন কর্মীর শৈথিল্য প্রকাশ পেলে অবিলম্বে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে এবং তাকে সংশোধনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পর্যাপ্ত প্রচেষ্টার পরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সংশোধিত না হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এমন ব্যক্তির প্রতি নমনীয় আচরণ করা হলে আনুগত্যহীনতাকেই উৎসাহিত করা হবে। এতে করে আনুগত্যহীনতার ব্যাধি সংক্রমিত হয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করার আশঙ্কা রয়েছে। সংগঠনের কোন পর্যায়ে কোন সমস্যা সৃষ্টি হলে তা যদি দ্রুততম সময়ে সমাধান করা না হয় তাহলে তা অল্প সময়ের ভেতরে পুরো সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই সংশোধনের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালানোর পর সংগঠনের স্বার্থেই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে একজন যোগ্য সংগঠকের কুণ্ঠিত হওয়া উচিত নয়। ২৬. ক্ষমাশীল ও রহমদিল ক্ষমাশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘তাদের বৈশিষ্ট্য তারা রাগ হজমকারী এবং লোকদের প্রতি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বনকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালোবাসেন।’’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩৪) আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, ‘‘নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ঐ ব্যক্তি যে অধীন লোকদের প্রতি কঠোর। সতর্ক থেকো যাতে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে পড়।’’ (মুসলিম ও বুখারি) কর্মীগণ সংগঠনের লক্ষ্য হাসিলের জন্য আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। কর্তব্য পালনের মান সকলের একই রকম হয় না। যোগ্যতা অনুসারে এর তারতম্য হবেই। তাছাড়া কার্য সম্পাদনকালে কারো কারো ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যেতে পারে। নেতৃত্বের কর্তব্য হচ্ছে কর্মীদের সেইসব ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। ভুলমুক্ত হয়ে কাজ করার জন্য তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কাজের মান উন্নত করার জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। আচরণের ক্ষেত্রেও সকল কর্মী একই মানের হবার কথা নয়। কারো আচরণ খুবই সুন্দর। আবার কারো আচরণে অনাকাক্সিক্ষত কিছু প্রকাশ পেতে পারে। অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটলে তা শুধরাবার প্রয়াস চালাতে হবে। বার বার সেইদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। নেতৃত্ব কর্মীদের প্রতি কোমল আচরণ করবে, তাদের প্রতি উদার হবেন এবং যত বেশি সম্ভব তাদেরকে ক্ষমাশীলতার দৃষ্টিতে দেখবেন, এটাই ইসলামের দাবি। ২৭. আমানাত সংরক্ষণ সূরা মুমিনুনে তাদেরকে সফলকাম বলা হয়েছে যারা আমানত রক্ষা করে ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও।’ (সূরা নিসা : ৫৮) সংগঠনের প্রতিটি জনশক্তি, কর্মশক্তি, জনসমর্থন, সংগঠনের অর্থ-সম্পদ সবকিছু আমাদের নিকট আমানত। এইগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং সঠিক ব্যয়-ব্যবহারের নামই আমানতদারিতা। আমাদের কোন দুর্বলতার কারণে কোন জনশক্তি যদি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, সংগঠন থেকে দূরে সরে যায়, চলে যায় জাহেলিয়াতের পথে; তাহলে আমরা আল্লাহর নিকট কী জবাব দিব? এই অনুভূতি নিয়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করা উচিত। সংগঠক কোন অবস্থাতেই সংগঠনের অর্থ ও সম্পদ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে খরচ করে ফেলবেন না। একজন যোগ্য সংগঠক আমানত সংরক্ষণে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ভূমিকা পালন করে থাকেন। সংগঠনের প্রয়োজনে সংগঠকই প্রধানত অর্থ ব্যয় করে থাকেন। অর্থ বা বায়তুলমাল সম্পাদক তহবিল সংরক্ষণ করেন। কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে তহবিলের অর্থ ব্যয় করার ক্ষমতা রাখেন না। অর্থ ব্যয়ের নির্দেশ আসবে মূল দায়িত্বশীলের কাছ থেকে। ‘রসিদ ছাড়া আয় নেই, ভাউচার ছাড়া ব্যয় নেই’ এই স্লোগান শতভাগ বাস্তবায়ন করতে হবে। একই ব্যক্তি অর্থ আদায় করা, অর্থ ব্যয় করা এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখা মোটেই উচিত নয়। এতে হিসাব সংরক্ষণে গোলমাল দেখা দিতে বাধ্য। তাই আমানতের ব্যাপারে দায়িত্বশীলকে সর্বোচ্চ সচেতন থাকতে হবে। ২৮. সঠিকভাবে রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ সুবিন্যস্তভাবে রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ করাটা একজন সুযোগ্য সংগঠকের অন্যতম বিশেষ গুণ। সংগঠনের অনেক জরুরি কাগজপত্র, ফাইল ও রেজিস্টার থাকে। এইগুলোকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। প্রত্যেকটি বিষয় সংক্রান্ত স্বতন্ত্র ফাইল, প্রত্যেকটি ফাইলে নির্দিষ্ট নাম্বার এবং ফাইলগুলোর একটি ইনডেক্স থাকা প্রয়োজন। ফাইলগুলো নির্দিষ্ট এবং নিরাপদ স্থানে সংরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কেউ এইগুলো ব্যবহার না করতে পারে। বর্তমানে সকল কাগজপত্র হার্ডকপির পাশাপাশি সফটকপিগুলো সংরক্ষণ করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসহ মেইল, গুগল ড্রাইভ, ড্রপবক্স বা পোর্টেবল হার্ডডিস্কে সাজিয়ে রাখা যেতে পারে। এতে করে ডাটা সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিরাপদ ও সহজতর হবে। ২৯. সঠিক ব্যক্তিদের বাছাই করে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক ধরনের কাজ রয়েছে। সেইগুলো এক ব্যক্তির পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই সংগঠককে একটি টিম গড়ে তুলতে হয়। বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর অর্পণ করতে হয় বিভিন্ন বিভাগের কাজ। বিভিন্ন কাজের জন্য লোক বাছাই করার ক্ষেত্রে সংগঠককে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ভেবে চিন্তে, জেনে শুনে এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিকে লক্ষ রেখে লোক নিয়োগ করা একজন বিচক্ষণ সংগঠকের একটি বিশেষ যোগ্যতা। কাক্সিক্ষত গুণাবলি অর্জনে আমাদের করণীয় হ    এই কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য দায়ীর ব্যক্তিত্ব আকর্ষণীয় হতে হবে। আর সেই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব গড়ার উপায় হিসেবে বাহ্যিক ও আত্মিক উভয় দিক দিয়ে পাক-পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হবে। শারীরিক দিক দিয়ে পোশাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়ে এবং আচার ব্যবহার, আমল আখলাকের দিক দিয়েও পূত-পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে। #    ভারসাম্যপূর্ণ জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। #    সময়কে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। #    মানসিক দৃঢ়তা ও পরিশ্রমপ্রিয়তা সৃষ্টি করতে হবে। #    ধৈর্যের সাথে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। #    জবাবদিহির মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। #    নিয়মিত অধ্যয়ন করা। ঞধনষব ড়িৎশ করা, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা। #    আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে কোন প্রতিদানের আশায় কাজ না করা। #    সকল পরিস্থিতিতে একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করা এবং একমাত্র তাকেই অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা। #    প্রতিপক্ষের, বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতা, সমালোচনার মোকাবিলায় ধৈর্য ধারণ করবে। #    নফল নামাজ রোজাসহ অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত হিসেবে নিজেকে তৈরি করা। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাপনায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নেতৃত্বের গুরুত্ব অসীম। শত বাধা, প্রতিবন্ধকতা ও হতাশার মাঝেও নেতা বা দায়িত্বশীলকে হতে হবে অনুপ্রেরণার উৎসস্থল, নির্ভরতার প্রতীক। হতে হবে ইসলামের আলোকে অনুপম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। জনশক্তিদের যোগ্যতা ও দক্ষতার মূল্যায়ন করতে হবে। একটি সফল ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে আমাদের প্রতিটি জনশক্তিকে যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তাদের মাঝে বপন করতে হবে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের এমন এক স্বপ্ন যা তাদেরকে একেক জন কারিগর হিসেবে তৈরি করবে। সর্বোপরি মহান রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ ও মুহাম্মদ (সা)-এর নির্দেশনার পথে যুগের পর যুগ টিকে থাকতে হবে সকল বাধা ও প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে। তাহলেই আমরা পৌঁছতে পারবো আমাদের কাক্সিক্ষত মঞ্জিলে। মহান আল্লাহ আমিসহ আমাদের সকলকে প্রত্যাশিত গুণাবলি অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন। হ লেখক : সাহিত্য সম্পাদক, বিআইসিএস

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির