post

বন্ধু বানাবেন কাকে?

মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত

২৮ ডিসেম্বর ২০২১

ছোটবেলায় বাংলা খাতায় হাতের লেখা প্রস্তুত করতে গিয়ে ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ লিখে কতবার যে পৃষ্ঠা পূরণ করেছি তার হিসেব নেই। পরিবারের অগ্রজ সদস্য কিংবা গৃহশিক্ষক বাংলা খাতায় এক লাইন লিখে দিতেন আর তা দেখে দেখে প্রতিদিনের হাতের লেখার খাতা পূরণ করতাম। তখন হয়তো ভেবে দেখিনি এই লাইনের কথাগুলো কত মূল্যবান। সৎ সঙ্গ বা বন্ধুত্বের সাথে স্বর্গবাসের সম্পর্ক আর অসৎ সঙ্গের সাথে সর্বনাশ তথা নরকের সম্পর্ক, এই উপলব্ধিটি নতুন করে আমার মাঝে নাড়া দিয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআন নতুন করে অর্থসহ অধ্যয়ন করতে গিয়ে অন্যতম সূরা ফুরকানের ২৭ ও ২৮ নম্বর আয়াতে এসে আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। এ দুটি আয়াতের অর্থের সাথে আমি ছোটবেলায় লেখা সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশের সামঞ্জ্যতা খুঁজে পাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস কথাগুলো মূলত কুরআনেরই কথা সূরা ফুরকানের ২৭ ও ২৮ নম্বর আয়াত থেকে নেয়া। এ দুটি আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, পরকালে জাহান্নামের অধিবাসী সেদিন তার দুনিয়ার জিন্দেগির বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করে আফসোস করবে। দুনিয়াতে বন্ধুত্ব বাছাইয়ে সে যে ভুল করেছে, সেই ভুলেই তার সর্বনাশ হয়েছে সেটি সে বলতে থাকবে। আলোচ্য দুটি আয়াতে আল্লাহ বলেন, (নিজের উপর জুলুমকারী) জালিম সেদিন নিজের হাত কামড়াতে কামড়াতে বলবে, ‘হায় আমার সর্বনাশ, যদি আমি রাসূল সা.-এর সাথে সঠিক পথ অবলম্বন করতাম, হায় দুর্ভাগ্য আমার, যদি আমি অমুককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতাম। (সূরা ফুরকান : ২৭-২৮)

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ একা চলতে পারে না। তাই সমাজে সঙ্গী-সাথীর প্রয়োজন হয়। একে অন্যের সহযোগিতা ভাবের আদান প্রদান, পারস্পরিক সম্পর্কের সেতুবন্ধ গড়তেও প্রয়োজন বন্ধু বা সহযোগীর। জীবন চলার পথে চলতে ফিরতে বহু পথে বহু প্রান্তরে বহু জনের সাথে মানুষ বন্ধুত্ব বা সখ্য গড়ে তোলে। এ প্রক্রিয়াটি মানুষের শিশু বয়স থেকেই শুরু হয়। শিশু বয়সে খেলার সাথী, কৈশোরে জ্ঞানার্জনের জন্য যখন পাঠশালায় গমন করে তখন সহপাঠী বন্ধু, কর্মজীবনে সহযোগী, পারিবারিক জীবনে কিংবা সামাজিক জীবনে বন্ধু, গুণগ্রাহী, মত ও পথের বিচারে রাজনৈতিক জীবনে দলীয় রাজনৈতিক বন্ধুত্ব মানুষের জীবনে ঘটে থাকে। এসবের সাথে মনের ভাব আদান প্রদান, সহযোগিতা দেয়া নেয়া এবং সুখ ও দুঃখ বিনিময়ের পাশাপাশি কারো কারো সাথে প্রবল এবং আন্তরিক বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে ওঠে। আর এমনই বন্ধুত্বের অংশ।

২. শিশু-কিশোর বয়সে বোধ বা বিবেচনা শক্তি তৈরি হয় না। এ সময়ে শিশু-কিশোররা খেলার সাথী বা বন্ধু হিসেবে যাকে গ্রহণ করছে তা তার পিতা-মাতা বা পরিবার পরিজনের নির্দেশনায়ই করে থাকে। পরিবারের সদস্যরা সাধারণত যাদের সাথে মিশতে দেন তাদের সাথেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু যখন থেকে মানুষের মেধা, বুদ্ধি ও বোধ জ্ঞান বাড়তে থাকে, যখন বিবেচনা করার শক্তি তৈরি হয় তখনকার বন্ধু বাছাইয়ের দায়দায়িত্ব নিজের ওপরই পড়তে থাকে। জ্ঞানার্জনের জন্য যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া হয়, জীবন জীবিকার সন্ধানে যখন কর্মব্যস্ত জীবনে প্রবেশ করা হয় এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রভাব যখন ব্যক্তির ওপর পড়ে তখন বন্ধু বাছাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ সময়গুলোতে কাকে আপনি বন্ধু বানাবেন, কার সাথে আপনি সখ্য গড়ে তুলবেন তা অবশ্যই বাছাই করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা এবং সচেতন থাকা অনেক অনেক বেশি জরুরি। বন্ধু বানানো ঠুনকো কোনো বিষয় হতে পারে না। এটি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ বন্ধু যদি সৎ হয় তাহলে সামাজিক চলার পথ হবে কল্যাণকর। একজন সৎ বন্ধু বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, সাহায্য করতে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসে, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভালো পরামর্শ দিয়ে বন্ধুকে উপকৃত করে। আর অসৎ বন্ধু বিপদে বন্ধুর সহযোগিতার চাইতে বন্ধুকে গর্তে ফেলে নিজের স্বার্থ পূরণে সচেষ্ট হয়। এ জন্য বিশ^ মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. দেখে শুনে বিবেচনা করেই বন্ধু বানাতে বলেছেন। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, বন্ধুর ধর্মই মানুষের ধর্ম, কাজেই তোমাদের কেউ যখন কারো সাথে বন্ধুত্ব করবে তখন সে যেন তা দেখে শুনে বিবেচনা করে। (তিরমিজি)। সৎ বন্ধু বাছাইয়ের উপকারিতা অনেক বেশি। অনেক সময় দেখা যায় সৎ বন্ধু তার অপর বন্ধুর উপকারিতা না করতে পারলেও কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করে না। সৎ বন্ধুর দ্বারা এমন আচরণ সম্ভব হয় না। পক্ষান্তরে অসৎ বন্ধুর সাথে সামগ্রিক সময়ই অকল্যাণকর। রাসূল সা. সৎ বন্ধু আর অসৎ বন্ধুর উদাহরণ দিয়েছেন- আতর বিক্রেতা ও কর্মকারের হাপরের উদাহরণ দিয়ে। আবু মুসা আশআরী রা. বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, সৎ বন্ধু আর অসৎ বন্ধুর উদাহরণ আতর বিক্রেতা আর কর্মকারের হাপরের মতো।

৩. আতর বিক্রেতা হয় তোমাকে আতর উপহার দিবে, অথবা তুমি তার কাছ থেকে আতর ক্রয় করবে, অথবা তার নিকট থেকে তুমি আতরের গন্ধ পাবে। পক্ষান্তরে হাপরের ফুঁকদাতা হয় তোমার শরীরে বা পোশাকে আগুন লাগাবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে। (বুখারি)

সৎ বন্ধু খুঁজে পাওয়াই বর্তমান সমাজে দুষ্কর। অধঃপতিত সমাজে বন্ধু কর্তৃক বন্ধুর উপকারের খবরের চাইতে বন্ধু কর্তৃক বন্ধুর সর্বনাশের খবরই বেশি যাওয়া যায়। বন্ধুর পাল্লায় পড়ে কিংবা বন্ধু কর্তৃক বন্ধুর সর্বনাশ হয়েছে এরকম কত খবর আমরা হর হামেশাই পাই। সোস্যাল মিডিয়ার এ যুগে এমন বহু ঘটনার খবর অনলাইনে নিয়মিত প্রত্যক্ষ করি। অসৎ বন্ধুর সাথে চলতে গিয়ে কিংবা অন্য বন্ধুত্ব কত শত তরুণ যুবকের সর্বনাশ হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে এমন হিসেবের কূলকিনারা করা কঠিন। ইদানীং পত্রিকা খুললেই ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাংয়ের খবর দেখে আঁতকে ওঠি, যে কিশোর বন্ধুত্বের ‘ব’ ঠিকমত বুঝার কথা না সেই কিশোর তরুণই আজ ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন কিশোর বয়সেই একজন কিশোর যে পারিপাশির্^ক পরিবেশের জ্ঞান অর্জন করছে তাতে বন্ধু বাছাই যে কিশোর বয়স থেকেই নজর দেয়া জরুরি। কিশোর বয়সে একজন কিশোরকে গাইড বা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। পাশাপাশি কিশোর হিসেবে নিজেকেও সঠিক পথে পরিচালনা এবং বন্ধু বাছাইয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। পরিবারে যদি একজন কিশোর সন্তান থাকে তাহলে সে কার সাথে মিশছে, কাদের বন্ধু বানিয়েছে, কার সাথে পাড়া মহল্লায় আড্ডা দিচ্ছে, কিংবা ঘুরতে যাচ্ছে তার খোঁজখবর নিয়ে সন্তানের তত্ত্বাবধান করা জরুরি। আগে তদারকি না করে, আগে খোঁজ খবর না রেখে বিপদে পড়ার পর কিংবা বন্ধুর পাল্লায় পড়ে সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর হাহুতাশ করে লাভ সামান্যই। আজ সমাজে বন্ধুর পাল্লায় পড়ে বন্ধু মাদকাসক্ত হচ্ছে, মদ, গাঁজা ইয়াবা ফেনসিডিল এমনকি মারাত্মক জীবনবিনাশী মাদকও সেবন করেছে। বন্ধুর পাল্লায় পড়ে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ইভটিজিং করছে, অবৈধ প্রণয়ে জড়াচ্ছে, বন্ধুর পল্লায় পড়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি, ধর্ষণ, সন্ত্রাসী এমনকি খুন-খারাবিতেও জড়াচ্ছে।

৪. সমাজে এসবের চিত্র যে কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে তা প্রতিনিয়তই খবরাখবরে দেখা যায়। এমতাবস্থায় বন্ধু বাছাইয়ে গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। বন্ধু কাকে বানাবেন কাকে নয়। চোখ বন্ধ করে বিষয়টি ভেবে দেখলে যে কেউ সহজেই উত্তর দিবেন একজন মানুষকেইতো বন্ধু বানানো উচিত যে হবে সৎ আদর্শবান এবং মানবিক। যিনি বিপদ-আপদে, সুখে-দুঃখের সাথী হবেন। কিন্তু আমাদের সমাজে নানা কারণে মানুষ বন্ধু বানায়। কেউ স্রেফ বন্ধুত্বের খোঁজে বন্ধু বানালেও স্বার্থসিদ্ধির জন্যও নানাজন নানাভাবে বন্ধু বানায়। বিশ^মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. কেমন সাথী বাছাই করেছেন, কেমন ছিলেন তিনি এবং তার বন্ধুদের আচরণ- এর উদাহরণ আমরা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে পাই। আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. এবং তার সাথী যারা তারা কাফিরদের প্রতি বজ্রকঠোর এবং পরস্পরের প্রতি রহমদিল। তুমি লক্ষ্য করেছো, তারা রুকু ও সিজদায় অবনত হয়ে আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে। তাদের লক্ষণ হলো তাদের মুখমণ্ডলে পরিস্ফুট দেখবে সিজদার প্রভাব। (সূরা ফাতাহ : ২৯) রাসূল সা.-এর সঙ্গীদের যে বর্ণনা আল্লাহ তায়ালা আমাদের সামনে উপস্থাপন করলেন বন্ধু বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের উচিত তার অনুসরণ করা। বন্ধুতো এমনই হওয়া উচিত যারা হবে পরস্পর রহমদিল, আন্তরিক, একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত এবং অন্যায়, অপরাধ ও কুফরির বিরুদ্ধে বজ্রকঠোর। এমন বন্ধু বাছাই করা উচিত যারা জাগতিক শক্তির কাছে অনুগ্রহ তালাশের পরিবর্তে মহান রাজাধিরাজ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে রুকু সিজদার মাধ্যমে অনুগ্রহ তালাশ করবে। এভাবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেও চমৎকার পুরস্কারের ঘোষণা রয়েছে। আল্লাহ বলেন, যে কেউ অনুগ্রহ করবে আল্লাহ এবং রাসূলের তারা সঙ্গী হবে আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত নবী, সিদ্দিক এবং পুণ্যবানদের। সঙ্গী হিসেবে এরা কতই না উত্তম। (সূরা নিসা : ৬৯)

৫. যারা আল্লাহর প্রকৃত বান্দা, যারা মুমিন মুসলমান তারা যে কাউকেই বন্ধু বানাতে পারেন না। মুমিনদের পরিচয় তুলে ধরে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, নিশ্চয়ই মুমিনরা হচ্ছে পরস্পর ভাই ভাই। (সূরা হুজরাত : ১০) সুতরাং মুমিনরাই হবে পরস্পরের বন্ধু। মুমিন পুরুষ হবে মুমিন পুরুষের বন্ধু, মুমিন নারী হবে মুমিন নারীর বন্ধু। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, মুমিন পুরুষ মুমিন নারী পরস্পরের (পুরুষ পুরুষের, নারী নারীর) বন্ধু তারা ভালো কাজের আদেশ করে, মন্দ কাজের নিষেধ করে। (সূরা তাওবা : ৭১) পক্ষান্তরে আল্লাহ বলেছেন, মুনাফিক পুরুষ আর মুনাফিক নারী তারা পরস্পরের দোসর বা বন্ধু। তারা মন্দ কাজের আদেশ করে, ভালো কাজের নিষেধ করে। (সূরা তাওবা : ৬৭) মুমিন আর মুনাফিক বন্ধুর পার্থক্য এখানেই। মুমিন যদি মুমিনকে বন্ধু বা সাথী বানায় তাহলে তারা ভালো ও কল্যাণকর কাজের সঙ্গী হবে আর তার বিপরীত কাউকে বন্ধু বানালে মন্দ কাজই হবে তাদের সঙ্গী। সুতরাং মুমিনরা মুমিন ছাড়া মুনাফিককে বন্ধু বানাতে পারে না। কেউ যদি মুমিন ছাড়া কাউকে বন্ধু বানায় তাহলে আল্লাহর সাথে ঐ মুমিনের সম্পর্কের কোনো ভিত্তি থাকবে না বলে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, মুমিনরা মুমিন ছাড়া কাফিরদের বন্ধু (বন্ধু/পৃষ্ঠপোষক) হিসেবে গ্রহণ করবে না। যে কেউ তা করবে আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক থাকার কোনো ভিত্তি থাকবে না। (সূরা আলে ইমরান : ২৮)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, হে ঈমানদার লোকেরা তোমরা ইয়াহুদি ও নাসারাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা নিজেরাই পরস্পরের বন্ধু। তোমরা কেউ যদি তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো তাহলে সে হবে তাদেরই লোক। (সূরা মায়েদা : ৫১) রাসূল সা.ও এ প্রসঙ্গে সতর্ক করে বলেছেন, তুমি মুমিন ছাড়া আর কাউকে সাথী বানাবে না, এবং তোমার খাদ্য মুত্তাকি ছাড়া কেউ যেন না খায়। (তিরমিজি)।

৬. মুমিনের বন্ধুত্ব হবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে, মুমিন কাকে বন্ধু বানাবে অথবা কাকে বন্ধু বানাবে না, মুমিন কাকে পছন্দ করবে কিংবা কাকে অপছন্দ করবে তা নির্ধারিত হবে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য তাহলেই মুমিনের ঈমান পরিপূর্ণ হবে। হযরত আবু উসামা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসলো, আল্লাহর জন্য কাউকে অপছন্দ করলো, আল্লাহর জন্য কাউকে কিছু প্রদান করলো এবং আল্লাহর জন্য দেওয়া থেকে বিরত থাকলো, সে ঈমানকে পরিপূর্ণ করলো। (আবু দাউদ)। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, ঈমানের সুদৃঢ়তম রশি হলো মহান আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব, নৈকট্য; আল্লাহর জন্য শত্রুতা, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য অপছন্দ-বিদ্বেষ। (বুখারি)। অর্থাৎ বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সখ্য হবে শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। এমন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব তৈরি হবে যিনি আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তারই ইবাদাতকারী আবেদ। আর এমন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে না যে মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হিসেবে পরিগণিত হতে পারেনি, যার উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট। যে তার জীবন পরিচালনাসহ সামাজিক কর্মকাণ্ড আল্লাহর নাফরমানিতে, আল্লাহর নির্দেশের বাইরে পরিচালিত করে, আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধবাদী এমন ব্যক্তিদের সাথে গোপনেও বন্ধুত্ব স্থাপনের ব্যাপারে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলেন, আল্লাহর শত্রুকে গোপনে বন্ধু করবে না, সুযোগ বুঝে তোমাদের কাবু করতে পারলে তারা তখন শত্রু হয়ে যাবে। (সূরা মুমতাহিনা : ১-২) আল্লাহ আরো বলেন, আল্লাহ যে কাওমের উপর ক্ষুব্ধ তাদের সাথে তোমরা বন্ধুত্ব করো না। (সূরা মুমতাহিনা : ১৩) কোনো কোনো কাওম বা জাতি গোষ্ঠীর সামগ্রিক আচরণ এমন যে তাদের সামগ্রিক তৎপরতা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে এমন গোষ্ঠীর সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। ৭. সখ্য, বন্ধুতা শুধু ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রেই নয় বরং তা বিভিন্ন দল, মত কাওম বা গোষ্ঠীর সাথে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ রয়েছে। এক্ষেত্রেও সচেতন ও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। বন্ধুতা করে কিংবা সখ্য গড়ে তুলে যে দল বা মত পথের সাথে আপনি ওঠা বসা করছেন, ভাব বিনিময় কিংবা দলের আদর্শ বাস্তবায়নে স্লোগান তুলছেন তার হিসাবও কিন্তু আপনার কাছ থেকে নেয়া হবে। যে নেতার অধীনে আমি আপনি ভূমিকা পালন করছি, নেতাকে ভালোবেসে তার নির্দেশ বাস্তবায়ন করছি কাল কিয়ামতের ময়দানে তার পরিণতি সম্পর্কেও আমাকে আপনাকে ভাবতে হবে, এমন সব বন্ধুর সাথে মিশে এমন দল ও গোষ্ঠীর কর্মসূচি বাস্তবায়নে আপনি ভূমিকা পালন করেছেন নাতো যাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। যারা অপরের হক মেরে খায়, অপরের সম্পদ লুণ্ঠন করে, দখল করে, জুলুম করে বনি আদমকে কষ্ট দেয় এমন দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গী হচ্ছেন নাতো। দুনিয়ার জিন্দেগিতে যে দল কিংবা গোষ্ঠী তার সামগ্রিক তৎপরতায় জাহান্নাম ক্রয় করে সেই দলের সঙ্গী কিংবা সেই দলের নেতার সহযোগী বা তার অধস্তনের বন্ধু হিসেবে পরকালের পরিণতি সম্পর্কে দুনিয়াতেই ভাবতে হবে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, তুমি দেখবে তাদের অনেকেই সত্য অস্বীকারকারীদের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে, তাদের কর্মকাণ্ড এতই নিকৃষ্ট যে যার কারণে আল্লাহ তাদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন, আর আজাবের মধ্যেই তারা থাকবে চিরকাল। (সূরা মায়েদা : ৮০) আল্লাহ আরো বলেন, সেদিন আমরা প্রতিটি জনসমষ্টিকে তাদের নেতার নেতৃত্বে ডাকবো। (সূরা বনি ইসরাইল : ৭১)। আল কুরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে, তারা আরো বলবে, আমাদের প্রভু! আমরা আমাদের নেতা ও মুরব্বিদের অনুসরণ করেছি, কিন্তু তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছে। (সূরা আহযাব : ৬৭) আপনি যাকে নেতা মানবেন সেই নেতার নেতৃত্বেই আপনাকে হাজির হয়ে জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং এমন মত, পথের দলের সাথে কিংবা তাদের নেতা বা নেতার অনুচরদের সাথে বন্ধুত্ব বা সখ্য করা ঠিক নয় যারা তার জনসমষ্টিকে পথভ্রষ্ট করে জাহান্নামের দিকেই নিয়ে যায়। প্রকৃত ঈমানদাররা এসব দল বা গোষ্ঠীর কারো সাথে বন্ধুতা করে না। আল্লাহ বলেন, ঈমানদার এমন কাউকে কখনো পাবে না যারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধিতাকারীদের সাথে বন্ধুতা ও ভালোবাসা রাখে। (সূরা মুজাদালা : ২২)

৮. দুনিয়ার জিন্দেগিতে এক বন্ধু অপর বন্ধুকে পাপের কাজে সহযোগিতা করেছে। শক্তিমত্তা ও ক্ষমতার প্রতিপত্তি দিয়ে বহু অবৈধ সুযোগ সুবিধা তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু শেষ বিচারে এসব বন্ধু কারো কোন কাজেই লাগবে না। কঠিন হাশরের দিনে কেউ কাউকে সাহায্য বা উদ্ধার করাতো দূরের কথা সামান্যতম উপকারও দুনিয়ার সেই শক্তিশালী দোর্দণ্ড-প্রতাপশালী বন্ধুরা করতে পারবে না। নিবে না সামান্যতম কোন খোঁজ-খবরও। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, সহকর্মী বন্ধু অপর বন্ধুর খোঁজ নিবে না। (সূরা মাআরিজ : ১০) সেদিন বন্ধু বন্ধুর কোনো উপকারে আসবে না এবং সাহায্য করা হবে না তাদের। (সূরা দুখান) তবে সেদিন পাপিষ্ঠ বন্ধুদের চাইতে মুমিন মুত্তাকি বন্ধুদের অবস্থা হবে ব্যতিক্রম। পাপিষ্ঠ বন্ধুরা একে অপরের শত্রু হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, সেদিন বন্ধুরা পরস্পরের শত্রু হয়ে যাবে শুধু মোত্তাকিরা ছাড়া। (সূরা যখরূফ : ৬৭) মুমিন মোত্তাকি লোকদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলে আপনার ইন্তেকালের সময়েও এ বন্ধুত্বের উপকার পাবেন। সাধারণত যাদের সাথে বন্ধুত্ব বা সখ্য ইন্তেকালের খবরে তারাই সবার আগে হাজির হয়। এসব বন্ধুরাই জানাযার দাফনে অংশগ্রহণ করে। বন্ধু যদি সৎ, মুমিন ও ঈমানদার হয় তাহলে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সময়েও আপনি সৌভাগ্যবান। কারণ মুমিন বন্ধুরা আপনার জন্য মাগফিরাত কামনা করবে। রাসূল সা. মাইয়েত্যের জানাযা সংক্রান্ত হাদিসে এমনই উল্লেখ করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. ইরশাদ করেন, যদি কোন মুসলিম মৃত্যুবরণ করেন, অতঃপর তার মৃতদেহের সামনে (সালাতুল জানাযা আদায়ের জন্য) ৪০ জন এমন ব্যক্তি দাঁড়ায় যারা আল্লাহর সাথে কোনো শিরকে লিপ্ত নয়, তাহলে তার (মৃতের) বিষয়ে তাদের (জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের) সুপারিশ আল্লাহ গ্রহণ করবেন। (মুসলিম) একবার ভেবে দেখুন, সারাজীবন যাদের সাথে সখ্য গড়ে তুললেন ওঠাবসা করলেন, বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করলেন, আন্তরিক সুহৃদ বানালেন, তারা যদি আল্লাহর প্রকৃত বান্দা না হন, আল্লাহর পথের পথিক না হন, উল্টো তারা যদি আল্লাহ ও রাসূল-বিদ্বেষী কিংবা সিরাতুল মুস্তাকিমের বিপরীত পথের পথিক হন তাহলে ইহজগৎ ত্যাগের সময় আপনার চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ নেই।

৯. একবার জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে অনুষ্ঠিত এক জানাজার ছবি সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক ভাইরাল হয়। কথিত এক বিশিষ্ট ব্যক্তির জানাজায় এক অমুসলিম ব্যক্তিকেও ডান হাতের উপর বাম হাত বেঁধে জানাজার প্রথম সারিতে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া সেই ছবিটি আমি খুঁটে খুঁটে দেখার চেষ্টা করি। জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের ছবি দেখে চেনা যায় তাদের বেশির ভাগই আল্লাহর পথের পথিক নয়, কেউ কেউ আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচারী কিংবা নাস্তিক হিসেবেও সমাজে পরিচিত। তারা ওযুর বা জানাজার নিয়ম জানে কি না কিংবা কিভাবে মাইয়্যেতের জন্য মাগফিরাত কামনা করতে হয় সে জ্ঞান তাদের আছে বলেও মনে হয়নি। জানাজায় ছবিটি দেখলাম আর আফসোস করলাম এই ব্যক্তিটি দুনিয়ার যশখ্যাতি সমৃদ্ধি সবই অর্জন করেছে, সমাজের নামীদামি, প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালীদের বন্ধু বানিয়েছে, মুসলিম নামধারী হয়েও একজন ঈমানদারকে বন্ধু বানাতে পারেনি। দুনিয়ার সবকিছু অর্জন করেছে কিন্তু মাগফিরাত কামনাকারী বন্ধু জোগাড় করতে পারেনি। হায় আফসোস তাদের জন্য। আপনি যখন খালি হাতে এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন সেদিন মাগফিরাত চাইতে জানে এমন বন্ধুরা জানাজায় শরিক হওয়ার প্রত্যাশা করে থাকলে মুমিনদেরই বন্ধু বানানো উচিত নয় কি? লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির