post

বাংলাদেশে বোরকা কি নিষিদ্ধ?

০৯ জানুয়ারি ২০১৩

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

[caption id="attachment_1538" align="alignleft" width="272"]
আওয়ামী লীগ সরকারের সকল কর্তা ব্যক্তি বোরকা বিরোধী অভিযানে নেমেছে অনেক আগ থেকেই[/caption]

২০০৭ সালে প্রধানমন্ত্রী তনয় জয় যুক্তরাষ্ট্রের এক ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন, বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে ৪০০ গুণ বোরকার ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের। বিদেশী একজন ব্যক্তির সাথে তার যৌথ প্রবন্ধ নিয়ে সেই সময় অনেক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। আসলে ইসলামের ব্যাপারে এটাই ছিল আওয়ামী লীগের আসল রূপ। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সব প্রতিশ্রুতিই দিতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আওয়ামী লীগ অনেক দলের বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির করার অভিযোগ করলেও, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি সবচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগ-ই করছে। এটাই আওয়ামী লীগের স্বভাব। তার প্রমাণ নির্বাচনের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী মাথায় হিজাব, হাতে তসবিহ আর কাবায় মুনাজাতরত ছবি ছাপিয়ে ভোটারদের মন জয় করতে যা করেছেন তা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নয় কি? নির্বাচনের প্রাক্কালে মরহুম আল্লামা আজিজুল হকের সাথে চুক্তি কি ধর্ম নিয়ে রাজনীতির মধ্যে পড়ে না? প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গোলাম আযমের সমর্থন চাওয়া আর জামায়াতকে নিয়ে ’৯৬ সালে কেয়ারটেকার আন্দোলন করা যেমনি যুদ্ধাপরাধীদের সাথে সম্পর্কের কোন মাপকাঠি বলা যায় না। এক সময়ের সেই মিত্রদের নিষিদ্ধ করতে এখন আবার গৃহপালিত বামদের প্রযোজনা আর পুলিশি হরতাল বাস্তবায়নের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ করলো কি? তেমনি এক সময়ের বিশ্ববেহায়া, সামরিক শাসক স্বৈরাচার এরশাদের সাথে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক জোট ও মিত্রতা তাদের গণতান্ত্রিকতার পথে কোন বাধা নয়। এমনি এক দ্বৈতনীতি সম্পন্ন দলের নাম আওয়ামী লীগ। যারা ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতায় থাকার জন্য সবই করতে পারে। বাংলাদেশে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতিহারে কুরআন-হাদিস বিরোধী কোন আইন পাস না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়মী লীগ। কিন্তু কেন এবার নির্বাচনী ইসতিহারে আওয়ামী লীগকে এমন কথা লিখতে হলো? তার কারণ আওয়ামী লীগ ৯৬-২০০১ পর্যন্ত এদেশের আলেম-ওলামা, মসজিদ মাদ্রাসা, বোরকা, দাড়ি-টুপি এবং মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো হেন কাজ নেই যা আওয়ামী লীগ করেনি। কিন্তু এবার ক্ষমতায় এসেই সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম উঠিয়ে দেয়ার জন্য চক্রান্ত শুরু করে আওয়ামী লীগ। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার নামে সংবিধান থেকে বিসসিল্লাহ উঠিয়ে দেয়া, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের জন্য জোর প্রচার প্রচারণা চালায়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার মাধ্যমে সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দিয়ে যুক্ত করা হয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। আর দেশকে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রমাণ করতে সরকার আলেম-ওলামা, মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, বোরকা পরা পরহেজগার মহিলাদের ওপর চালায় অমানবিক দমন-নিপীড়ন। এর মাধ্যমে সরকারের আসল চেহারাই ফুটে উঠেছে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের সকল কর্তা ব্যক্তি বোরকা বিরোধী অভিযানে নেমেছে অনেক আগ থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয়ের উদ্বেগের সাথে বোরকাবিরোধী এই অপারেশনে সরাসরি মাঠে আছেন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। বোরকার প্রতি অনীহা প্রকাশ করে বর্তমান সরকারের ডেপুটি স্পিকার বললেন- ‘কুৎসিত চেহারা ঢাকতেই মহিলারা বোরকা পরে। বর্তমানে বোরকার অধিক ব্যবহারে তিনি কষ্ট পেয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন। আওয়ামী ঘরানার কলামিস্ট হিসেবে সুপরিচিত ড. জাফর ইকবাল তার এক কলামে বোরকাকে নারীদের বন্দিশালা উল্লেখ করে লিখেন ‘মেয়েদের ঘরের ভেতর আটকে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভাল। একান্তই যদি ঘরের ভেতর আটকে রাখা না যায় অন্তত বোরকার ভেতর আটকে রাখা যাক।’ এ ছাড়াও পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী আব্দুল লতিফ নিজেই বোরকাবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেন। সরকারের সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে এবার বোরকা পরা ছাত্রীদের আটক অভিযানে নেমেছে পুলিশ।

সরকারের বোরকাবিরোধী অভিযানের কয়েকটি ১. গত ১৭ ডিসেম্ভর ২০১২ সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২০ শিক্ষার্থীসহ ২১ জনকে পুলিশ আটক করেছে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার স্ত্রীও রয়েছেন। বাকি ২০ শিক্ষার্থী বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থার সদস্য। তবে কী অপরাধে তাদের আটক করা হয়েছে এ বিষয়ে পুলিশ স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেনি। রমনা মডেল থানার ওসি শাহআলম জানান, ‘গতকাল বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ ছাত্রীসংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয় বড় মগবাজার ৪৯৩ নম্বর গ্রিনভ্যালি অ্যাপার্টমেন্টে অভিযান চালায়। সেখান থেকে কাদের মোল্লার স্ত্রী সানোয়ার জাহান (৫৫) সহ ২১ জনকে আটক করা হয়েছে। এ সময় বিপুল পরিমাণ ইসলামিক বই, কোরআন শরীফ ও চারটি কম্পিউটার জব্দ করেছে পুলিশ।’ পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী-পুলিশ যখন ওই অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকে তখন জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার স্ত্রী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলেন। পুলিশ প্রথমে তাকে আটক করে। তাকে নিয়ে পুলিশ ভবনের দোতলায় ছাত্রীসংস্থার মেসে প্রবেশ করে। পুলিশের এই অভিযানে কোনো মহিলা পুলিশ ছিল না। এ সময় পুলিশ কাউকে ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে দেয়নি। এমনকি সাংবাদিকেরাও চেষ্টা করে সেখানে প্রবেশ করতে পারেননি। পুলিশ ওই ফ্ল্যাটের প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালায় এবং মালামাল তছনছ করে। সেখান থেকে কিছু বইপত্র ও কম্পিউটার জব্দ করে পুলিশ। পুলিশ ছাত্রীসংস্থার নেতাকর্মীদের মোবাইল ফোন জব্দ করে। বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিট পর্যন্ত কোনো মহিলা পুলিশ ছাড়াই ছাত্রীসংস্থার মেসে অভিযান চালায় পুলিশ। প্রেফতারকৃত ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী বলে জানা যায়। (নয়া দিগন্ত ১৮-১২-১২) এক বিবৃতিতে ইসলামী ছাত্রীসংস্থার কেন্দ্রীয় সভানেত্রী জান্নাতুল কারীম সুইটি মগবাজারের ইসলামী ছাত্রীসংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশি তল্লাশির নামে অফিসের তালা ভেঙে ভাঙচুর, নিরীহ ছাত্রীদের হয়রানি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে সেক্রেটারি জেনারেল রেহানা সুলতানাসহ ১৯ জন মেধাবী ছাত্রীসহ ২১ জনকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে মহিলা পুলিশের সহায়তা নেয়া হয়নি। সরকার পরিকল্পিতভাবে ইসলামী ছাত্রীসংস্থার পর্দানশিন ছাত্রীদের হেনস্তা ও নাজেহাল করার জন্যই এ ঘটনা ঘটিয়েছে, যা সরকারের ফ্যাসিবাদী ও বাকশালী মানসিকতার পরিচয় বহন করে। কিন্তু সরকার জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে শেষ রক্ষা করতে পারবে না। তিনি অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত ছাত্রীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। (প্রেস বিজ্ঞপ্তি) ২. গত ২৭ নভেম্বর দিবাগত রাত ৩টায় বিনা কারণে শেরপুর পৌরসভা জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগের সহকারী সেক্রেটারি আয়শা আক্তারকে তার বাসা থেকে পুলিশের গ্রেফতার করে। পর্দানশিন একজন মহিলা নেত্রীকে গভীর রাতে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে সরকার তার ওপর জুলুম করেছে। এই সরকারের জুলুম থেকে আজও রেহায় পাচ্ছেন না পর্দানশিন পরহেজগার মহিলারাও। সরকারের এ ধরনের জুলুম অন্যায়, অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক। ৩. গত ২৩ মে ২০১২ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে তল্লাশি করে বিভিন্ন বিভাগের ৯ মেধাবী ছাত্রীকে আটক করেছে ছাত্রলীগ ও প্রশাসন। হলের মাঠ, রুমে রুমে তল্লাশি চালিয়ে গত রাত পৌনে ১০টার দিকে তাদের আটক করা হয়। তাদের আটকের পর তথ্য-প্রমাণ খুঁজতে রাত ১২টা পর্যন্ত রুমে রুমে এ তল্লাশি চলে। আটককৃতরা বিভিন্ন ইসলামী ও জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছে প্রশাসন ও ছাত্রলীগ। তা ছাড়া আটককৃতদের সম্পর্কে ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের কাছ থেকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। ছাত্রলীগ দাবি করেছে, আটককৃতরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রীসংস্থার কর্মী। প্রক্টর বলেছেন, তারা কোনো অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িত কি না খতিয়ে দেখছি। আর ভিসি বলেছেন, হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা তথ্য প্রমাণ রাত ১টা পর্যন্ত পায়নি প্রশাসন। আমরা যদি ধরেও নেই আটককৃতরা ইসলামী ছাত্রীসংস্থার কর্মী। তাহলে ইসলামী ছাত্রীসংস্থা কি কোন নিষিদ্ধ সংগঠন? আইনগত অধিকার হলো সেই স্বার্থ যা আইনের নীতিসমূহ দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। ঢাবি প্রশাসন এই অধিকার স্বীকার করেন কি? ৪. গত ২ জুলাই ’১২ চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের ছাত্রীরা হিজাব পরতে দেয়ার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। হিজাব পরা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষিকাদের নির্যাতনের পর থেকে তারা আন্দোলনে নেমেছেন। এদিকে ছাত্রীদের নামাজ পড়তে বাধা দেয়াসহ কর্তৃপক্ষ গতকাল নামাজ কক্ষ তালাবদ্ধ করে রেখেছে বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রীরা। কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, ড্রেস কোডের বাইরে তাদের কিছুই করার নেই। যদিও সরেজমিন দেখা গেছে, হিজাব ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ড্রেস কোড মানা হচ্ছে না। কলেজে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক ছাত্রী হিজাব পরে কলেজ হোস্টেলের সামনে অবস্থান নেন। উপস্থিত ভীতসন্ত্রস্ত ছাত্রীরা সাংবাদিকদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছাত্রীরা তাদের ওপর চলমান বিভিন্ন নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তারা অভিযোগ করেন, হিজাব এবং নামাজ পড়ার কারণে তাদের ক্লাস, পরীক্ষা এবং ওয়ার্ডে ডিউটিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হচ্ছে। ছাত্রীদের দাবি, মুসলমান হিসেবে তাদের হিজাব পরার অধিকার রয়েছে, কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের হিজাব পরতে দিচ্ছে না। নামাজ পড়া নিয়েও কর্তৃপক্ষ ঝামেলা করছে। তারা জানান, গতকাল সকালে অধ্যক্ষের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষিকা তাদের নামাজঘর তালাবদ্ধ করে রাখে। এ সময় শিক্ষিকারা সেখানে রাখা বিভিন্ন ধর্মীয় বই, হিজাব পরা ও নামাজ পড়া নিয়ে কটূক্তি করেন। অঞ্জলী দেবী নামে এক শিক্ষিকা জুতা পরা অবস্থায় নামাজঘরে প্রবেশ করে তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘নামাজঘরে জুতা নিয়ে ঢুকেছি, কই আল্লাহ আমাকে কী করেছে?’ ছাত্রীরা আরও অভিযোগ করেন, অধ্যক্ষ তাদের বলেছেন নার্সিং করলে নামাজ পড়তে হয় না। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ফোন করে তাদের সন্তানদের বহিষ্কারের হুমকি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এতে অনেক অভিভাবক তাদের মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেকটা বাধ্য হয়ে হিজাব ছাড়া ক্লাস করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ কলেজের নোটিশ বোর্ডে, নীতিমালা অনুযায়ী হিজাব পরা ছাত্রীদের ক্লাস এবং ওয়ার্ড ডিউটি থেকে এক রকম নিষিদ্ধ করেছে। হিজাব পরা ছাত্রীদের ক্লাস এবং পরীক্ষা হল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শীর্ষ আলেমরা ইসলামের ফরজ বিধান হিজাব তথা বোরকা পরতে বাধাদানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন এবং এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, হিজাব পরতে বাধা দেয়া সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। (আমার দেশ : ০৩-১২-১২) ৫. বাদ যায়নি বিদেশী পর্যটকও। গত ১ অক্টোবর ২০১০ সাইপ্রাসের এক পর্যটক নারী জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের ছবি তুলতে গেলে তাকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। ৬. গত ৩ জুলাই ২০০৯ সালে বোরকা পরার অপরাধে বরিশালের পিরোজপুরের তিন ছাত্রীকে নির্যাতনের পর পুলিশের হাতে তুলে দেয় ছাত্রলীগ। তাদের কাছে অবৈধ কোন কিছু না পেলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয় থানা পুলিশ। ৯ জুলাই কোন প্রকার অভিযোগ ছাড়াই তাদের বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। জিয়ানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক ওই তরুণীদের বোরকা খুলতে বাধ্য করে আদালতে সোপর্দ করে। ৭. এদিকে বোরকা পরে ক্লাসে আসার অপরাধে এক ছাত্রীকে কলেজে ঢুকতে দেননি উত্তরা মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার গোলাম হোসেন। আরো পাঁচ ছাত্রীকে গেটে দাঁড় করিয়ে রাখেন। অধ্যক্ষ বোরকাকে ‘অড’ বা দৃষ্টিকটু ড্রেস উল্লেখ করে বলেন, ‘একটা মেয়ে পায়ের নখ পর্যন্ত বোরকা পরে এসেছে এটা দৃষ্টিকটু। আমরা এটা এলাউ করতে পারি না। তাই তাকে ক্লাসে ঢুকতে দেয়া হয়নি।’ ৮. পর্দাবিরোধী সক্রিয় চক্রের কাছ থেকে রেহাই পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও। নামাজ আর পর্দা করার অপরাধে ৮ ছাত্রীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বের করে দেয়া হয়। ইডেন কলেজের ছাত্রীদের নির্যাতন করে দেয়া হয় পুলিশে। ৯. ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল বরিশালের নিউ সার্কুলার রোডের এক বাড়িতে র‌্যাব হানা দিয়ে বোরকা পরে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য জড়ো হওয়ার অপরাধে ২১ নারীকে গ্রেফতার করে। র‌্যাব সাংবাদিকদের কাছে তাদের অভিযানের সংবাদ জানালে তা ফলাও করে ছাপা হয়। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য না পেয়ে ২১ পরহেজগার নারীকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়। ঘটনার দীর্ঘ ২ মাস পর ২৩ জুন আদালত তাদের বেকসুর খালাস দেন। ১০. ২০০৯ সালের ১৯ জুন রাজশাহীতে জঙ্গি সন্দেহে ১৫ নারী ও শিশুকে গ্রেফতার করা হয়। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওইদিন বিকালেই মুচলেকা দিয়ে তাদের মুক্ত ঘোষণার পর আবার ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পুলিশ গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে ব্যাপক তদন্ত করেও জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য পায়নি। শেষ পর্যন্ত আদালত তাদের বেকসুর খালাস দিলে জুলাই মাসের ১ তারিখে ১১ দিন কারাবাস শেষে ১৫ জন নিরপরাধ নাগরিক মুক্তি পান। ১১. বোরকা পরার অপরাধে ২০০৯ সালের ৩ জুলাই পিরোজপুর জেলার জিয়ানগরে ছাত্রলীগের বখাটে কর্মীদের প্ররোচনায় পুলিশ জঙ্গি সন্দেহে তিন তরুণীকে গ্রেফতার করে। তারপর পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে তিন তরুণীকে ঢাকায় টিএফআই সেলে নিয়ে আসা হয়। ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত তরুণীদের বিরুদ্ধে মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন অমর সিংহ। এ সময় তাদের বোরকা খুলতে বাধ্য করে মহাজোট সরকারের দিনবদলের পুলিশ। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদেও কোনো জঙ্গি সংযোগের কাহিনী বানাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফাইনাল রিপোর্ট দিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দী থেকে অবশেষে তিন অসহায়, নিরপরাধ তরুণী মুক্তি পান। ১২. ২০১০ সালের ৩ এপ্রিল সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. এ কে এম শফিউল ইসলাম তার ক্লাসে ছাত্রীদের বোরকা পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তিনি ক্লাসে ‘মধ্যযুগীয় পোশাক বোরকা’ পরা যাবে না এবং এটি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের কোনো পোশাক হতে পারে না বলে ফতোয়া জারি করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটি বিভাগীয় কোনো সিদ্ধান্ত নয়, তবে আমার ক্লাসে কোনো ছাত্রীকে আমি বোরকা পরতে দেব না। ১৩. বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মো: জাকির হোসেনের দ্বৈত বেঞ্চ ২০১০ সালের ২২ আগস্ট স্বপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) আদেশ প্রদান করেন যে, দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না। ‘নাটোরের সরকারী রানী ভবানী মহিলা কলেজে বোরকা না পরলে আসতে মানা’ শিরোনামে ২২ আগস্ট একটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিচারপতিদ্বয় বোরকা পরিধানের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো এই রায় দেন। উপরোক্ত ঘটনাগুলোকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে কল্পিত ইসলামী জঙ্গিতত্ত্ব বিদেশে ফেরি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। ইসলামী দল, মাদরাসা, দাড়ি-টুপি আর বোরকার বিরুদ্ধে তাদের এই অভিযান। এই জন্যই আওয়ামী লীগ এবার সরকারি তত্ত্বাবধানে রামুর ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু সারা বিশ্বের মানুষ ভালো করেই জানে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা থাকলেই অসাম্প্রদায়িক হওয়া যায় না তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ প্রতিবেশী ভারত আর মিয়ানমার। আর সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস লেখা থাকলেই সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েন না, তার উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আমাদের সেই হাজার বছরের উজ্জ্বল ইতিহাসকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মোহে কলঙ্কিত করতে চায়। তাই দেশের আমজনতাকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল এই সরকারের প্রায় ক্ষমতাধর সকল ব্যক্তিই নারী। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও সংসদ উপনেতা, কৃষিমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহিলা হওয়ায় নারীদের অধিকার অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বেশি নিশ্চিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা না হয়ে পরিস্থিতি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় নারী সমাজ বেশি নির্যাতিত, অপমানিত, অধিকার বঞ্চিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুখে নারীনীতির কথা বলেন, আর নিরপরাধ, পরহেজগার, বোরকাপরা মেধাবী ছাত্রীদের গ্রেফতার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে এমন নাটক বন্ধ হবে কবে? কোরআন শরীফ, ইসলামিক বই আর বোরকা পরার অপরাধে পুলিশ এই নিরীহ, নিরপরাধ, পরহেজগার মেধাবী ছাত্রীদের ২ দিনের রিমান্ডেও নিয়েছে। এটা এ জাতির জন্য কলঙ্কের, বেদনার ও লজ্জার। এই সৎ চরিত্রবান মেয়েগুলোকে কনকনে শীতের মধ্যে সারা রাত আটক করে থানায় রেখেছে পুলিশ। জানা গেছে ঐ মেয়েগুলোর প্রত্যেকেই তাদের ডিপার্টমেন্টে ভালো রেজাল্টের অধিকারী। তাহলে ৯০% মুসলমানের দেশেও এই মেয়েগুলোর নামাজ পড়া, ইসলামী অনুশাসন মেনে চলা আর বোরকা পরাই কি একমাত্র অপরাধ? ধর্ম-কর্ম পালনে এটাই কি শেখ হাসিনার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উত্তম নমুনা। অথচ আওয়ামী লীগ বারবার বলছে তারা কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ইসলাম বিরোধী কোন আইন করবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাহলে নামাজ পড়া ও বোরকা পরা নামাজী মেয়েদের হল থেকে বের করে দেয়া, রিমান্ডে নেয়া, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নয় কি? এটি মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয় কি? একজন মেয়ের মা হিসেবে কিছু সময়ের জন্য ভাবুন তো। গভীর রাতে আমাদের মেয়েকে এভাবে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি করলে কেমন লাগতো? আমরা আসলেই কি বুঝতে পারছি!! এই মেয়েগুলোর বাবা-মা কত উদ্বিগ্ন সময় কাটাচ্ছেন!! অনবরত চোখের পানি ঝরছে তাদের পরিবারের। কিন্তু মজলুমের চোখের পানি কি বৃথা যায়!! মজলুমের ফরিয়াদ আর আল্লাহর আরশের মাঝখানে কোন কিছুই থাকে না। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো এই মেয়েগুলোর মধ্যে একজন কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্ব¡াও রয়েছেন। আইনজীবীদের অনেক আকুতি-মিনতির পরও তাকে মুক্তি দেয়া হয়নি। রেহাই পায়নি আব্দুল কাদের মোল্লা যিনি দীর্ঘ আড়াই বছর জালেমের কারাগারে আবদ্ধ তার ৫৫ বছর বয়সী স্ত্রীকেও। কত অমানবিক, জঘন্য আর কত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে এই সরকার!! আমার মনে হয় আওয়ামী লীগ জিহাদী বই, গোপন বৈঠক আর নাশকতার ধুয়া তুলে আর বেশি দিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। আমরা জানি কুরআন-ই হচ্ছে জিহাদের সবচেয়ে বড় গ্রন্থ। মুসলমানদের জিহাদের নির্দেশতো এখানেই দেয়া আছে। তাহলে সেটি নিষিদ্ধ করুন। আমার বিশ্বাস কয়েক ঘণ্টাও ক্ষমতার মসনতে টিকে থাকতে পারবেন না। দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এসব ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের সমুচিত জবাব দেবে। লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

[email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির