post

বারবার আগুন আর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি : দায় কার? । মুহাম্মদ তারেক হোছাঈন

২০ মে ২০১৯

বারবার আগুন আর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি : দায় কার? । মুহাম্মদ তারেক হোছাঈনবাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। তারপরও অনেক সম্ভাবনা। অনেক সুযোগ। রাজনৈতিক সমঝোতা থাকলে আরো অগ্রগতি সহজ হতো। জাতি এগিয়ে যেত। জনগণ নাগরিকসুবিধায় জীবনযাত্রার মান উন্নত হতো। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সততার অভাব প্রতিনিয়ত। উন্নয়ন অগ্রগতিতে প্রচুর বাধা। তাই বারবার মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে প্রিয় দেশ। ভয়াবহ আগুনের কবলে মার্কেট, গার্মেন্টস। সড়ক, নৌ দুর্ঘটনাতে লাশের মিছিল তো প্রতিনিয়ত আছেই। গুম, খুন জনমনে অন্যতম আতঙ্ক। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আতঙ্কের শেষ নাই। কখন কী বিপদ এসে যায় চিন্তার অন্ত নেই। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেন দুরূহ বিষয়। শান্তির ঘুম অধরা। বারবার ভয়াবহ আগুনের দুর্ঘটনা অনেক প্রাণহানি। অনেক সম্পদের ক্ষতি। মর্মান্তিক বিয়োগান্ত দৃশ্য সাধারণ মানুষকে রীতিমত হতবাক করেছে। আপনজন হারানোর ব্যথায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে প্রিয়জন। সাজানো পরিবারে দুঃখ আর দুঃখ। ছেলে মেয়েদের স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে যাওয়া। নারী-শিশুদের আর্তনাদের বিভীষিকাময় চিত্র মিডিয়ায় তোলপাড়। সাংবাদিকের বিবেকের তাড়নাও থমকে যায়। কলমের কালি যেন শোকে প্রবাহিত। বিগত দশকের নির্মমতা ভাবিয়ে তুলে জনগণকে। একটি শোকের দৃশ্য ভুলতে না ভুলতেই আবার নতুন দৃশ্য। পুরাতন চকবাজারে মৃত্যুর মিছিলের করুণ প্রতিধ্বনি না ভুলতেই রাজধানীর বনানীতে এফ আর টাওয়ারে আবার আগুনের ট্র্যাজেডি। এফ আর টাওয়ার ২২ তলা ওই ভবনটিতে ২৬টি স্বপ্নের করুণ মৃত্যুর নারকীয় দৃশ্য উপভোগ করেছে কোটি কোটি শোকাহত জনতা। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিস। উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছেন নৌ, বিমানবাহিনীর সদস্যরাও। আটকা পড়াদের সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধারে চেষ্টা করেছে। এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভেতরে আটকে ছিল অনেকে। ফায়ার সার্ভিসের ক্রেনগুলো ১২ তলার ওপরে পৌঁছুতে পারেনি। তবে ওপর থেকে কয়েকজনকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার উদ্ধার করেছে। ১২ তলায় আটকে পড়া ভয়ার্ত একজন তার এক স্বজনকে মোবাইল ফোনে এমনভাবে তার জীবনহানির আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, ‘ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। উপরে উঠতে পারছি না। আমরা ১৫ জন আটকা পড়েছি। বাঁচব কিনা জানি না, দোয়া করো।’ সন্তান ও পরিবার নিয়ে কত স্বপ্নই না ছিল লিটনের। বনানীর বিভীষিকায় শুধু লিটনের শরীর নয়, পুড়ে ছাই হয়েছে সব স্বপ্ন! অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে তার পুরো পরিবারকে। লিটনের বড় ভাই আলম শেখ জানান, বনানীর এফ আর টাওয়ারের ১০ তলায় একটি ফার্মে কাজ করতেন লিটন। আগুন লাগার পর স্ত্রীকে ফোনে বিয়ষটি জানান। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। বিকেলেই তারা ঢাকায় ছুটে আসেন। রাতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে লিটনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়। বেঁচে যাওয়া অ্যাঞ্জেলা বলেন, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থেকে কষ্ট করে ৮ম তলা থেকে ২২ তলার ছাদে পৌঁছাই। ছাদে গিয়ে দেখি অনেক লোক। তারা রেলিং দিয়ে পাশের ভবনে লাফিয়ে পড়ছেন। আহমেদ টাওয়ার নামে পাশের ভবনটিও ২২ তলার এবং সেখানে অনেকে দাঁড়িয়ে হাত এগিয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের জন্য। কিন্তু আমি রেলিং থেকে লাফিয়ে পড়তে পারছিলাম না। ভয় পাচ্ছিলাম। এ সময় অন্য ছাদের লোকেরা বলেন, লাফ দিন। না হলে অন্যদের আসার সুযোগ দিন। এই ছাদে থাকলে মারা যাবো, এই চিন্তা করে বাঁচার আশায় আমি লাফিয়ে পড়ি। সেই কঠিন মুহূর্তে অগ্নি থেকে জীবন বাঁচাতে ছয়জন ওপর থেকে লাফ দিয়েছেন। আগুন লাগার পরপরই ফাহাদ ইবনে কবীর নামে এক যুবক ফোন দেন মা ফরিদা ইয়াসমিনের কাছে। ফোন করে মাকে জানান, ভেতরে আগুনের ধোঁয়ায় তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি দম নিতে পারছেন না। তারা জানতেন সেখান থেকে লাফ দিলে মৃত্যু নিশ্চিত, কিন্তু তারা হয়তো চেয়েছেন তাদের লাশ আগুনে পুড়ে ছাই না হয়ে একটি লাশ হোক। তারা হয়তো ভেবেছেন তাদের লাশটি বিকৃত না হয়ে একটি স্বাভাবিক লাশ হোক। তারা হয়তো বুঝেছেন- এই সমাজ তাদেরকে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে পারেনি, কিন্তু তারা তাদের লাশের স্বাভাবিকতার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চান। এরকম মৃত্যু কতো কষ্টের! কতটা দুর্ভাগ্য যে একজন মানুষ মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বাঁচার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। চারদিকে হাজার হাজার মানুষ আছেন, কিন্তু তাদেরকে কেউ সাহায্য করতে পারছেন না। এর চেয়ে নির্মম অসহায়ত্ব মানুষের জন্য আর কী হতে পারে? প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভবনের ওপরের দিকের বিভিন্ন ফ্লোরের জানালা ভেঙে সাহায্যের আশায় হাত নাড়তে দেখা যায় অনেককে। ওপরে থেকে শার্ট, প্যান্ট দিয়ে ইশারা করেছেন অনেকে। এ ছাড়া উদ্ধারের জন্য চিরকুট লিখে নিচে ফেলেছেন তারা। আটকে পড়াদের মধ্যে অনেকে ভবনের কাচ ভেঙে দেয়াল বেয়ে নামার চেষ্টা করেছেন। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের সাহস জুগিয়েছেন। আটকা পড়াদের ওপর থেকে লাফ দিতেও নানাভাবে নিষেধ করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তবে অনেকে রশি দিয়ে নামতে গিয়ে আহত হয়েছেন। পিতৃত্বের আশায় অপেক্ষমান ছিল এক যুবক। ২ তারিখের দিকে পৃথিবীর আলো দেখেছে শিশুটি। কিন্তু পৃথিবীতে সফল আগমন ঘটলেও জন্মদাতা পিতার মুখ কোনোদিনই দেখতে পাবে না শিশুটি! যত মরদেহ, তার চাইতে বেশি আহত। কারো শরীর দেখে চেনা যায়, কারো চেনা কঠিন। এখানে অনেকেই খুঁজেছেন নিখোঁজ স্বজনদের। লাশ চেনাও দুরূহ। বীভৎস নারকীয় দৃশ্য। কত আহাজারি, নোনা জল। চোখ ভিজে আসে, চোখ ভিজে যায়। এতো মানুষের জীবন মুহূর্তেই চলে গেলো, পুড়ে ছাই হয়ে গেলো এতগুলো বনি আদম। রূপায়ণ টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড এটাই প্রথম নয়। আট বছর আগেও বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল ভবনটিতে। ২০০৮ সালের ৩১ আগস্ট এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পর দুই ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি ৭ দফা সুপারিশ জমা দেয়। কিন্তু প্রতিবেদন অনুযায়ী ভবনে আগুন প্রতিরোধে করণীয় কোনো নির্দেশনাই মানা হয়নি। গত ৮ বছরে তিন বার ভবন কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে নোটিশও দেয়া হয়। ওই নোটিশে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু তা মানেননি ভবন কর্তৃপক্ষ। ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা গবেষক সিদ্দিক মো. জুলফিকার আহমেদ বলেন, এফ আর টাওয়ারে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ঢাকা মেট্রো) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ভবনটি অগ্নিনিরাপত্তার জন্য ন্যূনতম কোনো সিস্টেম নেই। যে লিফট রয়েছে সেটিও ছোট, সিঁড়ি রয়েছে দুই ফুট আর চার ফুটের। জরুরি ভিত্তিতে বের হওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এক ভবনের সাথে আরেক ভবন লাগানো অবস্থায় রয়েছে, ফলে বাকি ভবনগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। তিনি বলেন, আট বছর আগে এই ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় অগ্নিনিরাপত্তা জোরদার করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সুপারিশ অনুযায়ী কোনো পরিবর্তন আসেনি ভবনে। সামান্য এক্সিটিংগুইসার পর্যন্ত নেই এই ভবনে। যেখানে প্রতি ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকা দরকার। এই ধরনের ভবনে সাধারণত জরুরি বের হওয়ার জন্য পথ থাকে সেটিও নেই এখানে। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বনানীর এই ভবনটি অনুমোদন ছাড়াই ১৯ তলা থেকে ২২ তলা করা হলো। ফায়ার সিস্টেম নেই। এটা এখন বলা হচ্ছে কেন? যাদের এটা দেখার কথা তারা দেখেননি কেন? তাদের কী শাস্তি হবে?’ ঢাকায় একেকটি দুর্ঘটনা ঘটে আর বেরিয়ে আসে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কথা। বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের পর জানা গেল ভবনটির নকশা রাজউক অনুমোদিত নয়, নেই ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা। ফায়ার সার্ভিসের আইন অনুযায়ী ছয় তলার বেশি উঁচু ভবন করলেই তাদের অনুমোদন নিতে হবে। আর থাকতে হবে নিজস্ব ফায়ার ব্যবস্থাপনা। কিন্তু রাজউকের আইনে ১০ তলা পর্যন্ত ফায়ারের অনুমোদন লাগে না। এই সুযোগটি নেয় ভবন মালিকরা। রাজউকের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা এই আইনের সুবিধা দেয়ার জন্য রেডি থাকেন। ১০ তলার পরে ভবন আরো যখন উঁচু করা হয় বা আরো তলা বাড়ানো হয় তখন ভবন মালিকরা পুরনো ভবনেরই সম্প্রসারণ দেখান। ফায়ার সার্ভিসের ধারে কাছেও যান না। এফ আর টাওয়ার ১৯ তলা থেকে ২২ তলা হয়েছে এইভাবেই। তারা রাজউকের নকশাও মানেনি। ফায়ার সার্ভিসতো দূরের কথা। মিডিয়ায় বুয়েটের প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদ হেলালী বলেন, একটা সেফ এক্সিট রুট লাগবে, আগুন লাগলে মানুষ যাতে নেমে আসতে পারে। এবং এখানে কোনো ধোঁয়া, বা আগুন কিছুই থাকবে না। আরেকটা হচ্ছে, ফায়ার লিফট থাকতে হবে, আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের লোকরা যেনো সেই লিফটটা আগুন নিভানোর কাজে ব্যবহার করতে পারে। সব ভবনের জন্য এই দুইটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে যেকোনো ভবনের ক্ষেত্রে নতুন করে মোডিফাই করা সম্ভব। এই নির্মম মহা দুর্ঘটনার পরদিন গুলশান-১ এর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সেখানে থাকা প্রায় ১৮৮টি দোকানের সবগুলোই পুড়ে গেছে। বছর পেরোতে না পেরোতেই আবারও এই অগ্নিকাণ্ডে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন গুলশানের ব্যবসায়ীরা। এর আগে গত বছরের ২ জানুয়ারি রাত ২টার দিকে রাজধানীর গুলশান ১ নম্বরে ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগে। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে মার্কেটের প্রায় ৬০০ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১০ বছর আগের ‘নিমতলী’র ঘটনারই পুনরাবৃত্তি পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ আগুন। কিছুদিন আগে রাত পৌনে ১১টার দিকে প্রথমে এক পিকআপের সাথে প্রাইভেট কারের সংঘর্ষ, শোনা যাচ্ছে সেই পিকআপে ছিল সিলিন্ডার গ্যাস, সেটার বিস্ফোরণ আগে হয় আর কেউ কেউ বলছেন, প্রথমে প্রাইভেট কারের সিএনজি বিস্ফোরণ। এর পাশেই ছিল হোটেল, হোটেলে রান্না হচ্ছিল গ্যাসে, সেই গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ মুহূর্তেই। সাথে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটির ট্রান্সফর্মারে বিস্ফোরণ। দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে লেলিহান শিখা সর্বত্র। ফায়ার সার্ভিসের অক্লান্ত চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে রাত ৩টায়। সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ৭০টি দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। হাসপাতালে আহতের দীর্ঘ সারি। নিমতলী থেকে আমরা শিক্ষা নেইনি, কাজেই একের পর এক উচিত শিক্ষা প্রকৃতিই দেবে, এই-ই নিয়ম। পুরান ঢাকার সেই কালো রাতে চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার নিয়ন্ত্রণে সরু রাস্তার কারণে তারা গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছাতে পারেনি। দ্রুত কাজ শুরু করতে পারলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আরও কম সময় লাগত। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমানো যেত। সেই দিন ভোরের আলোতে আগুনে পোড়া ছেলের টুকরো মাংসের সন্ধানে হাহাকার করছিল মা। ছোট্ট শিশুকে নিয়ে দুইভাই একে অপরকে জড়িয়ে পুড়ে মরলো। স্বামীসহ পুড়ে কয়লা হয়ে গেলো গর্ভবতী স্ত্রী। আড্ডা দেয়া চার বন্ধুর চারটি মাথার পোড়া খুলি পড়ে ছিল একসাথে! বিরিয়ানি খেতে চাওয়া সন্তানকে পাননি বাবা। কুরআনে হাফেজ ঢাবির মেধাবী ছাত্রের জবনিকাপাত। পুড়ে ছাই হওয়া ওয়াহিদ ম্যানশনের ওয়াহিদ সাহেব মারা গেছেন আগেই, তার দুই ছেলে এ ভবনে থাকতেন, ভাগ্যের কী পরিহাস, তারা যে কেমিক্যাল গোডাউন ভাড়া দিলেন, তার বিস্ফোরণেই প্রাণ গেছে নিজেদের পরিবারের লোকদের। পরদিন ছুটি থাকায় অধিকাংশ ব্যবসায়ী একটু গুছিয়ে নিচ্ছিলেন, সেই গোছানোয় চিরতরে গোছানো। ভয়াবহ নিমতলী ট্র্যাজেডি ৩ জুন ২০১০ সালে। এই দিনে পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন লোক প্রাণ হারান। রাসায়নিক পদার্থের কারণেই ভয়াবহ এ ঘটনা ঘটে। ফলে আগুনের লেলিহান শিখা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মুহূর্তে আগুন আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। শত শত মানুষের চোখের সামনে বহু মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। সেই দুর্ঘটনায় ১২৪ জন প্রাণ হারান। আহত হন অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় অনেক বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা। আহত যারা বেঁচে আছেন, শুধু তারাই বলতে পারবেন সেদিন তাদের চোখের সামনে কী বিভীষিকাময় চিত্রই না ফুটে উঠেছিল! সেই ঘটনার আতঙ্ক এখনো কাটেনি পুরান ঢাকাবাসীর মন থেকে। রাসায়নিকের গুদামগুলো পুরোপুরি না সরানোয় নয় বছর ধরে আতঙ্ক নিয়েই বসবাস করতে হচ্ছে তাদের। নিমতলী ট্র্যাজেডির মতো আরো বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করেছিল স্থানীয় বাসিন্দারা। আশঙ্কায় আবার করুণ পরিণতি হলো পুরান ঢাকাতে। প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, এককথায় বলব নিমতলী ট্র্যাজেডি থেকে আমরা কোনো শিক্ষাই নেইনি। এমন সর্বনাশা ঘটনাও আমাদের পথ দেখাতে পারেনি। স্থানীয়রা বলেন, এখনও কেমিক্যাল কারখানা অলিতে-গলিতে রয়ে গেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো নজর দেয়নি। অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ হওয়ায় চকবাজারের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি বিভীষিকাময় রূপ ধারণ করে। দাবি ওঠে সেসব কারখানা ও গুদাম ওই এলাকা থেকে অবিলম্বে সরিয়ে নেয়ার। এ ব্যাপারে সরকারও কেমিক্যালের গুদাম এবং কারখানা সরাতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তারপর কেটে গেছে ৯টি বছর, সরাতে পারেনি।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। দেশের পোশাকশিল্পের ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন। ২০১২ সালের এই দিনে তোবা গ্রুপের পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসের নিচ তলায় থাকা তুলার গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১৩ জন শ্রমিক মারা যান। আহত হন আরও তিন শতাধিক শ্রমিক। অনেক শ্রমিক ছাদ থেকে ভবনের পাইপ বেয়ে নিচে নেমে জীবন বাঁচান। অনেকে আবার প্রাণ বাঁচাতে ছাদ থেকে লাফ দেন। যারা ছাদে যেতে ব্যর্থ হন তাদের অনেকে জানালা দিয়ে লাফ দেন, অনেকে আবার জানালা দিয়ে বের হয়ে ভবনের পাইপ বেয়ে নিচে নামেন। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের অনেকেই জানিয়েছেন, সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। কেউ বেঁচে গেলেও বাবা-মা ও ভাই-ভাবীকে হারান। মা-ভাইয়ের লাশ পেলেও বাবা ও ভাবির লাশ পাননি। বেঁচে যাওয়া গার্মেন্টসকর্মীরা বলেন, ‘সহকর্মীদের বাঁচার আকুতি এখনও কানে ভেসে। বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদে মাঝ রাতে ঘুম ভাঙে এখনও। এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে ডাক্তারের কাছে গেছি। ডাক্তার বলেছে, যতদিন বেঁচে থাকব, সেদিনের স্মৃতি হয়ত আর ভুলতে পারব না।’ এ ঘটনার ৭ বছর পার হলেও শেষ হয়নি মামলার বিচারকাজ। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় অনেকটা থমকে আছে বিচার। মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, এটা প্রমাণিত যে মালিকপক্ষের অবহেলাজনিত কারণে এতো প্রাণহানি হয়েছে। এ মামলার বিচার না হলে মালিকপক্ষের কাছে কোনো নজির সৃষ্টি হবে না। তারা শ্রমিকের প্রতি অবহেলা করতে দ্বিধা করবে না। ছয় বছর হয়ে গেল এখনো প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ারের বিচার হলো না। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

২৪ এপ্রিল ২০১৩ সাভারের ধসে পড়া ভবন রানা প্লাজার নির্মম প্রাণহানি। পৃথিবীর আর কোথাও ভবনধসে এত বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। দুর্ঘটনার দশম দিন পর্যন্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে পাঁচ শতাধিক মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে, যা দক্ষিণ কোরিয়ার একটি ভবনধসে সংঘটিত প্রাণহানির সংখ্যাকে ইতোমধ্যেই পেছনে ফেলেছে। পৃথিবীর সমসাময়িক ইতিহাসে ভবনধসের ঘটনায় এত বেশি সংখ্যক লোক আর কখনই হতাহত হয়নি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘স্যামপুং’ ধসে ৫০২ জন নিহত ছাড়াও আহত হয়েছিলেন আরও প্রায় এক হাজার মানুষ। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলায় টুইন টাওয়ার ধসের ঘটনা বাদ দিলে সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে সাভারের বাণিজ্যিক ভবনধসেই সবচেয়ে বেশি মানুষ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় অবস্থিত পলাশবাড়ীতে নয়তলা একটি ভবনধসের ঘটনায় ৪৭ জন নিহত ও ১১৬ জন নিখোঁজ হওয়ার তথ্য প্রকাশ পায়। এ ছাড়াও ২০১০ সালের ১ জুন ঢাকায় ভবনধসে ২৫ জন নিহত হওয়ার তথ্য উল্লেখ করে সংস্থাটি। তাজরীন নিমতলী হামিম অতীতের দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নেইনি বাংলাদেশ। গত কয়েক বছরে আগুনে পুড়ে নিহত হয়ছে ৮০০ বেশি মানুষ। এদের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? একটি ইংরেজি দৈনিকের সূত্র মতে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৮টি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে কমপক্ষে ৯০০ বেশি মানুষ গত দুই দশকে আগুনের ঘটনায় অন্তত ৮০০ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনের মর্মান্তিক ঘটনায় এতো বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের প্রাণহানি আমাদের অমিত শোকস্মৃতিকে আরেকবার জাগিয়ে দিয়ে গেল। এ ঘটনার অগ্নিদগ্ধ হয়ে আরও শত শত মানুষ জীবনীশক্তি হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করল। অসংখ্য নিখোঁজের সন্ধান আজও মেলেনি। পত্রিকার তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০১০ সালে গার্মেন্টসের এ ধরনের দু’টি অগ্নিকাণ্ডে গাজীপুরের গরীব অ্যান্ড গরীব সুয়েটার ফ্যাক্টরিতে ২১ জন শ্রমিক মারা যান। একই বছরে ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় হামীম গ্রুপের কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যান ৩০ জন। ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কেটিএস কম্পোজিট টেক্সটাইলে আগুন ধরলে পুড়ে ভস্ম হন ৯১ জন শ্রমিক। ওই বছরে গাজীপুরের যমুনা স্পিনিং মিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হন আরও ছয়জন। একই বছরের মার্চে সায়েম ফ্যাশনে আগুনে ৩ মহিলা শ্রমিক নিহত হন। ২০০৪ সালে নরসিংদীর এক কারখানায় আগুন লেগে প্রাণ হারান ৪৮ শ্রমিক। ২০০১ সালে ৮ আগস্ট ঢাকার মিরপুরে মিকো সুয়েটার লিমিটেডে আগুন ধরার গুজবে ভিড়ে পায়ের নিচে চাপা পড়ে নিহত হন ২৪ গার্মেন্টস শ্রমিক। এর সপ্তাহখানেক আগে মিরপুরে কাফরুলে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন আরও ২৬ শ্রমিক। ২০০০ সালের নরসিংদী চৌধুরী নিটওয়ার অ্যান্ড গার্মেন্টস লিমিটেডে এ ধরনের ঘটনায় নিহত হন ৫৩ শ্রমিক।

সারা পৃথিবীতে অগ্নিদুর্ঘটনায় শীর্ষে আছে ঢাকা। এই শহরের কোন অংশই ঝুঁকির বাইরে নয়। ইট-সিমেন্টের প্রতিটি ভবন হয়ে উঠতে পারে প্রাণহানির কারণ। ২০১৮ সালে সারাদেশে ৮ হাজার ৪৬১টি আবাসিক ভবনে আগুন লাগে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৮টি দুর্ঘটনাই ছিল ঢাকায়। শিল্প কারখানায় ১ হাজার ১৩১টি অগ্নিকাণ্ডের ৫২৬টিই ঢাকায়। ‘বেলা’র এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত এক দশকে ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ডে সারাদেশে মৃতের সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ১৫৯ জন। অথচ ২০১৮তেই ঢাকায় মৃতের সংখ্যা ১২১ জন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ঢাকা শহরের ৪২৩টি হাসপাতালের মধ্যে ৪১৬টিই ভয়াবহ আগুনের ঝুঁকিতে আছে। ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, মার্কেট, আবাসিক হোটেলসহ তিন হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান ভয়াবহ আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকার মাত্র ৫টি মার্কেট ও শপিংমলের আগুন ব্যবস্থাপনা সন্তোষজনক। মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘ঢাকা শহর একটি বোমার ওপরে আছে। আগুনেই এই অবস্থা। আর যদি ৬ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয় তাহলে এখানকার গ্যাস, বিদ্যুৎলাইন বিপর্যয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। অধিকাংশ ভবনই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। প্রশাসনিক কেন্দ্র সচিবালয়, হাসপাতাল সব বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।’ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কোনো শাস্তি হয় না। হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবনের উদ্বোধন করেছেন দেশের দুই প্রধানমন্ত্রী। অথচ ভবনটি ছিল অবৈধ। এই অবৈধ ভবন নির্মাণ এবং তা উদ্বোধনে দুই প্রধানমন্ত্রীকে যারা নিয়ে এসেছেন তারা কারা? দেশের সর্বোচ্চ আদালত ভবনটি অবৈধ ও সরিয়ে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিলেও তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির উদ্যোগ নেয়নি। কারা মিথ্যা তথ্য দিলো, কারা অবৈধ কাজে সহায়তা করল, তাদের কি শাস্তি হয়েছে?’ এখন প্রশ্ন হলো এই অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনা কি আগে জানতে পারে না কর্তৃপক্ষ? যাদের এগুলো দেখার কথা তারা কী করেন? তাদের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অবৈধ সুবিধা যারা দেন, তাদের কি কোনো শাস্তি হয়? এইভাবে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া অনিয়ম, দুর্ঘটনা। এভাবেই প্রতিবার, প্রতিটি ট্র্যাজেডিতে আমরা প্রাথমিকভাবে খুব আবেগতাড়িত হই। প্রচণ্ড আঘাত পাই। বেদনায় নীল হয়ে অনলাইনের বায়বীয় পরিমণ্ডলে অশ্রু ফেলি। একদিন, দুইদিন, তিনদিন সর্বোচ্চ; তারপর ভুলে যাই। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসি। শুধু কি আমরাই? না, কেবল আমরাই না। বরং যারা আজ একটি মরদেহের দাম লক্ষ টাকা নির্ধারণ করবে, কাল হয়তো অন্য কোনো খাত থেকে আরো টাকা বাড়াবে। এভাবে পরশু হয়ত আরো কিছু। কিন্তু এরপর? এরপর এই যেই সেই। ট্র্যাজেডি ট্র্যাজেডির স্থানে, সবাই সবার পথে। তবে আমরা ভুলে গেলেও ওমর, কাওসার, লিটন, সাজুদের পরিবার কি আদৌ ভুলে যাবে? পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে ফেলা মানুষগুলি কি একদম ভুলে বসবে? না, মোটেই না। এরা কক্ষনো ভুলবে না আজকের কথা। আজকের এ কয় টাকা আগামী কয়দিন তাদের রুটি জুটাবে ঠিক, কিন্তু এরপর থেকেই এদের নামতে হবে জীবনসংগ্রামে। জীবিকার তাগিদে অন্যের ধারে ধারে। এভাবেই তাজরীন গার্মেন্টস থেকে রানা প্লাজা, নিমতলী থেকে চকবাজার, বনানী এফ টাওয়ার; একটি ট্র্যাজেডির বছর পূর্ণ হওয়ার আগে আরেকটি ট্র্যাজেডির সাক্ষী আর কতো হবো? আর কতো ঘটবে মৃত্যুর মিছিল? প্রাণ সংহারের উন্মত্ত নৃত্য? আজকের দগ্ধ হওয়া ভিকটিমের পরিবারগুলোকে কেবল কয়েক লক্ষ টাকার চেক ধরিয়ে দেওয়াই দায়মুক্তি ভাবলে চরম ভুল হবে। অসহায় পরিবারগুলোর স্থায়ী জীবিকার ব্যবস্থা করাই আমাদের আপনাদের মানবিক দায়িত্ব। এভাবে মৃত্যুর তালিকা বছরে বছরে বাড়তে থাকে। প্রতিটি ঘটনায় প্রত্যক্ষ করা যায়, প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি-বিরোধী দলের নেতার শোকবাণী, ফায়ার ব্রিগেডের উদ্ধার তৎপরতার রোমাঞ্চকর কাহিনী, ক্ষতিপূরণের নামে মালিকপক্ষের উদারতা প্রকাশের মেকি তৎপরতা। অন্য দিকে দেখা যায়, থরে থরে সাজানো লাশের মাঝে স্বজন-প্রিয়জনদের মাতম-আহাজারি। পোড়া লাশের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। চোখের সামনেই মূর্তিমান অভিশপ্ত মৃত্যুপুরী। অনিঃশেষ ট্র্যাজিক নাটক যেন চলতেই থাকে। কে বলবে ঢাকার বনানীর এই বিষাদময় ঘটনাই হবে শেষ ঘটনা! কেন এই মৃত্যু?! এ প্রশ্নের জবাব পেতে কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। কারখানার নিচ তলায় গোডাউন, অপ্রশস্ত সিঁড়ি, জরুরি নির্গমনপথের অভাব, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের অপ্রতুলতা, বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা, অবৈধ দখল, নির্দয় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। দীর্ঘ দিন ধরে বলে এলেও এসবকে থোড়াই কেয়ার করে। বাংলাদেশের ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর বিবেক, মানবতা অনেক আগেই পুড়ে গেছে বলে একের পর এক দুর্ঘটনায় মানুষ পুড়ছে। বিবেকের তাড়নায় সাড়া দিয়ে যদি কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিত তাহলে এ ধরনের বিষাদময় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো না। আর সরকারের আইন সে তো কাগজ, ঘুষ আর দুর্নীতির নিগড়ে বন্দি। প্রত্যেক এলাকায় অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল। কয়টা এলাকায় তা পালন করা হয়েছে? ম্যানেজ মানির জোরে সব কিছু ম্যানেজ করা যায়। লাইসেন্স, ছাড়পত্র পাওয়া যায়। তা না হলে এসব ঘটনা প্রতিরোধে আইন কড়াকড়িভাবে কার্যকর হতো। আইন এখন অসাধুর পকেটবন্দী, অপরাধীর হুকুমাত তালিমে ব্যস্ত। টাকা দিয়ে ক্ষমতাবানেরা সবকিছুই কিনে নেয়। দেশবাসী কাছে প্রশ্ন, প্রত্যেক ঘটনাতে কেন সরকারের টনক নড়েনি। তখন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু সে তদন্ত কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। সকলেই একমত যে, তদন্ত কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়াতে সমস্যা। এ ব্যাপারে সরকারই সিংহভাগ দায়ী। সরকারের অবহেলা ও অদূরদর্শিতার কারণেই একশ্রেণীর অর্থলোভী ব্যবসায়ী নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ব্যবসা করছে। রাষ্ট্রের চোখ খুলুক। আমাদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত হোক। না হয় কে জানে? আজ তাদের দিন ছিলো, কাল হয়ত আমার। অথবা আজ রিফাত দম্পতি ছিলো, কাল হয়ত আপনার। অবিলম্বে সরকার কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করে জনগণের শান্তি, স্বস্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির