post

বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে

২৭ এপ্রিল ২০১২
মুহাম্মদ আবদুল জব্বার সরকার জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনের অন্যতম সহায়ক। বিরোধী দলের সাথে সরকারি দলের দলীয় স্বার্থে কিছু মতপার্থক্যগত বিরোধ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, বিচার বিভাগ নীতিতে মতানৈক্য একটি দেশের অকল্যাণ আর বিশৃঙ্খলা বৈ আর কী আশা করা যায়? দলীয় বিবেচনায় কিছু সুযোগ-সুবিধা নেয়া বর্তমান রাজনৈতিক ফ্যাশনের অন্যতম। তবে দলীয় বিবেচনার বিষয়টি যখন বিচার বিভাগেও অনুপ্রবেশ করে তখন নাগরিকের জন্য সর্বশেষ ভরসাস্থল কোথায়? যখন বিচারকেরা বিবেকতাড়িত না হয়ে দলীয় ও সরকারি প্রভাবতাড়িত হয়ে বাহবা কুড়াতে ব্যস্ত থাকেন, তখন অসহায়ের আর্তচিৎকার গুমরে মরা ছাড়া আর কী করার থাকে? “জোর যার মুল্লুক তার”Ñ এ যেন আইয়্যামে জাহেলিয়াত! “সত্য সমাগত” শ্লোগানের পরিবর্তে মিথ্যা সমাগত শ্লোগানের অনুরণন ধ্বনি চৌদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেক মানুষের একটা সর্বশেষ আশা-ভরসার স্থল থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক, যেটাকে অবলম্বন করে সে বেঁচে থাকে। সমৃদ্ধি ও খ্যাতি লাভ করে। সর্বশেষ অবলম্বন যখন শেষ হয়ে যায় তখন তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ন্যায়-অন্যায়ের ফারাক সে বুঝতে পারে না। না পারাটাই স্বাভাবিক। সত্য সমাগত এর পরিবর্তে সমাজে মিথ্যা সমাগত শ্লোগান উচ্চারিত হয়ে তখন এমনটিই হয়। অন্তত সর্বশেষ একটা অবলম্বন যদি কারো থাকে তাহলে সে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করে। একটি দেশের একজন নাগরিকের এ সর্বশেষ অবলম্বন হলো বিচারের অধিকার। সে যখন সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে চরমভাবে অবহেলিত হয়; তখন তার অধিকার নিশ্চিত করে কেবলমাত্র বিচার বিভাগ। সরকার গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে রাজতন্ত্র-বাকশাল কায়েম করেছে। বিরোধী দল সরকারের অংশ। কিন্তু সরকার যখন বিরোধী দলকে শুধু প্রতিপক্ষই মনে করে তখন সংঘাত অনিবার্য। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের শুধু সরকারি দলের সমর্থকদের নিরাপত্তা ও অধিকার সংরক্ষণ করা দায়িত্ব কর্তব্য নয় বরং সকল জনগণের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সরকারের অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব। বিশ্বসভ্যতা আজ মাকাল ফলের রূপ ধারণ করেছে। মাকাল ফল সুন্দর তিক্ততা অসহনীয়। মানুষের সেবা, গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে বিভিন্ন জনপদে বিপন্ন মানবতা! পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বশান্তির কথা বলে নিজেদের আধিপত্য ও স্বার্থরক্ষার জন্য বিভিন্ন খোঁড়া অজুহাতে দেশের পর দেশ ধ্বংসলীলায় পরিণত করেছে। নয়া কৌশল! নিজেদের মর্জি মোতাবেক জাতিসংঘকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এসব অপকর্ম! কী মানবতাবোধ! হাজার হাজার টন খাবার মাছের জন্য হেলিকপ্টারে করে সাগরে ফেলছে। অথচ নিজেদের নির্লজ্জ আক্রমণে অসংখ্য মানবতা যুদ্ধের বিভীষিকায় গুমরে মরছে।  যেখানে লজ্জা নিবারণের ন্যূনতম বসনের ব্যবস্থা নেই, ডাস্টবিন থেকে কুকুরের সাথে অখাদ্য খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে। ধিক্ মাকাল ফল সদৃশ কুটিল মানবতাবোধ! পশ্চিমারা আমাদের শান্তি ও সৌহার্দ্যরে কথা বলে কিন্তু এতদঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির নীলনকশা তাদেরই। বন্ধু সেজে সেবার নামে আমাদের প্রভু হিসেবে শাসন করাই মূলত খায়েশ। এ খায়েশ পূরণ করতে গিয়েই সরকার তাদের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নে ব্যস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে চলছে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা। এসব কিসের লক্ষণ? বিরোধী দলকে আক্রমণ-নির্যাতন ও মামলা- মোকদ্দমায় জড়ানো সরকারি দলের রুটিন কাজ হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছে। যারা আক্রান্ত মজলুম, বিচারপ্রার্থী তারা থানা-কোর্ট-কাচারির কাছে ভিড়তে পারে না। এসব যেন শুধুমাত্র সরকারি দলের জন্য বরাদ্দ। এ সরকারের আমলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জন মেধাবী ছাত্র আল মুকাদ্দাস, ওয়ালি উল্লাহ ও বিএনপি নেতা ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমসহ গুম হয়েছেন অনেকেই। কারো লাশ পাওয়া গিয়েছে আর কারো ইয়ত্তা নেই। তাহলে জনজীবনের নিরাপত্তার দায়দায়িত্ব কার? যদি সরকারের হয়ে থাকে, তাদের সন্ধান এখনো মিলেনি কেন? অভিযোগ উঠেছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এর সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন,  দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচার করা উচিত। অথবা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে, দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে  দেশের বাইরের কোনো শক্তি কাজ করছে কি না তা খতিয়ে  দেখা জরুরি। সম্প্রতি বিরোধীদলীয় নেতা ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন। গুম হওয়ার দ্বিতীয় দিন রাতে একজন থানা আওয়ামী লীগের  নেতা  প্রায় সাড়ে এগার বছর আগের একটি ঘটনায় মামলা করেছেন। তা-ও গভীর রাতে। পুলিশও কোনো খোঁজখবর না নিয়ে এ মামলা গ্রহণ করলেন। এ কেমন আইনের রক্ষক? অথচ প্রতিদিন কত হাজার হাজার লোক থানায় মামলা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। এদেশের অহরহ রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করার পর থানায় মামলা করতে গেলে মামলা গ্রহণ না করা পুলিশ বাহিনীর ক্রেডিটে পরিণত হয়েছে। “উপরের নির্দেশ”  কমন ডায়লগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোজাহিদ, মাসুদ বিন হাবীব হত্যাকাণ্ডে পিতা মামলা করতে গেলে মামলা না নিয়ে উল্টো রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য নিরপরাধী কিছু ছাত্রকে মামলা দিয়ে লাশের রাজনীতি! এভাবে নাম না জানা কত সন্তানহারা পিতা কোর্ট-কাচারিতে ফেরি করে ফিরছেন তার ইয়ত্তা নেই। আইনের রক্ষকেরা  গ্রেফতার বাণিজ্য নিত্যদিনের কর্মসূচিতে পরিণত করেছে। কিন্তু নীতি কথায় বেশ পটু। সত্য কথা বললে হুঙ্কার ছাড়ে। গুম করে আরো কত কী!! কত লোক গুম হলো তার ইয়ত্তা নেই। কথায় গণতন্ত্র আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার সিদ্ধহস্ত। কিন্তু কর্মকাণ্ড করে তার বিপরীত। আদালতের রায় নিয়ে আসামিরা যখন কারামুক্ত হয় তখন জেল গেইট থেকে শ্যোন অ্যারেস্ট করা হয়। সাম্প্রতিককালে কয়েকজন ছাত্রকে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। বারবার চারবার গ্রেফতার করা হয় জেল গেইট থেকে। ডিবি অফিসে নিয়ে পুনরায় মামলা দেয়া হয়। এসব কী আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন নয়? ঠুনকো কিছু ইস্যু নিয়ে দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সরব দেখা যায়।  দেশের বিরাজমান অবস্থা মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে চোখে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে দেখাতে হবে? এরা নীরব কেন? তখন প্রশ্ন ওঠে এরা কারা? সাগর-রুনির হত্যার ব্যাপারে কেউ কি কোন দিন কিছু জানবে না? এসব অপকর্মের হোতা কারা? দেশের সকল মানুষ শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়, চায় কল্যাণ। কিন্তু দেশের মধ্যে চলছে এক চরম বিভক্তির কলুষ রাজনীতি। অসাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলে সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক আচরণে ব্যস্ত সরকার। যারা দেশের স্বাধীনতার কথা বলে, কল্যাণের কথা বলে নীতি-আদর্শ আর ধর্মের কথা বলে তাদেরকে মানবতাবিরোধী বলে জাতিকে সরকার দ্বিধা-বিভক্তির অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। যাদেরকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের নামে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মহাজোট সরকার বিচারকার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।  সকল মহল থেকে এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানায়। কিন্তু কিছুদিন পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো এটি আন্তর্জাতি নয়  দেশীয়। সরকারের এ মিথ্যাচারে মানুষ হতবাক হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচারের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষী হিসেবে যাদেরকে আনা হয় তাদেরকে অনেকদিন ধরে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে যাতে তারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। যাদেরকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করা হয় তারা নিজেরাই খুন, নারী নির্যাতন, লুট, চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধ মামলায় অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত। আদালত যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার সত্যতা খুঁজে পেল না তখন পুলিশি জবানবন্দীকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে সরকার ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ ধরনের মানবতাবিরোধী জঘন্য আইনের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।  যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান যখন আসামি পক্ষের আইনজীবীদের বলেন, আমি জাজ করতে পারবো না। তাহলে মানুষ কার কাছে বিচার চাইবে? পিরোজপুর-১ আসনের এমপি আব্দুল আউয়াল সাহেব মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে এসে মাওলানা সাঈদীকে সালাম দিলেন, মোসাফা করলেন আর বললেন, বিয়াই সাহেব কেমন আছেন? তিনি তার বিরুদ্ধে কোনো সত্য সাক্ষ্য দিতে পারলেন না। এরপরও কি জাজদের বিবেক নড়ে না? পরবর্তীতে আদালত থেকে বলা হলো অন্যান্য সাক্ষী যারা আছেন তাদেরকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা ব্যয়সাধ্য। বারবার সাক্ষ্য গ্রহণের সময় দিয়ে তাদেরকে হাজির করা সম্ভব হয়নি। অথচ তারা দিব্যি দেশের ভেতরেই ঘোরে বেড়াচ্ছেন। এসব ভুয়া মিথ্যা সাক্ষীদের আদালত আইনের আওতায় আনবেন কি? না দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নই মূল উদ্দেশ্য। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত বাবু বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের কোনো সাক্ষীর প্রয়োজন নেই, আবেগই যথেষ্ট। জাতি আজকে একইভাবে মনে করছে সুরঞ্জিতের দুর্নীতি এতই স্পষ্ট যে, বিচারের জন্য সাক্ষীর প্রয়োজন নেই,  আবেগই যথেষ্ট। সরকার বিচারের নামে বিরোধী দলকে দমন করতে গিয়ে আইন, আদালতসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এর প্রতিকার কী? সচেতন দেশপ্রেমিক মহলকেই জেগে উঠতে হবে। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্য প্রমাণ করেই দেশ জাতির মধ্যে ঐক্যের বন্ধনকে অটুটের মাধ্যমে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও সমৃদ্ধ অর্জন করে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির