post

বিজেপির বিজয় ও মোদির মসনদ

১২ মে ২০১৪

মোহাম্মদ আবু জাফর

Storyআব্কে হোলিয়া মেঁ ভর দেইনহেঁ তোলিয়া; মাই গঙ্গা ভর দেইনহেঁ মোদি কি ঝোলিয়া; পিএম কুরসি সঙ্গে মিলিহে আন্জেলিনা জোলিয়া; আউর ভাইয়া খুরশিদ পারাচেইন লাভা-এ-হোলিয়া। (এবারের হোলি উৎসবে আমাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে; মা গঙ্গা মোদির ঝুলি ভরে দেবেন আশীর্বাদে; শুধু প্রধানমন্ত্রীর গদি নয়, সেই সাথে হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলিও মোদির ভাগ্যে মিলবে; আর খুরশিদ ভাই তাদের বিয়েতে আশীর্বাদ করবেন)। কংগ্রেস নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ গুজরাটের দাঙ্গা ইস্যুতে মোদিকে বলেছেন, ‘নপুংসক মুখ্যমন্ত্রী’। মোদি যে তা নন, সেটা বোঝাতে হলিউড নায়িকাকে বিয়ে করার কথা বলা হয়েছে। মোদি অ্যাঞ্জেলিনাকে না পেলেও প্রধানমন্ত্রীর কুরসি তো পেতে যাচ্ছেন। এবার উত্তর ভারতের বারানসি শহরের রাজপথের ধারে এই নির্বাচনী কবিতা চোখে পড়েছে অনেকের। স্থানীয় একটি ক্লাব বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির সমর্থনে ভোজপুরি ভাষায় ব্যঙ্গকবিতাটি প্রকাশ করেছে। মোদি ‘পবিত্র শহর’ বারানসি থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। আগামীকাল প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ এবং সরকার গঠন করে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি ভারতের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছেন। বারানসিতে জিতে মোদি মসনদে বসে খাস আদমি হবেন। অন্য দিকে তার কাছে হেরে গিয়ে আম আদমি কেজরিওয়াল গেছেন কয়েদখানায়। ভারতের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জোট ৩৩৬ আসনে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস মোর্চা মাত্র ৫৯ আসনে জিতেছে। ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি একাই ২৮২ আসন পেয়েছে। কংগ্রেসের ভাগ্যে কেবল ৪৪টি। ভারতের এই নির্বাচন এবং নতুন সরকারের বিষয়টি এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। ভারতের এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলোÑ (১) ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ৬৭ বছরে এবারই প্রথমবারের মতো কোনো অকংগ্রেসি দল লোকসভায় পেল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। (২) স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী কংগ্রেস অতীতে একাধিক নির্বাচনে পরাজিত হলেও এবারের মতো এত কম আসন পায়নি। ফলে কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দলের স্বীকৃতি ও মর্যাদা পায় কি নাÑ তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। (৩) বামপন্থীরা আর কোনো নির্বাচনে এতটা বিধ্বস্ত হয়নি এবারের মতো। অতীতে তারা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন জোটের অংশীদার হতে পেরেছে। অর্থাৎ কংগ্রেস ক্ষমতায় যেতে তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। বামরা তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্ভাবনাও কিছুটা জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। অথচ এবার সিপিএম এবং সিপিআই পর্যন্ত এত খারাপ ফল করেছে যে তারা আর জাতীয় দলের মর্যাদা পাচ্ছেন না। (৪) হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে রাজনীতি সাধারণত ব্রাহ্মণ, তথা উচ্চবর্ণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এবার প্রথম এমন একজন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন যিনি নি¤œশ্রেণীর। মোদির এই পরিচয় তার বিজয়ের একটি বড় কারণ। নেহরু পরিবারের দুর্ভাগ্য, ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় আর প্রতিপক্ষ বিজেপির বৃহত্তম বিজয়, এবার এ দু’টি রেকর্ড একসাথে সৃষ্টি হলো ইন্দিরার পুত্রবধূ, শ্বেতাঙ্গিনী সোনিয়া দলের নেতৃত্ব দেয়ার সময়ে। উল্লেখ্য, বিজেপির জন্ম ১৯৮০ সালে। তবে এর অব্যবহিত পূর্বসূরি জনতা পার্টি এবারের মতো বিপুল বিজয় অর্জন করেছিল ১৯৭৭-এ। তখন ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার কুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ জবাব দিয়েছিল মোরারজি দেশাইকে ক্ষমতায় এনে। তিনিও মোদির মতো গুজরাটি। তবে রাজনৈতিক আদর্শের দিক দিয়ে মোদির প্রায় বিপরীত। অবশ্য তখন কংগ্রেস হেরে গেলেও শক্তিশালী বিরোধী দল হওয়ার মতো আসন পেয়েছিল। কথায় বলে, অক্ষমের সান্ত্বনাÑ রবীন্দ্রনাথ নরমাল স্কুলের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন।’ তেমনি কংগ্রেসের মা ও ছেলে (সোনিয়া-রাহুল) শুধু আক্ষেপ না করে কিঞ্চিত সান্ত্বনা পেতে পারেন। কারণ তারা এবার ৪৪ আসন পেয়েছেন। ১৯৮৪ সালে তো বিজেপি পেয়েছিল সর্বসাকুল্যে দু’টি। তবে এরপর ক্রমান্বয়ে বিজেপি যেভাবে নির্বাচনে এগিয়ে গেছে, কংগ্রেস কি আগামী দিনে সেই সাফল্য দেখাতে পারবে? এবারের নির্বাচনের প্রচারণা নিয়ে নানা ধরনের পর্যালোচনা হয়েছে, তেমনি ফলাফলও হচ্ছে নানাভাবে বিশ্লেষিত। প্রচারণার সময়ে কংগ্রেস বলেছিলÑ ‘মোদি তো সামান্য চা বিক্রেতার ছেলে; নিজেও স্টেশনে চা বেচতেন।’ মোদির মোক্ষম জবাব ছিল, ‘আমি চা বেচেছি; দেশ তো বিক্রি করিনি।’ ইঙ্গিতটা যে কংগ্রেস মহলের ‘জাতীয় স্বার্থবিরোধী ভূমিকা’র দিকে, তা স্পষ্ট। এখন বিজেপির বিজয়ে নির্বাচনী ফলাফলকে কেউ কেউ বলছেন, ‘ভূমিপুত্রের কাছে রাজপুত্র পরাজিত হয়েছে’। মোদিরা প্রতিপক্ষ রাহুল গান্ধীকে রাজপুত্র বলে ব্যঙ্গ করতেন। মোদির জয় দেখে আবেগে বলা হচ্ছে, ‘এ রায় পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং জনতন্ত্রের পক্ষে’। তবে ভবিষ্যৎই বলবে পরিবারের বদলে এবার বিশেষ গোষ্ঠী বা চক্রের শাসন জেঁকে বসবে কি না। এ পর্যন্ত ভারতবাসী দলের শাসন দেখেছে। অনেকের শঙ্কা, সামনের দিনগুলোতে দলের চেয়েও দলের মুরব্বিদের শাসন জাতির ঘাড়ে বেশি চেপে বসতে পারে। কারণ বিজয়ী দল বিজেপি তো চলে মুরব্বি আরএসএসের কথায়। স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি চরম সাম্প্রদায়িক এ সংগঠনের ক্যাডার। আরো আছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও শিবসেনার মতো মন্ত্রণাদাতারা। মোদিদের মনে রাখতে হবে, এবার তাদের সাফল্যের একটা বড় উৎস নেতিবাচক ভোট। তার মানে বিজেপি বা মোদির গুণে নয়, কংগ্রেসের দোষেই বিপুল ভোটার পদ্মফুলের দিকে ঝুঁকেছেন। বিজেপি ছাড়া আর কোনো বড় দল থাকলে, সেটিকেই তারা কংগ্রেসের বিকল্প ভাবতেন। একই সাথে এটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, ভাগ্য জোরে বিকল্প হওয়াই সমাধান নয়। বিকল্প যদি পূর্বসূরির চেয়ে উত্তম না হয়, তাহলে জনগণের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসবে না। কোটি কোটি ভোটার মোদিকে যেমন ভাসিয়ে দিয়েছেন, তেমনি ডুবিয়েও দিতে পারেন। প্রত্যাশা পূরণ না হলে এই ভোটাররা হতাশ হয়ে অন্য দল খুঁজবেন। আপাতত দল তো দু’টিÑ বিজেপি ও কংগ্রেস। অতএব, ভবিষ্যতে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। কংগ্রেস নির্বাচনে ইস্যু হিসেবে ‘ভালো কথা’ বলেছে, নতুন বা চমকপ্রদ কথা বলতে পারেনি। কংগ্রেস বরাবরের মতো ধর্মনিরপেক্ষতার মন্ত্র আউড়িয়েছে, যেভাবে বাংলাদেশে এটি আওয়ামী লীগের ট্রেডমার্ক বুলি। কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে; কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশকে অসাম্প্রদায়িক করার কোনো আন্দোলন গড়ে তোলেনি। বরং বারবার সুবিধাবাদ ও আপসকামিতার মাধ্যমে দলটি প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক ভূমিকা রেখেছে। এই প্রেক্ষাপটে এবার মুসলমানদের সমর্থন ফসকে যেতে দেখে কংগ্রেস বিজেপির হিন্দুত্ববাদ ও মুসলিমবিদ্বেষের তীব্র সমালোচনা করেছে। তবে ভোটারদের কাছে তা প্রচার কৌশল বলে যতটা মনে হয়েছে, ততটা মনে হয়নি আদর্শনিষ্ঠা। কংগ্রেসের জাতীয় ঐক্য, শান্তি ও অহিংসার বাণীও তেমন প্রভাব ফেলেনি। অপর দিকে নরেন্দ্র মোদি ও তার বিজেপির প্রধান নির্বাচনী ইস্যু ছিল উন্নয়ন, সুশাসন এবং দুর্নীতি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ। তারা ‘গুজরাট মডেল’ তুলে ধরে বলেছেন, ‘এই রাজ্যের অনুসরণে সারা দেশের জন্য বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারি আমরাই’। বিজেপি গড়ফরহড়সরপং ধাঁচের ঊপড়হড়সরপং বা অর্থনীতি চালু করতে চায়। কংগ্রেস ডুবেছে দুর্নীতির কলঙ্কের কারণেও। মোদি এর বিপরীতে, নিজেকে সৎ ও নির্লোভ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। বিশ্বের যে দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দরিদ্র মানুষের বাস, সেই ভারতের দারিদ্র্যমোচনকে তিনি একটা বড় লক্ষ্য ধরে এ জন্য কর্মসংস্থান এবং অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। অবকাঠামোর মধ্যে বিদ্যুৎ, সড়ক, পানি ইত্যাদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। ভারতের নির্বাচনী ফলাফলের কারণ অনেকেই উপলব্ধি করতে পারছেন না। মোদির মতো ‘কট্টর সাম্প্রদায়িক’ ও ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তির নেতৃত্বে বিজেপির ‘ভূমিধস বিজয়’ চরম বিস্ময়কর ও দুর্বোধ্য বলে মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। ভারতের নিকট অতীতের রাজনৈতিক ইতিহাসের খ্যাতনামা লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পল নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকায় লিখেছেন, ভারতের মানুষ আরো পাঁচ বছর কংগ্রেস শাসনে থাকতে চায় না কেন, সেটি সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিষয়ে মোদির অবস্থান এবং পুরনো রেকর্ড জানার পরও মানুষ তাকে নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত কেন, তা বোঝা অতটা সহজ নয়। মোদির ‘ঐতিহাসিক’ বিজয়ে ভারতের কেমন ইতিহাসের সূচনা হয়, তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তীব্র হতাশা, আশা-নিরাশার মিশেল এবং ইতিবাচক প্রত্যাশাÑ এ তিনটিই দেখা যাচ্ছে। তবে ডালরিম্পলের মতো ভারত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সাংবাদিক বলেছেন, ‘ভারতের জনগণ মারাত্মক এক জুয়াখেলায় মেতে উঠেছে। তারা মোদির মানবাধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতাবিষয়ক অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে তাকে নির্বাচিত করেছেন একজন শক্তিশালী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম ব্যক্তি হিসেবে। তিনি হয়তো কিছু কঠিন সংস্কার করতে পারবেন। এতে হয়তো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে। কিন্তু এর পরিবর্তে ভারতের মানুষ কী হারিয়েছে, তাদের এটি ভেবে দেখা প্রয়োজন।’ নরেন্দ্র মোদি যে ক’জন হিন্দু নেতাকে জাতীয়পর্যায়ে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেবেন বলে জানা গেছে, তাদের একজন মদনমোহন মালব্য। উত্তর প্রদেশের এই আর্য বর্ণবাদী ব্যক্তি হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। মোদির বিজেপির পূর্বসূরি সংগঠনগুলোর একটি এই মহাসভা। ১৯১৫ সালে এর জন্ম। ভারতের বেশির ভাগ অঞ্চলে ছিল এর শাখা। হিন্দু মহাসভা গোরক্ষা, হিন্দি ভাষার বিস্তারসহ বিভিন্ন ইস্যুর মাধ্যমে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করতে চেয়েছে। ১৯২৫ সালে কে হেডগেওয়ারের নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী মহাসভা থেকে আলাদা হয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়মসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) গঠন করে। প্রথম থেকেই এটি ছিল জঙ্গি বা সহিংস সংগঠন। হিন্দু মহাসভা মুসলমানদের ‘তবলিগ’-এর বিপরীতে ‘শুদ্ধি’ আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। মহাসভা তাদের কর্মকাণ্ডে কংগ্রেসের সহযোগিতা পেয়েছিল। সাম্প্রদায়িক সংগঠনটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের উসকে দিত। এর পরিণামে বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে মুসলমানদের সাথে দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। বর্ধমান, খুলনা, যশোর, ঢাকা ও নোয়াখালীতে এমন ঘটনার নজির রয়েছে। ১৯৪৬-৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মহাসভা বিশেষভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। তাদের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রভাবে হিন্দুদের অনেকে পশ্চিমবঙ্গে স্বপ্ন দেখছিলেন হিন্দু রাষ্ট্রের। মহাসভা আত্মরক্ষার নামে আগ্নেয়াস্ত্রধারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ার উদ্যোগ নেয়। সে মোতাবেক সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লোকদের দিয়ে হিন্দু তরুণদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ‘মুসলিম আধিপত্য প্রতিরোধ’-এর ধুয়া তুলে ‘হিন্দু ভদ্রলোক’দের শক্তিশালী রাজনৈতিক মঞ্চরূপে হিন্দু মহাসভা আবির্ভূত হয়েছিল বলে রাজশেখর বসু উল্লেখ করেছেন। এবার ভারতের সম্ভাব্য নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এমন ধারণা দিতে চেয়েছে, যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস দলের সাথে তাদের আদর্শিক মিল এবং রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা, তাই বিরোধী দল বিএনপি খুশি হবে কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ এবং সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির বিজয়ে। এমন আভাস-ইঙ্গিত দিয়ে আওয়ামী নেতারা নিজেদের খাঁটি অসাম্প্রদায়িক দেখাতে চেয়েছেন। অবশ্য রাজনীতির স্বার্থে তারা যে, সব রূপই ধারণ করতে পারেন, তার অভিজ্ঞতা এ দেশের মানুষের কম নয়। যা হোক, জনগণ মনে করে, যে দল ভারতপন্থী হিসেবে দীর্ঘ দিন পরিচিত, আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণে যারা আগের মতোই দিল্লি-মস্কো লাইনের অনুসরণ করে চলবেন, তাদের জন্য দিল্লিতে কোন দল ক্ষমতায়, তা মুখ্য নয়। বিজেপি কিংবা নরেন্দ্র মোদি কখনো বলেননি যে, তারা ভারতের সংবিধান বদলে দেবেন, যাতে (কাগজে কলমে হলেও) ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ থাকবে না। কিংবা তারা এমন ঘোষণা দেননি যে, ‘ক্ষমতায় গেলে আমরা ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ ঘোষণা করব।’ আনুষ্ঠানিকভাবে বা আইন করে এসব করা যে বাস্তবে হিতে বিপরীত হবে ভারতের জন্য, এতটুকু বোঝার বুদ্ধি তো তাদের আছে। মোদির নির্বাচনী প্রচারণায় জোর দিয়ে বলা হয়েছিল, তিনি জিতলে চৌকিদারের মতো দায়িত্ব পালন করবেন দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তিনি তার ইশতেহারে যে তিনটি প্রধান বিষয় তুলে ধরেন, সেগুলো হচ্ছেÑ উন্নয়ন, সুশাসন এবং রামমন্দির পুনর্নির্মাণ। মোদি নিজের সাম্প্রদায়িক ইমেজ চাপা দিতে নির্বাচনের আগে মুসলমানদের নানা কায়দায় চেয়েছেন খুশি করতে। অপর দিকে তার মূল সংগঠন আরএসএস এবং আদর্শিক পৃষ্ঠপোষক সঙ্ঘ পরিবারকে খুশি রাখতে হয় আরো বেশি। তাই বাবরি মসজিদ চত্বরে রামমন্দির নির্মাণের অঙ্গীকার করতেই হলো। সচেতন মানুষের স্মরণ থাকার কথা, বিজেপির ‘ধাড়ি নেতা’ আদভানির নেতৃত্বে সঙ্ঘ পরিবারের হাজার হাজার ক্যাডার ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার এটি করতে দিয়েছিল বলেই পুলিশ ছিল সাক্ষীগোপাল। ব্রাহ্মণ্যবাদী উন্মত্ততায় প্রায় পাঁচ শ’ বছর প্রাচীন মসজিদটির হত্যাযজ্ঞ সঙ্ঘটনের সময়ে প্রার্থনারত ছিলেন পাঁড় ব্রাহ্মণ প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও। রাজিব গান্ধীর উত্তরসূরি এই কংগ্রেস-কাণ্ডারি হয়তো রামমন্দির প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রার্থনা করছিলেন। দেখা যাচ্ছে, কট্টর সাম্প্রদায়িক হিন্দু জঙ্গিদের বিজেপি দিয়েছে আশ্রয় আর কংগ্রেস দিয়েছিল প্রশ্রয়। এই পাপে কংগ্রেসকে হারাতে হয়েছে দীর্ঘকালীন ‘ভোট ব্যাংক’ মুসলমানদের সমর্থন। এতে ফায়দা তুলেছে শ্রীপদ্ম প্রতীকধারী গেরুয়া বাহিনী। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের কংগ্রেস দলের সম্পর্ক ‘ঐতিহাসিক’। এটি নিছক রাজনৈতিক কৌশলগত নয়, বরং আদর্শিক ও আত্মিক। আওয়ামী মহল বলে থাকে, ‘ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু এবং এই মৈত্রীবন্ধন চিরস্থায়ী’। এটা বলা হয় আসলে কংগ্রেসকে লক্ষ করে। যা হোক, এবার নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আওয়ামী লীগ খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। তবুও সংশ্লিষ্ট নেতা ও কলামিস্টরা নানা আশাবাদের মধ্য দিয়ে নিজেদের সান্ত্বনা দেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত বিজেপির ভূমিধস বিজয় আর কংগ্রেসের শোচনীয় পতন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘ভারতের এই নির্বাচনী ফলাফল থেকে আমাদের শিক্ষণীয় আছে’। তিনি ঠিক কথাই বলেছেন। মানুষ শুধু অতীত নিয়ে পড়ে থাকে না। প্রতি মুহূর্তে আমরা ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলেছি। স্বাধীনতা আনয়নের ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকলেই স্বাধীনতা অর্থবহ করা যায় না। এ জন্য চাই উন্নয়ন ও সুশাসনÑ দুটোই। স্বাধীনতা সংগ্রামে কৃতিত্ব আছে বলে কোনো দল বা নেতা-নেত্রীকে জনগণ দুর্নীতি বা দুর্বৃত্তপনার লাইসেন্স দেয় না। গণতন্ত্র নির্ভর করে না বিশেষ কোনো দলের ওপর। দেশপ্রেমও কারো পৈতৃক সম্পদ নয়। সরল মানুষের আস্থা, আবেগ, অনুভূতির অসদ্ব্যবহার করে পরিবারতন্ত্র চাপাতে চাইলে প্রতিক্রিয়া হবেই। ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়া তুলে সংখ্যালঘুদের ‘নির্বাচনী সম্পত্তি’ মনে করা এবং কৌশলে সাম্প্রদায়িকতা লালনের পরিণাম মন্দ হতে বাধ্য। বাপ-মা কিংবা পূর্বপুরুষের ইমেজ দিয়ে নিজের ইমেজ গড়া রাজপুত্রের পক্ষেও সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ‘আমার আর মামু’দের নয় দেশটা। জাতি নয় কোনো দলের কাছে দায়বদ্ধ। বরং সব দল ও নেতা-নেত্রীকে নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের জন্য জাতির কাছে দায়ী থাকতে হবে। উঠতে হবে ইতিহাসের কাঠগড়ায়।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির