post

বিশাল ঘাটতি বাজেট জনরোষ এড়াতে নানা প্রণোদনার কর্মসূচি

১৬ জুলাই ২০১৪

রাইয়ান এম আলম

8রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫ জানুয়ারি ছিল দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত দিন। এ দিনে জনগণের রায় ছাড়াই ৩০০ আসনের সংসদ সদস্যের মধ্যে ১৫৩ জনই নির্বাচিত হন। এর বাইরে যারা নির্বাচিত হন সেটাও ছিল আইওয়াশ। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই জনগণের কোনো আস্থা নেই। বরং জন-অসন্তোষ রয়েছে প্রতি পদে পদেই। কেউ বিনিয়োগ করছে না । এমনি পরিস্থিতিতে ভোটারবিহীন সরকার তাদের প্রতি জন-অসন্তোষ কমাতে বিশাল অঙ্কের ঘাটতি বাজেট দিয়েছে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য। ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকাই ঘাটতি রাখা হয়েছে। আর এ ঘাটতি মেটানো হবে দেশী বিদেশী ঋণ নিয়ে। ঋণনির্ভর এ বাজেটে জন-অসন্তোষ কমাতে নানা প্রণোদনা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ভোটারদের ভোট ছাড়াই সরকার গঠনের পরে আগামী অর্থবছর থেকেই সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়বে। সমাজে বসবাসরত বিশাল সংখ্যক  অবসরভোগীদের ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের ওপর বিনিয়োগে আর  কোনো কর দিতে হবে না। মহিলাদের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে দেয়া হল। নতুন যারা কোম্পানি করবেন বা যে সকল কোম্পানি শেয়ার বাজারে নেই তাদের কর্পোরেট কর কমিয়ে দেয়া হয়েছে ‘পাক্কা’ আড়াই শতাংশ। কৃষি খাতে বিনিয়োগকারীদের করমুক্ত আয়ের সীমাও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে চারগুণ। তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে হবে। তাই তাদের দেয়া বিদ্যমান সুবিধা আগামী ৩০ জুন ২০১৫ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষকে ‘খুশি’ রাখতে নিত্য প্রয়োজনীয় ১৮টিরও বেশি পণ্য লোকাল এলসি করের আওতায় বাইরে রাখা রাখার ঘোষণা করা হলো। এবং একই সাথে এলসির কমিশন করও কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আর ‘চুপি-চুপি’করে করে কালো টাকা  সাদা করার সুযোগ রেখে দেয়া হলো আগের মতোই। এসব বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের নতুন বাজেটে। ফলে মনেই হতে পারে এ যেন নির্বাচনী বাজেট!। তা হলে কি সরকার মনে করছে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন আসন্ন? অদূরভবিষ্যতে অর্থনীতির কী দশা হবে, সেই চিন্তা দূরে থাক,  আপাতদৃষ্টিতে সবাইকে   খুশি করার একটি চেষ্টা করা হয়েছে এই বাজেটে। মুখে স্বীকার না করলেও সবার অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনে ভোটারদের মন জয় করার জন্য বাজেটে তো একটি প্রচেষ্টা নিতেই হয়। ব্যাংক থেকে অধিক হারে ঋণ নিয়ে হলেও এই ‘প্রচেষ্টা’কে সমুন্নত রাখা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বাজেটে। এর ফলে অদূরভবিষ্যতে অর্থনীতির কী দশা হয় সেই চিন্তা দূরের থাক। ঋণের ‘সুদ’ পরিশোধ করতে করতে রাষ্ট্র ‘ফতুর’ হয়ে যাক। তাতে কার বা কী আসে যায়! তারপরও এই বাজেটেই রয়েছে বিশাল ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’। নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ‘৮০ অতিক্রান্ত’ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে এ ধরনের একটি বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। নতুন ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেটের আকারটি নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। বিশাল এই বাজেটে ঘাটতিই ধরা হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। যা জিডিপি ৫ ভাগ। কিভাবে এই ঘাটতি মোকাবেলা করা হবে। ঘাটতি মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়ার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকাই নেয়া হবে ব্যাংক থেকে। অর্থাৎ এই পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাকি ১২ হাজার ৫৬ কোটি টাকা নেয়া হবে সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে। ঘাটতি মোকাবেলায় বিদেশী উৎস থেকে অর্থ নেয়ার প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। যদি এই পরিমাণ অর্থ না পাওয়া যায় তবে ব্যাংক থেকে আরও ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর কাজটি করতে হবে। যার অসম্ভাবী ফলটি হচ্ছে-দেশের ‘ইঞ্জিন’ হিসেবে বিবেচিত বেসরকারি খাত ঋণ বঞ্চনার শিকার হওয়া। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়, তার বাজেট বক্তৃতায় অনেক কিছুই অস্পষ্ট রয়েছে। ‘অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় : সম্ভাবনায়ময় আগামী পথে বাংলাদেশ’-শীর্ষক বাজেট বক্তৃতায় অনেক কিছুই ছিল অস্পষ্ট। মোট ১৬৩টি পৃষ্ঠা সম্বলিত বাজেট বক্তৃতায় আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা সাত দশমিক ৩ শতাংশ ধরে হলেও মূল্যস্ফীতি কত হবে তা বলা হয়নি। শুধু আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে থাকবে। অন্যান্য বার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিপরীতে কত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা ধারবাহিক অনুচ্ছেদে দেয়া হতো। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম, শুধু একটি ‘চার্ট’ দিয়ে সব ব্যয় বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। বহুল আলোচিত জেলা বাজেট বা এমপিওভুক্তি নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় তেমন কিছু নেই। শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরে বিশেষ একটি বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দের অঙ্কটি উল্লেখ করা হয়নি। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘দ্রব্যমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যথোপযুক্ত জীবনমান নিশ্চিত করার জন্য প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথাযথ বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য বেতন ও চাকরি কমিশন, ২০১৩ গঠন করা হয়েছে। আশা করছি চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কমিশন তাদের প্রতিবেদন সরকারের নিকট দাখিল করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আমরা ২০১৪-১৫ অর্থবছর হতেই নতুন বেতন কাঠামো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করব। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর জন্যও স্বতন্ত্র বেতন-ভাতা প্রবর্তনের বিষয়টিও বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। নতুন স্কেলে বেতন-ভাতা নির্ধারিত হওয়ার পর সব বেতন-ভাতার ওপর আয়কর আরোপের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ নতুন অর্থবছরের মহিলা, প্রতিবন্ধী ও মুক্তিযোদ্ধাদের আয়করমুক্ত সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে সাধারণ করদাতাদের আয়করমুক্তসীমা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই অনুযায়ী সাধারণ করদাতাদের আয়করমুক্ত সীমা দুই লাখ ২০ হাজার অপরিবর্তিত থাকছে। তবে মহিলা ও ৬০ বছর ঊর্ধ্ব করদাতাদের বিদ্যমান আয়করমুক্ত সীমা দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সাথে প্রতিবন্ধী করদাতার আয়করমুক্ত সীমা বিদ্যমান ৩ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা। এবং গেজেটভুক্ত যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্তসীমা দুই লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ করা হয়েছে। নন-পাবলিকলি ট্রেডেড (শেয়ারবাজারে নেই) কোম্পানি কর্পোরেট কর বর্তমানে রয়েছে সাড়ে ৩৭ শতাংশ। এটি কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া কোম্পানি ও অংশীদার ব্যবসার টার্ন-ওভারের ওপর প্রদেয় ন্যূনতম করের হার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।  আর অন্যান্য কোম্পানির কর হার অপরিবর্তিত রাখার কথা বলা হয়েছে বাজেটে। নতুন অর্থবছরে অনুন্নয়ন বাজেটের আকার ধরা হয়েছে এক লাখ ৬৮ হাজার ৬৯৯ কোটি  টাকা। এর মধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৩১ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। অনুন্নয়ন ব্যয়ে দ্বিতীয় বৃহৎ খাতে রয়েছে বেতনভাতা। এখানে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৮ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। অনুন্নয়ন বাজেটের ১৭ শতাংশ। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল এক লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। আদায়ের ব্যর্থতার কারণে পরে তা সংশোধন করে করা হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে কর থেকেই আদায়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে রাজস্ব আদায় ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা। আদায় ব্যর্থতার কারণে তা সংশোধন করে করা হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে আদায় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি ২৭ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।  বৈদেশিক অনুদান হিসেবে পাওয়া যাবে আরও ৬ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ধরা হয়েছে ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। তবে এর সাথে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার বাজেট ধরলে তা বেড়ে হবে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে বিদেশী নিট ঋণের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে উচ্চাভিলাষী। এ খাত থেকে আসবে  মনে করা হচ্ছে ১৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ১৪ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। তবে বিদেশী ঋণ আশানুরূপ না পাওয়ায় ঋণ প্রাপ্তি সংশোধন করে করা হয় ১২ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। বাজেট নিয়ে নানা জন নানা ধরনের সমালোচনা করেছেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, নতুন ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট লক্ষ্যবিলাসী এবং আয়-ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণহীন। সংস্থার পক্ষে বাজেট বিশ্লেষণে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, বাজেটের বিভিন্ন লক্ষ্য যেমন- আয়-ব্যয়, ঘাটতি অর্থায়ন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা, বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিলাসিতা করা হয়েছে। এই বিলাসিতা কাক্সিক্ষত, তবে তা আমাদের সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা বিলাসিতার কার্যকরিতা দেখতে চাই। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.৩ শতাংশ ধরা হয়েছে। এটা অর্জন করা সম্ভব হবে না। এটার জন্য আরো সংস্কার প্রয়োজন। এ ছাড়া বাজেটে পরিসংখ্যানের বিভ্রান্তি রয়েছে। তিনি বলেন, এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে সমঝোতামূলক রাজনৈতিক আবহাওয়া তৈরি করতে হবে। বাজেট নিয়ে চারটি বিশ্লেষণ তুলে ধরে ড. দেবপ্রিয় বলেন, বাজেটের আর্থিক কাঠামোর যেসব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে তাতে বাস্তবতার প্রতিফলন নেই। এ ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির যে সূচকগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এমনকি বাজেট করার সময় কোনো অনুশীলনও দেখছি না। তিনি বলেন, অন্য দিকে আয় ও বিনিয়োগ বাড়ানোসহ আর্থিক যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা ঠিক থাকলেও বাজেটে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পরিকল্পনা নেই। অর্থমন্ত্রী যে আগামীর পথ নির্দেশনার কথা বলেছেন, সেই পথ তো বানাতে হবে। সব আবহাওয়াতে এই পথ যেনো চলার যোগ্য হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। তা যেনো নিরাপদ হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। পরিসংখ্যানের বিষয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে বলে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে নতুনভাবে জিডিপিকে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে যেটা বলছেন, প্রবৃদ্ধির হিসাব ২০০৫-০৬ র্অথবছরের ভিত্তিতে। কিন্তু অন্যান্য হিসাব ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের ভিত্তিতে। উনি নিজেই বলেছেন যেহেতু ছয় মাস আগে কাজ শুরু হয় তাই ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমাদেরকে যেসব বই সরবরাহ করা হয়েছে তা ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরেই করা হয়েছে। আর এটা আমাদের কাছে আশ্চর্য লেগেছে। আমাদের প্রশ্ন হলো আগামী দিনে ৭.৩ শতাংশকে আমরা কোন ভিত্তিবছরের সাথে তুলনা করবো। ফলে এখানে এটা বিভ্রান্তি থাকবে। অর্থমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে বলেছেন, এটা পরিষ্কার করতে হবে। তা না হলে কিছু চিন্তাশীল লোক আছে তারা আগামীতে এটা নিয়ে অনেক আলোচনা করবে। আমার মনে হয় ওনার এই উদ্বেগটা সঠিক ছিল। তিনি বলেন, ৭.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা এর যৌক্তিক ভিত্তিটা কী। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হোক আপনাদের মতো আমরাও চাই। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন তা হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া কোনো সময় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। মোট বিনিয়োগকে ৮৩-৮৪ শতাংশে নিতে হবে। এটা নিতে হলে ৮-৯ শতাংশ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ থেকে আসবে। বাকিটা আসতে হবে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ থেকে। এ সব ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ অনুমান করা হয়েছে ২১ শতাংশ। এটাকে ২৫ শতাংশে নিতে হবে। আর এই বাড়তি ৪-৫ শতাংশ বিনিয়োগ একটি বছরে বৃদ্ধি করা যাবে কি না সেটাই প্রশ্ন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। দেড় থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। আর এই ৪-৫ শতাংশ দেশজ আয়ের অংশ হিসেবে অর্থমূল্য হলো ৭৫ হাজার কোটি টাকা বা সাড়ে ৯ বিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, পুরো বাজেট আলোচনার মধ্যে পরিসংখ্যানের দ্বৈত ব্যবহার। এক দিকে ২০০৫-০৬ অন্য দিকে ১৯৯৫-৯৬ ভিত্তি বছর এটা আগামী দিনে আমাদের বহু আলোচনাকে আক্রান্ত করবে। তাই দ্রুততার সাথে ২০০৫-০৬ অর্থবছরের ভিত্তি ধরে সব আলোচনাকে নিয়ে যাওয়া উচিত। সিডিপি বলছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অর্থ বরাদ্দ করা ও ব্যয় করার মানে এই না যে গুণগত মান নিশ্চিত হয়েছে। এসব নিশ্চিত করার পদক্ষেপ হিসেবেই আমরা এডিপির ব্যবস্থাপনা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করার সক্ষমতার কথা বলছি। এই কাজগুলো যদি ঠিক মতো না হয় তাহলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের যে পতন দেখছি তা রোধ করতে পারবো না। ঢাকা-চট্টগ্রাম ৪ লেন প্রকল্প চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা। কিন্তু তার কোনো পুনঃঅর্থায়নও পর্যন্ত করা হয়নি। এসব সময়মতো শেষ হচ্ছে না, ব্যয় বাড়ছে। জনগণ এসব থেকে সুবিধা পাচ্ছে না। তাই আমরা ব্যয় ও গুণ দুটোই বৃদ্ধির পক্ষে। কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় কমে আসছে। সিপিডি বলছে, প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে প্রাক্কলন করা হয়েছে বর্তমান বাস্তবতায় তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ছাড়া উন্নয়ন ব্যয়ের প্রাক্কলনও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা সবকিছুই বেশি বেশি করতে চাই। এটা ঠিক আছে। কিন্তু তা আমাদের সক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, রাজস্ব বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ চলে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ সুদ মেটাতে। ওনারা কোথায় ভর্তুকি দেবেন আর কোথায় দালান-কোঠা বানাবেন। বিশ্লেষণে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি বাজেট বক্তৃতায় কয়বার নির্বাচন ও মেনুফেস্টো শব্দটা বলা হয়েছে। যতবারই বলা হয়েছে তা ছিল গতানুগতিকভাবে ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে। একটি নির্বাচন হয়ে গেছে। নতুন সরকার এসেছে। সেই সরকারের একটি রাজনৈতিক ইশতেহার ছিল। নতুন সরকারের প্রথম বাজেটে অগ্রাধিকারগুলো বাস্তবায়নে যে ধরনের উদ্দীপনা থাকার কথা তা প্রস্তাবিত বাজেটে ছিল না। নিজেদের ইতশেহারের সামঞ্জস্যতা নেই। রাজনৈতিক নতুন অঙ্গীকার নেই। সিডিপি বলছে, রাজস্ব ঘাটতি মোকাবেলা বলার জন্য যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য ওনারা ঠিক করলেন অতো টাকা তো ওনারা পাবেন না। এখানে সরকারের উচিত ছিল অবাস্তব পরিকল্পনাগুলোকে কাটছাঁট করা। এখানে ১১ শ’ প্রকল্প রয়েছে, যা নামে মাত্র ১৩টি প্রকল্পে ১ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি প্রকল্প আছে বহুদিন ধরে চলছে তাদেরকে কোনো টাকা দেয়া হচ্ছে না। এডিপিতে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। এখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার। শৃঙ্খলা থাকলে ব্যয় কমতো। আর অনেক অপচয় আছে। এটা রোধ করা গেলেও ব্যয়ের পরিমাণ কমতো। তাহলে ঘাটতির পরিমাণও কিছুট কমতো। আর তখন অর্থায়নের পরিমাণটা আর্ োবাস্তবসম্মতভাবে করা যেতো। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি বলে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সমঝোতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই অবস্থায় রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে বিনিয়োগ বা প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জিত হবে না। বাজেটে জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় অর্থনীতি সমিতি অর্থমন্ত্রীর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্ব শর্তগুলোকে সমালোচনা করেছে। “সর্বোপরিÑরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করছি” অর্থমন্ত্রীর এমন উক্তিই দেশের বর্তমান অবস্থায় সবচে প্রণিধানযোগ্য, যা আগামী দিনে হয়তো বা আরো সত্য উক্তিতে রূপান্তরিত হবে। অর্থনীতি সমিতি মনে করে, তাই যদি হয় তাহলে শুধু ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধিই নয়, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার অনেক আকাক্সক্ষাই অপূরণীয় থেকে যাবে। বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, বাজেটে অর্থমন্ত্রীর সু-আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা অনেক। অর্থনীতি সমিতিরও তার চেয়ে কম নয়। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আর তা হলো, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্য ও জ্বালানির মূল্য কমবে, আসলে কি সেই শক্ত ভিত্তি যার ওপর দাঁড়িয়ে তিনি এমন কথা বরলেন বা ভাবলেন অথবা প্রক্ষেপণ করলেন তা পরিষ্কার নয়। বিনিয়োগসহায়ক মুদ্রানীতি (?) অনুসরণ করা হবে-বিনিয়োগ সহায়ক মুদ্রানীতিটা আসলে কী তা বোধগম্য নয়। মানবসম্পদ উন্নয়নের নানামুখী উদ্যোগ নেযা হবে-এসবের আসলে সুর্নিদিষ্ট মানে কী, কী করা হবে, কী করা হবে না, তা সুস্পষ্ট নয়। পুঁজিবাজার সংস্কারকার্যক্রম চলবে-এর অপারেশনাল মানেটা কী, আর ওই সংস্কারের সম্ভাব্য ফল কী এবং তা কবে নাগাদ ফলপ্রসূ ফল প্রসব করবে সে সম্পর্কে বলা হয়নি। বিদেশী বিনিয়োগ ও সহায়তা বাড়বে- এরই বা অসলে অর্থ কী; কিভাবে তা ফলপ্রসূ হবে; যেখানে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে তেমন উৎসাহ পান না সেখানে বিদেশীরা কী জন্যে আসবেন; বিদেশীদের কী এমন   সহায়তা দেয়া হবে যার ফলে তারা আসবেন যে সহায়তা দেশীয় বিনিয়োগকারীদের দেয়া যায় না (?)। অর্থনীতি সমিতি মনে করে এসব নিয়ে বাজেটে তেমন কোনো পথনির্দেশনা নেই। এরপর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করছিÑ অর্থমন্ত্রীর এমন উক্তিকে সমালোচনা করে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, বিষয়টি নিয়ে আরো খোলামেলা কিছু কথাবার্তা বলতে পারতেন অর্থমন্ত্রী। কারণ প্রচলিত অর্থে বাজেট এক অর্থনৈতিক দলিল (আসলে আয়-ব্যয়ের হিসেব) এ কথা সত্য, কিন্তু বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষিতে রাজেটকে হতে হবে নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক-অর্থনীতির পথনির্দেশকারী দলিল।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির