post

বিসর্জিত পন্থায় বিবর্ধিত দৃষ্টিতে

তাহমীদুল ইসলাম ভূঁইয়া

১৬ মে ২০২১

বর্তমান সময়ে শিক্ষা অর্জনে সবচেয়ে বড় বাধা মনে হয় পড়ালেখা। কোনো শব্দ উৎপন্ন করা হলে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এখন কেউ যদি প্রথম ধ্বনিকৃত শব্দ শুনতে না পান, তবে প্রতিধ্বনিকেই তার আসল বলে বিভ্রম হবে, আর এতে দোষের কিছু নেই। এই ধ্বনি বা প্রতিধ্বনি কোন মুখ থেকে নিঃসৃত হলো তা বিষয় না, কতো সুন্দর শব্দে তা প্রকাশিত হলো সেটাও বিষয় না বরং বিষয় হলো কথাটার ব্যবহারিক ও বাস্তবিক গ্রহণযোগ্যতা।

আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ঘাড় ধরে জ্ঞানার্জনে’র নীতিকে বহাল তবিয়তে বিদ্যমান রেখে যখন পড়ানো হয় “সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত” তখন ব্যাপারটাতে সাহস দেখানোর বিষয়টা অস্পষ্ট থাকে না। প্রশ্ন আসে, এই সাহসের কতটা সৎসাহস আর কতটা দুঃসাহস?

আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে আমার যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। আসলে আমাদের স্কুল কলেজে ভর্তি করানো হয় ফার্স্ট হওয়ার জন্য। একশ জনের মধ্যে যে ছেলেটা ফার্স্ট হয় তাকে আমরা মাথায় তুলি, দশ থেকে বিশের ভেতর যারা থাকে তাদের আলাদা মর্যাদা দেই, আর বাকিদের ‘ছ্যা ছ্যা’ বলে দূরে সরাই। অধিকাংশ সময় বৈষম্যের ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা তৈরি হলেও একটা বিচ্ছিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা মেধা আর এই মেধা বৈষম্যের দিকটি এখনো বেশ অনুন্মোচিত।

আমরা মূলত শিক্ষিত হই এই ‘প্রতিযোগিতামূলক’ বিশ্বে টিকে থাকার জন্য। বর্তমান বিশ্বের চাকরির বাজার অনেক সীমিত ও সঙ্কুচিত। এই বাজারে বিক্রি হতে হলে সার্টিফিকেটের কোনো জুড়ি নেই- এরূপ বিশ্বাস আমাদের মধ্যে এতোটাই বদ্ধমূল যে, তা প্রায় কুসংস্কারের পর্যায়ে চলে গেছে। যদিওবা দলে দলে মানুষ এই প্রতিযোগিতার হজমশক্তির কাছে নিজেদেরকে যথাসম্ভব সুষমখাদ্য হিসেবে জাহির করে তার উদরপূর্ণ করার চেষ্টায় রত, তারপরও এই প্রতিযোগিতা নিশ্চিতভাবেই এখনো বেশ অপুষ্ট। তাই অসুস্থও। আর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার মূলনীতি হিসেবে আমাদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হচ্ছে ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে’। বোধ হয় এই নীতিকে ছোটবেলা থেকেই বিশ্বাস করানোর জন্য আমাদের প্রচলিত আবহমান শিক্ষাব্যবস্থা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

আমরা একদিকে সবার জন্য সমান সুযোগ সুবিধার কথা বলি অন্যদিকে সবার চেয়ে ভালো সুবিধাগুলো লুফে নেয়ার জন্য হন্যে হয়ে থাকি। শিক্ষা যে জাতির মেরুদণ্ড তার পেছনেও একই ধরনের চিন্তাধারা উঁকি দেয়। প্রতিযোগিতার মাঠে নামার আগে শিক্ষিত হয়ে, সার্টিফিকেট জুটিয়ে মেরুদণ্ড শক্ত করে নেয়াই শ্রেয়। মেরুদণ্ড দৃঢ়কারী শিক্ষার প্রতি আমরা যতটুকু গুরুত্বারোপ করি তার কিছু অংশও যদি আমরা মস্তিষ্ক গঠনকারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতাম তাহলে বোধ হয় উপকার ছাড়া অপকার হতো না। আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের কতটা শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করছে সে বিষয়ক কোনো পরিসংখ্যান আমার হাতে নেই, তবে তা যে আমাদের তার অবয়বের দিকে তাকিয়ে গুণমুগ্ধ করতে পারছে না, সে দাবি আমি করতে পারি। শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি ক্ষেত্র হলো শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। যদিও এ দুটোর ক্ষেত্রফল বাংলাদেশের সমগ্র ক্ষেত্রফলের তুলনায় খুব কম না, তথাপি এই ক্ষেত্রফলের অনেকাংশই ‘শিক্ষা দূষণে’ দূষিত। যিনি শিক্ষা দেন তিনিই শিক্ষক। তবে দেখা যায়, বর্তমানে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার দূরত্ব অনেক ক্ষেত্রেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার দূরত্বের কাছাকাছি। এখানে শিক্ষা একটি আবদ্ধ জলাশয়ের মতো, অথচ এটির হওয়ার কথা ছিলো মহাকালব্যাপী প্রবহমান সাগর।

এখানে আরেকটা কথা বলি, ‘শিক্ষা প্রদান’ বিষয়টার চেয়ে ‘শিক্ষা অর্জন’ বিষয়টা অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহী ও যুগোপযোগী। আমরা যেন তা মানতেই চাই না। আমাদের স্কুল কলেজে অধ্যক্ষ কথা বলেন, শিক্ষক কথা বলেন, অভিভাবক কথা বলেন, গভর্নিং বডির মেম্বার কথা বলেন, শিক্ষামন্ত্রী কথা বলেন, বহিরাগত অতিথি কথা বলেন, পরলোকগত আত্মা কথা বলেন; কথা বলে না শুধু পিয়ন ও শিক্ষার্থী। এখানে কথা বলা মানে গত দিনের মুখস্থ পড়া দেয়া নয়, মতপ্রকাশ করা। অনেকে বলতে পারেন আমি শিক্ষার্থীর মতপ্রকাশের কথা বলে তার হাতে শিক্ষকের ভুল ধরানোর ক্ষমতা অর্পণ করছি কিনা। বস্তুত সব মানুষই ভুল করে। তবে ‘মতপ্রকাশের অধিকার’ শুধু যে প্রকাশকের মাধ্যমে কারও ভুল ধরিয়ে দেয়ার অধিকার নিশ্চিত করে তা নয়, বরং মতপ্রকাশকারীর কোনো ভুল ভাঙিয়ে দেয়ার সুযোগকেও সম্প্রসারিত করে। শিক্ষানির্ভর পরীক্ষাব্যবস্থা করার বদলে আমরা করেছি পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা। আর মেধানির্ভর পরীক্ষাব্যবস্থার বদলে আমরা করেছি মুখস্থনির্ভর পরীক্ষাব্যবস্থা। আর যেহেতু আমাদের সমাজব্যবস্থায় পরীক্ষাব্যবস্থাই জীবনব্যবস্থা হিসেবে গণ্য তাই পরিশেষে তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মুখস্থনির্ভর জীবনব্যবস্থা। একজন স্কুলছাত্র হিসেবেই বলি, আমাকে কেউ বোঝান, আমাকে কেন শকুনের মতো পড়া গিলে হায়নার মতো লিখতে হবে? আমি তো মানুষ, তাই না? জানোয়ার বানান কেন?

‘সৃজনশীলতা’র যুগের সাথে এদেশে পাকিস্তানি শাসনামলের কিছু মিল আছে। ব্রিটিশদের দেশত্যাগের পর এদেশে পাকিস্তানি শাসনের সময় যেমন বাঙালিরা ধারণা করেছিলো এবার মুক্তি পাওয়া গেছে এবং তাদের ধারণায় কাদামাটি দিয়ে পাকিস্তানিরা যে আচরণ করেছে তার সাথে এই পদ্ধতির মিল হলো, এর আগমনেও ছাত্ররা আশা করেছিলো মুখস্থ করার হাত থেকে এবার না হয় রেহাই পাওয়া গেল। কিন্তু দু’ক্ষেত্রেই যেই লাউ সেই কদু। যে ছাত্রটা আগে বই মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতো এখন সে বই মুখস্থ তো করেই সাথে আবার গাইডও মুখস্থ করে। এখন আমরা সৃজনশীলতা মুখস্থ করি। খারাপ কী?

আমাদের লক্ষ্যটা স্পষ্টতই শিক্ষাজীবী হওয়া, শিক্ষিত নয়। আবার শিক্ষিত হয়েও শিক্ষাজীবী হতে না পারলে আমরা হয়ে যাই বুদ্ধিজীবী। শিক্ষাজীবী অথবা বুদ্ধিজীবী হওয়ার চেয়ে রিক্সাজীবী হওয়া এজন্য ভালো যে, আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় অপরাধগুলো শিক্ষা কিংবা বুদ্ধিজীবীরাই করে আসছে। রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর কথা মিথ্যা না-“বুদ্ধিজীবীর রক্ত ¯œায়ুতে সচেতন অপরাধ”। তারপরে প্রাত্যহিক সমাবেশের বিড়ম্বনা তো আছেই। প্রাত্যহিক সমাবেশই খুব সম্ভবত একমাত্র অনুষ্ঠান যেখানে একই সাথে কুরআন পড়া হয় ও বাদ্যযন্ত্রের গানও হয়। যে ছেলেটা তার ধর্মবোধ থেকে এই গান গায় না, তাকে ডেকে এনে দেশপ্রেমের শিক্ষা দিয়ে গান গাইতে বাধ্য করা হয় এবং এই গান গাওয়া যে দেশপ্রেমের অংশ আর দেশপ্রেম যে ঈমানের অংশ তার শিক্ষা দেয়া হয় জাল হাদিস দিয়ে, ধর্মবই থেকেই। অথচ যে ছেলেটা ‘পাগল করে’ এর বদলে ‘ছাগল করে’ বলে জাতীয় সঙ্গীতের ব্যঙ্গাত্মক প্যারোডি করে সে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। “পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কি না গায়!”

হালের বাংলাদেশে যে দুটো প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি আছে তাহলো মসজিদ আর স্কুল। বলতেই হয় এই দুটো প্রতিষ্ঠানই কার্যত অকার্যকর। আমরা স্বভাবতই বস্তুগত জিনিসের প্রতি খুব বেশি দাম দেই। ‘ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার চেয়ে তাই ‘মসজিদ’ প্রতিষ্ঠা করা অনেক বেশি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। সহজও। একই কথা খাটে বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। বাজারে যখন ‘মানুষ কাকে বলে’ তার হাজারো রকম সংজ্ঞা পাওয়া যায় তখন ‘মানুষ’ বানানোর অতি জটিল একটা প্রক্রিয়ার চেয়ে স্কুল তৈরি করা বেশ সরল একটা সমীকরণ। আমাদের পাঠ্যবইয়ে যতই ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধ পড়ানো হোক, যতই জীবসত্তা, মানবসত্তা, উপরতলা, নিচতলা পড়ানো হোক- এই প্রচলিত শিক্ষা যে আমাদের কোনো ধরনের নৈতিক শিক্ষা দিচ্ছে না তা তো স্পষ্ট। একটা মানুষ যতটুকু নৈতিকতা শিখছে তা তার একান্ত নিজের বিবেক দিয়েই। কিন্তু এই যে আমাদের পাঠ্যবইয়ে এতো সুন্দর সুন্দর কথা- ভালো কাজ করো, সত্য কথা বলো, অন্যকে সাহায্য করো, অন্যের মতকে গুরুত্ব দাও, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করো ইত্যাদি সব বকবকানি কোনো কাজে আসছে না কেন? সহজ ভাষায় এর কারণ হলো- এগুলো সবই ফাঁকা কলসি। যা একটু বেশি বাজে। এতটুকুই। আমাদের সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারের আমলা-কামলা সবার মধ্যেই কথা ও কাজের যে এতো বিস্তর পার্থক্য তা একটা শিশু তার নাড়ি কাটার পর থেকেই দেখে আসছে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতখানি নীতি শিখাচ্ছে সে হিসেব কিভাবে করবেন জানি না, তবে আমি আমার এই কাঁচা বয়সেও একটা লম্বা ফিরিস্তি দিতে পারি তা কিভাবে আমাদের ভীতি শিখাচ্ছে। স্কুল ভীতি, পরীক্ষা ভীতি, ভাষণ ভীতি, শাসন ভীতি, টিসি ভীতি, প্রধান শিক্ষকের কুঁচকানো ভ্রুয়ের ভীতি, বেতন ভীতি, কোচিং ভীতি, মায়ের ভীতি, মারের ভীতি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই শিক্ষাব্যবস্থাকে একটা আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা করার জন্য আমাদের একদল শিক্ষাবিদ কেন জানি লালঝুঁটি কাকাতুয়ার মতো খালি বায়না ধরেন। আর আরেকদল গল্পের বানরের মতো অনুকরণের সমাধানে ব্রতী হন। যে শিক্ষাপদ্ধতি অপেক্ষাকৃত উন্নত তার অনুসরণ অবশ্যই করা যায়। কিন্তু তাই বলে ভালো শিক্ষাপদ্ধতিকে তুলে এনে কপি-পেস্ট করাতে কোনো লাভ হবে না। কেননা, প্রতিকূল জলবায়ু গুণে তা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। তখন তাকে আইসিইউতে ভর্তি করিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হলেও জীবনের অসহ্যতায় তা নিজে থেকেই আত্মহত্যা করবে।

আলোচনার জন্য লেখা শুরু করলেও লেখাটা বোধ হয় সমালোচনাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি স্বীকার করি সমালোচনা করার চেয়ে কোনো কিছু তৈরি করা অনেক কঠিন। তবে, সত্যি বলতে কি, আমি খুব করে একটা সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি। সে স্বপ্ন থেকেই সমালোচনা করি বা আলোচনা করি আমার চাওয়া এটাই। লেখক : শিক্ষার্থী, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির