post

ব্যাংকিং খাতে অধরাই থেকে যাচ্ছে লুটেরারা

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪

আশরাফুল ইসলাম

Orthonityশক্তিশালী ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা দেশের ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাদের মতে, গত কয়েক বছরে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, সর্বশেষ বেসিক ব্যাংক থেকে জনগণের আমানতের অর্থ লুটপাট হয়েছে। কিন্তু মূল হোতারা নানা কারণে অধরাই থেকে গেছে। বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে আমানতের অর্থ ব্যাংকের ওপর বোঝা হয়ে গেছে। এ কারণে ব্যাংক আমানতকারীদের নিরুৎসাহিত করতে সুদের হার কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের আমানত চলে যাচ্ছে সরকারের সঞ্চয়পত্রে ও বিভিন্ন খাতে। এতে আমানত কমে যাচ্ছে। আর আমানত কমে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অন্য দিকে ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দার কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। পাশাপাশি যেসব অর্থ নানা কৌশলে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ওই সব ঋণ আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে নিয়ম রক্ষার জন্য এসব খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। আর প্রভিশন রাখা হয় ব্যাংকের আয় থেকে। ফলে ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিলতার কারণে ফাঁকফোকর দিয়ে অন্যায় করে সহজেই পার পেয়ে গেছে অনেকে। নীতিমালা শিথিল করার কারণে অনেকটা ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। ফলে কাগজে-কলমে আদায় বেড়ে গেছে; অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে ঋণের টাকা আদায় না করেও কৃত্রিমভাবে আদায় দেখিয়ে মুনাফা স্ফীত করা। অন্য দিকে বিনিয়োগমন্দাজনিত কারণে আয় কমে যাওয়াসহ নানা কারণে ধকল সহ্য করার ক্ষমতা ব্যাংকের কমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতের চিত্র অনেকটা এমনই। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ নামক কোম্পানির এক হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সর্বশেষ বেসিক ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির চিত্র বের হয়ে আসার পর ব্যাংকিং খাতের সাবেক ও বর্তমান বিশ্লেষকেরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অথচ ঋণ কেলেঙ্কারির হোতারা অধরাই থেকে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নীতিনির্ধারক সেই দিন বলেই ফেললেন, চট্টগ্রামের ব্যাংকিং খাত যেন অগ্নিকুণ্ড হয়ে পড়েছে। হাত দিলেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি তার চট্টগ্রাম অফিসের নির্বাহী পরিচালক, মহাব্যবস্থাপকসহ ডজনখানেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে একসাথে বদলি করেছে। কিন্তু যাদের কারণে চট্টগ্রামের ব্যাংকিং খাত এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। এ দিকে নানা কারণে ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ব্যাংকগুলো সাধারণ আমানতকারীদের কাছ থেকে কম সুদে আমানত গ্রহণ করে অপেক্ষাকৃত বেশি সুদে গ্রাহকদের কাছে বিনিয়োগ করে থাকে। ঋণ ও আমানতের সুদের ব্যবধানই হলো ব্যাংকের মুনাফা। এ মুনাফা দিয়ে তার পরিচালনা ব্যয় অর্থাৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা, নানা ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করার পর সরকারের ট্যাক্স দিয়ে থাকে। সরকারের কর পরিশোধ করার পর শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বিলি বণ্টন করা হয়। তা হলে দেখা যায়, ব্যাংক ঋণ দিয়ে যত বেশি আদায় করতে পারবে, তত বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে। তত বেশি মুনাফা করতে পারবে। রিটেইন আর্নিং বাড়বে, বাড়বে মূলধন। ব্যাংকের ভিত্তি শক্তিশালী হবে। কিন্তু গত ডিসেম্বরের আগে বলা চলে কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়। যুক্তি দেখানো হয়েছিল, গত বছরের বিরোধী দলের আন্দোলনের কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ কারণে তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। ঋণখেলাপি হয়েছেন। এ জন্যই এ সুযোগ দেয়া হলো। সুযোগ কার্যকর ছিল গত ৩০ জুন পর্যন্ত। এ সুযোগ নিয়ে দীর্ঘ দিনের পুরনো খেলাপি ঋণও অনেকটা ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই নবায়ন করা হয়। এক হিসাবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয় কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে হলে, একটি নির্ধারিত পরিমাণ ডাউন পেমেন্ট অর্থাৎ আগাম খেলাপি ঋণের একটি অংশ পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নির্ধারিত সময়সীমা বেঁধে দিতে পারত; অর্থাৎ এক বছর বা ছয় মাসের মধ্যে যারা ঋণখেলাপি হয়েছেন, তাদের ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু নীতিমালা শিথিল করার সময় এ ধরনের কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। এর ফলে ঢালাওভাবে খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়। আর নবায়ন করার অনুমোদন দেয়া হয় যারা নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই বিভাগ থেকে। অথচ এত দিন বড় অঙ্কের ঋণ নবায়ন করার অনুমোদন দিত অন্য বিভাগ। ব্যাংকাররা আফসোস করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সার্কুলারে ব্যাংকের প্রকৃত আদায় কমে গেছে। আদায় বেড়েছে কাগজে-কলমে। এর ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণ কমেনি। অথচ এ সুযোগে একশ্রেণীর ব্যাংক খেলাপি ঋণ কম দেখিয়ে তাদের আয়কে স্ফীত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১০০ টাকা আয় করতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ৭৮ টাকা, যেখানে ২০০৯ সালে ছিল সাড়ে ৭২ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যয় সর্বাধিক হচ্ছে। সরকারি মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের গড় ব্যয় হচ্ছে ৮৪ টাকা ৭ পয়সা, আর বিশেষায়িত ব্যাংকের ব্যয় হচ্ছে ৯৫ টাকা। দেশীয় ব্যাংকগুলোর ব্যয় হচ্ছে ৭৮ টাকা। তবে বিদেশী ব্যাংকগুলোর ব্যয় ৫০ টাকা ৪০ পয়সা হওয়ায় সামগ্রিক গড় ব্যয় কমে নেমেছে ৭৮ টাকা। এমনি পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদেরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন আগামী দিনের ব্যাংক খাত নিয়ে। এ বিষয়ে ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আর এ জন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটানোর জন্য সরকারের সাথে বসা উচিত। আর টার্গেটেড ব্যাংকিং করতে হবে; অন্যথায় ব্যাংকের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। এসব কথা বলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় আমানতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব কী হবে ব্যাংকিং খাতেÑ এ প্রশ্নের জবাবে ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমানত হলো ব্যাংকের দায়। এ আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে গ্রাহককে সুদ পরিশোধ করতে হয়। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত নিয়ে তা বিনিয়োগ করতে না পারলে ব্যাংকের ব্যয় বেড়ে যাবে। কেননা আমানতকারীকে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে ঠিকই সুদ-আসলে পরিশোধ করতে হবে। অথচ ওই আমানত খাটাতে না পারলে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকঋণ দিতে পারছে না। বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। ফলে ব্যাংক তার তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে আমনত নিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে। তবে এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকের জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না। ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য কী করা উচিতÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংক ইচ্ছে করলেই ঋণপ্রবাহ বাড়াতে পারবে না। ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটাতে হবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটানোর জন্য সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত; গ্যাস, বিদ্যুৎ সঙ্কট কাটাতে হবে। সামগ্রিক অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে হবে। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটলেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাবে। এতে আপনা আপনিই ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ বেড়ে যাবে। সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমালে ব্যাংকের আমানতের পরিস্থিতি উন্নতি হবে কি নাÑ এ বিষয়ে ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে আমানতের সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ ও ১২ শতাংশ রয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমানতকারীরা বেশি মুনাফার আশায় ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমিয়ে দিলে আমানতকারীরা আবারো ব্যাংকের দিকে আসবে। তাতে কি সমস্যার মোকাবেলা হবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতে হয়তো ব্যাংকের আমানত বেড়ে যাবে, কিন্তু বিনিয়োগচাহিদা সৃষ্টি না হলে ব্যাংক আমানত নিতে পারবে না। তিনি বলেন, আমি তো আগেই বলেছি, আমানত হলো ব্যাংকের দায়। ঋণ দিতে না পারলে এ আমানত ব্যাংকের জন্য গলার কাঁটা হিসেবে দেখা দেয়। এ কারণে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমানত নিয়ে ব্যাংক তার দায় বাড়াবে না। সুতরাং সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে কোনো কাজে আসবে না। তিনি বলেন, সব কিছু নির্ভর করছে বিনিয়োগ পরিস্থিতির ওপর। ব্যাংকাররা বলছেন, সরকারের ঋণের জোগান দিতে গিয়ে ব্যাংকের আয় কমছে। অন্য দিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকাররা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এর ফলে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের আয় কমছে। এ বিষয়ে ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকারদের এ দাবি যুক্তিসঙ্গত। তারা ১০০ টাকা আমানত নিতে আমানতকারীদের যে পরিমাণ সুদ দেয়, সমপরিমাণ অর্থ সরকারের ঋণের জোগান দিলে তুলনামূলক কম সুদ পায়। এ জন্য তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমছে না। তবে এটাও ঠিক আমানতের সুদের হার কমালেও ঋণের সুদের হার কমাচ্ছে না। সরকারের কম সুদে ঋণের জোগান দিতে গিয়ে এটাও একটা কারণ হতে পারে। অন্য দিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ না করার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর খেলাপি ঋণের বিপরীতে ঋণ ভেদে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। তবে এ পরিস্থিতি কাটানোর জন্য ব্যাংকগুলো কম সুদে ঋণ দিলে বিনিয়োগকারীরা আবার বিনিয়োগে ফিরে আসতেও পারেন। তারা বিনিয়োগে ফিরে এলে ব্যাংকের অর্থ অলস পড়ে থাকবে না। এটা করে তারা দেখতে পারেন। বর্তমান পরিস্থিতি উন্নতির জন্য কী করা প্রয়োজনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের ব্যাংকের সংখ্যা বাড়লেও তাদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। তারা গতানুগতিক ব্যাংকিং করছে। আর মনোপলি করে নিজেরা বসে সুদের হার নির্ধারণ করছে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। টার্গেটেড ব্যাংকিং করতে হবে। অর্থাৎ ভালো গ্রাহক সন্ধান করে তাদের কম সুদে ঋণ দিতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটাতে ব্যাংকগুলো সরকারের সাথে বসতে পারে। কেননা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা না কাটলে সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নতি হবে না। আর বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নতি না হলে ঋণপ্রবাহ বাড়বে না। এটা ব্যাংকের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, বিনিয়োগ চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকের টাকার চাহিদা কমে গেছে। ব্যাংক ইচ্ছে করলেই ঋণপ্রবাহ বাড়াতে পারবে না। কেননা ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। তাদের বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা ভরসা না পাবেন ততক্ষণ তারা বিনিয়োগমুখী হবেন না। সুতরাং ব্যাংক ইচ্ছে করলেই ঋণপ্রবাহ বাড়াতে পারবে না। ড. আকবর আলি খান বলেন, ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ বাড়াতে হলে সামগ্রিকভাবেই বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়াতে হবে। যত দিন সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ চাহিদা সৃষ্টি হবে না, তত দিন ব্যাংকিং খাতের এ অবস্থাই চলতে থাকবে, যা ব্যাংকিং খাত কেন, কোনো খাতের জন্যই ভালো ফল বয়ে আনবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে সামনে ব্যাংকিং খাতে খারাপ দেখা দেবে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে এখন থেকেই প্রতিযোগিতামূলকভাবে নতুন নতুন প্রোডাক্ট আনতে হবে। সারভাইভ করার জন্য এখনই নানান পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় সামনে তাদের বড় ধরনের ধকল কাটানোর সক্ষমতা থাকবে না। সাবেক এ গভর্নর দেশের ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলা মেলা আলোচনা করেন। ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ার কারণ কীÑ এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ব্যাংকের আমানতের সুদ হার ও ঋণের সুদ হার কমা বা বৃদ্ধি নির্ভর করে মুদ্রাবাজারের চাহিদার ওপর। বাজারে ঋণের চাহিদা বেশি থাকলে ব্যাংকগুলোর টাকার প্রয়োজন হয়। আর এ প্রয়োজন মেটানোর জন্য বেশি হারে আমানত সংগ্রহ করে। সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে যখন একই অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন সবাই বেশি পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করতে আমানতের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, বর্তমানে বিনিয়োগ স্থবিরতা চলছে। নতুন নতুন বিনিয়োগকারী আসছে না। এর ফলে বাজারে টাকার চাহিদা তুলমানমূলক কমে গেছে। তিনি বলেন, প্রায় প্রতিটি ব্যাংকের হাতেই অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমিয়ে দিচ্ছে। আমানতের সুদের হার কমিয়ে দেয়ায় আমানত কমছে কি নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ গভর্নর বলেন, আমানতের সুদের হার কমিয়ে দেয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বেশি মুনাফার আশায় আমানতকারীরা অন্য জায়গায় যাবেন। আর এতে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ কমে যাবে। বর্তমান অবস্থা চললে সামনে ব্যাংকিং খাতে কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় বা আমানত কমে যাওয়ায় বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে আপাতত কোনো সমস্যা হবে না। কারণ প্রতিটি ব্যাংকের হাতেই এখন উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিন চললে ব্যাংকিং খাত সমস্যায় পড়ে যাবে। এজন্য এখন থেকেই ব্যাংকগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গতানুগতিক ব্যাংকিং খাত থেকে বের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিংয়ে ফিরে আসতে হবে। কেননা বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতামূলক কিছু নেই। এ কারণেই ব্যাংকগুলোকে নতুন নতুন প্রোডাক্ট আনতে হবে। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকগুলোর লোকসান বেড়ে যাবে। ছোটখাটো ব্যাংকগুলো বেশি বেকায়দায় পড়ে যাবে। ব্যয় কমানোর জন্য লোকবল ছাঁটাই করবে। ইতোমধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, সামনে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য খেলাপি ঋণ কমানো, নতুন করে খেলাপি না হয় সে দিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। সর্বোপরি ব্যাংকিং খাতের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালকদের ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমাতে হবে। তিনি দেশের বর্তমান ব্যাংকিং খাতের সমস্যা উত্তরণে ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ব্যাংকগুলোর আমানত কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ব্যাংকের লোকসান বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি ব্যাংকিং খাতের জন্য করণীয় কীÑ এ প্রশ্নের জবাবে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ কথা স্বীকার করতেই হবে দেশের ব্যাংকিং খাত চাপের মধ্যে রয়েছে। কেননা কয়েকটি সরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিকভাবে পরিচালক মনোনীত করায় ওইসব ব্যাংকে সুশাসনের অভাব দেখা দিয়েছে। সোনালী, বেসিকসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে অনৈতিকভাবে জনগণের আমানতের অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ ব্যাপক আকারে বেড়ে গেছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের হার বেড়ে গেছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। এসব হয়েছে মূলত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সুশাসনের অভাবের কারণে। এর বাইরে ব্যাংকগুলো যে হারে আমানত নিচ্ছে তুলনামূলক কম সুদে সরকারকে ঋণের জোগান দিতে হচ্ছে। অন্য দিকে ব্যাংকগুলোর বেতনভাতাসহ পরিচালন ব্যয় কমছে না। এতে ব্যাংকিং খাতের ব্যয়ের তুলনায় আয় কমে গেছে। এটা ব্যাংকিং খাতকে বাড়তি চাপে রেখেছে। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাত সামনে কী ধরনের সমস্যায় পড়বে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং খাত নিশ্চিত সমস্যায় পড়বে। ব্যাংকের লোকসান বেড়ে যাবে। বর্তমানে যে হারে লোকসান সমন্বয় করতে পারছে সামনে ওইভাবে পারবে না। অর্থাৎ লোকসান সমন্বয় করার সক্ষমতা কমে গিয়ে ব্যাংক অধিকতর সমস্যায় পড়বে। সমস্যা উত্তরণের উপায় কীÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, সামনে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ব্যাংকগুলোকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। পেছনে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ হয়েছে তা আদায় করার জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত; নতুন করে আর যেন খেলাপি না হয় সে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য দেখেশুনে ঋণ বিতরণ করতে হবে। ঋণ বিতরণের আগে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই করতে হবে। তৃতীয়ত; ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। পরিচালকেরা ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে যেন হস্তক্ষেপ না করে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সর্বোপরি দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চাঙ্গা হলে এমনিতেই ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা থাকবে না।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির