post

ব্ল্যাকহোল গবেষণায় নোবেল পেলেন পদার্থবিদ্যার তিন সারথি

গোলাপ মুনীর

০২ নভেম্বর ২০২০

আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি- ২০২০ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হয়েছেন পদার্থবিদ্যার তিন সারথি : রোজার পেনরোজ (Roger Penrose), আন্ড্রিয়া গেজ (Andrea Ghez) ও রাইনহার্ড গেনজেল Reinhard Genzel)। ‘রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স’ গত ৬ অক্টোবর তাদের এই সম্মানজনক পুরস্কার পাওয়ার কথা ঘোষণা করে। রোজার পেনরোজ কাজ করেন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্ডিয়া গেজ কাজ করেন লসঅ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর রাইনহার্ড গেনজেল কর্মরত আছেন জার্মানির গার্সিংয়ের ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব একস্ট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিক্স’-এ এবং একই সাথে বার্কেলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সন্দেহ নেই, এরা বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের এক রহস্যময় বিষয় নিয়ে গবেষণা করে এই বিরল পুরস্কার জিতে নেয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। আর সে বিষয়টি হচ্ছে ব্ল্যাকহোল। আমাদের ভাষায় এর নাম কৃষ্ণগহ্বর। এই তিন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ব্ল্যাকহাল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উদঘাটন করেছেন। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে সাধারণ পাঠকদের জন্য ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে একটি মোটামুটি ধারণা দেয়ার তাগিদ বোধ করছি। কারণ, আলোচনাটি সহজবোধ্য করার জন্য তা প্রয়োজন।

ব্ল্যাকহোল আসলে কী? ব্ল্যাকহোল সত্যিকার কোনো হোল বা গহ্বর নয়। এটি পুরোপুরি এর বিপরীত। আসলে ব্ল্যাকহোল মহাকাশের একটি স্থান। এগুলো মহাকাশের এমন স্থান, যেখান থেকে কোনো কিছুই ফিরে আসতে পারে না। গভীর অন্ধকারে ঢাকা সে স্থান। এই স্থানে অমিত পরিমাণ বস্তু একসাথে শক্তভাবে ঠাসাঠাসি অবস্থায় আছে। আবার এই স্থানের এ ধরনের বস্তু ধারণক্ষমতাও সীমাহীন। এটি সামনে যা-ই পায় তাই যেন গিলে খায়। এর গ্র্যাভিটি বা মধ্যাকর্ষণ ক্ষমতা প্রবল। ফলে এর সামনে পড়লে আর রক্ষা নেই। অর্থাৎ মধ্যাকর্ষণক্ষেত্রে মধ্যে চলে গেলে তা নিশ্চিত গিলে খাবে। এর এই প্রবল মধ্যাকর্ষণ বা টেনে ভেতরে নেয়ার হাত থেকে এমনকি আলোও রক্ষা পায় না। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে টেনে এনেছেন ইতালীয় কবি দান্তে অ্যালিগিয়েরির ডিভাইন কমেডিতে বর্ণিত দোজখের উদাহরণ। এই দোজখে প্রবেশ করার সময় সব আশা চিরতরে ছেড়ে দিতে হয়। কারণ এ থেকে বের হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্ল্যাকহোলও তেমনি এক স্থান। ব্ল্যাকহোল সামনে যা পায় তা নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে এগুলোকে মহাবিশ্বের এক বিশাল চরম গুরুভার (massive mass) বস্তুতে রূপান্তর করে, যা আর কখনোই ব্ল্যাকহোলের বাইরে আসতে পারে না। এই বস্তু শুধু বিশাল গুরুভারই নয়, এটি অতি ঘনও। মনে মনে নিউ ইয়র্ক নগরীর আকারের একটি ব্ল্যাকহোলের কথা ভাবুন। এই আকারের একটি ব্ল্যাকহোলের ভর (mass) ও আকর্ষণবল (gravity) হবে সূর্যের ভর ও আকর্ষণ বলের সমান। একটি তারকার জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে তারকাটি ধ্বংস হয়ে যায়, মরে যায়। জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার পর থেকে তারকাটি ক্রমেই সঙ্কোচিত হতে থাকে। সঙ্কোচিত হতে হতে চূড়ান্ত পর্যায়ে রূপ নেয় একটি কালো বিন্দুতে। এই কালো বিন্দুটি পরিচিত stellar-mass blackhole নামে এবং এভাবেই মৃত তারকা থেকে উৎপত্তি হয় একটি ব্ল্যাকহোল। এটি যে তারকা থেকে সৃষ্ট, তার চেয়ে আকারে অনেক ছোট হলেও এর ভর ও গ্র্যাভিটি ওই তারকার সমান। বড় আকারের কোনো একটি তারকা থেকে সৃষ্ট ব্ল্যাকহোল সূর্যের চেয়ে দশগুণ ম্যাসিভ বা গুরুভার হয়। মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথ নামের আমাদের গ্যালাক্সিতে এ ধরনের ১০ কোটির মতো ব্ল্যাকহোল রয়েছে। জ্যোতির্বিদদের ধারণা প্রতি সেকেন্ডে একটি করে নতুন ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হচ্ছে। তবে জেনে রাখতে হবে- ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের তারকা- যেমন সূর্য- কোনো ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি কতে পারে না। এসব তারকার জ্বালানি যখন ফুরিয়ে যায়, তখন এগুলো গ্রহের মতো ছোট আকার ধারণ করে। তখন এগুলোকে বলা হয় ফধিৎভ বা বামন তারকা। ‘স্টেলার-মাস ব্ল্যাকহোল’ খুবই সাধারণ ব্ল্যাকহোল। এগুলো তুলনামূলকভাবে আসলেই বামন বা খর্বাকৃতির। এর বিপরীতে রয়েছে বৃহদাকার ব্ল্যাকহোল। সেগুলোকে বলা হয় ‘সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল’ (supermassive blackhole)। এগুলোর ভর (Mass) লক্ষ লক্ষ, এমনকি শত শত কোটি তারকার ভরের সমান। আমাদের জানা এই মহাবিশ্বের মধ্যে এসব ব্ল্যাকহোল সবচেয়ে শক্তিধর বস্তু হিসেবে পরিচিত। একটি ব্ল্যাকহোলের গ্র্যাভিটি বা আকর্ষণশক্তি খুবই ব্যাপক। এই ব্ল্যাকহোল একসাথে গিলে খেয়ে ধারণ করতে পারে লক্ষ লক্ষ কিংবা শত শত কোটি তারকা, যেসব তারকা এক সাথে মিলে তৈরি করতে পারে একটি গ্যালাক্সি বা জ্যোতির্ময় নক্ষত্রপুঞ্জের বেষ্টনী, যাকে আমরা ছায়াপথও বলে থাকি। প্রকৃতপক্ষে Sagittarius A নামের একটি ‘ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল’ একসাথে ধারণ করে আমাদের পুরো গ্যালাক্সিটা। এটি আবিষ্কার করা হয় ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে। যেহেতু দৃশ্যমান আলো, অবলোহিত আলো, রঞ্জনরশ্মি, মাইক্রোওয়েভ বা অন্যান্য যে কোনো ধরনের বিকিরণ ইত্যাদিসহ কোনোকিছুই ব্ল্যাকহোলের গ্রাস থেকে পালাতে পারে না, তাই ব্ল্যাকহোল হচ্ছে অদৃশ্য বস্তু। তাই জ্যোতির্বিদেরকে এই ব্ল্যাকহোল পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে এর চারপাশে এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে। উদাহরণ টেনে বলা যায়, ব্ল্যাকহোল প্রায়শই সৃষ্টি করে এক ধরনের শক্তিশালী উজ্জ্বল গ্যাসীয় ও বিকিরণের ফোয়ারা জেট, যা টেলিক্সোপের সাহায্যে দেখা যায়। পদার্থবিদরাও এই জেটের আকার ব্যবহার করে এই জেট সৃষ্টিকারী ব্ল্যাকহোলের আকার নির্ণয় করতে পারেন।

ব্ল্যাকহোল ও এবারের নোবেল পুরস্কার গবেষকরদের গবেষণা থেকেই উদঘাটিত হয়েছে বিশ্বজগতের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু ব্ল্যাকহোল। এখন বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে এগুলোর অস্তিত্ব সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হাজির করেছেন। আর এজন্যই ২০২০ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন এই তিন বিজ্ঞানী। আগেই জেনেছি- ব্ল্যাকহোলগুলো হচ্ছে ম্যাসিভ অবজেক্ট বা গুরুভার বস্তু। এর গ্রাস থেকে কিছুই রক্ষা পায় না, এমনকি এগুলো আলো পর্যন্ত গ্রাস করে। এগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে হতবুদ্ধি সৃষ্টিকর একটি এলাকা। এর নাম সিঙ্গুলারিটি, যার অর্থ অনন্য। এর ব্যাপারে পদার্থবিদ্যার সূত্র প্রয়োগ করতেও থামতে হয়। এই অদ্ভুত বিস্ময়কর ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার ব্যাপারে পদার্থবিদ্যার এই তিন সারথি আমাদের সহায়তা করতে সক্ষম হয়েছেন। আর সেজন্যই তারকা যৌথভাবে নোবেল বিজয়ের গৌরব অর্জন করেছেন। এবার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর আন্ড্রিয়া গেজ বলেছেন- এই বিস্ময়কর ব্ল্যাকহোলের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমাদের জানা পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো যেন কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এর ব্যাখ্যায় আমাদের পদার্থবিদ্যার জ্ঞানকে আরো সম্প্রসারিত করতে হবে। ভৌতদুনিয়াকে আরো গভীরভাবে বুঝতে হবে। যখন ব্ল্যাকহোলের বিষয়টি প্রথম প্রস্তাব করা হয়, তখন বিজ্ঞানীরা এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। আন্দাজ-অনুমান করেছিলেন মাত্র। তখন এটি মৃত তারকা নামেই পরিচিত ছিল। পরে ১৯৬৭ সালে বিজ্ঞানী জন হুইলার এর নাম দেন ব্ল্যাকহোল। বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্ল্যাকসম্পর্কিত ধারণাটি এসেছিল আইস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব থেকে। আইনস্ট্ইানের মৃত্যুর ১০ বছর পর রোজার পেনরোজ ১৯৬৫ সালে গাণিতিক হিসাব-নিকাশ কনে দেখান- ব্ল্যাকহোল ভৌতভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে। তার এই অবদানের জন্য এখন এবারের পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কার অর্ধেক অর্থ, অর্থাৎ ১ কোটি ডলারের অর্ধেক তিনি পাবেন। পুরস্কারের বাকি অর্ধেক অর্থ যৌথভাবে পাবেন রাইনহার্ড গেনজেল ও আন্ড্রিয়া গেজ। তারকা দেখিয়েছেন ব্ল্যাকহোল নামের এই নিকষ কালো বস্তু ওত পেতে থাকে গ্যালাক্সি তথা ছায়াপথের কেন্দ্রে।

ব্ল্যাকহোল আর অদ্ভুত ধারণা নয় এবারের পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান ড্যাভিড হেভিল্যান্ড পুরস্কার ঘোষণার সময় বলেছেন: ‘বহু বছর ধরে পদার্থবিদেরা ব্ল্যাকহোল ধারণা নিয়ে নানা অজানা প্রশ্নের মুখোমখি হয়েছেন। এখন আমরা উদযাপন করছি মহাবিশ্বের এই অদ্ভুত বস্তু সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের বিষয়।’ পেনরোজ আবিষ্কার করেছেন এমন এক কৌশল, যা দূর করবে ব্ল্যাকহোল সম্পর্কিত অনেক জটিলতা। তার গবেষণাসূত্রে উদঘাটিত হয়েছে- আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রস্তাব ব্ল্যাকসম্পর্কিত একটি গাণিতিক ধারণামাত্র নয়। পেনরোজের গাণিতিক হিসাব দেখিয়েছেন- এরা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে ব্ল্যাকহোল অস্তি¡ত্বশীল হওয়া সম্ভব। ১৯৬৫ সালে তিনি ‘ফিজিক্স রিভিউ লেটার্স’-এর একটি যুগান্তকারী প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এতে তিনি বর্ণনা করেন কী করে পদার্থ ধ্বংস হয়ে একটি ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি করতে পারে। এবং তিনি আরো জানান এর একটি সিঙ্গুলারিটি থাকতে পারে এর কেন্দ্রে। ব্ল্যাকহোলসম্পর্কিত কিছু ধারণা পেনরোজের মধ্যে আসে, যখন তিনি বনের মধ্যে হেঁটে যেতেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি যখন বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতাম তখন ব্ল্যাকহোল সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন আমার মধ্যে জাগতো। আমি ভাবতাম, যদি আপনার-আমার চারপাশের সবকিছু হঠাৎ করে নাই হয়ে যেত, ধ্বংস হয়ে যেত, তখন পরিস্থিতিটা কেমন দাঁড়াতো?’ ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে গেজ ও গেনজেল আলাদা আলাদা দুটি টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এসব টিম টেলিস্কোপ ব্যবহার করছিল ছায়াপথের কেন্দ্র পরিদর্শনের জন্য। তাঁরা সেইসব তারকা কক্ষপথ পরিমাপ করছিলেন, যেগুলো গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে সবেগে ঘুরছিল। দুটি টিমই দেখলো- এসব তারকা চলে এতটাই দ্রুত যে, শুধূ অবিশ্বাস্য ধরনের ঘনবিন্যস্ত (কম্প্যাক্ট) ও গুরুভার (ম্যাসিভ) বস্তু, যেমন বড় আকারের ব্ল্যাকহোলই পারে এগুলোর বঙ্কিম ক্ষেপণ পথের (ট্র্যাজেকটরি) ব্যাখ্যা দিতে। তাদের এই গবেষণাকর্ম তখন থেকে কয়েক দশক ধরে চলতে থাকে। আর এই গবেষণাই শেষ পর্যন্ত ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। একই সাথে তা সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। ছায়াপথের কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোলকে ঝধমরঃঃধৎরঁং অ* বলা হয়। এর ভর সূর্যের ভরের ৪০ লাখ গুণ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বেশির ভাগ বড় বড় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এ ধরনের ব্ল্যাকহোল রয়েছে। গেজ হচ্ছেন চতুর্থ মহিলা, যিনি পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির