অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ। মহানবী সা. মদিনায় যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন কালক্রমে তা একটি সুদমুক্ত সমাজ সৃজন করেছিল, যেখানে ছিল না শোষণ-বৈষম্য, জুলুম-নিপীড়ন, বঞ্চনা ও অকল্যাণ। ইসলাম-পূর্ব আরবের অর্থনীতি ছিল খুবই মন্দা, অভাব-অনটন ক্ষুধার যন্ত্রণা ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। যৎসামান্য কিছু শিল্পকর্ম ছাড়া শিল্পের তেমন প্রসার ছিল না। ছিল না পরিকল্পিত কোনো অর্থব্যবস্থা। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একটি রাষ্ট্রের স্থায়ী ও সমৃদ্ধির বুনিয়াদ, তাই এক্ষেত্রেও রাসূল সা. অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ফলে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে মহানবীর সা. আরব ভূমিতে আর্থিক সমৃদ্ধির মডেল মদিনা রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন এবং দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। একটি দেশের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর। নি¤েœ মহানবী সা. প্রদত্ত সার্বজনীন অর্থব্যবস্থা আলোচনা করা হলো :
১. বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা : ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামী শরিয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত আধুনিককালের ন্যায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো ব্যাংকের অস্তিত্ব ছিল না বটে, কিন্তু মুসলমানগণ ইসলামী পদ্ধতিতে নিজস্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। আল্লাহর রাসূল সা. মদিনা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় আর্থিক লেনদেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা করেন। অতীত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক বিশ্বে ইসলামী অর্থ (ব্যাংক) ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
২. জাকাতব্যবস্থা : ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালের আয়ের অন্যতম উৎস হলো জাকাত। অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে সমাজে জাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জাকাতের অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্য হলো দারিদ্রদূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকারত্ব দূর করা এবং সর্বোপরি অভাব থেকে মুক্তি লাভ করা।
৩. ওশর : আল্লাহর দেওয়া প্রাকৃতিক পানি দিয়ে জমি আবাদ করে ফসল উৎপাদন করলে ফসলের এক-দশমাংশ, আর কৃত্রিমভাবে পানি দিয়ে আবাদ করলে তার ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ দান করাকে ওশর বলে।
৪. খারাজ : খারাজ অর্থ ভূমি কর। রাষ্ট্রকর্তৃক ধার্যকৃত ভূমি রাজস্বকে খারাজ বলা হয় ।
৫. জিজিয়া : জিজিয়া অর্থ বিনিময়, ইসলামী রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসরত প্রাপ্তবয়স্ক স্বাধীন কর্মক্ষম অমুসলিম পুরুষদের থেকে ধার্যকৃত বার্ষিক কর।
৬. গনিমত ও ফাই : ইসলামী রাষ্ট্রের দুটি অন্যতম উৎস হচ্ছে গনিমত ও ফাই। কাফিরদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হলে তাদের পরিত্যক্ত যাবতীয় ধন-সম্পদ বিজয়ী ইসলামী রাষ্ট্রের এক বৈধ আয় বিশেষ ।
৭. উদ্যোক্তা তৈরি করা : নবী করীম সা. ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করে অর্থ উপার্জন ও উৎপাদনের জন্য উদ্যোক্তা তৈরি করতেন। আনাস রাদিয়াল্লাহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন একদা একজন আনসার সাহাবি মহানবী সা.-এর নিকট এসে কিছু সাহায্য চাইলেন, কিন্তু মহানবী সা. নিজের থেকেও কিছু দেওয়ার চেষ্টা করলেন না এবং অন্য কারো নিকটও তার জন্য সাহায্য চাইলেন না, বরং দরিদ্র সাহাবিকে বললেন তোমার ঘরে কি কিছু আছে? উত্তরে সাহাবি বললেন হ্যাঁ একখানা কম্বল আছে আরেকটি পেয়ালা আছে যা দ্বারা পানি পান করি। তখন মহানবী সা. তাকে হুকুম দিলেন যাও কম্বল ও পেয়ালা দুটি নিয়ে এসো। মহানবী দুই দিরহামে জিনিস বিক্রি করে দিরহাম দুইটি আনসারি সাহাবির হাতে দিলেন এবং বললেন এক দিরহাম দিয়ে খাদ্য ক্রয় করে তোমার পরিবারকে দাও আর এক দিরহাম দিয়ে কুড়াল কিনে আমার নিকট নিয়ে এসো। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে সে কুড়ালে কাঠের বাঁট লাগিয়ে সাহাবির হাতে দিয়ে তাগিদ করে বললেন যাও পাহাড়ে বা জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে আনো এবং বিক্রি করে তোমার সংসার পরিচালনা করো। মহানবীর সা.-এর পরামর্শ অনুযায়ী সাহাবির অভাব দূর হলো এবং পর্যায়ক্রমে সে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে সর্বমহলে আর্থিক ব্যবস্থাকে বিকশিত করলো।
৮. ব্যবসা-বাণিজ্য : ব্যবসায়ীদের মর্যাদা অত্যন্ত উপরে। মহানবী সা. বলেন রিজিকের ১০ ভাগের ৯ ভাগই ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে। মহানবী ও সাহাবীগণ ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন এবং তাঁরা ছিলেন বংশ পরস্পরায় ব্যবসায়ী। মহানবী সা. সত্যবাদী ব্যবসায়ীদের আল্লাহর বন্ধু ঘোষণা করেন এবং কেয়ামতের দিন তারা আল্লাহর আরশের নিচে থাকবে। ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নতির একমাত্র পথ। আল্লাহর নিয়ামত অনুগ্রহ রিজিকের একমাত্র উপায়। তাই মহানবী ক্রয়-বিক্রয় ব্যবসা-বাণিজ্যে উৎসাহ প্রদান করেছেন।
৯. কাফফারা : কোনো অবাঞ্ছিত কাজ বা পাপকর্ম হয়ে গেলে সে পাপ স্খলনের জন্য যে কাজ করতে হয় তাকে কাফফারা বলে। পাপ ও দারিদ্র্যের মধ্যে কোনো প্রকার সম্পর্ক না গড়েও কেউ পাপ করলে বাধ্যতামূলকভাবে দারিদ্র্যের দান করার জন্য মহানবী সা. নির্দেশ দিয়েছেন।
১০. ফিদিয়া: যেসব লোক অতিরিক্ত বার্ধক্যজনিত কারণে রোজা রাখতে অপারগ কিংবা দীর্ঘকাল রোগভোগের দরুন দুর্বল হয়ে পড়েছে অথবা রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য উদ্ধারের ব্যাপারে একেবারে নিরাশ হয়ে পড়েছে, সে সব লোকদের বেলায়ও রোজা না রেখে রোজার ফিদিয়া (অর্থ) দেওয়ার সুযোগ রয়েছে ।
১১. মোহর : বিবাহের জন্য স্বামী স্ত্রীকে যে অর্থ দান করে তাকে মাহর বলে। এটা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেওয়া সম্মামনা। ইসলামী শরিয়া মোতাবেক স্ত্রীকে এ সম্পদ দান করা বাধ্যতামূলক এবং স্ত্রীর অর্থনৈতিক অধিকার।
১২. সাদাকাতুল ফিতর : পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতরের দিন বিত্তশালীদের ওপর গরিব-দুঃখীদের জন্য নির্দিষ্ট হারে যে বিশেষ দানের নির্দেশ রয়েছে তাকে সাদাকাতুল ফিতর বলে। মহানবী সা. বলেন সাদাকাতুল ফিতর আদায় না করা পর্যন্ত রোজাদার ব্যক্তির রোজা আসমান ও জমিনের মাঝখানে ঝুলন্ত অবস্থা বিরাজ করে, আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না। সাদাকাতুল ফিতর ব্যক্তিগত দান হলেও মহানবী সা. মদীনা রাষ্ট্রে তা আদায় করে দরিদ্র গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৩. নাফাকাত : নাফাকাত স্বামীর ওপর স্ত্রীর জন্য আহার্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, আবাস, সন্তান লালন-পালন, পরিচর্চা ইত্যাদির নিমিত্তে যে অর্থ ইসলামের বিধান মোতাবেক বর্তায়, তাকে শরিয়তের পরিভাষায় নাফাকাত বলে।
১৪. উদহিয়া : উদহিয়া হচ্ছে কুরবানি। কুরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা স্বীকার। মানুষ যে যাবতীয় ধন-সম্পদ ও নিয়ামতের জন্য আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ, কুরবানি করে সে তাঁরই হুকুম পালান করে। কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে বিক্রীত অর্থ গরিব, দুঃখী, অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টিত হয়। ইয়াতিম-অসহায়দের দান করা হয় এবং গরিবদের শিক্ষা, চিকিৎসা, পুনর্বাসনের জন্য ব্যয় করা হয়। কুরবানিকে কেন্দ্র করে মুসলিম দুনিয়ায় ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়। একদিকে গরু লালন-পালন, গরুর খাদ্য, গরুর চিকিৎসা ও ঔষধের ব্যবসা, গরু বাজারজাতকরণ, গরুর হাটের ইরজা, গরুর পরিবহন ব্যবসা, চামড়ার ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা হয়।
১৫. আকিকা : সন্তান জন্মের পর সন্তানের জন্য কল্যাণ কামনায় হালাল গৃহ পালিত পশু জবাই করাকে আকিকা বলে। এই গোশত অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করা যায় এবং পশুর চামড়া বিক্রয় করে তাদেরকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা যায়।
১৬. নজর : এর অর্থ নজরানা, মানত ইত্যাদি। কোনো মনোবাসনা পূরণের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে মানত করতে হয়। মানতের পরে মনোবাসনা পূর্ণ হলে ওই মানত আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়। মানতের মাধ্যমে গরিবরা আর্থিকভাবে উপকৃত হয়।
১৭. সাদাকাতে নাফেলা : যদি কোনো ধনসম্পদ বিনা প্রতিদানে কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য কাউকে প্রদান করা হয় তাকে সাদাকাতে নাফেলা বলে। মহানবী সা: বলেছেন তোমার কাছে থাকা একটি খেজুরের একাংশ হলেও তা দান করো। তবে যারা আসলে অভাবী নয় এবং যারা স্বাস্থ্যবান ও শারীরিক দিক থেকে সক্ষম তাদের দান করতে মহানবী অবৈধ ঘোষণা করেছেন।
১৮. হিবা : যদি কোনো সম্পত্তি কোনো প্রতিষ্ঠান গ্রহণ ব্যতিরেকে সাথে সাথে গ্রহীতাকে স্থানান্তর করা হয় তাহলে তাকে হিবা বলে। হিবা দান জনকল্যাণ ও দারিদ্র্যবিমোচনের অন্যতম একটি ভালো উপায়। মহানবী সা. হিবার মাধ্যমে দান করা বৈধ বলে তা করতে উৎসাহিত করেছেন।
১৯. ওয়াকফ : সদকায়ে জারিয়ার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রধান হচ্ছে ওয়াকফ। ওয়াকফ হলো এমন একটি কাজ যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি এমন কোনো সম্পদ ব্যবহার এবং হস্তান্তর থেকে বিরত থাকে যার দ্বারা যে কোনো ব্যক্তি লাভবান হতে পারে অথবা যতদিন টিকে থাকে ততদিনে সম্পদ অন্যের উপকারে ব্যবহৃত হতে পারে। রাসূল সা. ব্যাপকভাবে এর প্রচার করতে উৎসাহিত করেছেন।
২০. ওয়াসিয়াত : মৃত্যুর সময় সমাজকল্যাণমূলক কাজে বা দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে সাধারণভাবে স্বীয় সম্পদের একাংশ বা সব দান করে যাবার নাম ওয়াসিয়াত। এটি এমন একটি আমল যাদ্ধারা বিত্তবানরা জীবনের শেষ মুহূর্তে সৎকাজ হিসেবে দরিদ্রকে আর্থিক উপকার করতে পারে।
২১. জারাইর: জারাইর হলো দরকার মতন দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তকে সাহায্য করা। মহানবী সা. এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং সকলকে উৎসাহিত করেছেন।
২২. মিনাহ : দারিদ্র্য দূরকরণের গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি মেকানিজম হচ্ছে মিনাহ। এ মেকানিজমে উৎপাদনমুখী কোনো সম্পদ অভাবী দরিদ্রকে কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রতিদান ছাড়া প্রদান করা হয়। মহানবী সা.-এর শুভ সূচনা করেন। মদিনার সাহাবারা মক্কা থেকে হিজরতরত মুহাজিদেরকে এই পদ্ধতিতে সহায়তা করেছিলেন। মহানবী সা. হাদিস থেকে ভারবাহী পশু, কৃষি জমি, ফলের বাগান, দুদেল গাভী- এই ধরনের মিনাহ এর কথা জানা যায় ।
২৩. ইসরাফ : ইসরাফ হলো অপচয়, অপরিমিত ব্যয়, বাহুল্যজনিত ব্যয়, অতিরিক্ত পানাহার করা, বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছু ব্যয় করা, নষ্ট করা। ইসরাফ হলো হালাল খাতে এমন ব্যয় যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় ইসরাফ হলো সীমা অতিক্রম করা, সীমা লঙ্ঘন করা বা অপচয় করা।
২৪. তাবজির : হালাল সম্পদ হারাম কাজে ব্যয় করা। অশ্লীল কাজে ব্যয় করা, ইসলামের ক্ষতিসাধন করা অর্থাৎ কোনো বস্তুকে তার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে ব্যয় না করে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করলে, হারাম খাতে ব্যয় করলে, অপব্যবহার করলে সেটাকে বলা হয় তাবজির।
২৫. বুখল : সম্পদ ব্যয় ও ব্যবহার না করা। প্রয়োজনের ক্ষেত্রে মোটেই ব্যয় না করা, প্রয়োজন অনুপাতে ব্যয় না কওে বরং কম করা; এটাকে বুখল বলা হয়। ইসলামী জীবনবিধানে কৃপণতার কোনো স্থান নেই। ইসলামী অর্থনীতিতে বুখল নীতিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অতিরিক্ত খরচ যেমন পছন্দনীয় নয় তেমনি কৃপণতাও গ্রহণযোগ্য নয়।
২৬. কর্জে হাসানা : ধার-কর্জ করেও অর্থের মালিক হওয়া যায় এবং এটি মানুষের জন্য অপরিহার্য ব্যাপার। মহানবী সা. সর্বপ্রথম বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার রীতি চালু করেন। হাদিসে বলা হয়েছে সুদমুক্ত অর্থনীতি বাস্তবায়নে এটি একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
২৭. দান-দক্ষিণা : এ জাতীয় সম্পদের মালিক হওয়া যায় নিজস্ব পারিবারিক খরচ মিটিয়ে এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ এর পরও যদি উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে তবে তা থেকে দান করা উত্তম। মহানবী সা. বলেন যে ব্যক্তি অপরকে দয়া করে না আল্লাহ তাকে দয়া করেন না।
২৮. সুদ প্রথার বিলুপ্তি : ইসলামী অর্থব্যবস্থা সুদের লেনদেন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। সুদকে বলা হয় শোষণের অন্যতম হাতিয়ার। বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ভিত্তি সুদের ওপর হওয়ার প্রেক্ষিতে সামাজিক জীবনে শোষণের বিস্তৃতি ঘটেছে। বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। এ জন্য ইসলাম সুদকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করেছে।
২৯. অপব্যয় নিষিদ্ধকরণ : সম্পদ ব্যয় করার ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। বিলাসিতার কাজে সম্পদ ব্যয় করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছেন। আল-কুরআনে বলা হয়েছে অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।
৩০. সম্পদের সুষম বণ্টন : ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের ব্যবস্থা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয় ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মূলনীতি সুনিশ্চিত করা, যেন রাষ্ট্রের কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত না হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ জনপদবাসীর কাছে থেকে তাঁর রাসূলকে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, আল্লাহর রাসূলে, রাসূলের স্বজনদের, এতিমদের, অভাবগ্রস্ত ও পথচারীদের মধ্যে যারা বিত্তবান তাদের মধ্যে আবর্তন না করে’ (সূরা হাশর আয়াত : ৭)।
৩১. কালালা : কালালা হচ্ছে সে ব্যক্তি যার কোনো সন্তান নেই এবং বাপ-দাদাও জীবিত নেই। অন্য মতে কালালা হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেছে। ফিকাহবিদগণ এ ব্যাপারে আবু বকর রাদিয়াল্লাহুকে সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে কালালা হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার কোনো সন্তান নেই এবং বাপ-দাদাও জীবিত নেই। কুরআন হতে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়। কেননা কুরআনে কালালা বোনকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির অধিকারী করানো হয়েছে অথচ কারো পিতা জীবিত থাকলে কোনো কিছুই পায় না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে- ‘লোকেরা তোমার নিকট কালালা বিষয়ে পরিষ্কারভাবে জানতে চায়। আল্লাহ তাদেরকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন কোনো ব্যক্তির যদি সন্তান মরে যায় এবং তার একজন বোন থাকে তবে সেই বোন তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির ২/১ ভাগ পাবে এবং বোন যদি সন্তানহীন অবস্থায় মারা যায় তবে তার ভাই তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে। মৃতের উত্তরাধিকারী যদি দুই বোন হয় তবে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তি দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। আর যদি ভাই বোন হয়, তবে পুরুষের অংশ নারীর দ্বিগুণ হবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য আইন-কানুন সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন তোমরা পথ ভ্রষ্ট হবে এ আশঙ্কায়। আল্লাহ সবকিছু অবহিত’ (সূরা আন নিসা : ১৭৬)। এ আয়াতটি সূরা নিসার অন্যান্য আয়াত নাজিলের বহু পরে নাজিল হয়েছে। সূরা নিসা পূর্ব হতেই একটি সম্পূর্ণ সূরা হিসেবে নাজিল হয়ে আসছিল। এ কারণে সূরার শুরুতে মিরাস সংক্রান্ত আয়াতসমূহের ধারাবাহিকের সঙ্গে এ আয়াতকে শামিল করা হয়নি বরং পরিশিষ্ট হিসেবে রাখা হয়েছে।
৩২. ভূমিনীতি : হিজরতের পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে মদিনা এবং আশপাশের সমস্ত ভূমি রাসূলুল্লাহ সা. এর দখলে চলে আসে। যে সমস্ত ভূমি দখলে এসেছিল সেগুলো মহানবী সা. মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দেন এবং যেগুলো যুদ্ধ ছাড়াই অধিকৃত হয়েছিল সেগুলো শুধুমাত্র রাষ্ট্রের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। রাসূলুল্লাহ সা: নিজ অধিকারবলে মুহাজিরদেরকে ভূমি দান করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তাআলা বলেন, মহানবী সা. যখন মদিনায় আগমন করেন তখন তিনি সেখানকার সমস্ত জমি এবং যে সমস্ত পতিত জমি পড়ে থাকতো সেগুলো নির্যাতিত মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দেন।
৩৩. দিয়াত : ইসলামে নিহতের উত্তরাধিকারীকে যে অর্থ প্রদান করা হয় তাই দিয়াত। দিয়াত অর্থ রক্তপণ, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি। আল-কুরআনের সূরা নিসার ৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কোনো মুমিনকে হত্যা করা অন্য মুমিনের কাজ নয় তবে ভুলবশত করলে তা স্বতন্ত্র। কেউ ভুলবশত হত্যা করলে একজন মুমিন দাস মুক্ত করা এবং নিহতের পরিবারবর্গকে দিয়াত দিতে হবে, যদি না তারা ক্ষমা করে।’ এ পদ্ধতির কার্যকারিতার ক্ষেত্রে দিয়াত পরিশোধের দায়িত্ব হত্যাকারীর নিকট আত্মীয়-স্বজনদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। আত্মীয়-স্বজননের পরিশোধের দায়িত্ব পালন করার পেছনে যুক্তি রয়েছে, তা হচ্ছে হত্যাকারীর উপরে এককভাবে এ অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব না-ও হতে পারে এবং সে দেউলিয়াও হয়ে যেতে পারে। যাতে ক্ষতিপূরণের অর্থ অপরিশোধিত থেকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সাহায্যের ভাবধারাকে সম্মত রাখার দৃষ্টিভঙ্গিও এতে রয়েছে। মহানবী ইসলামের সূচনায় ইসলামী সমাজের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ বিধান কার্যকরভাবে চালু করে আধুনিক বীমা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
৩৪. দারাইব : যুদ্ধাবস্থা, দুর্ভিক্ষ অবস্থা, জনকল্যাণ এবং জনগণের বেকারত্ব দূর করার জন্য জাকাত-সাদাকাত ছাড়াও যে কর সরকারের তরফ হতে বিত্তবানদের ওপর আরোপ করা হয় তাকে দারাইব বলা হয়।
৩৫. আশুর : ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে পণ্যের ওপর নির্ধারিত হারে কাস্টমস শুল্ক আদাযয়ের পদ্ধতিকে আশুর বলা হয়। এ শুল্ক আদায়ের পরিমাণ হলো মুসলিমদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ৪০ ভাগের এক ভাগ জিম্মিদের ২০ ভাগের এক ভাগ এবং রাষ্ট্রের ব্যবসায়িক পণ্যের ১০ ভাগের ১ ভাগ।
৩৬. আরিয়াত: অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আরিয়াতের উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। কোনো ব্যক্তি তার নিজের মালিকানাধীন বস্তু উপকার ও কল্যাণ বিবেচনায় বিনা প্রতিদানে অন্যের অধিকারে দিয়ে দেওয়াকে ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে আরিয়াত বলা হয়।
৩৭. আল ফারায়েজ : ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে সম্পদ বণ্টনের যে পদ্ধতি রয়েছে তা অত্যন্ত ন্যায়ানুগ ও সুবিন্যস্ত। এই পদ্ধতি সুষ্ঠুভাবে পালন করা হলে এবং সমাজে এর প্রচন হলে পুঁজিবাদ সুলভ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার কোনই সম্ভাবনা থাকবে না। ফলে সমাজে একদিকে জমিদারি, জায়গিরদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটবে অপরদিকে মানুষের দুঃখ-দরিদ্রতা বৃদ্ধি পাবে না। কেননা ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে সম্পদেও উপকরণ সবসময় ঘুরতে থাকে। এক হাত থেকে বেরিয়ে অপর হাতে ঘোরার দরুন কমবেশি সবাই উপকৃত হতে থাকে। ইসলাম উত্তরাধিকার আইনের মাধ্যমে সম্পদ বণ্টনের পথ উন্মুক্ত করেছে। এই সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘তাতে (সম্পদে) পুরুষদের জন্য ন্যায্য অংশ রয়েছে যা তার মা-বাবা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় রেখে গেছে এবং মেয়েদের জন্য তাদের সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে যা তাদের মা-বাবা ও নিকট আত্মীয় রেখে গেছে। কম-বেশি যাই হোক না কেন তাতে অংশ নির্দিষ্ট করা হয়েছে।’ (সূরা নিসা আয়াত : ৭)।
পরিশেষে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মাত্র ১০ বছরে মহানবী সা. রাষ্ট্রের অর্থনীতির যে বিকাশ ও উন্নয়ন ঘটাতে শুরু করেছিল তা সমকালীন বিশ্বের বিস্ময়। এর পর হাজার বছর ধরে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা দাপটের সাথেই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাঁর ঘোষিত কর্মসূচির বদৌলতেই সুদূর স্পেন থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল মুসলিম বিশ্বে শোষণমুক্ত কল্যাণমুখী নতুন অর্থনীতি গড়ে ওঠেছিল। অর্থনীতির জটিল আবর্তে পর্যুদস্ত মানবজাতির আজাদি এনেছিলেন ইসলাম ও মহানবী সা.। কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী অর্থনীতির শোষণ ও তার প্রভাব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভয়ঙ্কর। যে অর্থনীতির কারণে মানবসমাজ আজ তার প্রাথমিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সমস্যায় জর্জরিত। আধুনিক অর্থনীতিবিদরা তাদের সীমিত চিন্তাভাবনা দিয়ে সমস্যা সমাধানের নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু মানবরচিত কোনো অর্থব্যবস্থা মানবতার এই করুণ আর্তনাদ শুনতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী সা. নির্দেশিত অর্থব্যবস্থা এনে দিতে পারে মানবতার মুক্তি ও কল্যাণ এবং গড়ে তুলতে পারে সমৃদ্ধশালী একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা।
লেখক : ইসলামী ব্যাংকার
আপনার মন্তব্য লিখুন