post

মহামারী ও পরিচ্ছন্নতা

এম মুহাম্মদ আব্দুল গাফফার

১৪ মে ২০২১

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও পূত-পবিত্র জীবন হলো ইসলামী সংস্কৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর মিশনকে বিশ্বে বাস্তবায়নের জন্য আম্বিয়ায়ে কেরামের ওপর যে দায়িত্ব দান করেন তাঁদের পূর্বপ্রস্তুতির বিষয়সমূহের মধ্যে পবিত্রতা তথা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ওপর তাগিদ প্রদানও অন্যতম। মহানবী সা.-এর ওপর পবিত্র কুরআনুল কারীমের যে সূরাসমূহ প্রাথমিক পর্যায়ে নাজিল হয়েছে সেগুলোর মধ্যে এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব সহকারে আলোকপাত করা হয়েছে। এ মর্মে বিশ^নবীর সা. উদ্দেশ্যে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন- ‘আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর, আর নিজের কাপড় পবিত্র রাখ, আর মলিনতা পূতিগন্ধময়তা হতে দূরে থাকো।’ (সূরা মুদ্দাসসির : ৩-৫)। এতে বুঝা যায় যে, মানুষের আত্মিক, নৈতিক ও আদর্শিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাই শুধু আল্লাহর রাসূলের সা. দায়িত্ব ছিল না, শারীরিক, সামাজিক ও পরিবেশগত নোংরামি থেকে বিশ^বাসীকে মুক্ত করে সুস্থ সুন্দর আবর্জনামুক্ত স্বচ্ছ মানবসমাজ গঠনের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। মহানবী সা. যথার্থই বলেছেন ‘আততুহুরু শাতরুল ঈমান’ অর্থাৎ পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ।

অপরিচ্ছন্নতা তথা অপরিষ্কার কোনোকিছুই মহানবীর সা. নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না। পাক পবিত্রতাকে আল্লাহর রাসূল সা. সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। শরীর নাপাক না থাকলেও ইবাদতের ক্ষেত্রে গোসল করে পরিষ্কার হবার প্রতি তিনি তাগিদ দিয়েছেন। মহানবী সা. প্রতি শুক্রবার জুমআর সালাতের পূর্বে গোসলের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন। এ মর্মে এভাবে হাদীস এসেছে- ‘আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন, প্রত্যেক বয়স্কের জন্যই জুমআর দিনের গোসল ওয়াজিব।’ (সহীহ বুখারী-৮৪৪)। পরবর্তী হাদীসটির অংশ বিশেষ এ রকম ‘রাসূল সা. বললেন প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আল্লাহর এ হক রয়েছে যে, প্রতি সাত দিনের মধ্যে একদিন সে গোসল করবে, তার মাথা ও শরীর ধুয়ে ফেলবে।’ (সহীহ বুখারী-৮৪৫ নং হাদীসের শেষাংশ)।

মানুষের ডান হাতটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানাহার ছাড়াও মুখ, নাক, চোখ ইত্যাদি চুলকানোর সময় সাধারণত ডান হাতই ব্যবহার হয়ে থাকে, এজন্য মহানবী সা. এ হাত দ্বারা নাপাকি বা ময়লা স্পর্শ করতে নিষেধ করেছেন। এ মর্মে একটা হাদীস এভাবে এসেছে ‘হযরত আবু কাতাদা রা. রাসূল সা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তোমাদের কেউ যখন পেশাব করে তখন সে যেন ডান হাত দ্বারা তার লজ্জাস্থান স্পর্শ না করে এবং ডান হাত দ্বারা শৌচক্রিয়া না করে...।’ (বুখারী, মুসলিম)। এ হাদীসের ভাষ্যে যে বিষয়ের প্রতি ইশারা রয়েছে তা হলো সর্বাবস্থায় পবিত্রতা বজায় রেছে চলা। এভাবে আল্লাহর রাসূল সা. পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও পরিষ্কার রাখার ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। যেখানে সেখানে মল ত্যাগ ও ময়লা নিক্ষেপকে তিনি নিষেধ করেছেন। এ মর্মে রাসূলের সা. একটি হাদীস এভাবে বর্ণিত হয়েছে- ‘হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন দু’টি অভিসম্পাতকারী বস্তু থেকে বিরত থাক। সাহাবীগণ রা. আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ অভিসম্পাতকারী দুুটি বস্তু কী? তিনি বললেন- লোকদের যাতায়াত পথে অথবা (রাস্তা) গাছের ছায়ায় পায়খানা করা।’ (মুসলিম)।

বর্ণিত হাদীসে যে সমস্ত কর্ম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে সেগুলো নিঃসন্দেহে পরিবেশ তো নোংরা করেই রোগব্যাধি ও মহামারী ছড়ায়। এ কথা আজ বাস্তব সত্য যে, দূষিত পানিতে রোগ ছড়ায় সবচেয়ে বেশি। আল্লাহর রাসূল সা. পানিকে অপরিষ্কারের হাত থেকে রক্ষা করতে জোর তাগিদ দিয়েছেন। এ মর্মে একটি হাদীস এভাবে এসেছে- ‘হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. স্থির পানিতে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম)। প্রার্থনার জায়গা তথা মসজিদকে পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারেও গুরুত্ব দিয়েছেন। এ সম্পর্কে অনেক হাদীস রয়েছে। এ সম্পর্কে হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মসজিদের ভিতরে থুথু ফেলা গুনাহের কাজ, আর তার কাফফারা হলো তা পুঁতে ফেলা।’ (বুখারী ও মুসলিম)। আরেকটি হাদীস এ রকম- ‘হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. একদিন মসজিদের কিবলার দিকের দেয়ালে থুথু অথবা নাকের ময়লা অথবা কফ দেখে তা খুঁচিয়ে উঠিয়ে ফেললেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)। মহানবীর সা. সার্বিক কার্যক্রম ও বিধিব্যবস্থার মধ্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ছিল খুবই গুরুত্ববহ। রোগব্যাধি ও মহামারী এ বিশে^ আল্লাহর নাজিলকৃত বালা-মুসিবত যা রহমতও বটে, মুসলিম জনসমাজের জন্য যা পরীক্ষা এবং কাফির মুশরিক বে-দ্বীনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে তা মুসিবত ও গজব হিসেবে পরিগণিত। তবে এসব রোগব্যাধি ও মহামারীর ঔষধও আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানুষকে এগুলো অনুসন্ধান তথা আবিষ্কার করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহানবী সা. ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার ঔষধ সৃষ্টি করেননি।’ (সহীহ বুখারী; কিতাবুত তিব-৫২১৭)। এ হাদীস থেকে যে বিষয় জানা গেল, যে কোনো মহামারীই পৃথিবীতে দেখা দিক না কেন তা নিরাময়ের ঔষধ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা অবশ্যই নাজিল করেছেন তবে সে ঔষধ মানুষকে পরিশ্রম করে গবেষণার মাধ্যমে বের করতে হবে। মানুষকে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন যা অন্য কোনো জীবকে দেননি। মানুষ চিন্তা, গবেষণা ও চেষ্টার বদৌলতে এগুলো উদ্ভাবন করে মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহার করতে পারবে। এ সমস্ত নেয়ামত যে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মানুষকে দিয়েছেন এ জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায়সহ সকল কাজে আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য মেনে চলা অপরিহার্য কর্তব্য।

মহামারী পৃথিবীর কোথাও দেখা দিলে সেক্ষেত্রে কী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে তাও আল্লাহর রাসূল সা. বাতলে দিয়েছেন। সংক্রামক রোগব্যাধি ও মহামারীর বিস্তার যাতে না ঘটে এবং মহামারী যেন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে না পারে এ জন্য আল্লাহর রাসূলের সা. নির্দেশনা ছিল অত্যন্ত বাস্তব ও বিজ্ঞানভিত্তিক। এ মর্মে একটা হাদীস এভাবে এসেছে- ‘হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রা. নবী করীম সা. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন: তোমরা কোনো এলাকায় মহামারীর কথা শুনলে সেখানে যেও না, অন্যদিকে কোনো এলাকায় মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়েছে এবং তোমরা সেখানে আছ এমতাবস্থায় তোমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এসো না।’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। মহামারী বিস্তাররোধে করণীয় সম্পর্কে আল্লাহর রাসূলের সা. এ হাদীসটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। রোগব্যাধিসহ যে কোনো দুঃখ দুর্দশায় নিছক তাকদিরকে দোষারোপ করে চুপচাপ করে বসে থাকা মহানবী সা. তথা ইসলামের বিধান নয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একটি ঘোষণা উল্লেখ করে আলোচনার ইতি টানতে চাই। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন- ‘নিজেদের হাতেই নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫)।

লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, সিরাজগঞ্জ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির