post

মানব জীবনে ইহসান

এইচ এম মুশফিকুর রহমান

২৯ মে ২০১৮
ইহসান মানব চরিত্রের অমূল্য সম্পদ। ইহসানই মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদা দান করেছে। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ইহসানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। ইহসানের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। ইহসান অবলম্বনকারী লোকদের আল্লাহ তাআলা অধিক পছন্দ করেন। কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে, “তোমরা ইহসান কর। কেননা আল্লাহ ইহসানকারীদের ভালবাসেন।” (সূরা বাকারা : ১৯৫) ইহ্সান বিষয়টি কী? আমরা তা ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করি। ইহসান শব্দটি ‘হাসান’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ‘হাসান’ অর্থ : ভালো, উত্তম, সুন্দর ইত্যাদি। আর ‘ইহসান’ অর্থ : ভালোভাবে কোন কাজ সম্পন্ন করা, উত্তম রূপে আদায় করা, ভালো আচরণ করা ইত্যাদি। পরিভাষায় ইহসান হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের চরম শিখর ও পরম অবস্থা। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনসমক্ষে বসা ছিলেন, এমন সময় তাঁর কাছে এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করল, ‘ঈমান কী?’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ঈমান হলো, আপনি বিশ্বাস করবেন আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, কিয়ামতের দিবসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রতি এবং তাঁর রাসূলের প্রতি। আপনি আরও বিশ্বাস রাখবেন মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি। আগন্তুক জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইসলাম কী?’ তিনি বলেন, ইসলাম হলো, আপনি আল্লাহর ইবাদত করবেন এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবেন না, সালাত কায়েম করবেন, জাকাত প্রদান করবেন এবং রমজান মাসে রোজা পালন করবেন। ওই ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইহসান কী?’ তিনি বললেন, আপনি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবেন, যেন আপনি তাঁকে দেখছেন, আর যদি আপনি তাঁকে না-ও দেখতে পান, তবে নিশ্চয় তিনি আপনাকে দেখছেন।” (সহীহ বুখারি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৩৮-৩৯, হাদিস : ৪৮) কুরআন ও হাদিসে ইহসানের তিনটি রূপ দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমত : আল্লাহ ও বান্দার মাঝে ইহসান, দ্বিতীয়ত : বান্দা ও অন্যান্যদের মাঝে ইহসান, তৃতীয়ত : বান্দার প্রতিটি কর্মের মাঝে ইহসান। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে ইহসান হচ্ছে দ্বীনের সর্বোচ্চ মান। বান্দার ও আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে ইহসানের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। কোন কোন ইহসান বান্দার অবশ্য করণীয় কর্তব্য হয়ে যায়। যেমন- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, আর তার সাথে কিছুই শরিক কর না। সদয় আচরণ কর মাতা-পিতার প্রতি, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, বিত্তহীন, আত্মীয় প্রতিবেশী ও অনাআত্মীয় প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের মালিকানাধীন ক্রীতদাস-দাসীদের প্রতি।” (সূরা নিসা : ৩৬) মাতা-পিতা ও অন্যান্যদের প্রতি ইহসান (সদয় আচরণ) করা উক্ত আয়াতে মুমিনদের প্রতি অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করে দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া অনাথ অসহায় ও আর্ত-পীড়িতের প্রতি সাহায্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে ইহসান করার জন্য মুমিনদেরকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি মানুষের সঙ্গে কথোপকথনের সময়ও সুন্দর ও শালীন ভাষায় সম্বোধনের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “তোমরা মানুষের উদ্দেশ্যে সুন্দরভাবে কথা বল।” (সূরা বাকারা : ৮৩) এ বিষয়ে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “তোমরা ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতে মুচকি হাসি দেয়াও তোমার জন্য সাদকার সওয়াব নিশ্চিত করে।” (বুখারি ও মুসলিম) প্রতিটি কাজেকর্মে ইহসান প্রসঙ্গে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলে সেখানেও ইহসান অবলম্বন করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব এবং কম কষ্ট দিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। শুধু মানুষ নয়, এমন কি প্রয়োজনের কারণে যখন পশু কোরবানি বা জবাই করতে হয়, তখনও তাদের প্রতি সদয় হতে বলা হয়েছে। কষ্ট দিয়ে দিয়ে সময় ক্ষেপণ করে ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে কোন পশু বধ করা শরিয়তে অনেক বড় গুনাহ। কোন প্রাণী জবাই করতে গেলে ইহ্সানের সাথে জবাই করতে হবে। তোমরা তোমাদের ছুরিটাকে অবশ্যই ধারালো করে নেবে, যাতে জবাইকৃত প্রাণীর কষ্ট কম হয়। (মুসলিম) মহান রাব্বুল আলামিন সৎকাজ সম্পাদন এবং অসৎকাজ বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, “আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকাজ ও সীমালঙ্ঘন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।” (সূরা নাহল : ৯০) উক্ত আয়াতে আল্লাহ তিনটি কাজের আদেশ দিয়েছেন। যেমন- সুবিচার, সদাচার ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি অনুগ্রহ করা এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনটি কাজ করতেও নিষেধ করেছেন। যেমন- : নির্লজ্জ কাজ, প্রত্যেক মন্দ কাজ এবং জুলুম বা নির্যাতন। এসব আদিষ্ট ও নিষিদ্ধ কাজসমূহের মধ্যে যাবতীয় সৎকাজ এবং অসৎকাজ এসে গেছে। আয়াতে বর্ণিত শব্দ কয়টি এতটাই ব্যাপক অর্থবোধক যে, এর মধ্যে যেন সমগ্র ইসলামী শিক্ষাকে ভরে দেয়া হয়েছে। এ কারণেই পূর্ববর্তী মনীষীদের আমল থেকে আজ অবধি জুমা ও দুই ঈদের খুতবার শেষ দিকে এ আয়াতটি পাঠ করা হয়। আয়াতে উল্লিখিত শব্দ আদল বা সুবিচার হচ্ছে মানুষ ও আল্লাহর মধ্যে সুবিচার করা। এর অর্থ এই যে, আল্লাহ তাআলা হককে নিজের ভোগ-বিলাসের ওপর এবং তার সন্তুষ্টিকে নিজের কামনা-বাসনার ওপর অগ্রাধিকার দেয়া। আল্লাহর বিধানাবলি পালন করা এবং নিষিদ্ধ ও হারাম বিষয়াদি থেকে বেঁচে থাকা। দ্বিতীয়ত আদল হচ্ছে মানুষের নিজের সঙ্গে সুবিচার করা। তা এই যে দৈহিক ও আত্মিক ধ্বংসের কারণাদি থেকে নিজেকে বাঁচানো, নিজের এমন কামনা-বাসনা পূর্ণ না করা যা পরিণামে ক্ষতিকর হয় এবং সবর ও অল্পে তুষ্টি অবলম্বন করা ইত্যাদি। তৃতীয়ত আদল হচ্ছে নিজের এবং সমস্ত সৃষ্টজীবের সঙ্গে শুভেচ্ছা ও সহানুভূতিমূলক ব্যবহার করা। ছোট-বড় ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা না করা। সবার জন্য নিজের বিবেকের কাছে সুবিচার দাবি করা এবং কোনো মানুষকে কথা বা কার্য দ্বারা প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কোনোরূপ কষ্ট না দেয়া। আয়াতে উল্লিখিত শব্দ ইহসান বা সদাচরণ অর্থ সুন্দর করা, ভালোভাবে করা। আর তা দুই প্রকার : এক. কর্ম, চরিত্র, অভ্যাস ও ইবাদতকে সুন্দর ও ভালো করা। দুই. কোন ব্যক্তির সঙ্গে ভালো ব্যবহার ও উত্তম আচরণ করা। কাজ ও কর্মকে সুচারুরুপে সম্পন্ন করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। আন্তরিকতার পাশাপাশি দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিপূর্ণ বিকাশ ও প্রয়োগের মাধ্যমে পেশাগত মান নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যা ইচ্ছে তাই বা গা সারা গোছের, অথবা দায়িত্বে অবহেলার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। প্রতিটি ব্যক্তি তার কর্ম, পেশা এবং দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের ব্যাপারে (কিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” (সহীহ বুখারি : ৮৪৪) মুসলিম সমাজে অমুসলিমদের প্রতি ইহসান-অনুকম্পা নিঃসন্দেহে ইসলাম প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। জিম্মা ও নিরাপত্তা চুক্তির আওতাধীন অমুসলিমদের সাথে সদাচার একটি শরিয়তসিদ্ধ বিষয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আল্লাহ নিষেধ করেন না ওই লোকদের সাথে সদাচার ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে যারা তোমাদের সাথে ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের আবাসভূমি হতে তোমাদেরকে বের করে দেয়নি। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।” (সূরা আল মুমতাহানা : ৮) এই আয়াতটি চুক্তিবদ্ধ অমুসিলমদের সাথে সদাচার বিষয়ে একটি মাইলফলক। মাতা-পিতা অমুসলিম হলে তাদের সাথে সদাচারের নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। তবে তিনি মাতা-পিতা ও সন্তানদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের সম্পর্ক কায়েম করা থেকে বারণ করেছেন তারা যদি কুফরকে ঈমানের ওপর প্রাধান্য দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য কঠোর আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন। নিশ্চয় তারা যা করে তা কতই না মন্দ! ” (সূরা আল মুজাদালা : ১৫) ইহসানের ন্যায় মহৎ গুণ ব্যতীত প্রকৃত মুমিন হওয়া যায় না। কারণ ঈমানের বিভিন্ন আহকাম ও আমল সুন্দররূপে সম্পন্ন করার জন্য ইহসান অপরিহার্য। আল্লাহর প্রতি পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে তাঁর ইবাদত করার জন্য ইহসান দরকার। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “ইহসানকারীরূপে যে ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে সে ব্যক্তি দৃঢ়ভাবে মজবুত হাতল ধারণ করেছে।” (সূরা লুকমান : ২২) ইহসানের মাধ্যমে মানুষের মানসিক ও নৈতিক চরিত্রের উন্নতি হয়। ইহসানই মানুষকে সৃষ্টি জগতের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। ইহসানের বিনিময়ে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ দান করেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী, “উত্তম কাজের জন্য উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?” (সূরা রহমান : ৬০) ইহসান অর্জনের উপায় কী? এ প্রসঙ্গে মুহাক্কিক আলেমগণ বলেন, আমিত্ব ও অহঙ্কার বিসর্জন দেয়া ও নফসের গোলামি থেকে মুক্ত হওয়া ইহসান অর্জনের পূর্বশর্ত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইহসানকারীদের সঙ্গে আছেন। কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ইহসানকারীদের সাথে আছেন।” (সূরা আনকাবূত : ৬৯) ইবাদতের চূড়ান্ত পর্যায় হলো ইহসান। এ পর্যায়ে পৌঁছতে হলে বহু সাধনার প্রয়োজন। যারা এ সাধনায় রত থাকেন তারা একদিকে যেমন আল্লাহর ইবাদতের স্বাদ লাভ করতে সক্ষম হন, অপরদিকে আল্লাহর বান্দাদের প্রতিও তারা থাকেন সহানুভূতিশীল। ইহসান হলো মোমিন জীবনের চরম সাফল্য ও পরম পাওয়া। এর মাধ্যমে বান্দার প্রতি আল্লাহর করুণার সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটে এবং বান্দাও আল্লাহর প্রতি সর্বতোভাবে অনুগৃহীত বোধে বিলীন হয়। লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির