post

মিসরে গণজোয়ারের পূর্বাভাস : গন্তব্য ঠিক করার এখনই সময়

মো: কামরুজ্জামান (বাবলু)

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
তথ্য-প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং মানুষের গবেষণাকর্মের পরিধি বাড়ার ফলে যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী চলমান নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখন কম-বেশি অনেকের কাছেই পরিষ্কার। পৃথিবীর ইতিহাসে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ব্যবহারে বিভিন্ন যুগে অত্যন্ত পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে ইহুদি জাতির লোকেরা। যায়নবাদী এই চক্রটি তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে নারী, ক্ষমতা ও অর্থকে খুবই দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে আসছে। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্ষমতাবানদের ঘরে কোনো না কোনোভাবে ইহুদি নারীরা অবস্থান করছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই সুন্দরী ইহুদি নারীরা তাদের সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলছে। ইহুদিবাদের উত্থানের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত মুসলমানদের সমূলে বিনাশ করতে বহু শতাব্দী ধরেই তারা এই নারী-অস্ত্রের অপপ্রয়োগ করে আসছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশের প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের ঘরে ইহুদিরা বিভিন্ন কৌশলে তাদের সুন্দরী ও ধূর্ত মেয়েদের বিয়ে দিয়ে বা রক্ষিতা হিসেবে কিংবা অন্য যে কোনো উপায়ে পুশ-ইন করে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্তের অংশ হিসেবে এই নারীরা মুসলিম পরিবারের সাথে মিশে গিয়ে মুসলমানদের ঔরসে সন্তানের জন্ম দেয়। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম পিতার ঔরসে এবং মুসলিম সমাজে জন্ম নেয়া এই সন্তানদের মুসলমানরা তাদের অংশ হিসেবেই গ্রহণ করে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্তের অংশ হিসেবে ওই ইহুদি নারীরা তাদের সন্তানদের ধীরে ধীরে মনেপ্রাণে ইহুদি হিসেবে গড়ে তোলে এবং মুসলমান ও ইসলাম ধর্ম স¤পর্কে তাদের মনে তীব্র ঘৃণাবোধের বীজ বপন করে থাকে। ইহুদিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় এসব নারী তাদের সন্তানদের ইহুদিবাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মানসিকতাস¤পন্ন করে গড়ে তুলতে থাকে। বড় হয়ে মুসলিম দেশ ও সমাজে এই সন্তানরা যখন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয় তখনই শুরু হয় আসল খেলা। আর ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যায়। মুসলমানদের তখন আফসোস করা কিংবা নিজেরা নিজেরা বিবাদে জড়ানো ছাড়া কিছুই করার থাকে না। মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া এসব ছেলেমেয়েরা যখন নিজেদের মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিয়ে বড় বড় পদ দখল করে নানা সূক্ষ্ম কূটচাল দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি ও ইহুদিদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করতে থাকে তখন তাদের সাথে পেরে ওঠা অনেকাংশেই দুরূহ হয়ে পড়ে। মিসরের সাম্প্রতিক ইতিহাস আবারো সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে নতুন করে দেখিয়ে দিলো ইহুদিদের সেই পুরনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের এক সফল প্রয়োগ। নীল-নকশার খেলোয়াড় সিসির আসল পরিচয় মিসরের সেনা-সমর্থনপুষ্ট বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিও (Abdel Fattah al-Sisi) দেশটিতে দীর্ঘমেয়াদি ইহুদি চক্রান্তেরই আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ। বিগত ২০১১ সালের আরব বসন্তের ফলে মিসরে সুদীর্ঘ তিন দশক (১৯৮১-২০১১) ধরে দাপটের সাথে ক্ষমতায় থাকা হোসনি মুবারক (Hosni Mubarak) সরকারের পতনের পর দেশটিতে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসে শহীদ হাসান আল বান্না ও সাইয়েদ কুতুবের রক্তাপ্লুত সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড (ইখওয়ানুল মুসলিমুন)-এর রাজনৈতিক শাখা (Political wing) ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির (Freedom and Justict Party-PJT) সমর্থনপুষ্ট প্রার্থী মুহাম্মদ মুরসি (Muhammad Mursi)। ২০১২ সালের জুনে দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ভোটে জনগণের সমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুরসি। আর মুরসির প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সেনাপ্রধান হন আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি (Abdel Fattah el-Sisi)। নামাজ পড়তে পড়তে যেভাবে সিজদার দাগ হয়ে যায় অনেকটা তেমনই কপালে দাগ নিয়ে এবং নিজ স্ত্রীকে হিজাব পরিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হরহামেশা অংশ নেয়া সিসি যে আসলে ইহুদিদের এজেন্ট তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি মুরসি। শুধু তাই নয় পরিস্থিতি যখন প্রায় পুরোপুরি আয়ত্তের বাইরে চলে যায় তখনই ফেটে যায় আসল বোমাটি। আর তা হলো সিসি শুধু ইহুদিদের টিকটিকিই নয়, সে ইহুদি মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া এক প্রচন্ড মুসলিম ও ইসলামবিদ্বেষী বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু ততক্ষণে নদীর পানি বহু দূর বয়ে যায়, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মুরসির জায়গা হয় কারাগারের চার দেয়ালের ভেতর এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন সিসি। ২০১৩ সালের আগস্টে এই ভয়াবহ তথ্যটি প্রথম ফাঁস করেন কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার (Al-Jazeera) আরবি বিভাগের একজন আলোচক জামাল নাসসির(Gamal Nasser)। আলজেরিয়ার আল-ওয়াতান (Al-Watan) পত্রিকার বরাত দিয়ে ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট আল-জাজিরায় এক আলোচনায় নাসসির বলেন, I was surprised to learn, from the Algerian Al-Watan newspaper, that el-Sissi is of Jewish origin. অর্থাৎ “আলজেরিয়ার আল-ওয়াতান পত্রিকা থেকে এ কথা জেনে আমি বিস্মিত হয়েছি যে আল-সিসি জন্মসূত্রে ইহুদি।” বোমা ফাটানো এই তথ্য ফাঁস হওয়ার পর তা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিষয়টি উঠে আসে। এমনকি খোদ ইসরাইলের গণমাধ্যমেও বিষয়টি প্রকাশিত হয় যদিও সেখানে বিষয়টিকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এতদসত্ত্বেও নাসেরের আল-জাজিরায় দেয়া সাক্ষাৎকারের আরো খানিকটা যা ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট ইসরাইলের প্রভাবশালী ইংরেজি পত্রিকা ‘দি টাইমস অব ইসরাইল (The Times of Israel)- এ প্রকাশিত হয় তা তুলে ধরা যেতে পারে। সংবাদটির শিরোনাম ছিল  El-Sissi’s uncle, the Haganah member. অর্থাৎ “আল-সিসির মামা হাগানাহ সদস্য”। প্রতিবেদনের খানিকটা তুলে ধরছি : His mother is called Mulaika Titani, and her brother was a member of the Jewish Haganah organization. Thus, we see that this man, by any standard, is implementing a Zionist plan to divide Egypt.Ó (The Haganah was the pre-state precursor of the Israel Defense Forces.) অর্থাৎ “সিসির মা মুলাইকা তিতানি। আর তার মামা ছিলেন ইহুদি সংগঠন হাগানাহর সদস্য। এভাবেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এই লোকটি যে কোনোভাবেই মিসরবাসীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার ইহুদিবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন।” (উল্লেখ্য, হাগানাহ হলো ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালীন ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর মূল সংগঠন) বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও যে বিষয়টিতে প্রায় সবাই একমত তা হলো ইহুদি মায়ের সন্তান সিসি মনেপ্রাণে ইহুদিবাদের একজন একনিষ্ঠ ও অনুগত গোলাম এবং প্রচণ্ডভাবে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হলো এবং মুরসির সমর্থনে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভকে যেই নির্মম হস্তে সিসি দমন করেছেন তাতেই তার চেঙ্গিসীয় চরিত্র সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। তদুপরি তার আসল জন্ম পরিচয় ফাঁস হওয়া এবং তার সমর্থনে ইসরাইলসহ পশ্চিমাদের ন্যক্কারজনক ভূমিকার পর সিসি স¤পর্কে মানুষের ধারণা বদলে যায়। একতরফা ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে মরিয়া সিসি প্রকৃত অর্থে জোর করে পুনরায় চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন সিসি। কিন্তু অত্যন্ত ধূর্ত ও ইহুদিবাদী চরিত্রে সিদ্ধহস্ত সিসি বিশ্ববাসীকে সেটা বুঝতে দিতে চান না। তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবির্ভূত হতে চান। অর্থাৎ- জোর জবরদস্তি করে ক্ষমতায়ও আসবেন কিন্তু নিজেকে স্বৈরশাসক কিংবা জবরদখলকারী হিসেবেও আখ্যায়িত করবেন না। নিজের এই ধোঁকাবাজি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাই একে একে তিনি তার সমস্ত প্রতিপক্ষকে নির্বাচনী মাঠের বাইরে রাখতে চান। এরই মধ্যে চলতি (২০১৮) সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইচ্ছুক অনেক প্রার্থীকেই সিসি ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা নানা কূটকৌশলে নির্বাচন থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছেন। এমনকি সিসির থেকে অনেক সিনিয়র সাবেক সেনাকর্মকর্তাও রেহাই পাচ্ছেন না তার রোষানল থেকে। উদাহরণস্বরূপ, মিসরের সাবেক সেনাপ্রধান সামি আনানের (Sami Anan) প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যেতে পারে। এই সাবেক সেনাপ্রধান মার্চের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করতেই তার ওপর নেমে আসে সিসির খড়গহস্ত। শুধু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর হুমকির মধ্যেই সিসি সীমাবদ্ধ থাকেননি। সিনিয়র এই সাবেক সেনাপ্রধানকে গ্রেফতার করে সিসি সরকার। এক হাস্যকর অভিযোগ এনে তাকে আটকের পর রাখা হয়েছে দেশটির সেনাবাহিনীর প্রসিকিউটর কার্যালয়ে (Military Prosecutor's office)। তার বিরুদ্ধে সেনাবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া একটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছে প্রকাশের মধ্যে সেনাবিধি লঙ্ঘনের কী উপাদান থাকতে পারে? তাহলে সিসিই বা কিভাবে ২০১৪ সালে প্রথম দফায় এবং ২০১৮ সালে দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে পারেন? আন্তর্জাতিক রাজনীতি স¤পর্কে যারা মোটামুটি ধারণা রাখেন তারাও হয়তোবা একমত হবেন যে, পশ্চিমা গণমাধ্যম শেষ পর্যন্ত সিসির পক্ষেই নানা কৌশলে সাফাই গাইবে। তবে, এমন কিছু বিষয় রয়েছে যাকে সাংবাদিকতার ভাষায় “হার্ড-নিউজ” বলা হয়- তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ থাকে না। সামি আনানের বিষয়টিও অনেকটা সেই রকম। সাবেক এই সেনাপ্রধানকে নির্বাচনের প্রাক্কালে এভাবে ঠুনকো অজুহাতে গ্রেফতার করার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করে। পশ্চিমা মিডিয়াসহ বিশ্বের সমস্ত প্রভাবশালী গণমাধ্যমেই সামি আনানের গ্রেফতার ও গণতন্ত্রের লেবাসে মিসরে সিসির স্বৈরশাসনের নানা প্রসঙ্গ আলোচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে গত ২৩ জানুয়ারি (২০১৮) Egypt election: Retired general and candidate Sami Anan arrested - অর্থাৎ “মিসরের নির্বাচন : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ও প্রার্থী সামি আনান গ্রেফতার” এই শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, Former chief of staff in the Egyptian army, Sami Anan, has been detained after announcing his intention to run for president. Mr Anan has been accused by the armed forces of violating Egypt's military code, running for the post without permission and forging documents. অর্থাৎ “রাষ্ট্রপতি পদে লড়াই করার আগ্রহ প্রকাশ করার পর মিসরের সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান সামি আনানকে আটক করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে আনান সেনাবিধি লঙ্ঘন করেছেন এবং অনুমতি ছাড়া ও কাগজপত্র জালিয়াতি করে নির্বাচন করতে চান।” কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই সাবেক সেনাপ্রধান যদি নির্বাচনে অংশ নিলে তিনি যে সিসির সামনে অত্যন্ত শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন- সেই ভয় থেকেই মূলত তাকে আটক করা হয়েছে। বিষয়টি এত সোজাসাপ্টাভাবে না বললেও সব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এটা এক বাক্যে স্বীকার করছে যে সামি আনান সিসির অত্যন্ত শক্ত প্রতিপক্ষ হতে পারতেন। বিবিসির প্রতিবেদনে বিষয়টি বলা হয়েছে এভাবে- “ He was widely considered to be the last high-profile challenger to Egypt's President Abdul Fattah al-Sisi.” অর্থাৎ “সার্বিক বিবেচনায় তাকেই প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসির সবশেষ বড় হুমকি হিসেবে দেখা হতো।” সত্যিকার অর্থেই মিসরের সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কাউন্সিল (Egypt’s supreme military council for armed forces -Scaf)- এর সাবেক এই সদস্যকেই সিসির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে কার্যত একটি একতরফা ও লোক দেখানো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারো প্রেসিডেন্টের পদে সিসি বসতে যাচ্ছেন বলেই আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হচ্ছে। চাপ সামলাতে ব্যর্থ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শুধু সামি আনানিই নন, মিসরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শাফিককেও (Ahmed Shafik) প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করা থেকে কূটকৌশলে দূরে রেখেছেন সিসি। সিসি বিভিন্ন কৌশলে ও নানাবিধ চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে তার এই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিজের পথ থেকে সরিয়ে দেন। ধূর্ততার সাথে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় যে শাফিক নিজেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। মিসরের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকেও আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিসির কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবেই মনে করা হচ্ছিল। সিসির আজ্ঞাবহ মিসরের স্থানীয় গণমাধ্যমে বিষয়টিকে একভাবে প্রচার করা হলেও আন্তর্জাতিক প্রায় সব প্রভাবশালী গণমাধ্যমেই শাফিকের ওপর সিসির চাপ প্রয়োগের বিষয়টি ঠিকই উঠে আসে। এমনকি ২০১২ সাল থেকে পাশের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে (United Arab Emirates-U.A.E.) নির্বাসনে থাকা শাফিককে সিসির চাপে সেখানে গৃহবন্দী পর্যন্ত করা হয়। আরব আমিরাত ত্যাগ করতে আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। এসবই করা হয় সিসির প্রতিপক্ষ হিসেবে তার ২০১৮-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণার পর পরই। অর্থাৎ শাফিক যেন কিছুতেই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন সেজন্য সম্ভাব্য সব ন্যক্কারজনক পন্থাই গ্রহণ করে সিসি সরকার। আমেরিকার প্রভাবশালী ইংরেজি গণমাধ্যম (The New York Times)- পত্রিকায় ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর “Ex-General Says U.A.E. Blocks His Return to Egypt to Run for President.” অর্থাৎ “রাষ্ট্রপতি পদে লড়াই আটকাতেই মিসর ফিরতে বাধা দিচ্ছে আরব আমিরাত: সাবেক জেনারেলের অভিযোগ, এই শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিষয়টি বেশ খোলামেলাভাবেই তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে শাফিকের একটি ভিডিও টেপের উদ্ধৃতি দিয়ে তার বক্তব্যও তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, “I was surprised to find myself prevented from leaving our sister country. I reject interventions into the affairs of my country by preventing me from participating in a constitutional process and a sacred national mission.” অর্থাৎ “আমি বিস্মিত যে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রটি দেশত্যাগে আমাকে বাধা দিচ্ছে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এভাবে নাক গলানো এবং পবিত্র জাতীয় কর্তব্য পালন ও দেশের সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে আমাকে বাধা দেয়াকে আমি প্রত্যাখ্যান করছি।” অবশ্য রহস্যজনকভাবে পরবর্তীতে শাফিককে দেশ ত্যাগ করতে দেয়া হয় এবং এক বিশেষ বিমানে করে তাকে মিসরে পাঠানো হয়। কায়রো বিমানবন্দরে পৌঁছলে তাকে কিডন্যাপ করা হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়। আর এমনই এক পটভূমিতে হঠাৎ করেই দৃশ্যপটে হাজির করা হয় শাফিককে এবং প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন তিনি। বিষয়টি একটু পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায় চাপের মুখে তাকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। এ বিষয়ে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করে সুইডেন থেকে পরিচালিত মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন “দি মিডল ইস্ট অবজারভার (The Middle East Observer)। চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস গত ১০ জানুয়ারি (২০১৮) তারিখে মিডল ইস্ট অবজারভারে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয় “All those are Competing in Next Election in Egypt – pick and choose” যার ভাবানুবাদ দাঁড়ায় অনেকটাই এরকম- “মিসরের আসন্ন নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, চোখ বন্ধ এবং বেছে নাও”। প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন ভঙ্গিতে সাতজন প্রার্থীর ছবি দেয়া হয়। শিরোনাম পড়ে এবং ছবির দিকে হঠাৎ তাকালে মনে হবে মিসরের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে এগিয়ে থাকা সাতজনের ছবি দেয়া হয়েছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে ছাপানো সাতটি ছবির সবগুলোই সিসির। এর মানে হলো নির্বাচনে আপনি যাকেই চান না কেন ভোট সিসিকেই দিতে হবে। প্রতিবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাফিককে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এক গোপন আলাপের অডিও তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা যায় সিসি সরকারের একজন উচ্চপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তা এক টেলিভিশন সাংবাদিককে নির্দেশ দিচ্ছেন শাফিককে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য। শাফিকের সাথে নিষিদ্ধ সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের যোগসাজশ রয়েছে এমন ভিডিও ক্লিপিং তৈরির জন্য নির্দেশ দেয়া হয় সেই সরকারি এজেন্টের পক্ষ থেকে। শুধু তাই নয় শাফিক বাড়াবাড়ি করলে এবং তাদের প্রেসক্রিপশন মেনে না নিলে তাকে চরমভাবে হেনস্তা করারও সু¯পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেই আলাপ চারিতায়। প্রতিবেদনের কিয়দংশ তুলে ধরছি: “…leaked conversation revealed that an Egyptian secret service agent ordered a prominent TV host to prepare a show reel of footage to discredit former presidential hopeful Ahmed Shafik as a Muslim Brotherhood sympathize. Audio of conversations between the agent Captain Ashraf al-Kholi and the host Azmi Megahed, broadcast by the Turkish-based Arabic television channel Mekameleen on Monday evening, reveals a plan to ÒcrackÓ Shafik’s head and smear him if he steps out of line. ” অর্থাৎ “ফাঁস হওয়া কথোপকথনে দেখা যায় যে, মিসরের গোপন সংস্থার একজন এজেন্ট এক প্রখ্যাত টিভি উপস্থাপককে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইচ্ছুক আহমেদ শাফিককে নিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশের ব্যবস্থা করেন যেখানে শাফিককে মুসলিম ব্রাদারহুডের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দেখানো হবে। তুরস্কভিত্তিক আরবি টেলিভিশন চ্যানেল মেকামেলিন সোমবার (৮ জানুয়ারি ২০১৮) এই গোপন আলোচনার অডিওটি ফাঁস করে। সামরিক এজেন্ট ক্যাপ্টেন আশরাফ আল-কোহলি এবং উপস্থাপক আজমি মেগাহিদের মধ্যে এই কথোপকথন হয়। আলোচনায় শাফিক সীমারেখা অতিক্রম করলে তাকে চরমভাবে অপদস্থ করারও পরিকল্পনা আঁটা হয়।” মিডল ইস্ট অবজারভারের প্রতিবেদনে অপরাপর যেসব প্রার্থী শেষমেশ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন তাদের বিষয়েও আলোকপাত করা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দু’জন হলেন- সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আমর মুসা (Amr Moussa) এবং মিসরের সাবেক ক্ষমতাসীন পার্টি “(National Democratic Party)”-এর মহাসচিব হোসসাম বাদরাওই (Hossam Badrawi)। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল আহমেদ কনসোয়াকে (Ahmed Konsowa) মিসরের এক সামরিক আদালত কর্তৃক ৬ বছরের কারাদন্ড প্রদানের ইস্যুটিও তুলে ধরা হয় এই প্রতিবেদনে। কনসোয়াও সিসির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন। বিশ্ব মোড়লদের একচোখা নীতিতে সিসির লাভ বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এত কিছুর পরও পশ্চিমারাসহ বর্তমান বিশ্বে মোড়লের আসনে থাকা দেশগুলোর পক্ষ থেকে সিসির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। কারণ সিসি ইসরাইল ও আমেরিকার পরীক্ষিত দালাল এবং মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে এক শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। সুতরাং তথাকথিত গণতন্ত্রের সবকধারী আমেরিকা বা জাতিসংঘ এখন কিছুদিন জেগে জেগে ঘুমানোর ভান ধরবে। আর এরই মধ্যে হয়তো বা একতরফা নির্বাচনে আবারো ৪ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে সিসি জগদ্দল পাথরের মতো মিসরবাসীর ঘাড়ে চেপে বসতে পারেন। আশার আলো ধারণা করা হচ্ছে এরই মধ্যে মিসরের জনগণ আরব বসন্তের চেয়েও জোরালোভাবে এক গণবিস্ফোরণে জেগে উঠবে। আর তখন পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরাইলের শত শঠতা এবং নিজস্ব দালালদের মাধ্যমে মিসর নিয়ন্ত্রণ করা আর সম্ভব হয়ে উঠবে না। শেষমেশ শহীদ হাসান আল বান্না ও সাইয়্যেদ কুতুবের রক্তভেজা সংগঠন ইখওয়ানই মূল চালকের ভূমিকায় আসীন হবে সে ব্যাপারে আশাবাদী অনেকেই। তবে সেটা যে অনেক রক্তপাত ও কণ্টকাকীর্ণ হবে সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কারণ বিশ্বের তাবত পরাশক্তির সম্মিলিত কূটচালকে পরাস্ত করেই সেটা হতে হবে। তাই মিসরের আকাশে কালো মেঘ দূর হতে হয়তো বা আরো কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু গণজোয়ারের এক পূর্বাভাস বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির