post

যে কারণে বারবার হোঁচট খায় বাংলাদেশের মানুষ । আরাফাতুর রহমান

১৩ নভেম্বর ২০১৮

পলাশীর যুদ্ধের কথা আমরা কে না জানি? বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের কাহিনী শ্রবণে আজও হয়তো চোখের কোণ ভিজে যায় অনেকেরই। গুটি কয়েক ইংরেজের ষড়যন্ত্র ও মীরজাফরের মতো কিছু বিশ্বাসঘাতকের কারণে দেশপ্রেমিক নবাবের মর্মান্তিক পরাজয় ও নির্মম হত্যাকাণ্ড এই উপমহাদেশের মানুষের হৃদয়ে এতটাই রেখাপাত করেছিল যে আজও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে উচ্চারিত হয় মীরজাফরের নাম। সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধের কাহিনী সবারই জানা। সেটা বর্ণনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি এখানে শুধু সেই ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের যুদ্ধ ছাড়াই ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলকারী ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ বা লর্ড ক্লাইভের পরবর্তীতে করা একটি মন্তব্য উল্লেখ করতে চাই। তিনি উপহাস করে বলেছিলেন, বিজয়ীর বেশে ইংরেজ সেনারা যুদ্ধস্থল ত্যাগ করার সময় দুই পাশে যে উৎসুক জনতা দাঁড়িয়েছিলেন তারা একটি করে ইটের বা পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করলেও ইংরেজ বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের চরিত্রের এক বাস্তব দিক। তারা এতটাই উদাসীন যে নিজেদের শত্রু-মিত্র পর্যন্ত চিনতে পারে না। যখন আবেগতাড়িত হয় তখন মুহূর্তে অনেক কিছু করে বসে। কিন্তু এরপর যুগের পর যুগ থাকেন উদাসীন। পাশাপাশি ভারসাম্যপূর্ণ বিবেচনাবোধেরও রয়েছে যথেষ্ট অভাব। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অহঙ্কার ও অর্জন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা। একবাক্যে সবাই এ কথা স্বীকার করবেন। আর এই যুদ্ধে ভারত কিছুটা সাহায্য করেছিল একেবারেই নিজেদের স্বার্থে। তবুও আমরা ভারতের সেই অবদানের জন্য আজও কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের মানুষের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতাযুদ্ধকে আজও স্বীকার করে না এ নিয়ে আমাদের সামান্যতম আফসোস নেই। আমাদের আবেগ ও অহংকার ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে ভারত আজও পাক-ভারত যুদ্ধ বলে দাবি করছে। কিন্তু এই তথ্য আমরা অনেকেই জানি না, জানার চেষ্টাও করি না। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি খবর ছাপা হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল “সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তানকে কড়া বার্তা প্রণবের”। এমন শিরোনাম দেখে যে কারো মনে হবে এটি একান্তই ভারত-পাকিস্তান বিষয়ক একটি খবর। কিন্তু এই সংবাদটির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার এই ৪৫ বছরের মাথায় আরো একবার দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল যে ভারত বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আজও মেনে নিতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র ব্রাসেলসে ইউরোপের এক টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে মূলত এই সংবাদটি তৈরি করেছিল আনন্দবাজার। সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের বিভিন্ন সমালোচনার একপর্যায়ে প্রণব মুখার্জী বলেন, “কিন্তু, ভারতের পক্ষে তার সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয় এমন কোনও সমঝোতা করা সম্ভব নয়। আর সীমান্তের ওপার থেকে সন্ত্রাসে মদদ দেয়াও বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। শিমলা চুক্তির পরে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বন্দি ৯১ হাজার পাক সেনাকে ছেড়ে দিয়েছিল ভারত।” প্রণব মুখার্জীর কথায় মনে হচ্ছে যেন ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হলো আমাদের গৌরবগাথা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ, লাল-সবুজের পতাকা। ভারত আমাদের সেই যুদ্ধে সেনাবাহিনী, আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছিল সেটি আমরা সবাই স্বীকার করি। এ জন্য অবশ্যই আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। ইতিহাস সাক্ষী একাত্তরে প্রকৃত লড়াইটা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদার বাহিনীর মধ্যে। যুদ্ধে হতাহতের জরিপ থেকেও তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত এবং এটাই ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এ যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কেবল আমাদের ‘অকৃত্রিম বন্ধু’ হিসেবেই মূল্যায়ন করা যায়। কিন্তু প্রণব মুখার্জীর কথায় সেই যুদ্ধ যেন হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। তার এই বক্তব্য কী বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও ইজ্জত হারানো মা-বোনদের প্রতি অবমাননা নয়? প্রণব বাবু বলেন, শিমলা চুক্তির পরে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বন্দি ৯১ হাজার পাক সেনাকে ছেড়ে দিয়েছিল ভারত। পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করলো আমাদের দেশের মানুষকে, ইজ্জত নিলো আমাদের মা-বোনদের, আর তাদেরকে ছেড়ে দিল ভারত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ছেড়ে দেয়ার ভারত কে? তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকলো কোথায়? অথচ আমরা জানি, সিমলা চুক্তি মূলত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যেই হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি ভারতের ওই সময়ের সক্রিয় সহযোগিতার কারণে এবং ওই সময়ের বাস্তবতায় চুক্তিতে তিন দেশই স্বাক্ষর করেছিল এবং সেই হিসেবেই চুক্তিটিকে ত্রিদেশীয় চুক্তি বলা হয়। কিন্তু ভারত কিভাবে বলে যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানের ৯১ হাজার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে দিয়েছে ভারত? শুধু কি তাই প্রণব মুখার্জী তার সাক্ষাৎকারে বলেন, “যুদ্ধে দখল করা ভূখন্ডও ছেড়ে চলে এসেছিল ভারতীয় সেনা।” তার মানে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে কিছু সেনা পাঠিয়ে বাংলাদেশকে যে সহায়তা ভারত করেছিল সেটাকে আজও তারা বাংলাদেশের ভূখন্ড দখলের সাথে তুলনা করে। আর সেই ভূখণ্ড ছেড়ে আসাকে তাদের উদারতা হিসেবে তারা বিশ্বময় এখনো প্রচার করে আসছে। ভারতের এই মনোভাবের প্রেক্ষিতে অনেকেরই এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশীদের যে প্রাণপণ লড়াই ও অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেয়ার দৃশ্য ভারত দেখেছে তাতে ভীত হয়েই তারা এই ভূখন্ড ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। শুধুমাত্র উদারতা দেখিয়ে তাদের দখল করা একটি ভূখন্ড তারা ছেড়ে দিবে এমন বক্তব্য সারা দুনিয়া বিশ্বাস করলেও অন্তত কোন বাংলাদেশী বিশ্বাস করে না। স্বাধীনতার পর ফারাক্কা বাঁধসহ একের পর এক ৫৩টি মতান্তরে ৫৪টি অভিন্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার ভারতীয় ষড়যন্ত্র আমরা কতটুকু মনে রাখছি। সীমান্তে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলছে ভারত। ফেলানীর কথা আমরা কত সহজে ভুলে গেছি। আমাদের ঘুম কিছুতেই ভাঙছে না। পুরো সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেঁড়া নির্মাণের মাধ্যমে চিরশত্রুতার বারতা দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের প্রতি ভারত অনেক আগেই। কিন্তু আমরা তাতে কিছুই মনে করি না। বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশের পানিসম্পদ সচিব ছিলেন আসাফ-উদ-দৌলাহ। একদিন তার বাসায় গিয়েছিলাম একটি ইন্টারভিউ আনার জন্য। তিনি সেদিন বলেছিলেন, একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে অখণ্ড পাকিস্তান আমলে ভারত পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের অনুমতি চেয়েছিল পাকিস্তানের কাছে। সেদিন পাকিস্তান সরকার বলেছিল এ ধরনের কোনো বাঁধ নির্মাণ করা হলে সাথে সাথে তা বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হবে। সেই কঠোর অবস্থানের কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারত সাহস পায়নি ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহায্য করে অকৃত্রিম বন্ধু সেজে ভারত একের এর এক ক্ষতি করছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। অথচ আমরা আজও শুধু পাকিস্তানকেই গালি দিচ্ছি সেই ৪৫ বছর আগের অপরাধের জন্য। সবার বোঝার সুবিধার্থে আরও খানিকটা তথ্য দিচ্ছি। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদীতে তিন হাজার ছয়শতটি বাঁধ তৈরি করেছে। হিমালয়ের ভাটিতে বাংলাদেশের উজানে এসব বাঁধ ছাড়াও আরো এক হাজার বাঁধের নির্মাণ কাজ চলছে পুরোদমে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হওয়ায় এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই তা করার কথা। আইন অনুযায়ী এসব নদীতে বাঁধ নির্মাণ করতে হলে বা পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই ভাটির দেশ বাংলাদেশের অনুমতি লাগবে। কিন্তু অনুমতি নেয়া তো দূরের কথা বাংলাদেশের জোর আপত্তি সত্ত্বেও ভারত এসব নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে রীতিমতো মরুভূমিতে পরিণত করে চলেছে। আর এরই কুফল হচ্ছে এক সময়ের খরস্রোতা পদ্মা এখন ধূধূ বালুচর এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের বিরাট অংশ পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে দ্রুততার সাথে। কিন্তু মুখে শুধু ফেনা তুলছি ভারতের একাত্তরের ভূমিকার গুণকীর্তন করতে করতে। মুদ্রার অপর দিকটিতে কিছু আছে এবার তারই খানিকটা দেখা যাক। একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হবার মুহূর্তে ও তার পর পরই আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু ভারত এদেশে যা করেছিল সেই প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিল তার “অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা” বইয়ে লিখেছেন: “ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক সেই লুটপাটের খবর চারিদিক থেকে আসা শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিত্যক্ত কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক গাড়ি, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ আরো মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাকবোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। প্রাইভেট কার পর্যন্ত যখন রক্ষা পায়নি, তখনই কেবল আমি খুলনা শহরের প্রাইভেট গাড়িগুলো রিকুইজিশন করে খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে হেফাজতে রাখার চেষ্টা করি। এর পূর্ব পর্যন্ত যে গাড়ি পেয়েছে, সেটাকেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সীমান্তের ওপারে। যশোর সেনানীবাসের প্রত্যেকটি অফিস এবং কোয়ার্টার তন্ন তন্ন করে লুট করেছে। বাথরুমের মিরর এবং অন্যান্য ফিটিংস পর্যন্ত সেই লুটতরাজ থেকে রেহাই পায়নি।” বইয়ে তিনি আরও লিখেছেন, “আমারই স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দী। ৩১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল রূপের প্রথম দৃশ্য দেখলাম আমি। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মদদে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝে উঠতে তখন আর আমার এক মিনিটও বিলম্ব হয়নি।” যাই হোক লেখার পরিধি আর বাড়াতে চাই না। শুধু বলতে চাই আমাদের খাসলতটা একটু পরিবর্তন করা দরকার। ইতিহাসের পাতা থেকে একটু শিক্ষা নেয়া দরকার। কে শত্রু আর কে মিত্র তা সচেতনভাবে ঠিক করা দরকার। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এখনই জেগে ওঠার সময়। ভারতের দালালি যারা করছেন তাদের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এখনই উপযুক্ত সময়। মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সাথে আর বেঈমানি না করে আসুন আমরা সঠিক ইতিহাস জানার চেষ্টা করি এবং নিজেদের দেশকে নিজেরা গড়ে তুলতে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োজিত করি।

লেখক : সাংবাদিক, ঢাকাটাইমস২৪

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির