post

রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী

১০ জুলাই ২০১৩

এ.কে.এম. নাজির আহমদ

জামায়াতে ইসলামী নিছক একটি রাজনৈতিক দল নয়। এটি কেবল সামাজিক ও সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও নয়। এটি একটি পূর্ণাংগ ইসলামী আন্দোলন। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলকুরআন ও আস্সুন্নাহর আলোকে গড়ে তোলার জন্য চার দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে কাজ করছে জামায়াতে ইসলামী। এই চার দফা কর্মসূচীর সর্বশেষ তথা চতুর্থ দফাটিই কেবল রাজনৈতিক। চার দফার কাজ যুগপৎ এগিয়ে নেওয়ার জন্যই অন্য তিনটি দফার সাথে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক ময়দানেও সাধ্যমত ভূমিকা পালন করে এসেছে। এই লেখাটিতে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নয়, শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী যেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে তারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো। প্রেক্ষাপট বুঝার প্রয়োজনে আনুসঙ্গিক কিছু তথ্যও সন্নিবেশিত করা হলো। জামায়াতে ইসলামী গঠন ১৯৪১ সনের ২৬শে অগাস্ট বৃটিশশাসিত দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের লাহোর সিটিতে গঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ৭৫ জন। সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী আমীরে জামায়াত নির্বাচিত হন। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণের একাংশে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীতে যাঁরা যোগদান করবেন তাঁদেরকে এই কথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, জামায়াতে ইসলামীর সামনে যেই কাজ রয়েছে তা কোন সাধারণ কাজ নয়। দুনিয়ার গোটা ব্যবস্থা তাঁদেরকে পাল্টে দিতে হবে। দুনিয়ার নীতিনৈতিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতিÑ সবকিছু পরিবর্তন করে দিতে হবে। দুনিয়ায় আল্লাহদ্রোহিতার ওপর যেই ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে তা পরিবর্তন করে আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’১ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও জামায়াতে ইসলামী হিন্দ ১৯৪৭ সনের ১৪ ও ১৫ই অগাস্টের মধ্যবর্তী রাতে দিল্লীতে বসে বৃটিশশাসিত দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তখন গোটা উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য সংখ্যা ছিলো ৬২৫ জন। দেশ ভাগ হলে জামায়াতে ইসলামীও ভাগ হয়। মোট ২৪০ জন সদস্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ এবং ৩৮৫ জন সদস্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান কাজ শুরু করে। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সূচনা পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ ওয়াদা করেছিলেন যে একটি স্বাধীন দেশ হাতে পেলে তাঁরা দেশটিকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর তাঁরা সেইসব কথা বেমালুম ভুলে যান। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে তাঁরা আলোচনা শুরু করেন পাকিস্তানের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম উপযোগী, না আমেরিকান প্রেসিডেনশ্যাল সিস্টেম, তা নিয়ে। ১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে করাচির জাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের প্রতি চারটি দফার ভিত্তিতে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ (ঙনলবপঃরাবং জবংড়ষঁঃরড়হ) গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানান। দফাগুলো হচ্ছে

  •    সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে।
  •    ইসলামী শারীয়াহ হবে দেশের মৌলিক আইন।
  •     ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল করা হবে।
  •    ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শারীয়াহর সীমা লংঘন করবে না।২

এইভাবে জামায়াতে ইসলামী ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে। ‘ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি’ প্রণয়ন ১৯৪৮ সনের ১১ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের স্থপতি মি. মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। গভর্ণর জেনারেল হন ঢাকার নওয়াব পরিবারের সন্তান খাজা নাজিমুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন লিয়াকত আলী খান। লিয়াকত আলী খান সরকার ১৯৪৮ সনের ৪ঠা অকটোবর ইসলামী শাসনতন্ত্রের অন্যতম বলিষ্ঠ কণ্ঠ সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। প্রায় ২০ মাস জেলে রাখার পর ১৯৫০ সনের ২৮শে মে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৫০ সনের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে দেশের আলিম সমাজ যদি সর্বসম্মতভাবে কোন শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব উপস্থাপন করে, গণপরিষদ তা বিবেচনা করে দেখবে। প্রধানমন্ত্রী আস্থাশীল ছিলেন যে বহুধাবিভক্ত আলিম সমাজ এই জটিল বিষয়ে কখনো একমত হতে পারবে না এবং কোন সর্বসম্মত প্রস্তাবও পেশ করতে পারবে না। ১৯৫১ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে করাচিতে সারা দেশের সকল মত ও পথের ৩১ জন শীর্ষ আলিম একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে একত্রিত হন। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ সুলাইমান নদবী। সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী একটি খসড়া পেশ করেন। আলাপ-আলোচনার পর চূড়ান্ত হয় একটি মূল্যবান দলীল “ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি।” দফাগুলো ছিলো নিুরূপ : ১.    দেশের সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ। ২.    দেশের আইন আলকুরআন ও আস্সুন্নাহর ভিত্তিতে রচিত হবে। ৩.    রাষ্ট্র ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালার উপর সংস্থাপিত হবে। ৪.    রাষ্ট্র মা‘রুফ প্রতিষ্ঠা করবে এবং মুনকার উচ্ছেদ করবে। ৫.    রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য সম্পর্ক মজবুত করবে। ৬.    রাষ্ট্র সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের গ্যারান্টি দেবে। ৭.    রাষ্ট্র শারীয়াহর নিরিখে নাগরিকদের সকল অধিকার নিশ্চিত করবে। ৮.    আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। ৯.    স্বীকৃত মাযহাবগুলো আইনের আওতায় পরিপূর্ণ দীনী স্বাধীনতা ভোগ করবে। ১০.    অমুসলিম নাগরিকগণ আইনের আওতায় পার্সোনাল ল’ সংরক্ষণ ও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। ১১.    রাষ্ট্র শারীয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত অমুসলিমদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে। ১২.    রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলিম পুরুষ। ১৩.    রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হবে। ১৪.    রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি  মাজলিসে শূরা থাকবে। ১৫.    রাষ্ট্রপ্রধান দেশের শাসনতন্ত্র সাসপেন্ড করতে পারবেন না। ১৬.    সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রাষ্ট্রপ্রধানকে পদচ্যুত করা যাবে। ১৭.    রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর কাজের জন্য মাজলিসে শূরার নিকট দায়ী থাকবেন এবং তিনি আইনের ঊর্ধ্বে হবেন না। ১৮.    বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন হবে। ১৯.    সরকারী ও প্রাইভেট সকল নাগরিক একই আইনের অধীন হবে। ২০.    ইসলামবিরোধী মতবাদের প্রচারণা নিষিদ্ধ হবে। ২১.    দেশের বিভিন্ন অঞ্চল একই দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট বলে গণ্য হবে। ২২.    আলকুরআন ও আস্সুন্নাহর পরিপন্থী শাসনতন্ত্রের যেই কোন ব্যাখ্যা বাতিল বলে গণ্য হবে।৩ এই নীতিমালা বিপুল সংখ্যায় মুদ্রণ করে সারা দেশে ছড়ানো হয়। এর পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সারা দেশে বহুসংখ্যক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামী শাসনতন্ত্রের পক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টি হতে থাকে। কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণার আন্দোলন ইতোমধ্যে কাদিয়ানী ইস্যুটি সামনে আসে। ১৯৫৩ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাজলিসে আহরার, জমিয়তে আহলে হাদীস, মুসলিম লীগ, আনজুমানে তাহাফ্ফুযে হুকুকে শিয়া প্রভৃতি দল করাচিতে একটি সম্মেলনে মিলিত হয়। জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাব করে যে কাদিয়ানী ইস্যুটিকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে নেওয়া হোক। সেই সম্মেলনে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হলো না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ফেব্র“য়ারি মাসে করাচিতে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদের মিটিং ডাকা হয়। এই মিটিংয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশনের’ পক্ষে প্রবল মত প্রকাশ পায়। জামায়াতে ইসলামী গোড়া থেকেই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলো বিধায় ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশনের’ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসে। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি ১৯৫৩ সনের মার্চ মাসে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে কতিপয় দলের ডাইরেক্ট এ্যাকশনের ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এই অবনতি পাঞ্জাবেই ঘটেছিলো বেশি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মার্শাল ল’ ঘোষণা করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে ১৯৫৩ সনের ২৮শে মার্চ  মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী ও আরো কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার, সামরিক ট্রাইব্যুনাল ১৯৫৩ সনের ৮ই মে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদীকে ফাঁসির হুকুম দেয়। জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি এবং সকল শ্রেণীর ইসলামী ব্যক্তিত্ব এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ও বলিষ্ঠ আন্দোলনে নেমে পড়ে। ফলে সরকার মৃত্যুদণ্ড রহিত করে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদীর চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের কথা ঘোষণা করে। তবে দুই বছর একমাস জেলে থাকার পর ১৯৫৫ সনের ২৯শে এপ্রিল সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী মুক্তি লাভ করেন। তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্তের আসল লক্ষ্য ছিলো ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের বলিষ্ঠতম কণ্ঠটিকে স্তব্ধ করে দেওয়া। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের ইচ্ছা ছিলো ভিন্ন। তিনি মুক্তি পান। আর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গণদাবির মুখে গণপরিষদ ১৯৫৬ সনের ২৯শে ফেব্র“য়ারি একটি শাসনতন্ত্র পাস করে। পুরোপুরি ইসলামী না হলেও ১৯৫৬ সনের শাসনতন্ত্রে ইসলামের যথেষ্ট প্রতিফলন ছিলো। ঐ বছরের ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের তৃতীয় গভর্নর জেনারেল মালিক গোলাম মুহাম্মাদকে অব্যাহতি দিয়ে প্রণীত শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট বানানো হয় মেজর জেনারেল ইস্কানদার আলী মির্যাকে। জনগণের ভোটাধিকার পুনর্বহাল দাবিতে আন্দোলন কথা ছিলো ১৯৫৯ সনে নতুন শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোপূর্বে ১৯৫৪ সনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ৩০৯টি আসনের মধ্যে ৩০০টি আসনে বিজয়ী হয়। মাত্র ৯টি আসন পায় মুসলিম লীগ। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের দলগুলোর আন্তকলহের ফলে প্রাদেশিক সরকারে ভাংগা ও গড়া চলতে থাকে। ১৯৫৮ সনের ২০শে সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খান সরকারের প্রতি আস্থা ভোটের জন্য পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসে। অধিবেশনে স্পিকার আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়। স্পিকারের দায়িত্ব লাভ করেন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারী। পরিষদে হট্টগোল চলতে থাকে। উত্তেজিত সদস্যদের আঘাতে শাহেদ আলী পাটোয়ারী মারাত্মক আহত হন। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি হাসপাতালে মারা যান। ১৯৫৮ সনের ৭ই অকটোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কানদার আলী মির্যা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদসমূহ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাগুলো ভেঙ্গে দেন। নয় বছরের চেষ্টাসাধনার ফসল শাসনতন্ত্রটি বাতিল করে দেন। প্রধান সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত হন সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মাদ আইউব খান। ২৭শে অকটোবর আইউব খান প্রেসিডেন্ট পদটিও দখল করেন। চলতে থাকে এক ব্যক্তির স্বৈরশাসন। ১৯৬২ সনের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান দেশের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র জারি করেন। এটি না ছিলো ইসলামিক, না ছিলো গণতান্ত্রিক। এতে বিধান রাখা হয়, দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’দের (ইধংরপ উবসড়পৎধঃং) দ্বারা নির্বাচিত হবেন। আর ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ হবেন পূর্ব পাকিস্তানের ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বার মিলে ৪০ হাজার জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বার মিলে ৪০ হাজার জন। অর্থাৎ ৮০ হাজার ব্যক্তি ছাড়া দেশের কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এই আজগুবী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আওয়াজ তোলে জামায়াতে ইসলামী। ১৯৬২ সনে রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকতবাগ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। এতে প্রেসিডেন্ট আইউব খান ক্ষেপে যান। তাঁরই নির্দেশে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ১৯৬৪ সনের ৬ই জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনী ঘোষণা করে। আমীরে জামায়াত সহ মোট ৬০ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। বন্দিদের মধ্যে ছিলেন- আমীরে জামায়াত সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী, মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ, নাঈম সিদ্দিকী, নাসরুল্লাহ খান আযিয, চৌধুরী গোলাম মুহাম্মাদ, মাওলানা ওয়ালীউল্লাহ, মাওলানা আবদূর রহীম, অধ্যাপক গোলাম আযম, জনাব আবদুল খালেক, ইঞ্জিনিয়ার খুররম জাহ মুরাদ, অধ্যাপক হেলালুদ্দীন, মাস্টার শফিকুল্লাহ, মাওলানা এ.কিউ.এম. ছিফাতুল্লাহ, অধ্যাপক ওসমান রময্, মাস্টার আবদুল ওয়াহিদ (যশোর), আবদুর রহমান ফকির, জনাব শামসুল হক, মাওলানা মীম ফজলুর রহমান প্রমুখ। জনাব আব্বাস আলী খান, জনাব শামসুর রহমান ও মাওলানা এ.কে.এম. ইউসুফ জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন বিধায় গ্রেফতার হননি। এবারও জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি উচ্চমানের ধৈর্যের উদাহরণ পেশ করেন। জামায়াতে ইসলামী সরকারের অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। স্বনামধন্য আইনজীবী মি. এ.কে. ব্রোহীর নেতৃত্বে একটি টিম মামলা পরিচালনা করে। পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষে এবং পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয়। ১৯৬৪ সনের ৯ই অকটোবর জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’-এর শরীক দল হিসেবে ভূমিকা পালন ১৯৬৪ সনের ২০শে জুলাই ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইউব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এই জোটের নাম দেওয়া হয় ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’ (ঈ.ঙ.চ.)। এতে শরীক ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও নেযামে ইসলাম পার্টি। ১৯৬৪ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’ ১৯৬৫ সনের ২রা জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইউব খানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মি. মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতিমা জিন্নাহকে নমিনেশন দেয়। এই সময় জামায়াতে ইসলামী ছিলো বেআইনী ঘোষিত। নেতৃবৃন্দ ছিলেন জেলখানায়। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মাজলিসে শূরার যেইসব সদস্য জেলের বাইরে ছিলেন, তাঁরা ১৯৬৪ সনের ২রা অকটোবর একটি মিটিংয়ে একত্রিত হন। ‘আলোচনান্তে মাজলিসে শূরা অভিমত ব্যক্ত করে যে স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মহিলাকে রাষ্ট্রপ্রধান করা সমীচীন নয়। কিন্তু এখন দেশে চলছে এক অস্বাভাবিক অবস্থা। স্বৈরশাসক আইউব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে মিস ফাতিমা জিন্নাহর কোন বিকল্প নেই। এমতাবস্থায় সার্বিক অবস্থার নিরিখে জামায়াতে ইসলামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিস ফাতিমা জিন্নাহকেই সমর্থন করবে।’৪ ১৯৬৪ সনের ৯ই অকটোবর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ জেল থেকে মুক্তি লাভ করে উক্ত সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। নির্বাচনে আইউব খান পান ৪৯,৬৪৭ ভোট। মিস ফাতিমা জিন্নাহ পান ২৮,৩৪৫ ভোট। প্রেসিডেন্ট আইউব খানের চোখরাংগানি ও নানামুখী চাপ উপেক্ষা করে ২৮ হাজারের বেশি ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ মিস ফাতিমা জিন্নাহকে ভোট দেওয়ায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো দেশের রাজনৈতিক হাওয়া স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বইছে। আর এই হাওয়া সৃষ্টিতে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ছিলো খুবই বলিষ্ঠ।    (চলবে) তথ্যসূত্র : ১. আব্বাস আলী খান, জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৮৭। ২. প্রফেসর মাসুদুল হাসান, মাওলানা মওদূদী এন্ড হিজ থট, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৫২। ৩. প্রফেসর মাসুদুল হাসান, মাওলানা মওদূদী এন্ড হিজ থট, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪২৫। ৪. প্রফেসর মাসুদুল হাসান, মাওলানা মওদূদী এন্ড হিজ থট, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৭৩। লেখক : নায়েবে আমীর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির