post

রাশিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন ও মুসলিম বিশ্ব । সোলায়মান আহসান

৩০ আগস্ট ২০১৯

রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন ও মুসলিম বিশ্ব । সোলায়মান আহসান১৯৯০ সালের মাঝামাঝি এক সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর এক শব্দে রাশিয়ার অর্থনীতির অবস্থা বলার জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। জবাবে ইয়েলৎসিন বললেন ‘গুড’। আরেকটু বিস্তারিত দু’টি শব্দের মধ্যে তিনি এবার ইয়েলৎসিন বললেন, ‘নট গুড’ অর্থাৎ ভালো নয়। এই পুরনো কৌতুকটি সম্ভবত একটি জনশ্রুতি। তার রাশিয়ার অর্থনীতির অবস্থা যখন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তখনও ভালো ছিল না, এখনও খুব ভালো নয়। তার কারণ রুশ নেতৃত্ব বরাবর মানুষের চেয়ে শক্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। আধিপত্য ও প্রাধান্য বিস্তারকে গুরুত্ব দিয়েছে। বিশেষ করে আফগানিস্তান দখলের নেশা রুশদের চরমভাবে বিপর্যস্ত করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক দিয়ে। আফগানিস্তানকে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে দখলের প্রচেষ্টা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে চরমভাবে মূল্য দিতে হয়েছে। সামরিক দিক দিয়ে যেভাবে মার খেয়েছে তেমনি দীর্ঘ ৯ বছর আফগানিস্তানে মিলিত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে গিয়ে তাদের অর্থনীতি চরমভাবে ভেঙে পড়েছে। আর তার প্রতিক্রিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ ফুঁসে ওঠে। পারেননি মিখাইল গর্বাচেভ (গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট, ১৯৯০) ‘গ্লাসনস্ত’ (রাজনীতির সংশোধন) এবং ‘পোরস্ত্রয়কা’ (অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তন) ইত্যাদি সংশোধন তত্ত্বের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন রোধ করতে। বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫ টুকরা হয়ে পড়ে। এই ভাঙার দায় নিয়ে চলে যেতে হয় এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মুখে মিখাইল গর্বাচেভকে ১৯৩১ সালে। তিনি অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৫ মার্চ ১৯৯০ হতে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১ পর্যন্ত। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মিখাইল গর্বাচেভ বহুদিন পর ২০১৭তে টাইম ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাপী রাজনীতিকীকরণ ও নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার মুখে পারমাণবিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে পুতিন ও ট্রাম্পের প্রতি কঠোর হওয়ার আহবান জানান। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন মনে হচ্ছে বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্ব। গর্বাচেভ এর আগে পুতিনকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন সময় এসেছে রশিয়াকে পুনঃএকত্রীকরণের মাধ্যমে অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়ার। এই হলো গর্বাচেভের নীতির নমুনা। একদিকে তিনি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার আহবান জানাচ্ছেন, অন্যদিকে স্বাধীনতা লাভ করা পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৪ দেশকে একীভূত করার উদ্যোগ নিতে নসিহত করছেন। মূলত এমন এক দ্বিমুখী নীতির দ্বারা রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এর ফলে রাশিয়া তার অর্থনীতির চাকাকে আজতক সচল করতে পারেনি। এই ‘ভালো নয়’ অবস্থা থেকে উঠতে পারছে না রাশিয়া। আর শিগগিরই ভালো কোনো সময় আসবে এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পশ্চিম নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্যকে অবশ্য পঙ্গু করে দিয়েছে। রুশ কোম্পানিগুলোকে এখন বিদেশ থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নয়, বরং সারা বিশ্ব থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে রুশ কোম্পানিগুলোকে। এমনকি চীন থেকেও তারা কড়া শর্তে ধার নিচ্ছে। চীন অবশ্য আগে সহজ শর্তেই রাশিয়াকে ঋণ দিয়েছে। রাশিয়ার অর্থনীতি অন্য অনেক ক্ষেত্রেও সঙ্কটের সম্মুখীন। ২০১৫ সালে রাশিয়ার মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১৩ শতাংশ। ২০১৬ সালে সর্বাধিক লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়। বিশ্বব্যাংকের অনুমান অনুযায়ী রাশিয়ার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীর সংখ্যা ২০ মিলিয়নের বেশি বেড়ে ১৪০ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া এক দশক ধরে তেলের উচ্চ দাম এবং অস্ত্রবিক্রি থেকে গড়ে তোলা তহবিল দিয়ে এ পর্যন্ত বাজেটের ওপর দুরবস্থার প্রভাব খানিকটা কমাতে সক্ষম হলেও তবে রিজার্ভ সর্বনিম্ন ৪৪.৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এতদসত্ত্বেও রাশিয়া বিগত এক দশকে একটু একটু করে বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। রাশিয়া মানেই পুতিনের রাশিয়া। বলা হচ্ছে এ অন্য এক রাশিয়া। নব্বই দশকে ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল অংশটি রাশিয়া ফেডারেশন। এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ। কিভাবে হলো? একটু বিশ্লেষণে যাবো। এক সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির অফিসার ভ্লাদিনির পুতিন (১৯৫২) ছিলেন বরিস ইয়েলৎসিনের স্নেহধন্য। ইয়েলৎসিনের ক্ষমতায় আরোহণ করতে কেজিবির এই অফিসারের খানিকটা অবদান ছিল। পরবর্তীকালে পুতিনের সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার ব্যাপারেও ইয়েলৎসিনের স্নেহ-হাত অবদান রাখে। ইয়েলৎসিনের পদত্যাগের প্রেক্ষিতে পুতিন প্রাইম মিনিস্টার থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন। পরে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিনত হন (২০০৪)। রুশ সংবিধান মোতাবেক ২০০৮ এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকেন পুতিন। দিমিত্রি মেদভেদের হন প্রেসিডেন্ট। ২০১২তে পুতিন পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মেদভেদের তার রানিংমেট হিসেবে প্রধানমন্ত্রী যথারীতি। ২০১৭তে তিনি আবার ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যথারীতি প্রধান হন দিমিত্রি মেদভেদের। পুতিনের রাজনৈতিক জীবন কিন্তু ঘটনাবহুল। অনেকটা ধীর স্থিরভাবে পা ফেলে তিনি উঠে এসেছেন ক্ষমতার মগডালে। এবার তিনি রুশ সংবিধান পরিবর্তন করে নিয়েছেন। যার ফলে দু’বারের প্রেসিডেন্ট থাকার সাংবিধানিক বাধা উঠে গেছে। চীনের মতো রাশিয়াও সংবিধানে এ ধারার সংশোধন করে নেয়ায় এখন পুতিন এবং শি জিন পিং প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকতে পারবেন পরপর দুই টার্মের বেশি। এখন দেখার বিষয় এরা কতদিন থাকেন। পুতিন এখন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। রুশ জনগণ এবং সারা বিশ্বের সমাজতন্ত্র আদর্শে বিশ্বাসীদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি। সে স্বপ্ন বিশ্ব শাসন করার মতো শক্তিধর রাশিয়া ফেডারেশনের পুনরাভির্বারের। আইএস নির্মূলের নামে সিরিয়ায় সৈন্য পাঠিয়ে এবং বিমান আক্রমণ করে বাশার বিদ্রোহীদের দমন করে পড়ন্ত বাশার সরকারকে টিকিয়ে রাখার কৃতিত্ব দেখিয়ে পুতিন আলোচিত হন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাত থাকার বিষয়টিও পুতিনকে করেছে বিখ্যাত। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এটাকে গোড়া থেকেই অস্বীকার করে আসছেন। কিন্তু তদন্ত প্রক্রিয়াকে থামাতে পারেননি। পুতিনও এ ব্যাপারে তেমন জোরেশোরে তেমন কিছু বলেননি। মুচকি হেসে বোঝাতে চেয়েছেন দেখো আমার হাত কতো বড়। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বুলগেরিয়া পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি দেশসমূহের বিপর্যয়, আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্রের পরাজয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। ন্যাটোর মোকাবেলায় ওয়ারশ জোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও আর রইল না। কারণ সাত সদস্যের ওয়ারশ জোটের ৬ দেশই ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৪টি ইউনিয়নও আলাদা। এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশসমূহে হামলে পড়ে নানা দেশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা কোন কোন দেশ চরম পাষণ্ডনীতি অবলম্বনে গোটা বিশ্বকে আগুনের লেলিহান শিখার যন্ত্রণায় নিপতিত করে। ২৫টি বছর এক নম্বর সুপার পাওয়ার হিসেবে মার্কিনিরা বিশ্বের কোটি কোটি মানবশিশু নিধনের ‘হোলি’ খেলার উন্মত্ততায় মেতে ছিল। আর মুসলিম বিশ্বের মানচিত্রকে কামড়ে আঁচড়ে রক্তাক্ত করে ‘নরক বিলাস’ করেছে মার্কিনিরা। এ ব্যাপারে রুশদের ইতিহাসও তেমনি অন্ধকার। আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে ১৯৭৯ (২৪ ডিসেম্বর) হতে ১৯৮১ (১৫ ফেব্রুয়ারি) ২০ লক্ষ বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। ৫০ লক্ষাধিক আফগান নাগরিক বিভিন্ন দেশের শরণার্থী জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ৩০ লক্ষ বেসামরিক আফগান নাগরিক আহত অথবা পঙ্গুত্ব জীবনকে অসহায় করে দিয়েছে। আর সিরিয়ায় স্বৈর সরকার বাশারকে টিকিয়ে রাখতে রুশ বিমান আক্রমণ ও যুদ্ধে (২০১৫-র ৩০ সেপ্টেম্বর হতে ২০১৭ পর্যন্ত) ১৫ হাজারের বেশি বেসামরিক সিরীয় নাগরিক হাতাহত হয়েছে। পুতিন সিরিয়া থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও সামরিক অবস্থান ঠিকই ধরে রেখেছে। এমনকি রুশ এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম তারা সিরিয়ায় মোতায়েন করেছে। পুতিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং তার মিত্র পশ্চিমা দেশসমূহের প্রতি প্রথম চ্যালেঞ্জটি ছুড়ে দেয় এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত থাকা ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দ্বীপপুঞ্জ দখলে নেয়ার মাধ্যমে (২০১৪)। ন্যাটো জোটভুক্ত ইউক্রেন তার সীমিত শক্তি দিয়ে রুশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা রুশ বাহিনীর কাছে সেই প্রতিরোধকে কার্যকর করতে পারেনি। পরে ক্রিমিয়া দ্বীপপুঞ্জের রুশরা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে যা পশ্চিমা দেশগুলোকে তাক করে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা দেশসমূহ তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম (ইন্ডিপেন্ডেন্ট)ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, রাশিয়া চাইলে রাতারাতি পোল্যান্ড দখল করে নিতে পারে। অতি সহজে ন্যাটো জোটকে হকচকিত করে দিতে পারে। এক সমীক্ষায় এ কথাও বলা হয়েছে তা সত্ত্বেও এখনই ন্যাটোকে সারাসরি চ্যালেঞ্জ কারার কোনো ইচ্ছে মস্কোর নেই। পুতিন অত্যন্ত ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের রাষ্ট্রনায়ক তা ইতোমধ্যে তিনি প্রমাণ রেখেছেন। ২০১৮তে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনসহ একে একে ১৪টি ইউরোপীয় দেশ হতে শতাধিক রুশ কূটনীতিক বহিষ্কার করা হলো তখন ধারণা করা হয়েছিল বুঝি বা পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মস্কো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে। কিন্তু পুতিনের মুখপাত্র এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এমন সিদ্ধান্তকে ‘উসকানিমূলক’ ইটের বদলে পাটকেল নীতিতে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও তেমন কিছু ঘটেনি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল। এদিকে ন্যাটোর ভাঙন বেশ স্পষ্ট। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রেক্সিট নিয়ে ব্রিটেন ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু লেজটা আটকে আছে ব্রিটেনের এখনো। তা নিয়ে ব্রিটেনে রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। তুরস্ক ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে। তুরস্ক হচ্ছে ন্যাটো জোটের ২৮ সদস্য রাষ্টের মধ্যে দ্বিতীয় শক্তিধর দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্র্ক ভালো যাচ্ছে না। ২০১৭ সালে এরদোগানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুথানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বিরোধী দলনেতা ফেতুল্লা গুলেনকে নেতৃত্ব দানকারী মনে করা হয়। আঙ্কারা গুলেনকে তাদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে যা যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাখ্যান করে। শুধু গুলেনকেন্দ্রিক নয়, নানা কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের টানাপড়েন দিন দিন জটিল হতে চলেছে। তুরস্ক তার নিরাপত্তার স্বার্থেই রাশিয়া থেকে বর্তমান বিশ্বের অত্যাধুনিক মিসাইল সিস্টেম এম -৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ব্যাপারে আগ্রহী এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে। ওই মিসাইল সিস্টেম ক্রয় করলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্বের চুক্তিকৃত এবং অর্থপরিশোধিত স্টিলথ যুদ্ধবিমান এফ-৩৫ সরবরাহ করতে অস্কীকৃতি জানায় তুরস্ককে কিন্তু রাশিয়া থেকে ওই ক্ষেপণান্ত্র সিস্টেম কেনার ব্যাপারে তুরস্ক অনড়। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইঁদুর বিড়াল খেলায় বাদ সেধেছে তুরস্ক এখন। সে সঙ্গে ইরানও একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খেলায়। কাতারের ব্যাপারে সৌদি আরবসহ কতিপয় দেশ ২০১৭ সালে যে অবরোধ আরোপ করেছিল তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এক গভীর কূটচাল। কিন্তু তুরস্ক তা অনুধাবন করে সময়মতো কাতারের পাশে দাঁড়ানোয় যুক্তরাষ্ট্রের ওই কূটচাল ব্যর্থ হয়। ইরানও সে সময় বলিষ্ঠ ভূমিকা নেয় তুরস্কের পাশাপাশি। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও কম দৌড়ঝাঁপ করেননি। কিন্তু পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে সৌদি আরবের প্রতি মুখাপেক্ষী হওয়ায় তেমন দৃঢ় ভূমিকা নিতে পারেনি। কিন্তু তুরস্ক ও ইরান সব ধরনের ঝুঁকি উপেক্ষা করেন কাতারের পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং এখনও রয়েছে তারা। সে সময় কাতারকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ১২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয় চুক্তি করিয়ে নেয় (১৫.৬.২০১৭)। এর মাত্র এক মাস আগেই ট্রাম্প সৌদি আরব সফরে এসে ঝট করে ১১শ বিলিয়ন ডলারের আরেকটি অস্ত্রক্রয় চুক্তি করিয়ে নেয়। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিয়াল দায়িত্ব পালনের এ যাবৎকালের মধ্যে মার্কিনিদের জন্য ওই ১২২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ব্যবসায়ই উল্লেখযোগ্য অর্জন। এখন পরিস্থিতি বুঝে সৌদি অরব ইরান আরব আমিরাত রাশিয়ার কাছ থেকে এম-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম কেনার জন্য দরাদরি করছে। তবে রাশিয়া তুরস্ককে ওই সিস্টেম দিলেও অন্যরা পেতে পারবে কিনা সন্দেহ। এবার আমরা বর্তমান বিশ্ব ভূরাজনীতির পালাবদল রাশিয়ার অবস্থান এবং মুসলিম বিশে^র সঙ্কট নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করব। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতক নীতির জন্য বিশ্বের মুসলিম দেশসহ অনেক দেশ এখন নতুন সখ্য খুঁজছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় গোটা বিশ্ব ছিল কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। অপর ভাগ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। তখনো চীনের উত্থান ঘটেনি। চীন নীরবে বিশ্বের ঘটমান বাস্তবতা থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে এগিয়ে যাওয়ার সাধনায় ছিল ব্যাপৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পরবর্তী সময়ে সমগ্র বিশ্ব যখন ওই দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার নিগড়ে আবদ্ধ সেই বন্ধন হতে মুক্তি পেতে নিজেই আন্দোলন বা জোটনিরপেক্ষ দেশ থাকার একটা প্রচেষ্টা হয়েছিল। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওই নির্জোট আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। জোটনিরপেক্ষ বা নির্জোট আন্দোলনের (The non-Aligned Movement-NAM) সদস্য রাষ্ট্রগুলো নীতিভ্রষ্ট হয়ে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ঝুঁকে পড়ে বৃহৎশক্তির দেশের প্রতি। পরিস্থিতি চরমভাবে একদিকে হেলে পড়ে নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়েনের বিলুপ্তি ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দেশসমূহের বিপর্যয়ে। আর এ পরিস্থিতিতে মুসলিম দেশসমূহ দলে দলে ভিড় করে মার্কিনিদের ছত্রছায়ায়। ১৯৬৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের একান্ত বশংবদ শাহ মো: রেজা পাহলভীর পতনের মাধ্যমে প্রথম ধাক্কা খায় মার্কিনিরা। ফ্রান্সে অবস্থান করে ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী একটি সফল বিপ্লবের নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর রাষ্ট্রের মিত্র সরকারের (রাজতান্ত্রিক) পতন ঘটানোর একটি বিস্ময়কর বিষয় ছিল। একই সময় (১৯৮৯) আফগানিস্তানে রুশ বাহিনীর পরাজয় এবং ইসলামী আদর্শের দলগুলোর ক্ষমতা গ্রহণ মুসলিম বিশ্বকে এক উৎসাহ ও আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। কিন্তু এ পরিস্থিতি বেশিদিন স্থিতিশীল থাকতে দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা দেশসমূহ। আমেরিকার বিশ্বাসঘাতক নীতি সর্ববিদিত। আর এ কারণেই এক সময় ইরাক লিবিয়া, আলজেরিয়াসহ অনেক দেশ রাশিয়ামুখী হয়েছিল। বিশেষ করে ইসরাইলকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কতিপয় পশ্চিমা দেশের মুসলমানদের সঙ্গে যে পাশাখেলা চালিয়ে আসছে যার কারণে মুসলিম দেশগুলো শক্তিশালী আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হয়। সে আশ্রয়টি হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশসমূহ বরাবর মুসলিম শক্তিকে বিনষ্ট করা খর্ব করা, ঐক্যে ফাটল ধরানো এবং সম্পদ কুক্ষগত করার নীতি অবলম্বন করে এসেছে। তাদের পাতা ফাঁদে পড়ে বার বার মুসলিম দেশসমূহ হারিয়েছে মানুষ ও প্রাকৃতির মূল্যবান সম্পদ। একমাত্র ইরান ইসলামিক রিপাবলিক মার্কিনি দোসরদের হাতে ধরা দেয়নি। তেমনি ইরানের ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে পারেনি নস্যাৎ করতে। তবে শিশু ইসলামী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য ইরাককে দিয়ে ইরানকে আক্রমণ করিয় দীর্ঘ ৯ বছর সেপ্টেম্বর ১৯৮০-আগস্ট ১৯৮১। সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। ইরাককে যুক্তরাষ্ট্রর পশ্চিমা দেশসমূহ এই মর্মে আশ্বস্ত করেছিল যদি ইরানকে আক্রমণ করে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ায় ইরাক তাহলে যুদ্ধের যাবতীয় ব্যয়ভার এবং অস্ত্রশস্ত্র তারাই বহন করেবে। এই প্রস্তাব সাদ্দাম হোসেন লুফে নেয় এ কারণে সাদ্দাম আরব দেশমূহের মধ্যে নিজেকে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ করতে চায়। এমনিতে সাদ্দাম ছিলেন রাশিয়াপন্থী বাম দল বাথ পার্টির নেতা। ইরাকের সামরিক শক্তির উৎস ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্বজার্মানি বুলগেরীয় দেশসমূহ। ইরান আক্রমণের পুরস্কার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদেশসমূহের নিকট হতে অস্ত্র প্রাপ্তি সাদ্দাম নিজের শক্তি বৃদ্ধির এক মহার্ঘ সুযোগ হিসেবে দেখলেন। কিন্তু শেষতক দীর্ঘ দিনের এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ অমীমাংসিত অবস্থায় থামে। ইরানের ত্যাগী জনগণ এবং সেনাবাহিনী অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইসলামী আদর্শের ওই দেশটিকে রক্ষা করে। তবে প্রচুর সম্পদ ও লোকজনের হানি ঘটে ওই পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধে। সাদ্দাম হোসেন যুদ্ধ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যে এবং পশ্চিমা অন্যান্য দেশসমূহ হতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র হাতিয়ে নেয়। কিন্তু যুদ্ধ থেমে গেল এই সরবরাহ ও আর্থিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের কারণে বহির্বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় আসে চরম মন্দা। তেল খনিগুলোর অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইরাকের অর্থনীতিতে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। এ সময় আরেক দুর্বুদ্ধি দেয় সাদ্দামকে কুয়েত দখল করে নেওয়ার। এই দুর্বুদ্ধি আসে সিআইএর এজেন্ট ইরাকের সে ময়কার ভাইস প্রেসিডেন্ট তারিক আজিজের কাছ থেকে। সাদ্দামকে বোঝানো হয় যদি সম্পদশালী শক্তিহীন কুয়েতকে দখল করে নেয়া হয়, তাহলে তাদের দেশ আর্থিকভাবে এতো লাভবান হবে যার প্রেক্ষিতে খুব অল্প সময়ে ইরাক হয়ে উঠতো মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে শক্তিশালী দেশ। সাদ্দাম ইরানের কাছে পরাজিত হওয়ায় এমনিতেই ছিলেন মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত। তাই ওই আত্মঘাতী পরামর্শ তিনি লুফে নেন। গভীর রাতে সাদ্দামের বাহিনী অতর্কিত কুয়েত আক্রমণ করে বসল (২ আগস্ট ১৯৯০) সামরিক শক্তি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ায় খুব অল্প দিনেই পতন ঘটল ইরাকি বাহিনীর হাতে কুয়েতের। ইঙ্গ-মার্কিন ও পশ্চিমাদেশসমূহ দ্রুত এগিয়ে এলো কুয়েতসহ অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যর দেশসমূহকে রক্ষা করতে আগ্রাসী সাদ্দামের হাত হতে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক পাস হলো ইরাকের বিরুদ্ধে যৌথভাবে পাল্টা অক্রমণ করার। যুদ্ধের প্রথম দিনে দেড় শ’ মার্কিন বিমান একসঙ্গে বোমাবর্ষণ করে এবং ৯৮টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। ৪৪ দিনব্যাপী ইরাকে অপারেশন ডেজার্ট স্পম সামরিক অভিযান পরিচালনা করে মার্কিনিরা ইরাকের গোটা অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়। এ যুদ্ধে ইরাকের পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটে। বোমার প্রতিক্রিয়ায় ক্যান্সারসহ মারাত্মক রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে ইরাকে। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ১৫ লাখ ইরাকি শিশু নিহত হয়েছে। এ ছাড়া লাখ লাখ ইরাকি নিজ দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছে দীর্ঘ দিন। একই নাটক মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিল ২০১৭ এর শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে দিয়ে। কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি আরবসহ তার মিত্র ৮ দেশ যে অবরোধ ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দিয়েছিল তা মূলত মার্কিনিদের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত নতুন ষড়যন্ত্র। এটা ট্রাম্পের কথায়ই প্রকাশ পায়। ট্রাম্প মুখ ফসকে বলে ফেলেন সৌদি আরব যা করছে তা তার চিন্তাধারার বিরোধী কিছু নয়। কিন্তু তুরস্ক এবং ইরান সেই ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয়। সৌদি আরবকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রর খেলা থেমে থাকেনি, আজো চলছে। সৌদি আরবকে দিয়ে ইয়েমেনের আক্রমণ করানো এবং ইরানকে প্রাতপক্ষ দাঁড় করিয়ে জুজুর ভয় দেখিয়ে অস্ত্র বিক্রির ব্যবসায় বেশ চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিনিরা। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস অন্ধকারাচ্ছন্ন। বিশেষ করে দেশে দেশে সামরিক আগ্রাসন এবং নিষ্ঠুরতার পরিসংখ্যান বলছে এই দেশটি বিশ্বশান্তির জন্য বরাবর থেকেছে হুমকি হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে (এমনিতেই যুদ্ধ থেমে যেতো এমন পরিস্থিতিতে) শুধুমাত্র পরীক্ষা করার অভিলাষে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে যে কলঙ্ক ইতিহাস রচনা করেছে তা বিশ্ববাসী আজো ভুলে নাই, ভুলে যাওয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র অধিকাংশ সময় সরাসরিভাবে নয়, এজেন্টের মাধ্যমে দেশের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিংবা নষ্ট রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক হয়ে বিশ্বাসঘাতক মানসের ব্যক্তিকে ক্ষমতার শীর্ষে বসিয়ে সেই দেশ থেকে ফায়দা লুটে থাকে। ইরানের বিপ্লবকে বিপথগামী করতে বিপ্লবোত্তর প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আবুল হাসান বনিসদর (১৯৩৩) দ্বারা সেই চেষ্টা করেছিল। বনি সদর সিআইএর এজেন্ট তা আয়াতুল্লাহ খোমেনি বুঝতে পেরেই দ্রুত সরিয়ে দিয়ে মোহাম্মদ আলী রাজায়িকে বসান। উল্লেখ্য, ইরানের বর্তমান ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পুরোপুরি ইসলামী আদর্শের মডেল বলা যবে না। যেহেতু ইসলাম কোনো বিভেদ স্বীকার করে না। ইরানের রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা আছেন তারা শিয়া মতাবলম্বী হিসেবে পরিচয় দেন। এক সময় আয়াতুল্লাহ খোমেনি মরুহুম বলেছিলেন শিয়া-সুন্নি ফারাক নিস্ত ( অর্থাৎ শিয়া-সুন্নির পার্থক্য নেই) তা পরবর্তীতে তেমন কার্যকর দেখা যায়নি। ইরানের মদদেই বিভিন্ন দেশে ‘কুর্দি সঙ্কট’ দেখা দিয়েছে। তার বৃহত্তর মুসলিম স্বার্থ রক্ষায় ইসরাইলের মত ইসলাম ও মুসলমানের চরম শক্রকে মোকাবেলায় ইরানকে অবশ্যই দরকার। এখন বর্তমান বিশ্ব পরিস্থতির আলোকে মুসলমান ও মুসলিম দেশসমূহের কী করণীয় তা সংক্ষেপে আলোচনা করব। জোনাথন আরনস্ট নামের একজন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বিগত বছরে একটি নিবন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যেমন বিশ্ব পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল, বর্তমান সময়ে তেমনটা দেখা যাচ্ছে। তার মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় পার করছে বিশ্ব। হ্যাঁ আমরাও লক্ষ্য করছি নানা স্থানে, দেশে যুদ্ধ প্রস্তুতির দুরন্ত তোড়জোড়। যৌথভাবে এককভাবে সামরিক মহড়া। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন চীনের টানটান উত্তেজনা। শক্তি লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় স্নায়ু যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর মার্কিনি ও পশ্চিমাবিশ্বের গোটা বিশ্বে আস্ফালন, তৎপরবর্তীকাল তৃতীয় পরাশক্তি হিসেবে গণচীনের উত্থান ভিন্ন এক বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মনে হয় আমরা এক মহাযুদ্ধের কাছাকাছি এসে গেছি। সে আশঙ্কাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভূরাজনীতির আঁতাত-দাঁতাতের সমীকরণ পাল্টে যাচ্ছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে মুসলিম দেশসমূহের উল্লেখযোগ্য শক্তি পাশ ফিরে যাচ্ছে মার্কিনিদের সঙ্গে সম্পর্ক আলগা করে ছুটে যাচ্ছে কেউ কেউ রাশিয়ার দিকে। শুধু মুসলিম দেশ কেন পশ্চিমাদেশগুলোর মধ্যে অনেকেই মার্কিনিদের ওপর ভরসা রাখছে না। জার্মানিরা মার্কিননির্ভরতা বাদে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবছে। ন্যাটোর সঙ্গে মার্কিনিদের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। জাপানও মার্কিনিদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। অপর দিকে রাশিয়ার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলছে জাপান। অনেক দেশ চীনের সঙ্গে বিবাদে না জড়িয়ে নিজের ক্ষতি মেনে নিয়েই সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যস্ত। আসিয়ানভুক্ত অনেক দেশই দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বন্দ্ব থেকে নিজেদের সরিয়ে চীনা বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। এমতাবস্থায় মুসলিম বিশ্বকে ভাবতে হবে কে দেবে সত্যিকার নিরাপত্তার গ্যারান্টি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? রাশিয়া? না চীন? এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব মত মুসলিম বিশ্বকে এরা কেউই নিরাপত্তা দেবে না। দিতে পারে না। অতীত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। তাই মুসলিম বিশ্বের নিরাপত্তা বিধানে মুসলিম দেশসমূহকে এক নয়া শক্তির জোট গঠন করতে হবে। নির্জোট আন্দোলন। ওআইসি আরব লিগ প্রমুখ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো ব্যর্থ হয়েছে। আর জাতিসংঘ সারা বিশ্বের ৭৩৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষের (বিশ্ব জনসংখ্যা রিপোর্ট ২০১৫ জাতিসঙ্ঘ) এ পৃথিবীকে পারেনি দিতে নিরাপত্তা ও মানবতার গ্যারান্টি। তা হলে? অতএব, মুসলিম দেশের এক নয়া জোট আজ সময়ের দাবি। সেটা কিভাবে সম্ভব, কতদূর এগিয়েছে তা নিয়ে হতে পারে আরেকটি বিশ্লেষণ।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির