post

শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা: একটি প্রেরণা একটি ইতিহাস

২৩ মার্চ ২০১৪
AK Mollah   ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ সাল ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। এই দিনটি ইতিহাসে একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই দিনে বিশ্বের ইতিহাসে একজন নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে রাষ্ট্রীয় আয়োজনের মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ইতিহাস হয়তো একদিন প্রমাণ করবে এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। দার্শনিক সক্রেটিসকে হ্যামলক বিষ প্রয়োগে হত্যার রায় দিয়েছিল আদালত। আদালতই যিশু খ্রিষ্টকে (হজরত ঈসা আ) শূলে চড়িয়ে হত্যার রায় দিয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় আদালতের নির্দেশেই। হাজার বছর পর এসে প্রমাণিত হয়েছে তিনটি রায়ই ভুল রায় ছিল। বিচার-ইতিহাসে এ ধরনের রায়ের অসংখ্য নজির রয়েছে, যার ভিত্তিতে কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তি হত্যার পর প্রমাণিত হয়েছে, আদালতের দেয়া রায়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ছিল না। জামায়াত নেতা জনাব আবদুল কাদের মোল্লার বিষয়েও হয়তো ভবিষ্যতে এমনটি বলা হতে পারে, যে রায়ের ভিত্তিতে তাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে তা সঠিক ছিল না। এই জন্যই আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাকলোয়েন চার্লস মানুষের দুর্দশার চিত্র আঁকতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমার মতে ইতিহাসের কোনো যুগেই কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এত কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়নি, প্রশাসনের সামনে বিচার বিভাগ কখনও এতটা অসহায়ত্ব বোধ করেনি, এ বিপদ অনুভব করা এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্বে কখনও চিন্তা করার এতটা তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়নি যতটা আজ দেখা দিয়েছে।’ পৃথিবীর সব নীতি-নৈতিকতা, মানবাধিকার, সব উপেক্ষা করে যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি একাধারে একজন রাজনীতিবিদ, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, লেখক, ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও সদালাপী প্রাণপুরুষ। তিনিই রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সেদিন শুধু একজন আবদুল কাদের মোল্লাকেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে মানবাধিকার, সত্যপন্থা, কল্যাণ, সুন্দর আর ন্যায়ের প্রতীক আবদুল কাদের মোল্লাকে। যিনি নিজেই তার দীর্ঘ সাফল্যমণ্ডিত কর্মের আবিষ্কারক। যিনি ২ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার জরিপারডাঈী গ্রামে পিতা মো: সানাউল্লাহ মোল্লা এবং মাতা বাহেরুন্নেসা বেগমের ঘরকে আলোকিত করে এই পৃথিবীতে আগমন করেন। মেধাবী আবদুল কাদের মোল্লা শিক্ষাজীবন শুরু করেন ১৯৫৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষাবৃত্তি লাভ করার মধ্য দিয়ে, আর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৭ সালে শিক্ষা প্রশাসন থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। সেই পথ ধরে কর্মজীবনের পরতে পরতে রাখেন সাফল্যের স্বাক্ষর। জনাব আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকার বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক এবং একই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে। এরপর তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর সংস্কৃতি কর্মকর্তা, ১৯৭৮ সালে রিসার্চ স্কলার হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী সেন্টার, ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় পারদর্শী জনাব আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৮১ সালে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। সেখানেও যেন হারবার নয়। তিনি ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে পরপর দুই বছর ঢাকা ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট (ডিইউজে)-এর সহসভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই তার কর্মময় জীবনের সাক্ষী। তার পরিচয় তিনি নিজেই। চলনে-বলনে, সহজ-সরল আর সাদাসিধে, বুদ্ধি-বাগ্মিতায় অসাধারণ, কর্মপ্রাণ চঞ্চলতায় যেন সর্বত্র বিরাজমান, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও নিরহঙ্কার, পরোপকারী এবং সজ্জনব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। যিনি একবার তার সাহচর্য পেয়েছেন তিনি তাকে ভুলতে পারবেন না। কারাগারে অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত থেকে তার আচার-ব্যবহারের প্রশংসা শুনেছি। দ্বীনের দায়ী হিসেবে সারা বাংলাদেশে নয়, বরং ছুটে বেড়িয়েছেন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর অনেক প্রান্তে। মিথ্যা কালিমা আর ষড়যন্ত্রের কালো কাপড় কি সেই আলোকচ্ছটাকে আবৃত করতে পারে? যেই শির আজন্ম এক পরওয়ারদিগার ছাড়া কারও কাছে নত হয়নি, ফাঁসির আদেশে সেই শির কি দুনিয়ার কোনো শক্তির কাছে নতি স্বীকার করতে পারে? শাহাদাতের পূর্বে আল্লাহর দ্বীনের মুজাহিদের জবানীতে এমন সাহসী উচ্চারণ উদ্দীপ্ত করেছে সারা বিশ্ববাসীকে। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলনের জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। আমি অন্যায়ের কাছে কখনও মাথা নত করিনি, করব না। দুনিয়ার কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট প্রাণভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। জীবনের মালিক আল্লাহ। কিভাবে আমার মৃত্যু হবে তা আল্লাহই নির্ধারণ করবেন। কোনো ব্যক্তির সিদ্ধান্তে আমার মৃত্যু কার্যকর হবে না। আল্লাহর ফয়সালা অনুযায়ীই আমার মৃত্যুর সময়ও তা কার্যকর হবে। সুতরাং আমি আল্লাহর ফয়সালা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেবো।’ কাজেই এ দুনিয়ায় কিভাবে প্রাণ বাঁচিয়ে চলতে হবে এটা চিন্তার নয়। বরং আসল চিন্তার বিষয় হলো ঈমানকে কিভাবে বাঁচানো যাবে, কিভাবে থাকা যাবে আল্লাহর আনুগত্যের গণ্ডির মধ্যে। যদি দুনিয়ায় প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঈমান হারিয়ে ফেলে তা তো বিরাট এক ব্যর্থতা। তাহলে সে ঈমানের মূল্য কী? আর ঈমান বাঁচাতে যদি দুনিয়ায় প্রাণ বিসর্জিত হয় তাহলে এ এক মহা সফলতা। এমন মৃত্যু সত্যিই গৌরবের। এই মৃত্যুকে অভিনন্দন। শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা সত্যিই অনেক সৌভাগ্যের অধিকারী। তার মর্যাদা আসলেই ঈর্ষনীয়। সুতরাং প্রাণের জন্য উৎসর্গিত ঈমান আর ঈমানের জন্য উৎসর্গিত প্রাণ বড়ই ব্যবধান। হজরত রাশেদ বিন সা’দ জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন। ‘কোনো এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা)! কবরে সকল মুমিনের পরীক্ষা হবে, কিন্তু শহীদের হবে না, এর কারণ কী? হুজুর (সা) জবাবে বলেন, তার মাথার ওপর তলোয়ার চমকানোই তার পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট।’ জন্ম থেকে শাহাদাত পর্যন্ত জনাব আবদুল কাদের মোল্লা একটা নাম, একটা প্রেরণা, একটা জীবন্ত ইতিহাস। রাজনীতিসচেতন জনাব আবদুল কাদের মোল্লা অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালেই কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর মাওলানা মওদূদী (রহ) লিখিত তাফহীমুল কুরআন পড়ে আলোকিত জীবনের সন্ধান পেয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে তিনি তৎকালীন সময়ে মেধাবী ছাত্রদের সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ পূর্ব পাকিস্তান শাখায় যোগদান করেন। চৌকস নেতৃত্বের অধিকারী জনাব মোল্লা ছাত্রসংঘের শহীদুল্লাহ হল সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি ও একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে জামায়াতে যোগ দেন এবং সর্বশেষ তিনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। জনাব আবদুল কাদের মোল্লা বিভিন্ন মেয়াদে চার-চারবার কারাবরণ করেছেন। আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের দায়ে ১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতো তিনি বাম রাজনীতিক হিসেবে গ্রেফতার হন। ১৯৭২ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন কিন্তু স্থানীয় জনতার বিক্ষোভের মুখে পুলিশ তাকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশন কাস্টোডি থেকেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়! জেনারেল এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কারণে আবদুল কাদের মোল্লাকে আবারও আটক করে রাখা হয়। পরে উচ্চ আদালত তার এ আটকাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করলে চার মাস পর তিনি মুক্ত হন। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আন্দোলন করায় তৎকালীন বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে তাকে আটক করে। যাকে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী বানিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তিনি যুদ্ধাপরাধ তো দূরের কথা স্বাধীনতার সপক্ষে একজন যোদ্ধার প্রস্তুতিই নিয়েছেন। এবার শুনুন জনাব আবদুল কাদের মোল্লা সেইফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদের ’৭১ সালে তার ভূমিকা নিয়ে যা বললেন। তিনি বলেন, ‘২৩ মার্চ, ১৯৭১ ওই দিন আমরা ১২টার সময় জেসিও সম্ভবত উনার নাম ছিল মফিজুর রহমানের ডাকে আমরা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্র এবং স্কুলের উচ্চ শ্রেণীর কয়েকজন ছাত্র একত্রিত হই। মফিজুর রহমান সাহেব আমাদেরকে বললেন, তিনি বিকেল থেকেই আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেবেন এবং সেই লক্ষ্যে তিনি কিছু কাঠের তৈরি ডামি রাইফেল জোগাড় করেছেন। তিনি আরও বললেন, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। তাই আমাদেরকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা ওইদিন বিকেলে তার পরামর্শমতো ৩০-৪০ জন একত্রিত হই। তিনি প্রাথমিক পরীক্ষা নেয়ার পর ২-১ জন বাদে প্রায় সবাই প্রশিক্ষণ নেবার জন্য মনোনীত করেন এবং ঐদিন থেকেই আমরা পিটি, প্যারেড শুরু করি। তিনি প্রথম তিন দিন আমাদেরকে ডামি রাইফেল দেননি। পরে ২০-২১টি ডামি রাইফেল আমাদেরকে দেন এবং এই রাইফেলগুলো দিয়েই আমরা প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকি।’ আবদুল কাদের মোল্লাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে। কিন্তু রাতের একান্তে নিভৃতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের বিবেককে যদি প্রশ্ন করেন, আপনি কি কসাই কাদেরকে হত্যা করেছেন? আমার মনে হয়, উত্তর হবে ‘না’।AK Mollah-01 আপনি জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে হত্যা করেছেন। যিনি এখন আপনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। এক সময় তিনি আপনার রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন। একসময় একান্ত নিভৃতে ডেকে রাজনৈতিক শলা-পরামর্শও করেছেন তার সঙ্গে। আবদুল কাদের মোল্লা সেইফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদের বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে জামায়াত এবং বিএনপি আলাদাভাবে নির্বাচন করে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একপর্যায়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং আমাকে বললেন, আমরা তো সরকার গঠন করলাম, আমাদের কিছু পরামর্শ দেন। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর মুখ্যসচিব ছিলেন এবং তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে রিসিভ করেন। আমি তখন প্রধানমন্ত্রীকে কিছু গঠনমূলক পরামর্শ দেই যা শুনে তিনি আমাকে সাধুবাদ দেন। একইভাবে তিনি পরে আমাকে আরও দুইবার ডেকেছিলেন। এখন আমি মনে করছি দীর্ঘদিন যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলন করলাম, মিটিং-মিছিল করলাম, সুসম্পর্ক রাখলাম, সখ্য রেখে চলেছি তারা এখন শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য দীর্ঘ ৪০ বছর পর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জাতির জিজ্ঞাসা, যে কুখ্যাত, হত্যাকারী কসাই কাদেরকে জাতি চিনত, তাহলে আপনি কি সেই কসাই কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন? আমরা রাজনৈতিক চোরাবালিতে এতটাই আটকে গেছি তা সত্যিই জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। শেখ হাসিনা আজ তার শত্রæ কাদের মোল্লাকে হত্যা করেছেন শুধু রাজনৈতিক কারণে আর প্রভুদের খুশি করতে। আর বিরোধীদলীয় নেত্রী আজ তার রাজনৈতিক জোট মিত্র কাদের মোল্লার মৃত্যুতেও প্রকাশ্যে সমবেদনা জানাতে পারেননি, তাও রাজনৈতিক কারণেই। যদিও হয়তো তিনি ব্যথিত। শেখ হাসিনা হয়তো এখন বিস্মিত!! কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এত কুৎসা রটনার পরও তিনি যে আজ পৃথিবীবাসীর কাছে বিখ্যাত আর এত জনপ্রিয়। ফরিদপুরের অজগ্রামের আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যু এখন সারা পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর প্রেরণা। যিনি অর্থবৃত্তে ধনী অথবা দুনিয়ার ক্ষমতাশালী কোনো ব্যক্তিও ছিলেন না। কিন্তু এমন সৌভাগ্য জীবনের অধিকারী তিনি হলেন সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার গায়েবানা জানাজায় অংশগ্রহণ করেছে। কেয়ামত পর্যন্ত কোটি মুসলমান তার জন্য দোয়া করতে থাকবে। তাহাজ্জুদে চোখের পানিতে জায়নামাজ ভাসাবে। এমন গৌরবের মৃত্যু কতজনের ভাগ্যে জোটে!! আর এদেশের মানুষ অনেক জাতীয় নেতার মৃত্যুও দেখেছে, ভালো করে জানাজা পড়ার লোকও আসেনি। আইন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা যায়, স্যালুট আদায় করা যায়, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যায় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খোঁজ নিয়ে দেখবেন কি, যে কারাগারে আপনি আবদুল কাদের মোল্লাকে আটকে রেখেছিলেন, সেই কারাগারে যারা মোল্লা সাহেবের খেদমত করেছেন তাদের অনুভূতি এখন কেমন। অবাক হয়ে যাবেন এই মানুষগুলোর কথা শুনলে! আপনি অবাক হবেন তাদের কান্না দেখলে! কাদের মোল্লার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দেখলে! আমি কারাগারে কিছু দেখে এসেছি। আবদুল কাদের মোল্লাকে যেদিন কাশিমপুর থেকে ফাঁসির রায় কার্যকরের জন্য ঢাকা আনা হয়েছে, সেদিন অসংখ্য হাজতি-কয়েদি নির্বাক হয়ে চোখের পানি ঝরিয়েছে। এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কয়জনের ভাগ্যে জোটে? আবদুল কাদের মোল্লা সাহেবের কারাসঙ্গীরা তার মৃত্যুর বেদনায় এখন কাতরাচ্ছে! চাঁদা তুলে গোশত বিতরণ করে তার জন্য দোয়া করছে। কিন্তু বেদনার কথা হচ্ছে আবদুল কাদের মোল্লার সন্তানেরা আর আব্বা বলে কাউকে ডাকতে পারবে না। সহধর্মিণী আর স্বামী ফিরে পাবেন না। কিন্তু চোখের পানি কি বৃথা যাবে? আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পরিবারের দাবি : বিচার বিভাগের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কাদের মোল্লাকে হত্যা করা হয়েছেÑএমনই মন্তব্য করেছেন কাদের মোল্লার আইনজীবী, পরিবারের সদস্য, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল ও বিভিন্ন সংস্থা। কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গত বছর ৫ ফেব্রæয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইন সংশোধন করে আপিল করে সরকার। আপিল বিভাগের দ্বিধাবিভক্ত রায়ের ভিত্তিতে গত ১৪ ডিসেম্বর রাতে তড়িঘড়ি করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হওয়ার পর থেকেই জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থা রায়ের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তা কার্যকর করা থেকে সরকারকে বিরত থাকার আহŸান জানায়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের কথিত অভিযোগে আটক, বিচারপ্রক্রিয়া, সরকার পক্ষের অনুসন্ধান ও তথ্য-প্রমাণ, তদন্ত কর্মকর্তা ও সরকারি আইনজীবীদের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা, বার বার আইন সংশোধন করে ফাঁসির উপযোগী করা, অপরাধ নয় আওয়ামী লীগ ও শাহবাগীদের দাবিই বিচার্য বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করা, সাক্ষী নিয়ে সরকার পক্ষের লুকোচুরি খেলাসহ ফাঁসির রায় আদালতে সরকার পক্ষের জবরদস্তিমূলক আচরণে বিচারের মানদণ্ড নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। ফরিদপুরের আবদুল কাদের মোল্লাকে মিরপুরের কুখ্যাত কসাই কাদের রূপ দিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পর আইনজীবীরা আদালত ও সরকার পক্ষের কাছে যেসব প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পাননি সেগুলো হলোÑ আদালতে মোমেনা পরিচয় দিয়ে যে মহিলা কাদের মোল্লার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি একাত্তরে নির্যাতিতা ও স্বজন হারানো মোমেনা নন। প্রকৃত মোমেনা আদালতে সাক্ষ্য দিতেই আসেননি। মিরপুরের ‘কসাই কাদের’ ও ফরিদপুরের মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারের বাসায় থাকা কাদের মোল্লা এক ব্যক্তি নন। কাদের মোল্লা যদি মিরপুরের বহুল আলোচিত ‘কসাই কাদের’ হন তাহলে তিনি কী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে থেকে পড়ালেখা করে ১৯৭৭ সালে পাস করে বের হন? মেধাবী ছাত্র হিসেবে স্বীকৃতির পর কী করে সরকার তাকে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে উদয়ন স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ দেন? মাত্র এক বছর পর প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার মর্যাদায় তাকে কী করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক পদে চাকরি দেয়া হয়? কোনো সাক্ষীই নিজ চোখে আবদুল কাদের মোল্লাকে একাত্তরে অপরাধ করা তো দূরের কথা, মিরপুর এলাকাতেই দেখেননি। শোনা কথার ভিত্তিতে ও ধারণামূলক বক্তব্যের ভিত্তিতে কাউকে ফাঁসি দেয়া যায় কি? এসব প্রশ্নের জবাব এখনও পাওয়া যায়নিও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, কাদের মোল্লা শুধু ন্যায়বিচার থেকেই বঞ্চিত হননি, হত্যার শিকারে পরিণত হয়েছেন। মিরপুরের কসাই কাদের আর ফরিদপুরের কাদের মোল্লা এক ব্যক্তি নন। তথ্য-প্রমাণসহ আইনজীবীরা এ দাবি করেন। হাসবে মিরপুরের কসাই কাদের ‘আমি ফরিদপুরের কাদের মোল্লা। সরকার আমাকে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে হত্যা করতে যাচ্ছে। আমার হত্যাকাণ্ডের পর আমি কিয়ামত পর্যন্ত কাঁদতে থাকব। আর হাসবে মিরপুরের কসাই কাদের।’ কথাগুলো আবদুল কাদের মোল্লার। আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনির মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে দেয়া একটি ছোট্ট চিঠিতে এমন অনুভূতিই প্রকাশ করেছিলেন কাদের মোল্লা। সরকার তাকে মিরপুরের কুখ্যাত কসাই কাদের সাজিয়ে হত্যা করতে যাচ্ছে এমন কথাই বলেছেন তিনি। গোলাম মাওলা রনি তার এ চিঠিটি ফেসবুকে ছেড়ে দেয়ার পর বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায় তা। (সূত্র : দৈনিক আমার দেশ) কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের এক ব্যক্তি নন। এমন বক্তব্য দিয়ে মিডিয়ায় ঝড় তুলেছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি। এমন সত্য উপলব্ধির জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। আবদুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের সঙ্গে অসংখ্য স্মৃতি আজ নাড়া দেয় প্রতিনিয়ত। ২০০৯ সালে আবদুল কাদের মোল্লা ভাই সৌদি সরকারের রয়েল গেস্ট হিসেবে আর আমি ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে পবিত্র হজ পালন করতে যাই। মোল্লা ভাইয়ের সঙ্গে মদিনায় সাক্ষাৎ। তার সফর ছিল সংক্ষিপ্ত। তাই মদিনায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মোল্লা ভাই ছিলেন প্রধান অতিথি আর আমি ছিলাম বিশেষ অতিথি। অনুষ্ঠানে আমি যখন সারাদেশে আমাদের ভাইদের ওপর জুলুম নির্যাতন এবং শহীদ ভাইদের ঘটনা বর্ণনা করছিলাম তখন উপস্থিত সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। আমি মোল্লা ভাইকে অনেকবার চোখের পানি মুছতে দেখেছি। আলোচনায় তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশে শিবিরের যুবক-তরুণেরা জীবন দিচ্ছে দ্বীনের জন্য। সুতরাং আপনারা শুধু দান-খয়রাত করলে মুক্তি পাবেন না। কারণ আপনারা এমন জায়গায় আছেন যেখানে রাসূল (সা) শুয়ে আছেন। বদর, ওহুদ সব এখানেই। সুতরাং দ্বীনের পথে ত্যাগ কোরবানি ছাড়া আমাদের মুক্তি মিলবে না।’ আজ তিনি নিজেই সারা পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর কাছে একটি প্রেরণা, একটি ইতিহাস, এই দুঃসাহসিক দুর্জয় পথে দুরন্ত সাহস। শাহাদতের জন্য মোল্লা ভাইয়ের মন কেমন পাগলপারা ছিল এই ঘটনা থেকে তা উপলব্ধি করা যায়। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন ট্র্যাজেডি। দিবসটি প্রতি বছরই অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিনই সবাই কাঁদবে আওয়ামী লীগের বৈঠার আঘাতে যারা শহীদ আর গাজী মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন তাদের জন্য। আর খুনিরা কেয়ামত পর্যন্ত মানবতার অভিশাপ পেতে থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। খুব সম্ভব ২০০৯ সালের ২৮ অক্টোবর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজন করে আলোচনা সভার। অতিথিরা উপস্থিত। আলোচনা সভা শুরু হয়ে গেছে। ঠিক মাঝখানে আমাদের প্রিয় মোল্লা ভাই প্রোগ্রামে এসে হাজির। আমি দাঁড়িয়ে রিসিভ করে বললাম, মোল্লা ভাই আপনি আসছেন এ জন্য মোবারকবাদ। কারণ মোল্লা ভাই আমাদের দাওয়াতি মেহমানের মধ্যে ছিলেন না। তবু তিনি নিজ উদ্যোগে আলোচনা সভায় হাজির হয়েছেন। বলতে না বলতে তিনি বললেন, শোনেছ ২৮ অক্টোবর ২০০৬ প্রোগ্রামে অনুপস্থিতির বেদনা আমাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। পল্টনে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। যেখানে আমাদের ভাইয়েরা শহীদ আর গাজী হয়েছেন। ওই দিন আমি ঢাকায় ছিলাম কিন্তু আমিরে জামায়াত আমাদের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সব খোঁজখবর রাখতে বললেন। এই জন্য আমি পল্টনে ছিলাম না। সেদিনের এই অনুপস্থিতির বেদনা থেকে তোমাদের দাওয়াত না পেয়েও বে-দাওয়াতে এখানে উপস্থিত হয়ে গেলাম। এই কথাগুলো মোল্লা ভাই স্টেজে বসে বসে বললেন। তখন বুঝতে পারিনি কিন্তু আজ সারা পৃথিবী জানে তিনি কত গভীরভাবে শাহাদাতের চেতনাকে লালন করতেন। মোল্লা ভাইয়ের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মোল্লা ভাই আল্লাহর দরবারে তার মৃত্যু যেন বৃহস্পতিবারে হয় তার কামনা করতেন। আর তার নামাজে জানাজা যেন তাহাজ্জুদের সময় হয়। আবেদন শুনে আমার কাছে জটিলই মনে হয়েছে। কিন্তু আল্লাহতাআলা এই প্রিয় বান্দার সেই ফরিয়াদও কবুল করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। এই সরকার তার ফাঁসি প্রথম দিন ১১ ডিসেম্বর কার্যকর করতে চেয়েছিল কিন্তু তা আদালতের নির্দেশের কারণেই হয়নি। তার ফাঁসি ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবারই হয়েছে। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দার ফরিয়াদ অনুসারে বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১ মিনিটে বান্দার ফরিয়াদ কবুল করে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করালেন। দ্বিতীয়ত, জানাজার নামাজ প্রশাসন ফরিদপুরে ৫টার সময় ঠিক করেছে। কিন্তু আবদুল কাদের মোল্লার কফিন আগেই পৌঁছে যাওয়ায় তার নামাজের জানাজা ৪টার সময় অনুষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহতাআলা তার প্রিয় বান্দার ফরিয়াদ অনুসারে তাহাজ্জুদের সময়ই তাকে মাবুদের সান্নিধ্যে তুলে নিলেন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় আবদুল কাদের মোল্লা ভাই সত্যিই শাহাদাতের জন্যই নিজেকে গড়ে তুলেছেন। এই জালেম সরকার তার পরিবারকে মোল্লা ভাইয়ের কফিন শেষবারের মতো দেখতে সুযোগ দিলো না। অংশগ্রহণ করতে দিলো না তার জানাজায়। মোল্লা ভাইয়ের ফাঁসির পরপরই তার পরিবার আত্মীয়স্বজন যখন মগবাজারের বাসা থেকে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনার জন্য বের হয়েছে ঠিক তখনই ছাত্রলীগ, যুবলীগ, পুলিশ একযোগে তাদের বাসার সামনে গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে আহত করে অনেককেই। শুধু তা-ই নয়, পুলিশ আহতদের উল্টো গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। এতে আবদুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়স্বজন কেউ-ই শেষবারের মতো আর তাকে দেখতে পেলেন না। মানুষ কত নিষ্ঠুর, কত পাষাণ, কতটুকু পশুর মতো হলে এমন আচরণ করতে পারে? কিন্তু এমন অবস্থায়ও মোল্লা ভাইয়ের সহধর্মিণীর ধৈর্যে হতবাক হতে হয়! বাসায় হামলার ওই মুহূর্তে আমি ফোন দিলাম ভাবীকে। তারা ফরিদপুরে যাবেন কি না, কারণ গাড়ি তদারকির দায়িত্ব আমার ছিল। উত্তরে অবিচল স্বাভাবিক কণ্ঠে আমাকে বললেন, এই পরিস্থিতিতে আমি ছোট বাচ্চা, ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে যাবো কিভাবে? যারা আমাদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলেছে তারা আমাদের ওপর হামলা করছে। যাকে আল্লাহ কবুল করার তিনি তো চলে গেছেন, এখন আর যেয়ে কী হবে? তিনি স্বাভাবিক কণ্ঠে এই কথাগুলো বলছেন আর আমি চোখের পানি মুছছি। আর ভাবছি আল্লাহ যাকে ধৈর্য দান করেন শুধু তারাই ধৈর্যধারণ করতে পারে। নচেৎ এমতাবস্থায় সবর করা কঠিন নয় কি? সত্যিই, জনাব আবদুল কাদের মোল্লাসহ আল্লাহর দ্বীনের মুজাহিদদের ঈমানী দৃঢ়তা দ্বীনের পথিকদের উৎসাহিত করছে। আবদুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করার পরও কিন্তু দ্বীনের এই মুজাহিদকে এতটুকু হতাশাও আচ্ছন্ন করতে পারেনি। এইজাতীয় সাহসী বীর মুজাহিদ এখন মাওলানা মওদুদী, সাইয়েদ কুতুব, আর হাসান আল বান্নার কাতারে দণ্ডায়মান। দ্বীনের পথে সংগ্রামরত বিশ্বের অসংখ্য মুজাহিদের জন্য এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। শাহাদাতের রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে জনাব আবদুল কাদের মোল্লা তার স্ত্রী, পুত্র, মেয়ের কাছ থেকে এভাবেই শেষ বিদায় নিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদের অভিভাবক ছিলাম। এ সরকার যদি আমাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, তাহলে সেটা হবে আমার শাহাদাতের মৃত্যু। আমার শাহাদাতের পর মহান রাব্বুল আলামীন তোমাদের অভিভাবক হবেন। তিনিই উত্তম অভিভাবক। সুতরাং তোমাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। ইসলামী আন্দোলনকে বিজয়ী করার মাধ্যমে আমার হত্যার প্রতিশোধ নিও। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধেই আমাকে হত্যা করা হচ্ছে। শাহাদাতের মৃত্যু সবার নসিবে হয় না। আল্লাহতায়ালা যাকে শহীদি মৃত্যু দেন সে সৌভাগ্যবান। আমি শহীদি মৃত্যুর অধিকারী হলে তা হবে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। আমার প্রতিটি রক্তকণিকা ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করবে ও জালেমের ধ্বংস ডেকে আনবে। আমি নিজের জন্য চিন্তিত নই। আমি দেশের ভবিষ্যৎ ও ইসলামী আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত। আমি আমার জানা মতে কোনো অন্যায় করিনি।’ পরিবারের সদস্যদের তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা ধৈর্যের পরিচয় দেবে। একমাত্র ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমেই আল্লাহতায়ালার ঘোষিত পুরস্কার পাওয়া সম্ভব। দুনিয়া নয়, আখেরাতের মুক্তিই আমার কাম্য। আমি দেশবাসীর কাছে আমার শাহাদাত কবুলিয়াতের জন্য দোয়া চাই। দেশবাসীর কাছে আমার সালাম পৌঁছে দিও।’ বিদায় বেলায় স্ত্রীর সঙ্গে শেষ কথা বলেন তিনি, ‘ধৈর্য ধরো, আল্লাহর ওপর ভরসা রেখো। তোমার হক যথাযথভাবে আদায় করতে পারিনি বলে ক্ষমা করে দিও।’ প্রতি-উত্তরে স্ত্রী বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকায় আপনার সেবা করতে পারিনি। বিদায় বেলায়ও পাশে থাকতে পারছি না। জীবন চলার পথে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কোনো অন্যায় হয়ে থাকলে মাফ করে দিবেন।’ এ সময় খানিকটা আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলেও কাদের মোল্লা ছিলেন দৃঢ়, অবিচল। এই দৃঢ়চিত্ততা কেবল আল্লাহর ওপর ভরসাকারী ঈমানদারগণই দেখাতে পারেন। কারণ তারা জান্নাতের বিনিময়ে দুনিয়ার সব বিসর্জন দিতে পারেন অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়। হজরত উম্মে হারেসা বিনতে সারাকা থেকে বর্ণিত, ‘তিনি হুজুর (সা) এর দরবারে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি কি হারেসা সম্পর্কে কিছু বলবেন না? জঙ্গে বদরের পূর্বে একটি অজ্ঞাত তীর এসে তার শরীরে বিঁধে যায় এবং তিনি শহীদ হন। যদি তিনি জান্নাতবাসী হয়ে থাকেন তাহলে আমি সবর করব, অন্যথায় প্রাণভরে কাঁদব। হুজুর (সা) জবাব দিলেন, হারেসার মা, বেহেশতে তো অনেক বেহেশতবাসীই রয়েছেন, তোমার ছেলে তো সেরা ফেরদাউসে রয়েছেন।’ সারা পৃথিবীতে আজ মুসলমানরা নির্যাতিত। ইসলামী আন্দোলন সবচেয়ে বেশি মজলুম। এর সংগঠনই কঠোর পরীক্ষা ও প্রতিকূলতার বিভিন্ন মনজিল অতিক্রম করেছে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, দুনিয়াতে হকের বিজয়ের জন্য যখনই কোনো ব্যক্তি বা দল সাহসিকতার সঙ্গে মাথা উঁচু করেছে তখনই তাদেরকে এসব মনজিল অতিক্রম করতে হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনও একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্তমান প্রবাহ আমাদের জীবনে নতুন হলেও আন্দোলনে তা অনেক পুরনো। কুরআন, হাদিস, রাসূলের সিরাত, সাহাবীদের জীবনী অধ্যয়ন করলে আমাদের সামনে সেই ইতিহাস প্রস্ফুটিত হয়। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৮২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী বামদের হামলায় নবীন-বরণে ছাত্রশিবিরের ৩ জন শাহাদাত আর অসংখ্য আহত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে ১৫ মার্চ সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায় শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ‘শোক করিয়া লাভ নাই, শহীদি খুনের নজরানা চাই’ এই শিরোনামে লিখেছিলেন, ‘আমি কিন্তু এত হিংস্রতা, এত নিষ্ঠুরতা, এতটা অমানবিক আচরণে মোটেই বিস্মিত হই নাই। তিনজন শহীদের জন্য শোক করারও তেমন কিছু দেখি না। বরং অত্যন্ত প্রশান্তচিত্তে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি, আমার মনে হইয়াছে ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই অগ্রসর হইতেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, পশুত্বের বিরুদ্ধে মানবতার, অমানুষদের বিরুদ্ধে মানুষের সর্বোপরি কুফরির বিরুদ্ধে ইসলামের সংগ্রামের ইতিহাসের এইভাবেই রক্তের অক্ষরে লেখা। কোনো নবীই এই পথ এড়াইতে পারেন নাই, কোনো মুজাদ্দিদের জন্যই ভিন্ন পথ ছিল না। কোনো ইমামও অন্য প্রকার পুষ্প আচ্ছাদিত পথের কথা চিন্তাও করেন নাই। সুতরাং এই যুগেও যাহারা ওই একই পথের যাত্রী বলিয়া দাবি করেন তাহাদের পথ ভিন্নতর কিছু হইবে কেমন করিয়া? ইসলামের গোটা ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে যেন আমার মনে হয় ইসলাম নামক শ্যামল সতেজ গাছের রঙ সারের অভাবে যখনই ফিকাব পিঙ্গল হইয়া গিয়াছে তখনই শহীদের তাজা রক্তের সার দিয়া গাছটিকে আরও তরতাজা করিয়া ফুলে ফলে সুশোভিত করা হইয়াছে। সুতরাং ভয়ের কিছু নাই। শঙ্কার কিছু নাই। আক্ষেপের কিছু দেখিতেছি না বরং দিব্যদৃষ্টিতে যেন দেখিতেছি এই দেশেই ইসলামের কালেমা খচিত বিজয়ী পতাকা মিনারের চূড়ায় পতপত করিয়া উড়িতেছে।’ যিনি এমন ঐতিহাসিক কথাগুলো লিখেছেন তিনি নিজেই আজ বিশ্বের খবরের পাতায় শিরোনাম। তিনি নিজেই তার জীবন উৎসর্গ করে সত্যের সাক্ষী হয়ে গেলেন আজ।AK Mollah-02 শহীদেরা তাদের মাবুদের সঙ্গে তামাম জিনিসের বিনিময় করে শুধু একটি বাক্যের ভিত্তিতে ‘রাদিয়া আল্লাহু আনহুম অরাদু আন্হ’। যারা এই মহৎ কাজে নিজেদের জানমাল, পিতা, পুত্র, ভাইবেরাদর, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের মায়া এবং ঘরের আরাম-আয়েশ, বিলাস-ব্যসন সবকিছুই বিসর্জন দিতে পারে, তাদের চেয়ে বেশি আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লাভের অধিকারী আর কে? সাফল্য ও বিজয়ের সিংহদ্বার তাদের জন্য ছাড়া আর কার জন্য উন্মুক্ত হতে পারে? তাদের শক্তির উৎস অনেক গভীর থেকে প্রোথিত। আবদুল কাদের মোল্লা ১৮৮২ সালে শহীদ দিবস উপলক্ষে লিখেছেন : ‘মানুষকে যদি মানুষের মতো বাঁচিতে হয় তাহা হইলে এই মানুষখেকো আদর্শকে দুনিয়ার প্রতিটি প্রান্ত হইতে চিরতরে উৎখাত করিতে হইবে, নির্মূল করিতে হইবে। এই রক্তপিপাসু অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুনিয়ার প্রতিটি প্রান্তে গড়িয়া তুলিতে হইবে প্রতিরোধ। বাংলার প্রতিটি জনতাকে এই বন্য আদর্শের আসল চেহারা আর অনুসারীদের আসল চরিত্র বুঝাইতে হইবে। দেশকে বাঁচাইতে হইলে সর্বোপরি ঈমান আকিদা লইয়া বাঁচিতে চাহিলে বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের সাথে সিদ্ধান্ত লইতে হইবে। ঈমানদার প্রতিটি মানুষকে আজ অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। অন্যথায় শুধু বুক চাপড়াইয়া শহীদদের জন্য শোক করিয়া কোনো লাভ নাই। আজ একটি গজলের কলিগুলি বড় আবেগে-আপ্লুত কণ্ঠে গাহিতে ইচ্ছা করিতেছে- ‘তোরি দেশের বাঁকে বাঁকে লক্ষ শহীদ আজো ডাকে তবুও কি তুই রইবি বেহুঁশ আজি এ কথার জবাব যে চাই।’ জবাব দিতে হইলে মুখের কথায় অথবা মিটিং মিছিল আর প্রতিবাদ সভায় কাজ হইবে না। ঈমানের আলোতে প্রজ্বলিত বক্ষের তাজা শহীদি খুনের নজরানা চাই। আজ জীবিত আবদুল কাদের মোল্লার চাইতে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা অনেক বেশি শক্তিশালী। জেল-জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, গুম, খুন চালিয়ে ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায় না, বরং দ্বীনের বিজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। যারা আবদুল কাদের মোল্লাকে হত্যা করে এ দেশকে কলোনিভুক্ত করার স্বপ্ন দেখছে, শহীদদের রক্তের শপথ নিয়ে বাংলার তৌহিদি জনতা তা রুখে দাঁড়াবে ইনশাআল্লাহ। [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির