post

শহীদ রহিম উদ্দীন ত্যাগের অনন্য প্রতীক

মুহাম্মদ তারেক হোছাঈন

২২ নভেম্বর ২০১৫
‘শাহাদাত’ শব্দটি শুনলেই শরীর শিউরে ওঠে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। লোমারূপের ছিদ্রাবরণে অনুভূত হয় বেদনার কশাঘাত। হৃদয় হয়ে যায় ছিন্নভিন্ন। মর্মপীড়ার লেলিহানে ভস্মীভূত হয় প্রশান্তির আবরণ ও স্বপ্ন। আবার হৃদয়তন্ত্রে উজ্জীবিত হয় প্রেরণার স্রোত। যে স্রোত মরভূমিকে দান করে সজীবতা। এই সজীবতা অনাবাদি জমিকে আবাদ করতে ঢেলে দেয় জীবনের পর জীবন। প্রবাহিত হয় নয়নযুগলে অশ্রুর অবিরাম বন্যা। এ যেন আষাঢ়ের বর্ষণ আর কান্নার অশ্রু জোয়ার। যেন বিদ্যুৎ চমকানো দুরু দুরু ঝড়ো হাওয়ার মতো প্রাণের কম্পন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা মাধবকুন্ডের প্রবহমান স্রোতমালা। যে স্রোতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে শিবিরের হাজার কারবালা। মিশে আছে শত শহীদের পবিত্র রক্ত আর অগণিত দ্বীনপাগলের তুলনাহীন নজরানা। দিন যায় স্মৃতি থাকে। স্মৃতির পরশে রক্তমাখা ঝরে যাওয়া দিনগুলো কারো কাছে অশ্রুমালার অপূর্ব দর্শন। আমাদের হৃদয়বাতায়নে সে যেন এক আগ্নেয়গিরি করুণ কান্নার মর্মপীড়ার শিহরণ। চট্টগ্রামের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসীদের কত নিষ্ঠুরতা! কত বর্বরতা! কত নির্মমতা আর রক্তের হোলিখেলা। এই ক্যাম্পাস অনুপ্রেরণার অন্যতম বিদ্যাপীঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত জনশক্তি নয়, অধ্যয়নরত জনশক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালনে চেষ্টা করতাম। সঙ্কটকালীন মুহূর্তে দায়িত্বশীলের নির্দেশে প্রাণপণে ছুটে যেতাম এই দ্বীনি ক্যাম্পাসে। এই সবুজ কাননে হায়েনাদের নির্মমতার শিকার সাতকানিয়ার কৃতী সন্তান শহীদ রহিম উদ্দীনকে জানার চেষ্টা করেছি। প্রেরণার মিনার হিসেবে শাশ্বত উপলব্ধি আজ সবখানে। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৯। মিশে আছে শহীদ রহিম উদ্দীন ও মাহমুদুল হাসানের তরতাজা প্রাণ। মিশে আছে জুলুমের বর্বরতম নিষ্ঠুরতা। পাহাড়ঘেরা ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ঘাসে শহীদ রহিম উদ্দীনের রক্তের নিশানা আজও সবার স্মৃতির পরশে চির অম্লান। এখনো ভেসে ওঠে সবার হৃদয়ে এক করুণ প্রতিচ্ছবি। শহীদ রহিম উদ্দীন বাংলা দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ফতেপুর থানা শাখার সেক্রেটারি ও সংগঠনের সদস্য। প্রতিদিনের মতো সেদিন ছুটে গেলেন সবুজের প্রিয় ক্যাম্পাসে। পবিত্র রমজান মাসের এ দিনে হলের সবাই পড়ালেখায় ব্যস্ত ছিল। এই সুযোগে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সোহরাওয়ার্দী হল দখলের জন্য সশস্ত্রভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাই হলের আশপাশে অবস্থানরত নিরীহ শিবির নেতাদের ওপর তৎকালীন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি কলিমের নেতৃত্বে বাহার, মেজবাহ, রায়হান, তানভীরসহ চিহ্নিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করে। মুহুর্মুহু গুলির আঘাতে মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন শিবির নেতা রহিম উদ্দীন, ফাইন্যান্স বিভাগের মেধাবী ছাত্র মাহমুদুল হাসান ও আবদুস শাকুর। সাথে সাথেই রক্তাক্ত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে লুটিয়ে পড়েন। রক্ত আর রক্তের ফোয়ারা। মাটিতে শুধুই যেন রক্তের ছাপ আর লাল নিশানা। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনার সময় পথিমধ্যে অ্যাম্বুলেন্সেই দ্বীনের দুই সৈনিক রহিম উদ্দীন ও মাহমুদুল হাছান পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করে চলে যান পরম প্রভুর প্রিয় সান্নিধ্যে। শাহাদাতেই ঢুবে গেল তাদের তাজা প্রাণ। শহীদ রহিম উদ্দীনকে আজও খুঁজে ফিরেন স্বজনরা। তৎকালীন সময়ের ফতেপুর থানা সভাপতি একই সাথে গুলিবিদ্ধ আবদুশ শাকুর ভাই বলেন, “শহীদ রহিম উদ্দীন ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে, মোলায়েম ও মিষ্টভাষী। ক্লান্তিহীন চেহারা, ব্যতিক্রমী অনুরাগ। সবার সাথেই শিশুসুলভ আচরণ করতেন। সত্যের পথে আপসহীন ছিলেন সবসময়।” সত্যিই দায়ী হিসেবে তার এই চরিত্র অসাধারণ ও অনুকরণীয়। বিনয়ী মেধাবী আর পরিশ্রমপ্রিয় রহিম উদ্দীনের এই শূন্যতা আজো সর্বত্র। এখনো ভার্সিটির সামনে থেকে রক্তের গন্ধ আসে, শত শত ছাত্রের কান্নার আহাজারি আকাশে ভাসে। শোনা যায় এখনো সেই শব্দ। সেই কান্না, সেই নির্মম হত্যার আর্তনাদ। সেদিন স্বজনদের আর্তনাদে আকাশ বাতাস সবুজ প্রকৃতি নীরবে কাঁদলো। কেঁপে উঠলো খোদার আরশ। শাহাদাতই যার ঠিকানা অবশেষে ফিরে গেলেন মহান রবের সেই ঠিকানায়। তাকে ঘিরে পরিবারের ছিল অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা আকাক্সক্ষা। কিন্তু সব কিছু ভেঙে চুরমার করে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিলো নরঘাতকেরা। চার ভাই ও ৩ বোন আর বাবা-মা নিয়ে তাদের সুখী পরিবার ছিল। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে শহীদ রহিম উদ্দীন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তার সেই স্বপ্নকে পূরণ হতে দেয়নি। ফুটতে দেয়নি একটি স্বপ্ন গোলাপ। কলিতেই তাকে নিষ্প্রাণ করে দিয়েছে। শহীদ রহিম উদ্দীন জন্মগ্রহণ করেছেন দ্বীনি ময়দান খ্যাত ঐতিহ্যবাহী সাতকানিয়া উপজেলার চরতি ইউনিয়নে। এই উপজেলায় তখন চলছে আওয়ামী বর্বরতার হিংস্র তান্ডব। শহীদ রহিম উদ্দীনের শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয় এই ইউনিয়নের দ্বীনপ্রিয় জনতা। তাইতো শহীদ রহিম উদ্দীনের শাহাদাত-পরবর্তী জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে এই অঞ্চলে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী প্রতিবারই বিপুল ভোটে বিজয়ী হচ্ছেন। শহীদি এই ময়দানে জামায়াতে ইসলামী চরতি ইউনিয়ন সভাপতি ও উপজেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ডা: রেজাউল করিম দু’বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। শহীদ রহিম উদ্দীনের শাহাদাতে সিক্ত অসংখ্য শপথের কর্মী আজ এই ইউনিয়নে। শহীদি মৃত্যুতে চিরদিনের জন্য উর্বর হয়েছে এই জমিন। এ মৃত্যুগুলো হাজারো জীবনের চাইতেও উত্তম।  সে মৃত্যুইতো জীবনের সফলতা। একটি আলোকবর্তিকা, যা মুক্তিপাগল মানুষকে আঁধার রাতে সত্যের পথ দেখায়। শরীর থেকে যে রক্ত ঝরেছে, সবুজ শ্যামল বাংলায় সৃষ্টি হয়েছে রক্তে রক্তে নদী। সেই নদীর হাজার হাজার ফোঁটা রক্ত বিপ্লবীদের তৃষ্ণা নিবারক। শাহাদাতের রক্তে অর্জিত অসীম উর্বরতার এ ক্যাম্পাস সজীবতার প্রত্যাশায় হাজার হাজার দ্বীনের সৈনিক। শাহাদাতপিয়াসী অগণিত প্রহরী। সন্ত্রাসীরা হয়তো ভেবেছে এভাবেই তাদের বিজয় হয়েছে। কিন্তু জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ এই পৃথিবীতেই শেষ নয়। বরং তাদের এক একটি আঘাত দ্বীনের সৈনিককে করেছে জান্নাতের কাছাকাছি। তারা হয়েছে জাহান্নামের নিকটবর্তী, ফেরাউন আবু লাহাবের সঙ্গী। কন্টকময় পথে শাহাদাতের ফুলই আন্দোলনের গতিকে করেছে অপ্রতিরোধ্য। এটি ইসলামী আন্দোলনের ঐতিহ্য ও ইতিহাস। শিবিরের ইতিহাস শাহাদাতের অধ্যায়ে রচিত। ইতিহাস পথ দেখায়। ইতিহাসে বদর, ওহুদ, খন্দকের ময়দানে আল্লাহপ্রেমিক মুজাহিদরা যেমন শত জুলুমের পাহাড় দলে জান্নাতের নেশায় প্রতিযোগিতায় ছিল। শিবিরের নেতাকর্মীরাও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে একই নেশায় বিভোর। সুতরাং কে পারবে জান্নাতের রাজপথে বাধার প্রাচীর নির্মাণ করতে? যুগে যুগে কালে কালে পারেনি ফেরাউন, নমরুদ, সাদ্দাদ, পারেনি গাদ্দাফী, সীমার, নেতানিয়াহু , এরশাদ, পারবে না রানী ইসাবেলার বোন শেখ হাসিনা। এইভাবে আমাদের সামনে আলোর রেখাগুলো উঁকি দিচ্ছে। সেই পথ ধরেই আমাদের পাড়ি দিতে হবে বহুদূর। পৌঁছতে হবে কাক্সিক্ষত মন্জিলে। বিজয় আসবেই ইনশাআল্লাহ। লেখক : সাবেক সভাপতি, বিআইসিএস,  চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির