post

শহীদ রাশেদুল ইসলাম রান্টু মোছেনি আজও রক্তের দাগ

মো:আফজাল হোসেন

১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

২৬ অক্টোবর ২০১৩ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৮ দলের হরতালের সমর্থনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কাজলা এলাকায় ছিল পথসভা কর্মসূচি। সকাল থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আমরা প্রচার প্রচারণা চালাই। বিকেল ৪টায় শুরু হবে মূল কর্মসূচি। এরই প্রেক্ষিতে জোহরের নামাজ শেষ করে সকলে সামান্য কিছু খাওয়া দাওয়া শেষ করে কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে আমরা ধরমপুর মতিহার থানার আমজাদের মোড়ে এসে জড় হই। বেলা ৩টায় গোটা মোড় জনশক্তিতে ভরে যায়। চারিদিকে শুধু নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার, একদফা একদাবি শেখ হাসিনা কবে যাবি, এই মুহূর্তে দরকার কেয়ারটেকার সরকার ইত্যাদি শ্লোগানে মুখরিত। চারদিক থেকে মিছিল আসছে। শুনলাম, ছাত্রশিবির ডাঁশমারী অঞ্চল থেকে একটা বিশাল মিছিলের বহর আসছে। অপেক্ষা করতে থাকলাম, মিছিলকে অভিনন্দন জানানোর জন্য।

কিছুক্ষণ পর মিছিলটি আমজাদের মোড়ে এসে পৌঁছে। আমি ঠিক সামনে থেকে খেয়াল করলাম রাশেদুল ইসলাম রান্টুকে। সে মিছিলের সামনে ডান পাশে ব্যানারের এক প্রান্ত ধরে খুব আবেগতাড়িতকণ্ঠে জোরে জোরে শ্লোগান দিচ্ছিলো। রান্টু ছিল সুঠাম দেহের অধিকারী এবং সেদিন তাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছিল। পরনে একটি ট্রাউজার, গায়ে আকাশি ও সাদা রঙের টানা টানা দাগওয়ালা গেঞ্জি। মিছিলটি যখন আমাদের সাথে এসে যুক্ত হয়, তখন আমরা প্রায় ২০০০ জনশক্তি নিয়ে আমজাদের মোড় থেকে কেডি ক্লাবের দিকে মিছিল নিয়ে এগোতে থাকি। সবার কণ্ঠে প্রতিবাদের শ্লোগান। মিছিল যখন কাজলা পানির ট্যাংকি বিশ্বরোডের কাছে পৌঁছায় তখন ঠিক বিকেল ৪টা বাজে।

প্রশাসন ও আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের হামলা হঠাৎ করে দেখি রোডের ডান দিক থেকে অর্থাৎ বিনোদপুরের দিক থেকে র‌্যাবের অনেক গাড়ি আসছে। গাড়িগুলো আসতে দেখে আমি জনশক্তিদের আটকিয়ে রাখলাম। রাস্তায় উঠতে দিলাম না। আমি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে গাড়িগুলোকে সাইড দিচ্ছিলাম। একে একে ৬টা গাড়ি আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। যেতে যেতে হঠাৎ করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই র‌্যাবের গাড়িগুলোর দরজা খুলেই এলোপাতাড়ি লাঠি পেটা শুরু করে। কী ব্যাপার? আমাদের এ কর্মসূচিতে তো প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে তারপরও কেন এই লাঠিপেটা? কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অনুমতি থাকায় এখানে ছোট-বড় আবালবৃদ্ধ সবাই এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন। হামলার প্রেক্ষিতে সেখানে হাজার হাজার জনশক্তি সবাই এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। র‌্যাবের পাশাপাশি দেখা যায় অনেক সাদা পোশাকে আওয়ামী সন্ত্রাসী যাদের সবার হাতে একে-৪৭সহ ভারী ভারী অস্ত্র। তারা যৌথভাবে আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। চারিদিক মুহুর্মুহু গুলির শব্দ!

আমি সকল জনশক্তিকে নিয়ে কেডি ক্লাবের দিকে সরে যেতে লাগলাম। এরই ভেতরে দেখি অনেকে আমার সামনে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। আমি বারবার জনশক্তিকে পিছু হটতে বলেছিলাম। কারণ র‌্যাব ও সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে একে-৪৭সহ অত্যাধুনিক অস্ত্র, সেই অস্ত্রের সাথে আমরা কিছুতেই মোকাবেলা করতে পারবো না। এরপর আমি বেশ কিছু জনশক্তিকে সাথে নিয়ে কাজলার কেডি ক্লাবের পূর্ব দিক দিয়ে আমজাদের মোড়ের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। যাওয়ার কিছু সময় পর ডাঁশমারীর তৎকালীন সভাপতি আলম আমাকে ক্রন্দনরত কণ্ঠে ফোন দিয়ে বললেন, “ভাই রান্টু গুলিবিদ্ধ হয়েছে।” এই কথা শুনে আমার বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ডটা কেঁপে উঠল। আমি বললাম কোথায়? তিনি বললেন, রেডিও সেন্টারের ভেতরে বরই বাগানে। আমি বললাম, তাকে উদ্ধার করে আমজাদের মোড় দিয়ে নিয়ে আসতে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো রাবার বুলেট লেগেছে। এরপর আমি দ্রুত রাস্তায় উঠলাম। এর কিছুক্ষণ পর যখন রান্টুকে রিকশায় করে আমার কাছে নিয়ে এলো তখন আমি দেখলাম, তার বুকের ওপর বাম পাশে ফুসফুস বরাবর পেটের একটু ওপরে সামান্য ফুটো। আমার ডান হাতের আঙুলটা তার বুকের সেই গুলিবিদ্ধ ফুটো স্থান দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।

তখন সে খুব আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল এবং তার মুখের ডান দিক থেকে সাদা সাদা ফেনা বের হচ্ছিল। এবার দেখি আমার আঙুল তার সেই গুলিবিদ্ধ স্থান দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। আমি আর আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম, হে আল্লাহ, তুমি পিতার একমাত্র সন্তানকে তোমার দ্বীনের জন্য কবুল করলে। কারণ তার যে স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়েছে তাতে করে আল্লাহর রহমত ছাড়া তার বাঁচা কোনোভাবে সম্ভব নয়। আমার দুই চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো। এরপর আমি তাকে দুই হাত দিয়ে আমার বুকে টেনে নিলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মোটরসাইকেল তুলে দিলাম তাকে হসপিটালে নেয়ার জন্য। কিন্তু সে আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো যেন সে আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। সে যে আর বাঁচবে না, আল্লাহ যে তাকে শহীদ হিসেবে কবুল করবেন হয়তো সেটাই বারবার আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। তার নিস্তেজ দেহটা আমার বুকের সাথে যেন লেগে গেছে। তার মাথাটা আমার কাঁধে ঝুলে আছে।

আমি ও তাজমিনুর তারই মামাতো ভাই দুইজন মিলে তাকে মোটরসাইকেলের পেছনে তুলে দিলাম এবং পেছনে একজনকে তাকে ধরে রাখার জন্য দিলাম। তার পা দুটো মোটরসাইকেলের দুই পাশে ঝুলতে থাকে আর পেছন থেকে তাকে একজন চেপে ধরে মেডিক্যালে নিয়ে যায়। তাকে আমার বুক থেকে নামানোর পর দেখি আমার গেঞ্জিটা রক্তে ভিজে গেছে। রান্টুকে হসপিটালে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলাম। এদিকে আসরের নামাজের সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছিলো। এমন সময় ফোন এলো আমার মোবাইলে, “ভাই রান্টু আর বেঁচে নেই”। আমি ফোন পেয়ে কাউকে কিছু বললাম না। এই মুহূর্তে তাদের কথাটা বললে তারা সবাই ভেঙে পড়বে। আমি কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারবো না। কিন্তু কেন যেন আমার চোখের পানিকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। বারবার মনে পড়ছিল শহীদ শাহাদাতের বাসায় ঈদের দিনে রান্টুর সেই কান্নার দৃশ্য। শহীদ শাহাদাতের মা যখন শাহাদাতের মৃত্যুর কথা বর্ণনা করছিলেন তখন রান্টুর অনেক জোরে জোরে কান্নার শব্দ শুনে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। কিছুতেই তার কান্না থামছিল না। এর কিছুদিন পরই এই ঘটনা! আমার দু’চোখ দিয়ে পানি ঝরা দেখে জনশক্তিদের আর বুঝতে কষ্ট হলো না যে শহীদ রাশিদুল হক রান্টু আর বেঁচে নেই।

কিছুক্ষণ পর মাগরিবের নামাজ শেষ করে তৎকালীন রাবির সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি শহীদের পরিবারে গিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর ইমন ভাই এলে- তিনি, আমি ও বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীলসহ শহীদ রাশেদুল ইসলাম রান্টুর বাসায় রওনা হলাম। কিন্তু বারবার আমার আবেগজড়িতকণ্ঠে কান্না বের হয়ে আসছিল। কিভাবে সান্ত্বনা দেবো শহীদের মা, বাবা ও ভাই হারানো বোন দুটোকে? কী নিয়ে দাঁড়াবো তাদের সামনে? এই ভেবে আমার দু’চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরতে থাকে। অবশেষে আবেগভরা হৃদয় নিয়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে তৈরি হলো এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। চারিদিকে শুধু কান্নার রোল, শহীদের পিতা-মাতাকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারলাম না। সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আমাদের কান্না দেখে সেখানে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায় এবং তারাও কান্নাকাটি শুরু করে।

শহীদ রাশেদুল ইসলাম রান্টু ছিলেন শিবিরের ১৮১তম শহীদ। তিনি ছিলেন এলাকার সবার কাছে প্রিয় একজন ব্যক্তি। যেমন ছিলেন চরিত্রবান, তেমনি ছিলেন সাহসী। শিবিরের প্রতিটা কর্মসূচিতে তাকে সব সময় সামনে দেখা যেত। এমনকি অঞ্চলের প্রতিটা প্রোগ্রামে আমি তাকে উপস্থিত দেখতে পেতাম। তিনি পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই পিতা-মাতার খেদমত করতেন। প্রতিটা কাজে তার পিতা-মাতাকে সহযোগিতা করতেন। তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী, সংগঠনিক কাজের পাশাপাশি তিনি নিজে পরিশ্রম করে প্রতি ঈদে তার বোনদের ও পিতা-মাতাকে পোশাক কিনে দিতেন। তিনি সমাজের প্রতিটা মানুষের কাছে ছিলেন খুবই প্রিয়। কারো উপকার করার জন্য তিনি সর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। তিনি সুযোগ পেলে নিজের পরিবারের পাশাপাশি এলাকার গরিব-দুঃখীদের সাহায্য ও সহযোগিতা করতেন।

এভাবেই আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিলেন শহীদ রাশেদুল ইসলাম রান্টু। যেভাবে বিদায় নিয়েছিলেন শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানী, শহীদ হাফিজুর রহমান শাহীন, শহীদ শাহাদাতসহ অসংখ্য আল্লাহর পথের সৈনিক। আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না তারা আমাদের মাঝে। শহীদ রান্টুর পিতা আজ নানা রোগে আক্রান্ত। কে নেবে তার দেখাশোনা করার দায় দায়িত্ব? বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতার একমাত্র আশ্রয়স্থাল হয় তার সন্তান। কিন্তু তাঁর একমাত্র সন্তান আজ চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে। আজও শহীদ রাশেদুল ইসলাম রান্টুর সাথীরা ভুলতে পারেন না, সংগঠনের প্রতিটা কাজে আজও তাকে স্মরণ করেন প্রতিটা মুহূর্তে। শহীদ রাশেদুল ইসলাম রান্টুর রক্তে  ভেজা সেই গেঞ্জিটা আজও আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। যখনই সেই গেঞ্জিটা আমার চোখে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় সেই দিনের সেই লোমহর্ষক ঘটনা। হাজারো রান্টুর জীবন কেড়ে নিলেও মহান আল্লাহ তার দ্বীনকে এই জমিনে প্রতিষ্ঠিত করবেনই ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ যেন শহীদ রাশেদুল ইসলাম রান্টুকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেন। আমিন। লেখক : সাবেক ক্রিড়া সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির