post

শ্রীলঙ্কার মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতি

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

০৭ অক্টোবর ২০১৭
[দ্বিতীয় কিস্তি] ইউরোপীয় বণিকদের আধিপত্য ও মুসলমানদের অবস্থা ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রেক্ষিতে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে ইউরোপীয় বণিকদের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়। ১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামার সমুদ্রপথে দক্ষিণ-আফ্রিকার উত্তমাসা অন্তরীপ হয়ে পশ্চিম ভারতের কালিকট বন্দরে অবতরণের মাধ্যমে পর্তুগিজদের প্রাচ্য আগমনের সূচনা হয়। ভাস্কো দা গামার এ ভারত আগমনই ছিল ইউরোপীয় বাণিজ্যের বিস্ময়কর সাফল্যের সূচনা। এ পথ ধরেই পর্তুগিজ, ডাচ ও ইংরেজসহ ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বাণিজ্যে আধিপত্য লাভের মাধ্যমে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সম্প্রসারণ ঘটায়। শ্রীলঙ্কাও এদের আধিপত্যের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়। ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠীর মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম বণিকগোষ্ঠী যারা মুসলমানদের সুপ্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক কর্মকান্ডকে উচ্ছেদ করতে আসে। ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত পর্তুগাল নামক ক্ষুদ্র এ দেশটির অধিবাসীরাই পর্তুগিজ। তারা রোমান সা¤্রাজ্যের অধীনে একটি নগণ্য প্রদেশ হিসেবে ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানদের স্পেন জয়েন মাধ্যমে পর্তুগালও তাদের শাসনাধীনে আসে এবং মুসলমানদের উন্নত জীবনধারা, রাজনীতি ও শিক্ষা সংস্কৃতির প্রভাবে তারা নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটায়। অতঃপর ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে জায়গা করে নেয়। পরবর্তীতে পর্তুগাল যুবরাজ হেনরি দি নেভিগেটর এর সূত্র ধরে নাবিক ভাস্কো দা গামা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পথ উন্মুক্ত করেন। বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন, খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচার ও প্রসার, বাণিজ্যপথে মুসলিম কর্তৃত্ব খর্ব করে নিজেদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তেই তারা আন্তরিকভাবে কর্মকান্ড শুরু করে। আগেই বলা হয়েছে যে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সিংহলের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করতো মুসলমানরা। ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজরা প্রথম সিংহলে এসে ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং নৌচালনার জন্য উপযুক্ত এক দ্বীপ হিসেবে তারা সিংহল বন্দরকে লক্ষবস্তুতে পরিণত করে। গোয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝপথে অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানকার বন্দরে ব্যাপকভাবে পণ্যবাহী জাহাজ যাতায়াত করতো। সিংহল দারুচিনির জন্য ছিল খুব বিখ্যাত। এ বাণিজ্যিকেন্দ্র দখলের জন্য পর্তুগিজরা প্রাণপণে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। পর্তুগিজরা ভারত মহাসগর তথা এশীয় অঞ্চলে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রাচ্য বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও রাজ্যগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন, মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন, দখলনীতি প্রভৃতির পাশাপাশি মুসলিম বণিকদের শক্তি ধ্বংস করার নীতি গ্রহণ করেছিল। যেহেতু মশলার উৎপাদনকেন্দ্র থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক কেন্দ্রসমূহ পর্যন্ত মুসলমানদের কর্তৃত্বের আওতায় ছিল তাই তারা এসব দখলকেই প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে। তারা মুসলিম বণিকদের জাহাজ দেখলেই আক্রমণ করতো এবং জাহাজে রক্ষিত মালামাল লুণ্ঠন করে দখলীকৃত জাহাজগুলোকে জানিয়ে দিতো। জাহাজের নাবিক ও বণিকদেরকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করতে না। বন্দী বা অপহৃত নারী ও শিশুদেরকে দাস হিসেবে বিক্রি করতো। মুসলমানদের আধিপত্য হ্রাসের লক্ষ্যে তারা এশিয়ার সকল সমুদ্রপথে শুল্ক আরোপ ও পরিচয়পত্র চালুরও ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বাণিজ্যিক জাহাজ ও স্থাপনা ধ্বংস করা ছাড়াও পর্তুগিজরা সিংহলের মুসলমানদের ওপর নানামুখী নির্যাতনমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে। তারা ১৫০২ সালে কলম্বোতে এসেই মুসলিম জনপদে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য তারা স্থানীয় রাজাদের সহায়তা কামনা করে এবং তাদের কাছে ব্যবসায়িক লাভের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ শক্তি সম্পর্কে ভয় ও আশঙ্কার ভবিষ্যদ্বাণী করে। এভাবে তারা অতি অল্পসময়ে শাসকশ্রেণীর কাছাকাছি চলে আসে। সেইসাথে প্রশাসনের সহায়তায় তারা মুসলিমম বাড়িঘরে হামলা, গুদামঘর লুণ্ঠন, হত্যা, জ্বালাও পোড়াওসহ তাদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলে। ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় তারা মুসলমানদের আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করে। শহরের বাণিজ্যিক এলাকা থেকে শুধু নয় কলম্বোসহ মূল শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকেও তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়। এ হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে বাঁচার জন্য মুসলমানরা পর্তুগিজ প্রভাবিত এলাকার বাইরে গিয়ে বিশেষত কানড়ি, সিতাওয়াকাসহ বিভিন্ন দূরবর্তী শহর ও গ্রামে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পর্তুগিজরা মুসলমানদের সকল ধরনের ইতিহাস ঐতিহ্যও ধবংস করে ফেলে। বিশিষ্ট গবেষক Lathef Farook বলেন, Much historic evidence of early Arabs in north was destroyed by he Portuguese when they brutalised Muslims, deprived them their trade, destroed their properties and mosques and looted their belongings before driving them into the interior areas. খ্রিষ্টধর্মের প্রচার পর্তুগিজদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। পর্তুগিজ প্রধান আফোনসো ডি আলবুকার্ক খ্রিষ্টান ধর্মের বিস্তারের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্মগ্রহণকারীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন পুরস্কার ও সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তারা খ্রিষ্টান ও শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে আন্তঃবিবাহ চালুর মাধ্যমে ধর্মীয় প্রচারের পথ সুগম করে। ইউরোপ থেকে খ্রিষ্টধর্মের ওপর লিখিত গ্রন্থের অনুবাদ করে ছাপিয়ে বিনামূল্যে জনসাধারণের মধ্যে বিলি করা হতো। কিন্তু আল বু কার্কের মৃত্যুর পরে পর্তুগালের রাজা তৃতীয় জনের নির্দেশে পর্তুগিজরা খ্রিষ্টধর্মের প্রচার ও প্রসারে জোরজবরদস্তিমূলক নীতি গ্রহণ করে। মুসলমান, হিন্দু ও বৌদ্ধদের ধর্মীয় উপাসনালয়সমূহকে ধ্বংস করে সেখানে তারা গির্জা নির্মাণ করতো। পর্তুগিজদের ধ্বংসযজ্ঞ হতে মন্দির, মসজিদ, মঠ কিছুই রেহাই পায়নি। অপর্তুগিজ উপাসনালয়সমূহ ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে মসজিদসমূহে মুসলমানগণ নামাজে তাদের সাহায্যের জন্য মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর নাম উচ্চারণ করতে না পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সব ধর্মনেতা, শিক্ষক এবং শিক্ষক ও ধার্মিক লোকদের বিতাড়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কুরআন শরিফসহ ধর্মীয় গ্রন্থাবলিকে দেখামাত্র তা হস্তগত করে ধ্বংস করে দেয়ার কথা বলা হয়। এ নির্যাতনের ক্ষেত্রে সিংহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমানগণ। ১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে সিংহলের মূল কেন্দ্রবিন্দু থেকে মুসলিম বিতাড়নের একশ বছর পূর্তিতে মুসলমান নিধনে বিশেষ উৎসব পালন করা হয়। এ সময় মুসলমানদের মধ্যকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কৃষিজীবীও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। তারা এ সময়ে মুসলমানদের ধর্মীয় স্থাপনা বিশেষত মসজিদ ও মাদরাসাসমূহকেও দখল করে নেয়। অনেক মসজিদকে তাদের গির্জায় রূপান্তরিত করে। গবেষক Latheef Farookউল্লেখ করেন,the Christian Church 'Our lady of Miracles' al Sinnakada, was the first Jumma Mosque with capacity to accommodate around 1000 people. This mosque was demolished by the Portuguese on 8 May 1614 to construct 'Our Lady to Miracles' Church which was first called Our lady of Victory. This church is still found in Sinnakkada. . এ অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমানদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে খ্রিষ্টান ধর্মের দীক্ষা দেয়ার প্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু মুসলমানগণ ধর্মান্তরিত না হওয়ার কারণে অধিকাংশ মুসলমানকে হত্যা করা হয় এবং অবশিষ্টরা দূরবর্তী গ্রামীণ জনপদে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ দখল করে সেখানে খ্রিষ্টান শিশু শিক্ষায়তন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে মুসলমানগণ অর্থনৈতিকভাবে যেমনভাবে ভেঙে পড়ে তেমনি শিক্ষাকেন্দ্রেও ব্যাপকভাবে পিছিয়ে পড়ে। সিংহলের ঐতিহ্যমন্ডিত অভিজাত মুসলিম জনগোষ্ঠী অচিরেই অনগ্রসর ও অশিক্ষিত কৃষক শ্রেণিতে পরিণত হয়। সিংহলি মুসলিম সমাজের জন্য দুর্ভাগ্যের দ্বিতীয় কারণ ছিল ডাচ বা ওলন্দাজরা। হল্যান্ড থেকে আগত এ ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠীও মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকান্ড পরিচালনা করে। ১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে জন পিটারসুন কোয়েনের নেতৃত্বে ওলন্দাজরা জার্কাতা জয় করে সেটাকে বাটাভিয়া নাম দিয়ে বাণিজ্যিক কর্মকান্ড পরিচালনা শুরু করে। ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান পর্তুগিজ ঘাঁটি এবং বাণিজ্যিকেন্দ্র মালাক্কা দখল করে। মাত্র কিছুকালের মধ্যেই ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তারা সিংহলে এসে পর্তুগিজদের স্থলাভিষিক্ত হয়। অতিঅল্প সময়ের ব্যবধানে সিংহলের ক্রিংকোমালি, ব্যাট্রিকোলোয়া, নিগাম্বো, কালাকাতুর এবং কলম্বো প্রভৃতি বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো পর্তুগিজদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ওলন্দাজরা পর্তুগিজদের নিকট থেকে একে একে জাফনাপত্তম, নেগাপত্তম, কুইলন, ক্রাঙ্গানুর, ক্যানানুর ও কোচিনেরও দখল নিয়ে নেয়। যদিও ডাচরা পর্তুগিজদের চেয়ে কোনোভাবেই শ্রেষ্ঠ ও শক্তিশালী ছিল না, তবুও তারা খুব দ্রুত পর্তুগিজদের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। ডাচরা ছিল অনেকাংশে স্বাধীন। তারা নিজেরাই অবস্থার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতো। পক্ষান্তরে পর্তুগিজরা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারতো না। অন্য দিকে মুসলমানরা ছাড়াও হিন্দু ও বৌদ্ধরাও পর্তুগিজদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। তাই তারা ডাচদের আগমনকে অনেকাংশে স্বাগতই জানিয়েছিল। ওলন্দাজরা পর্তুগিজদের নৈতিক অবক্ষয় ও স্পেনীয় শাসনের অধীনের বিড়ম্বনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। অবশেষে স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসনের পরোক্ষ সহায়তায় তারা সিংহলে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। প্রথম পর্যায়ে ডাচরা হিন্দু ও বৌদ্ধদের মতো মুসলমানদের সাথেও ইতিবাচক আচরণ করলেও তা খুব বেশিদিন স্থায়ী থাকেনি। মুসলমানরা কিছু কিছু মসজিদ সংস্কার করে নামাজ আদায়ের চেষ্টা করলে স্থানীয় হিন্দু বিশেষত বৌদ্ধ বাধা প্রদান করে। বিশেষত তামিল প্রভাবিত এলাকাসমূহে তারা ডাচদের সাথে যোগাযোগ করে মুসলমানদের স্থাপনাসমূহ ভেঙে মুসলমানদেরকে তাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার প্রস্তাব দেয়। এমতাবস্থায় প্রাথমিকভাবে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। এই কৃতজ্ঞতা ক্ষরণ করে যে, পর্তুগিজদের বিতাড়িত করার সময় মুসলমান ডাচদের সাথে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু এতে তামিলরা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। অবশেষে তারা মুসলমানদের খাবার পানির কূপে শূকরের রক্ত ও মাংস ফেলে নোংরা করে। তাদের সাথে সামাজিকভাবে অসহযোগিতার মাধ্যমে জীবনযাপন দুর্বিষহ করে ফেলে। অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে পূর্ব নাভানতুরাহ অঞ্চলে চলে যায়। মাত্র এক বছরের মধ্যে ডাচরা পর্তুগিজদের পক্ষ অনুসরণ করে। তারা মুসলমানদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর আচরণ শুরু করে। তাদের বসতবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ নানামুখী নির্যাতন শুরু করে। ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে গাল্লি ও মাতারা অঞ্চল থেকেও মুসলমানদের বসতবাড়ি উচ্ছেদ করে দেয়। এমনকি ১৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে কলম্বো থেকেও মুসলিম বসতির উচ্ছেদ ঘটানো হয়। উচ্ছেদকৃত মুসলমানগণ অন্যত্র গিয়ে জমি ক্রয় করে বসতবাড়ি নির্মাণের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। সেই সাথে বিনাপারিশ্রমিকে বাধ্যতামূলক শ্রম আদায়ে বাধ্য করা হয়। এমতাবস্থায় মুসলমানদের অধিকাংশই নির্জন পাহাড়ি অঞ্চলে গিয়ে বসবাস শুরু করে নতুবা অন্য কোন অঞ্চলে শরণার্থী হিসেবে পাড়ি জমায়। ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে কৌশলী রাজনীতি ও বণিকদল হিসেবে মিশন পরিচালনায় সফল হয়েছে ইংরেজরা। পর্তুগিজ বাণিজ্যের সাফল্য এবং তাদের এ সাফল্যের ধারা নিজেদের দিকে নিয়ে স্থায়ী আসন লাভ করার প্রয়াসে তারা দীর্ঘদিন শুধু সম্ভাব্যতা যাচাই ও নিজেদের সুযোগ সুবিধার কৌশলই খুঁজে বেড়িয়েছে। ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে রানী এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর প্রায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়েই সময় কাটায়। ফ্রান্সিস ড্রেক ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে সমুদ্রপথে সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন শেষে উত্তমাশা অন্তরীপের পথে ফিরে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে র‌্যালফ ফিচ ভারতবর্ষ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভ্রমণ করে লন্ডনে ফিরে যান। জেমস ল্যাংকাস্টার ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে এপ্রিল মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে পেনাঙ সফর করে ১৫৯৪ সালের মে মাসে লন্ডন প্রত্যাবর্তন করেন। ১৫৯৯ সালে জন মিলডেন হল স্থলপথে ভারত সফর করেন। তারা উপলব্ধি করেন যে, ব্যক্তিগত বাণিজ্যে পর্তুগিজদের সাথে সফল হওয়া সম্ভব নয়। তাই সম্মিলিত বাণিজ্যের জন্য রানী এলিজাবেথ ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর 'The Governor and Company of Marchants of London Trading into the East Indies'' কোম্পানির নামে রাজকীয় সনদ দান করেন। এ কোম্পানিই সাধারণভাবে ‘ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ নামে পরিচিত। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর অবশেষে স্যার টমাস রো ভারতে বাণিজ্যের সূত্রপাতে সফল হন। সেই সূত্র ধরেই তারা ডাচদেরকে সুকৌশলে বিদায় করে দিয়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায়। এক্ষেত্রে ডাচও পর্তুগিজ কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করে। বিশেষত, হিন্দুদের মন্দির, বৌদ্ধদের মঠ ও মুসলমানদের মসজিদগুলো পুনরায় চালুর সুযোগ করে দেয়। তাদের ধর্মীয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনঃচালুর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। ফলে স্থানীয় জনগণ ডাচদের চেয়ে ইংরেজদেরকেই তুলনামূলক উত্তম হিসেবে ভাবতে শুরু করে। ডাচরা ইংরেজদের রাজনৈতিক কৌশল বুঝতে পেরে তারাও ধর্মীয় বিষয় কিছুটা উদারনীতি গ্রহণ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে তারা মুসলমানদের জন্য ‘ইসলামিক পারসোনাল লজ’ প্রবর্তন করে। এর মাধ্যমে মুসলমানগণ ব্যক্তিগতভাবে ধর্মচর্চার পূর্ণসুযোগ লাভের সাথে সাথে ইসলামের পারিবারিক আইনের বাস্তবায়ন করার সুযোগ পায়। মিরাস, বৈবাহিক ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামী নীতিমালাসমূহ রাষ্ট্রীয়ভাবেই পালনের সুযোগ ঘটে। ইংরেজরা ডাচ প্রবর্তিত সুযোগ সুবিধাগুলো মুসলমানদের বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি করে দেয়। ফলে দীর্ঘদিন পরে মুসলমানগণ নিজেদেরকে আলোকিত জগতের অধিবাসী হিসেবে ভাবতে শুরু করে। অবশেষে ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ডাচদের বিদায় করে ব্রিটিশরা সিংহলের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে, মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে প্রবর্তিত আইনসমূহ সংস্কারের জন্য ব্রিটিশের কাছে দাবি জানাতে থাকে। দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের ভূমিক্রয় নিষিদ্ধ আইন এবং বাধ্যতামূলক শ্রম আইন বাতিল করে মুসলমানদেরকে দাসত্বপূর্ণ জীবনযাত্রা থেকে মুক্তি দেয়। অতঃপর ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে পারিবারিক আইনের বিষয়ে মুসলিম বিচারক বা কাজীর মাধ্যমে ইসলামিক আইন অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করার সুযোগ প্রদান করে। মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তিতে কিছুটা অধিকার ফিরে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে সেসব স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধমে মুসলমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পায়। শ্রীলঙ্কান মুসলমানদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা শ্রীলঙ্কা মধ্যম আয়ের দেশ হলেও বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতে মুসলমানদের পেশাগত পরিবর্তনের কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে বেশ কয়েকটি স্তরবিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। সেই সাথে আরবীয়, মালয়ী ও ভারতীয় মুসলমানদের সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণে সেখানে ধর্মীয় ও সংস্কৃতির দিক থেকেও কয়েকটি স্তরবিন্যাস চোখে পড়ে। আর্থসামাজিক ও পেশাগত অবস্থান শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্য ব্যাপদেশেই মুসলমানদের আগমন ঘটেছিল। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর দিকেই আরবীয় মুসলমানগণ ব্যবসায়-বাণিজ্যের মিশন নিয়ে এ অঞ্চলে আসেন। পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিনা বাধায় এ ধারা অব্যাহত থাকায় মুসলমানদের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি মুসলমানগণ অর্থনৈতিক দিক থেকেও অনেক সমৃদ্ধশালী ছিল। তা ছাড়া আরবীয় বংশোদ্ভূত ও স্থানীয় মহিলাদের বর্ণসংকর হলেও শ্রীলঙ্কান সমাজে তাদেরকে সম্ভ্রান্তশালী জনগোষ্ঠী হিসেবেই মর্যাদা দেয়া হতো। শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য তারা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নিকটও সমাদৃত ছিলেন। কিন্তু পর্তুগিজ, ডাচ ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে তারা শুধু পেশাগতভাবে বাণিজ্যিক ঐতিহ্য থেকেই ছিটকে পড়েনি বরং স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি হারিয়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছেন। জীবিকার প্রয়োজনে তাদের অনেকেই কৃষি, মৎস্য শিকার, দর্জি, শ্রমিক প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিত হয়। সমগ্র মুসলমানদের মধ্যকার শতকরা ৯০ ভাগ কৃষিজীবী ও শ্রমিক। বাকি শতকরা ৯ ভাগ ব্যবসায়ী এবং মাত্র শতকরা ১ ভাগ সরকারি চাকরিজীবী। ফলে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ও শিক্ষায় সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে তাদের অনেকেই সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষে পরিণত হয়। তবে ব্রিটিশের শেষ পর্বে অর্থাৎ বিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে মুসলমানদের অনেকেই আবারো তাদের পুরনো ঐতিহ্য ফিরে আনতে শুরু করেছে। শিক্ষার ধারা খানিকটা উন্মুক্ত হওয়ায় মুসলমানগণ শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ৭৪৯টি মুসলিম স্কুল এবং ২০৫টি মাদরাসা রয়েছে যেখানে ইসলামিক শিক্ষার সুব্যবস্থা আছে। জামিয়া নালিমিয়া নামে বেরুওয়ালায় একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে বর্তমান সময়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে কেউ কেউ দেশের অ্যাকাউন্টস, মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় স্থান দখল করতে শুরু করেছে। সেই সাথে অনেকে দেশে ভালো কোন পেশা গ্রহণ করার সুযোগ না পেয়ে দেশের বাইরে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সামাজিক শ্রেণীভেদে মুসলমানদেরকে প্রধানত তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রথমত, মুর বা মোরো মুসলিম শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ মুসলমান মুর বা মোরো নামে পরিচিত। এ নামটি মূলত পর্তুগিজদের দেয়া এক প্রকার গাল-মন্দ করার শব্দ। স্পেনীয়রা মরক্কোসহ শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ মুসলমান এবং স্পেনীয় মুসলমানদেরকে সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করতো। তাই অনেকটা বিদ্বেষবশত ঘৃণাভরে তারা মরক্কোর অধিবাসী হিসেবে তাদেরকে মোরো বলত। সেই ধারাবাহিকতায় মুসলমানদেরকে মোরো বা মুর নামে আখ্যা দেয়। কালক্রমে স্পেনীয় ও পর্তুগিজদের দেয়া ব্যঙ্গাত্মক নামেই ফিলিপাইনের মুসলমানগণ এবং শ্রীলঙ্কার আরবি ও পূর্বতন মুসলমানগণ মোরো বা মুর নামে অভিহিত হয়। শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের ইতিহাসে মুরদের ইতিহাসই প্রাচীন। আরবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সমকালেই যে আরবীয় মুসলিম বণিকগণের আগমনের ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল এরা তাদেরই বংশধর। সূচনালগ্ন থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এ মুসলমানগণই শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু পর্তুগিজদের দমন-পীড়নে এরা জীবনের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শহর থেকে বিতাড়িত হয় পাহাড়ি ও গ্রামীণ জনপদে। প্রসিদ্ধ বণিকগোষ্ঠীর সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে নেমে যায় কৃষক, শ্রমিক, মৎস্যজীবী, ক্ষুদ্র দোকানদার, ফেরিওয়ালা এবং নিম্নশ্রেণীর পেশাদার জনগোষ্ঠীতে অর্থনৈতিক দেনা ও পেশাগত দুর্বলতার কারণে তারা সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জনগোষ্ঠী হলেও তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এখনো শিষ্টাচার ও নিয়মনীতির প্রভাব লক্ষণীয়। ভাষা ব্যবহারেরও তারা আরবীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করার চেষ্টা করে। দৈনন্দিন তাদের ব্যবহৃত শ্রীলঙ্কান ভাষাতেও আরবি শব্দমালা ‘অ্যারাবিক টার্ম’ ও ইসলামী ঐতিহ্যপূর্ণ শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কোন কোন পরিবারে এখনো মাতৃভাষার মতো আরবি ভাষা ব্যবহৃত হয় একান্ত পারিবারিক পরিসরে। তবে বর্তমানে এ ধারা অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। তামিল মুসলমানরাও মুর নামেই পরিচিত। এরাও পর্তুগিজদের আগমনের পূর্ব থেকেই ইসলামী দীক্ষা নিয়েছে বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তামিল মুসলমানগণ ভারতের তামিললাড়– থেকে এসে শ্রীলঙ্কায় স্থায়ী আবাসন গড়ে তোলে। এরা সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কান তামিলদের চেয়ে ভিন্নতর হয়ে পড়েছে। ভাষাগতভাবে তামিল ব্যবহৃত হলেও তাদের মধ্যে আরবি ও ইসলামী শব্দ অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে তামিল ভাষা এবং ইসলামী আদর্শের লালনের ক্ষেত্রে এদের অনেকেই খুব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেই অনুমিত হয়। 'Islam engal vazhi: inpath thamil engal mozli' (Islam is our path: rejoicing Tamil is our languageশ্লোগানটি তামিল মুসলমানদের কাছে খুব প্রিয়। একসময় এদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান অনেক উন্নত থাকলেও ঔপনিবেশিক শাসনামলে অনেকাংশে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। তবে ব্রিটিশের শেষ দিকে তারা শিক্ষাগ্রহণ ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কিছুটা সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হয়। বর্তমানে অধিকাংশ তামিল মুসলমানই নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন যাপন করে থাকে। দ্বিতীয়ত, মালয়ী মুসলিম মালয়ী বংশোদ্ভূত মুসলমানদেরকে সাধারণত মুর নামে আখ্যা দেয়া হয় না। এরা মালয়ী মুসলমান হিসেবেই পরিচিত। এদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে প্রায় ৫০ হাজার। ইন্দোনেশিয়া অঞ্চল থেকে ডাচরা শ্রীলঙ্কা আগমনকালে এদের অধিকাংশই ডাচদের সৈনিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের সাথেই শ্রীলঙ্কায় এসে বসতি গড়ে তোলে। এদের বৃহৎ অংশই পরবর্তীতে স্বদেশে ফিরে গেলেও কিছু মালয়ী শ্রীলঙ্কান নাগরিক হিসেবেই সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। মালয়ী ও ইন্দোনেশীয় বংশোদ্ভূত শ্রীলঙ্কান এ মুসলমানরা পারিবারিকভাবে বাহাসা-মেলায়ু ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তবে শ্রীলঙ্কান ভাষাতেও তারা স্বাভাবিক পারদর্শী। এরা তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ উন্নত এবং অধিকাংশই ব্যবসায়ী ও কিছু নাগরিক চাকরিজীবীও রয়েছে। তৃতীয়ত, ভারতীয় ও অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠী ভারতীয় অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মেমোন, দাউদি বোহরা, খোজা প্রভৃতি। মেমোনরা মূলত বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধ অঞ্চলের অধিবাসী। ১৮৭০ সালে এরা প্রথম শ্রীলঙ্কায় আগমন করে। এদের সংখ্যা মাত্র ৫ হাজারের বেশি হবে না। ১৮৮০ সালের সমসাময়িককালে গুজরাট অঞ্চল থেকে দাউদি বোহরা ও খোজা নামক মুসলমানরা শ্রীলঙ্কায় আসে। এদের সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি হবে না। এরা সকলেই শ্রীলঙ্কান ভাষা ব্যবহার করলেও ইতঃপূর্বে স্ব স্ব অঞ্চলের মাতৃভাষাকে অনেকটা আদর দিয়েই আগলে রেখেছে। এরা যেহেতু ঔপনিবেশিক অঞ্চলে বাণিজ্যের কারণেই এসেছিল। সুতরাং এদের অধিকাংশের পেশা এখনও বাণিজ্যকেন্দ্রিক। অর্থনৈতিক দিক থেকে এরা খুব সচ্ছল না হলেও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে এরা খুবই যতœবান। শ্রীলঙ্কান মুসলমানরা ধর্মীয় দিক থেকে খুবই শান্তিপ্রিয়। শিয়া-সুন্নি, হানাফি-শাফেয়ি প্রভৃতি গোত্র ও মাজহাবের লোকজন বসবাস করলেও সেখানে তেমন কোন মতভেদ লক্ষ্য করা যায় না। মুসলমানদের মধ্যকার মুর মুসলমানগণ সুন্নি ধারায় এবং শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী। ইসলাম পালনের ক্ষেত্রে এরা অনেকটা কট্টোরপন্থী হিসেবে পরিচিত। নাম গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা স্থানীয় প্রভাব রাখলেও আরবীয় শব্দ গ্রহণে খুব যতœবান। মালীয়রাও সুন্নি ধারার মুসলমান। তারাও শাফেয়ি মাজহারের অনুসারী। এরাও মুর মুসলমানদের মতই অনেকাংশে রক্ষণশীল মানসিকতা লালন করে। মেমোন মুসলমানরা সুন্নি ধারার মুসলমান এবং হানাফি মাজহাবের অনুসারী। তবে দাউদি বোহরা এবং খোজা মুসলমানরা শিয়া মতাবলম্বী। এরা ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান পালনের চেয়ে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। শ্রীলঙ্কায় প্রায় দুই হাজারের বেশি মসজিদ আছে। মসজিদগুলো সরকারি ট্রাস্টিবোর্ড ও ওয়াকফ বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রত্যেক মসজিদে কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সেখানে তামিল ও শ্রীলঙ্কান ভাষায় ইসলামী গ্রন্থের সঙ্কট রয়েছে। হজব্রত পালনের সুযোগ কম থাকলেও নিজস্ব উদ্যোগে প্রত্যেক বছরই কম বেশি মুসলমান হজব্রত পালনের জন্য গমন করে থাকেন। রাজনৈতিক অবস্থান রাজনৈতিক দিক থেকে মুসলমান কখনোই সুবিধাজনক অবস্থানে আসতে পারেনি। ধর্মীয় ঐতিহ্যের লালন করতে গিয়ে তারা ঔপনিবেশিক শাসনামলে যেমন নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছে, এখনো সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় বৌদ্ধরা ও হিন্দুরা রাজনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী। তারা রাজনৈতিক ইস্যুকে অনেক সময় ধর্মীয় দাঙ্গার রূপান্তর ঘটিয়ে মুসলমানদের ওপর জুলুম ও নির্যাতন চালিয়ে থাকে। বিশেষ করে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে পাত্তালাম অঞ্চলে এবং ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে গ্যালে অঞ্চলে রাজনৈতিক সহিংসতাকে ধর্মীয় দাঙ্গায় পরিণত করে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করেছিল। তবে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে মন্ত্রিপরিষদে একজন করে মুসলমান মন্ত্রী রাখা হয়ে থাকে। মুসলমানদের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও স্বাবলম্বী করার জন্য অনেক সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনগুলো হলো মুসলিম লিগ, দ্যা সিলোন মুরসলিগ, দ্য ইসলামিক সোসালিস্ট ফ্রন্ট, দ্য জামায়াতে ইসলামী, দ্য অল সিলোন কাউন্সিল অব উলামা, দ্য মুসলিম ইউথ লিগ, দ্য অল সিলোন মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স, দ্য ইউনিভার্সিটি মুসলিম মজলিস, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইনস্টিটিউট, অল সিলোন জামিয়াতুল উলামা, মুরস ইসলামিক কালচারাল হোম, নাশিমিয়া ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক স্টাডিজ সোসাইটি, অল সিলোন মুরস অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি। সংগঠনসমূহ রাজনৈতিক কর্মসূচির চেয়ে ইসলাম চর্চা, মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশেই অধিকতর ভূমিকা পালন করে থাকে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসসহ ইসলামের বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থসমূহ আরবি ভাষা থেকে তামিল ও শ্রীলঙ্কান ভাষায় অনুবাদ করে মুসলমানদের জাতের নাগালে পৌঁছে দিতে এসব সংগঠনের ভূমিকা প্রশংসনীয়। পরিশেষে বলা যায়, শ্রীলঙ্কা ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ একটি প্রাচীন জনপদসমৃদ্ধ রাষ্ট্র। দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে এখানকার জনজীবনে খুব বেশি উন্নয়নের সুযোগ আসেনি। তদুপরি প্রায় তিন দশক যাবৎ গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মুসলমানরা ইসলামী তাহজিব তমদ্দুনের ব্যাপারে সুযোগ না থাকার কারণে কেউ কেউ ইসলামের মৌলিক আদর্শ থেকে খানিকটা দূরবর্তী অবস্থানে চলে গেছে। বিশেষ করে রামবুক্কানা অঞ্চলের মুসলিম শিশুরা বৌদ্ধ মঠসমূহে শিক্ষাগ্রহণ করার কারণে তারা ইসলামের আদর্শ সম্পর্কে খুবই কমই অবগত হওয়ার সুযোগ পায়। তদুপরি তারা মসজিদকে এতটাই শ্রদ্ধা করে যে, মসজিদে শব্দ যায় এমন দূরত্বে গানবাজনা বন্ধ করে রাখে। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছরের ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ ও জুলুম নিপীড়নে মুসলমানরা উন্নত আর্থ-সামাজিক অবস্থান থেকে দরিদ্রতার মাঝে নিমজ্জিত হয়েছে। আধুনিককালে স্বাধীনতা-উত্তর শ্রীলঙ্কার কিছুটা উন্নয়নের ছোঁয়া লাগায় সুযোগ তৈরি হলেও দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ মুসলমানদের অনেকাংশে সমস্যার মুখোমুখি করে ফেলেছে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলীয় এলাকার লক্ষাধিক মুসলমান ও গৃহযুদ্ধের কারণে নিজেদের বসতবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তদুপরি মুসলমানরা স্বদেশের প্রতি অত্যন্ত অনুগত এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হলেও মুসলমানরা তাদের স্বদেশকে প্রাণ দিয়েই ভালোবাসে। দেশের উন্নয়নে তারা ভীষণভাবে আন্তরিক। ঐতিহাসিক গ.M. Ali Kettani বলেন,Muslims are completely integrated in the country and serve it most sincerely as they did for one thousand years. সুতরাং রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ব্যাপারে আরো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দাবিদার তারা হতেই পারে। (সমাপ্ত) লেখক : কবি ও গবেষক; প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির