post

শ্রীলঙ্কার মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতি

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আলোচিত দেশ শ্রীলঙ্কা। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত এ দ্বীপটির পূর্ব নাম ছিল সিংহল, যা বর্তমানে শ্রীলঙ্কা নামে পরিচিত। এখানকার জনসাধারণ বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এখানে দীর্ঘদিন যাবৎ হিন্দুশাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে বাণিজ্যিক সূত্রে এ অঞ্চলের সাথে আরবীয় বণিকদের যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্র ধরেই আরবে ইসলাম বিস্তারের সময়কালেই ব্যবসায়িক সূত্রে এ অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে। কিন্তু রাজনৈতিক সহনশীল পরিবেশের অভাবে এখানে মুসলমানরা সালতানাত প্রতিষ্ঠার মতো সুযোগ গ্রহণ করতে পারেনি। বিশেষ করে পর্তুগিজ, ডাচ ও ব্রিটিশের নির্যাতনমূলক আচরণের কারণে মুসলমানরা সর্বস্বান্ত ও পর্যুদস্তই হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে শ্রীলঙ্কা অনেকটা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল। যার কারণে ষোড়শ শতক পর্যন্ত দক্ষিণ ভারত ও সিংহলের মধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয় এবং এখানকার সম্রাটগণ ভারতের মাদুরা পর্যন্ত দখল করে স্বীয় শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপের বিভিন্ন সা¤্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এ অঞ্চলের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। প্রথমদিকে এখানে ওলন্দাজদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠা হলেও ১৭৯৬ সালে ব্রিটিশরা ওলন্দাজদের নিকট থেকে সমগ্র সিংহল দ্বীপ অধিকার করে ১৮০২ সালে উপনিবেশ স্থাপন করে। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার শাসনভার ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ১৯২৮ সালে ডোনেমোর কমিশন নামে একটি কমিশন নিয়োগ করে এর ওপর শ্রীলঙ্কার শাসন-সংস্কার সাধনের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার পুরোপুরিভাবে শ্রীলঙ্কাকে উপনিবেশের মতই শাসন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অন্যান্য দেশের মতো শ্রীলঙ্কাতে স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হলেও তা ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এ আন্দোলনকে দমন করার জন্য সোলবারি কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করে একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেন। তিন বছর পর ১৯৪৭ সালের জুন মাসে বড় লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের আদেশ মোতাবেক শ্রীলঙ্কাকে শর্তাধীনে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দান করে। অতঃপর শ্রীলঙ্কার নতুন সংবিধান ‘অর্ডার ইন কাউন্সিল’ বা সপরিষদ রাজাজ্ঞা বলে কার্যকর করা হয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হলেও শ্রীলঙ্কা ব্রিটেনের ডমিনিয়নে থেকে যায়। ডমিনিয়নের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার প্রধান শাসক বা গভর্নর জেনারেল ব্রিটেনের রাজা বা রানী কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। ১৯৭২ সালের ২২ মে এ অবস্থার সমাপ্তি ঘটে এবং স্বাধীন সিংহলের নাম পরিবর্তন করে শ্রীলঙ্কা রাখা হয় এবং একে কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শ্রীলঙ্কায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার বিচিত্র বর্ণ ও সম্প্রদায়ের আবাসভূমি শ্রীলঙ্কা। এখানে একদিকে যেমন বর্ণপ্রথা বিদ্যমান। অন্যদিকে সিংহলি, সিলন তামিল, মালয়ি, ভারতীয় তামিল, পাকিস্তানি, ইউরোপীয়, বর্গি, আরবীয়সহ মানবজাতির বিভিন্ন শ্রেণী, বিভক্তি মেরুকরণ শ্রীলঙ্কান সমাজের ঐক্যের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা তৈরি করে। রাজনৈতিকভাবে হিন্দু প্রভাবিত অঞ্চল হলেও এখানে বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসের মানুষের সংখ্যা প্রায় শতকরা ৬৮ ভাগ। আরবে ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই শ্রীলঙ্কায় ইসলাম প্রচার ও প্রসার শুরু হলেও অদ্যাবধি সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় মাত্র শতকরা ১০ ভাগ। এ অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে কয়েকটি স্তর লক্ষ্য করা যায়। এক. দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল শ্রীলঙ্কা। রোমান পর্যটক কসমস শ্রীলঙ্কাকে চীনা রেশম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মসলা বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রস্থল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পূর্বদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহসহ চীন এবং পশ্চিমে মালাবার ও ফরমন্ডলীর রাজ্য ও পশ্চিম এশিয়া। মিসরসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত ছিল। খ্রিষ্টপূর্বেই রোমান স¤্রাট ক্রদিয়াস (খ্রি. পূর্ব-২২ থেকে ৭ খ্রিষ্টাব্দ), বাইজানটাইন স¤্রাট জুলিয়ানের (৩৫৫-৩৬০ খ্রি.) নিকট শ্রীলঙ্কা থেকে দু’টি মিশন প্রেরণের কথা জানা যায়। তা ছাড়া পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমার্ধে শ্রীলঙ্কা থেকে টানেও চংরাট মিশন প্রেরিত হয়। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে বাণিজ্য শক্তি হিসেবে আরব মুসলমানদের অভ্যুদয়ের পর আরব, গুজরাট ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ইউরোপীয়দের এশীয় অঞ্চলে আগমনের পূর্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ইসলামে দাওয়াতি কাজের সম্প্রসারণকে অন্যতম ফরজ ইবাদত হিসেবে ঘোষণা করার কারণে মুসলমানগণ ব্যবসায়ী কর্মকান্ড পরিচালনার পাশাপাশি ইসলাম প্রচারকে অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে। সেই সূত্রেই মহানবী সা:-এর জীবদ্দশাতেই তার অন্যতম সাহাবী হযরত সাদ (রা)-এর চীনে আগমনের তথ্য পাওয়া যায়। সেই সাথে হিজরি প্রথম শতকেই শ্রীলঙ্কাতে মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে ইসলামের আগমন ঘটেছে বলেও উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদ M. Ali Kettani e‡jb, Islam entered Sri Lanka in The Seventh Century C.E. with Arab Traders from South Arabia. From the beginning, Muslims were well received by the local kings and they soon became a trading community with necessary international links. দুই. শ্রীলঙ্কা ছিল তৃতীয় পক্ষীয় বাণিজ্যকেন্দ্র। এ অঞ্চলেও উন্নতমানের দারুচিনি উৎপাদিত হতো। সেই সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে মসলা এবং চীন থেকে রেশম ও চীনামাটির দ্রব্য এখানে আমদানি করা হতো। এগুলো ভারতের বিভিন্ন স্থানসহ পারস্য এবং লোহিত সাগরের দিকে প্রেরিত হতো। এসব পণ্যসামগ্রী সংগ্রহের জন্য আরব বণিকগণ এ দ্বীপটিতে ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য ব্যাপকভাবে যাতায়াত করতো। নৌবাণিজ্যে দীর্ঘসময়ের যাতায়াত পথের কারণে অনেকেই তার পরিবার পরিজন নিয়ে আসতো এবং দীর্ঘসময় এখানে বসবাস করতো। কেউ বা স্থানীয় মেয়েদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শ্রীলঙ্কাকে দ্বিতীয় আবাসস্থল হিসেবে গ্রহণ করতো। অষ্টম শতাব্দীর সূচনালগ্নে অর্থাৎ ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের সেনাপতি এবং ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু অভিযানের অন্যতম প্রধান কারণই ছিল জলদস্যু কর্তৃক লুণ্ঠিত মালামাল ও মুসলমানদের উদ্ধার করা। দীর্ঘদিন যাবৎ আরবীয় বণিকগণ শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্য মিশন পরিচালনা করতো। কোন এক মহামারীতে শ্রীলঙ্কায় বসবাসকারী আরবীয় বণিকদের অধিকাংশই ইন্তেকাল করেন। শ্রীলঙ্কার রাজা নিহত বণিকগণের জন্য খুব শোকাহত হয়ে পড়েন। উক্ত বণিকগণের স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনকে সঠিকভাবে আরবে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং স্বদেশে পৌঁছে তারা যাতে অর্থনৈতিকভাবে সমস্যায় না পড়েন এই জন্য পর্যাপ্ত মালামালসহ ৮টি জাহাজে খলিফা আল ওয়ালিদের জন্যও কিছু উপঢৌকন প্রেরণ করেন। কিন্তু উক্ত জাহাজগুলো সিন্ধুর নিকটবর্তী দেবল বন্দরে উপনীত হলে স্থানীয় জলদস্যু কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়। সিন্ধুরাজা দাহিরকে এর বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খলিফা দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তিনি কোন ব্যবস্থা না করায় সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধুতে অভিযান প্রেরিত হয়। যাহোক, আরব বণিকরা যে শ্রীলঙ্কায় কেবল ব্যবসায়-বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল না বরং সেখান আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ ইসলামের সুমহান আদর্শ দিয়ে রাজার মন জয় করে তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, নিহত মুসলিম পরিবারের প্রতি তাঁর সহানুভূতিসুলভ আচরণে তা স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত হয়। তিন. মালয় জগতের পাসাই অঞ্চলে ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই। পাসাইকে ঘিরে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহে তখন ইসলামের প্রচার ও প্রসারে মুসলমানগণ বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। এ সময় উত্তর মিলন অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন চন্দ্রভানু। তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি প্রচন্ড বিদ্বেষ পোষণ করতেন। বৌদ্ধ ধর্মের মূলোৎপাটন করার জন্য পার্শ্ববর্তী শাসকদের সহায়তা কামনা করতেন। সেই সূত্র মালয়িরাজা নাখোন শ্রী ধাম্মারাতকে সহযোগিতার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি উত্তর শ্রীলঙ্কার ক্রা ও মালয় উপদ্বীপ এর মধ্যকার সংযোগ স্থলে মালয়ি সৈনিকসহ সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন। ১২৪৭ সালে আগত উক্ত মালয় সৈনিকদের সাথে বেশ কিছু মুসলমান সৈনিকও শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন। তারা নিম্নবর্ণের হিন্দুসহ নির্যাতিত বৌদ্ধদের মাঝে ইসলামের সাম্যশান্তির সুমহান আদর্শের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে সক্ষম হন। বিশেষ করে জাভা পাতনাম বা জাফনা জাভা কাচচেরি বা চাভাকাচ্চেরি, হামবানতোতা প্রভৃতি অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ব্যাপকভাবে সফল হন। চার. হালাকু খান কর্তৃক ১২৫৮ সালে বাগদাদ ধ্বংস হলে শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের সাথে আরবীয় বণিকদের যোগাযোগ অনেকাংশে হ্রাস পায়। অনেক আরবীয় বণিক আর আরবে ফিরে না গিয়ে শ্রীলঙ্কাতেই স্থায়ী আবাসস্থল হিসেবে শ্রীলঙ্কাকেই বেছে নেয়। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কান মুসলমানগণ দক্ষিণ ভারতের মুসলমানদের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে। এদের কেউ কেউ দক্ষিণ ভারতে বসতি গড়ে তুললেও দক্ষিণ ভারত থেকেও অনেকে শ্রীলঙ্কায় এসে বসতি স্থাপন করে। আরবীয়রা সাধারণত ইমাম ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর মতাবলম্বী এবং দক্ষিণ ভারতীয়রা তামিল মুসলিম নামে খ্যাত। ঐতিহাসিক M Ali Kettani বলেন, This, The Present Muslim population of Sri Lanka received from South Arabia, its school (Shafii) and from South India, its Language (Tamil) which is different from the language of the majority (Sirhalese).এ সময় সিংহলের উত্তরাঞ্চলসহ প্রায় একক প্রভাব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সমগ্র সিংহলীয় বাণিজ্যে মুসলমানরা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। পাঁচ. চতুর্দশ, পঞ্চদশ এবং ষষ্ঠদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ ছিল মুসলমানদের স্বর্ণালি যুগ। এ সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশেষত মালয় অঞ্চলে মুসলমানরা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। পূর্ব এশিয়ায় বিশেষত মালয় অঞ্চলে মুসলমানগণ সালতানাত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। সেই প্রভাবে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে ইসলামের সুমহান বাণীর প্রচার ও প্রসারে ব্যাপক তৎপরতা ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ সময় আরবীয় বণিকদের পাশাপাশি ভারতীয় ও মালয়ি বণিক, ইসলাম প্রচারক-আউলিয়া কিরাম সিংহলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এ সময় স্থানীয় বণিকশ্রেণী, রাজপরিবারের সদস্য, রাজসভার অমাত্য প্রভৃতি অভিজাত শ্রেণী থেকে শুরু করে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও নির্যাতিত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। মুসলমানদের উন্নত নৈতিকতা ও আদর্শিক ভিত্তি, অর্থনৈতিক সহযোগিতানীতি এবং বর্ণবাদহীন সামাজিক উদারতা স্থানীয় সমাজে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। অনেকে ইসলাম গ্রহণ না করলেও পর্দাপ্রথা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, উন্নত ও মজাদার রান্নাপদ্ধতি, শালীন পোশাক পরিচ্ছদ, সামাজিক লেনদেনে স্বচ্ছতা প্রভৃতি বিষয়গুলো তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসে থেকেও সামাজিকভাবে গ্রহণ করেছিল। মুসলমানগণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হলেও সমাজ পরিবর্তনের প্রধান ভূমিকায় ছিলেন মুসলমানগণ। ঐতিহাসিক গ. M Ali Kettani বলেন, By The sixteenth century The Muslims were well concentrated in the south-west coast with main centers at Colombo, Beruwala and Galle. ষষ্ঠদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইসলামের এ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াই এতোটাই সম্প্রসারিত হয়েছিল যে, স্থানীয়ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে মুসলমানগণই অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এমনকি প্রশাসনিক দিক থেকে মুসলমানগণ সমাজের অভিজাত শ্রেণী ও রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সুতরাং বলা যায় যে, মুসলমানরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শ্রীলঙ্কায় এসে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করতে সক্ষম হন। রাজধানীসহ শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি অঞ্চলেও ইসলামের নৈতিক প্রভাব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি অনেকে সরাসরি ইসলামে দাখিল না হলেও স্বধর্মে অবিচল থেকেও ইসলামের আর্থ-সামাজিক সমবিধানের প্রতি অনুগত ছিল। মাদকতা, ব্যভিচার এবং বেপর্দাপ্রথার বিপরীতে সেখানে ইসলামের সাম্যনীতি ও মানবতাবাদ ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিল। ফলে সেখানে সামাজিক শৃঙ্খলা ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও মুসলিম প্রভাব ব্যাপকভাবে ফলপ্রসূ হয়েছে। (চলবে) লেখক : কবি ও গবেষক; প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির