post

সম্পাদক ও মিডিয়ার প্রতি আওয়ামী বিদ্বেষ

১৬ জুলাই ২০১৩

তানভীর আহমেদ

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেই ভিন্নমতের সম্পাদকরা নির্যাতিত ও নিগৃহীত হন। স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান আমল পর্যন্ত প্রতিটি আওয়ামী লীগ আমলেই সত্যনিষ্ঠ ও সাহসী সাংবাদিকরা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের তোষণ না করায় কোনো কোনো সম্পাদককে সরকারি মালিকানাধীন সংবাদপত্র থেকে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে। তবে কোনো সম্পাদককে গ্রেফতারের পর দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের ঘটনা প্রথম বারের মতো ঘটেছে বর্তমান শাসনকালে। দৈনিক আমার দেশ-এর সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান হয়েছেন এ নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের বিশিষ্ট ও বরেণ্য সম্পাদকরা নির্যাতিত হন। গ্রেফতারের পর সম্পাদকদের রিমান্ডে নিয়ে চরমভাবে নির্যাতন এ দলের রেকর্ডেই আছে। আদালতকে ব্যবহার করে সম্পাদককে ভিত্তিহীন মামলায় সাজা দেয়ার ঘটনা স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আমলেই ঘটেছে। রিমান্ডে নিয়ে সম্মানিত সম্পাদককে বিবস্ত্র করার জঘন্য রেকর্ডটিও আওয়ামী লীগের দখলে। সম্পাদকদের নির্যাতনের জন্য নতুন আইন প্রণয়ন আওয়ামী লীগের রাজনীতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। দলটির সমালোচনা করে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কর্মকাণ্ডের দায়ে গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন প্রখ্যাত সম্পাদকরা। সম্পাদক নির্যাতনে আওয়ামী লীগের এ রেকর্ড দেশের আর কোনো রাজনৈতিক দলের তো নেই-ই, এমনকি বিভিন্ন দেশের সামরিক শাসকদের ইতিহাসেও নেই। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু হওয়া আওয়ামী লীগের সম্পাদক নির্যাতন এখনও চলছে। এর আগে দু’বারের (১৯৭২-৭৫, ১৯৯৬-০১) শাসনামলে নির্যাতন ও গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন গণকণ্ঠ সম্পাদক প্রখ্যাত কবি আল মাহমুদ, অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম, হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান, হক কথা সম্পাদক ইরফানুল বারী। এছাড়া গ্রেফতার করার চেষ্টা করা হয়েছে ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনকে। দলটির সমর্থক হলেও সামান্য ভিন্নমত পোষণ করায় দৈনিক বাংলার সম্পাদনা পরিষদ থেকে হাসান হাফিজুর রহমান, তোয়াব খানকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক, প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদ, আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও শীর্ষনিউজ সম্পাদক একরামুল হককে। সম্পাদককে গ্রেফতারের পাশাপাশি দু’দফায় আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে। সম্পাদককে নির্যাতনের মাধ্যমে সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ ও অনলাইন পত্রিকা শীর্ষনিউজডটকম-এর প্রকাশনা বন্ধ করতে বাধ্য করা হয় বলেও অভিযোগ আছে। মহাজোট সরকারের আমলে দু’বার গ্রেফতার হয়েছেন নন্দিত সম্পাদক কলামিস্ট মাহমুদুর রহমান। দু’বারই রিমান্ডে নিয়ে তাকে নির্যাতন করা হয়। বানোয়াট মামলায় গত ১১ এপ্রিল তাকে আমার দেশ কার্যালয় থেকে দ্বিতীয় বার গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে ডিবি অফিসে নির্মম নির্যাতন চালানো হলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ১৮ এপ্রিল সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় তাকে আদালতে হাজির করে চিকিত্সার জন্য রাজধানীর বিএসএমএমইউ’র আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। তার চিকিৎসা শেষ না হতেই এবং তার চিকিত্সকদের অনুরোধ, দাবি উপেক্ষা করে গত ২৭ মে তাকে অন্যায়ভাবে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যমতে, একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পরের বছর, অর্থাৎ ’৭২ সাল থেকে শুরু হয় তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও সম্পাদক নির্যাতন। সংবিধানে তখন ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র অধিকার দেয়া থাকলেও আওয়ামী লীগ ভিন্নমতের পত্রিকার প্রতি ছিল অসহনশীল। এসব পত্রিকার সম্পাদকেরও জেল-নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনকালের সব বছর পত্রিকা বন্ধ, সাংবাদিক, সম্পাদকদের গ্রেফতার, হয়রানির ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ অবজার্ভার সম্পাদক আবদুস সালাম জাতীয় সরকার গঠনের দাবির সমর্থনে ‘দ্য সুপ্রিম টেস্ট’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন, যা ’৭২ সালের ১৫ মার্চ প্রকাশিত হয়। এ সম্পাদকীয় প্রকাশের দিন তাকে চাকরিচ্যুত করে সরকার। এভাবেই একজন সম্মানিত সম্পাদককে তার অভিমত প্রকাশের মূল্য দিতে হয়। ’৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান একটি নিবন্ধ লেখার কারণে তার বিরুদ্ধে সংসদে, এর বাইরে আওয়ামী লীগের নেতারা অত্যন্ত কুিসত ভাষায় বিষোদ্গার করেন। এ বিষোদ্গার থেকে তার স্ত্রীও তখন রেহাই পাননি। ’৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্রহত্যার ঘটনায় সেদিন বিকালে দৈনিক বাংলা একটি টেলিগ্রাম ইস্যু প্রকাশ করে। এতে সরকার ক্ষুব্ধ হয়। দৈনিক বাংলার সম্পাদনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হাসান হাফিজুর রহমান, সম্পাদক তোয়াব খানকে অপমানজনকভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। শামছুল হক সম্পাদিত বাংলা সাময়িকপত্র ১৯৭২-৮১ বইয়ে উল্লেখিত তথ্যমতে, স্বাধীনতালাভের বারো মাসের মধ্যে গণশক্তি, হক কথা, লাল পতাকা, মুখপত্র, বাংলার মুখ, স্পোকসম্যান ইত্যাদি সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো নিষিদ্ধ করে সরকার। পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদেরও তখন গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন মুখপত্র, স্পোকসম্যান সম্পাদক ফয়জুর রহমান, হক কথার সম্পাদক ইরফানুল বারী প্রমুখ। ’৭৩ সালের মার্চে ঢাকার দৈনিক গণকণ্ঠ আর আগস্টে চট্টগ্রামের দৈনিক দেশবাংলার প্রকাশনা বাতিল করে পত্রিকা দুটির সম্পাদককে গ্রেফতার করে সরকার। গণকণ্ঠ সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে রাতের অন্ধকারে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গণকণ্ঠ কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের রক্ষীবাহিনী পত্রিকাটির কার্যালয়ে তল্লাশি চালায়। পুলিশ সাংবাদিক, কর্মচারীদের গণকণ্ঠ কার্যালয় থেকে বের করে দেয়। ওই সময় সম্পাদকসহ অন্য সাংবাদিকদের শারীরিক নির্যাতন ও লাঞ্ছিত করা হয়। উল্লেখ্য, ’৭২ সালে আল মাহমুদের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে গণকণ্ঠ সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। প্রকাশনা শুরুর ৪২ দিন পর পত্রিকাটি দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পর ভিন্নমতের পত্রিকা ও সম্পাদকরা রোষানলে পড়েন। সরকারের দাবি করা ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ এক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধে। কয়েক সম্পাদকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক অসংখ্য মামলা করেন মন্ত্রী, সরকার দলীয় সংসদ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের তখনকার ফেনীর সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরের আবু তাহেরসহ আরও কয়েক সংসদ সদস্য প্রকাশ্যে, এমনকি জাতীয় সংসদেও দেশের বরেণ্য সম্পাদকদের বিষোদ্গার করেন। জয়নাল হাজারী সংসদে দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদককে অশ্লীল, অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করেন ও হুমকি দেন। সরকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে সাপ্তাহিক দেশব্রতী, সাপ্তাহিক উপমা, সাপ্তাহিক দিশারী, সাপ্তাহিক সমকাল বার্তা, দৈনিক নতুন দিশারী ও ইংরেজি সাপ্তাহিক এভিডেন্স পত্রিকার। এসব পত্রিকার সম্পাদকদের গ্রেফতারের হুমকি দেয়া হয়। ’৯৭ সালের ৩০ অক্টোবর সরকার দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস, বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রা -এ চারটি পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। এসব পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গেও সরকার অসদাচরণ করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৯ সালের শুরুতে মহাজোট সরকার গঠনের শুরু থেকেই সম্পাদক নির্যাতন চলে আসছে। সম্পাদক গ্রেফতার, সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা সাংবাদিকদের হুমকি-মামলা, পত্রিকা, টিভি চ্যানেল বন্ধ করার মতো গণমাধ্যমবিরোধী ঘটনা অবিরাম ঘটছে। এ পর্যন্ত তিনজন সম্পাদককে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া হয়। তারা হলেন সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদ, আমার দেশ-এর মাহমুদুর রহমান ও শীর্ষ নিউজর একরামুল হক। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর করা মামলায় ২২ মে দৈনিক মানবকণ্ঠ সম্পাদক শাহজাহান সরদার এবং ঢাকা টাইমসের সম্পাদক আরিফুর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে হুমকি দেয়া হয়েছে বিভিন্ন সম্পাদককে। ২০১১ সালের ১৯ মে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমদ সিদ্দিকী দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে গ্রেফতারের হুমকি দিয়ে বলেন, ‘চাইলেই আমরা ওই সম্পাদককে গ্রেফতার করতে পারি।’ ‘২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি দৈনিক নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবীরকে মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেয় আওয়ামী লীগের কয়েক ক্যাডার। আমাদের সময়-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানকেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়। প্রথম আলো, নয়া দিগন্ত, মানবজমিন, ইত্তেফাক, যুগান্তর, সমকাল, কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মন্ত্রী, সরকারি দলের সংসদ সদস্য, নেতারা কয়েক ডজন মামলা করেন। আমার দেশ পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর ঘুষ নেয়ার অভিযোগ সম্পর্কে ২০০৯ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্য জনসভা ডেকে মাহমুদুর রহমানকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। অন্যদিকে মহাজোটের আমলে ২০১০ সালের ২ জুন গভীররাতে প্রথমবার গ্রেফতার হন সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তাকে আমার দেশ কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয়। দ্বিতীয় দফায় চলতি বছরের ১১ এপ্রিলও তাকে আমার দেশ কার্যালয় থেকে কমান্ডো স্টাইলে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়। ২০১০ সালে গ্রেফতারের পর একের পর এক মামলা দিয়ে তাকে বারো দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। জেলখানায়ও তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়। তাকে তখন রিমান্ডে নিয়ে বিবস্ত্রও করা হয়। সরকারের প্রভাবশালীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষায় লিখতে গিয়ে রোষানলের শিকার হয়ে ৯ মাস ১৭ দিন বা ২৮৮ দিন তাকে কারাভোগ করতে হয়। এ দেশের ইতিহাসে আর কোনো সম্পাদককে এভাবে গ্রেফতার করা, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন আর একটি প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার কারণে আপিল বিভাগের হুকুমে এতদিন কারাভোগ করতে হয়নি। আদালতকে ব্যবহার করে কোনো সম্পাদককে সরকারের নির্যাতনের উদাহরণ স্বাধীন বাংলাদেশে মাহমুদুর রহমান ছাড়া আর একটিও নেই। ২০১০ সালের ২১ এপ্রিল আমার দেশ এ ‘চেম্বার জজ মানেই সরকার পক্ষের স্টে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সুপ্রিমকোর্টের সরকারি দলের সমর্থক দুজন আইনজীবী মামলায় শাস্তি দেয়া হয় মাহমুদুর রহমানকে। মহাজোট সরকারের শুরু থেকে একে একে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অর্ধশতের বেশি মামলা হয়। গত ১১ এপ্রিল গ্রেফতারের পর মাহমুদুর রহমানকে তিনটি মামলায় ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের বহুল আলোচিত স্কাইপ কেলেঙ্কারি ফাঁস, পুলিশের কাজে বাধাদান ও মারপিটের অভিযোগ এ তিনটি মামলায় মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পুলিশ ২৪ দিনের রিমান্ড চাইলে নিম্ন আদালত ১৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ২৭ মে বিএসএমএমইউ থেকে মাহমুদুর রহমানকে কামিশপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরের সময়ও নির্যাতনের পন্থা বেছে নেয় পুলিশ। সম্পাদক হিসেবে তাকে মর্যাদা দেয়া হয়নি। মাহমুদুর রহমানকে জরাজীর্ণ প্রিজন-ভ্যানে দাঁড় করিয়ে রেখে কারাগারে নেয়া হয়। রাস্তায় উত্তরায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) কার্যালয়ের সামনে গিয়ে বিকল হয়ে পড়ে ভ্যানটি। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের মিডিয়া সম্পর্কে তাদের পর্যবেক্ষণ বলেছে, শাপলা চত্বরের ঘটনায় বাংলাদেশের মিডিয়া নতজানু। ‘মুখে রাম নাম বগলে ইট’ তন্ত্রে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এ দলটি কখনোই সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনি এবং এখনো করছে না। গণতন্ত্রের মূল শর্ত হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং পরমতসহিষ্ণুতা। এ দুটোর কোনোটাতেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে না। আওয়ামী লীগ যে মিডিয়ার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, তা উপরোক্ত বিষয়গুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। তারপরও আরো দু’বকেটি প্রমা এখানে তুলে ধরা হলো ৬ এপ্রিল ১৯৭৪। প্রাচ্যবার্তা পত্রিকার সম্পাদক ফজল লাহানীকে গ্রেফতার করা হয় এবং বন্ধ করে দেয়া হয় প্রাচ্যবার্তার প্রকাশনা। পত্রিকাটি প্রকাশ করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। (জনাব লাহানী মুক্তি পাওয়ার পর বিদেশ চলে যান। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘যদি কিছু মনে না করেন’ নামে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান দীর্ঘ দিন ধরে পরিচালনা করেন।) ১ এপ্রিল ১৯৭৪। হংকং থেকে প্রকাশিত ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকার বাংলাদেশে খণ্ডকালীন সংবাদদাতা ছিলেন সৈয়দ কামাল উদ্দিন। একই সাথে তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় পূর্ণকালীন পদে কর্মরত ছিলেন। ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকায় সৈয়দ কামাল উদ্দিনের শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই অপরাধে তাকে বাসস থেকে বরখাস্ত করার তোড়জাড় শুরু হয়। তিনি অবশ্য পদত্যাগ করে নিজের সম্মান রক্ষা করেন। (পরবর্তীকালে সৈয়দ কামাল উদ্দিন ফার ইস্টার্ন রিভিউ পত্রিকার হংকংয়ের হেড অফিসে যোগ দেন এবং তেহরানসহ বিভিন্ন স্টেশনে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে, পত্রিকা বন্ধ এবং সাংবাদিক নির্যাতন করেও যখন আওয়ামী লীগ সরকার স্বস্তি পাচ্ছিল না তখন তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সংবাদপত্র বন্ধ করার। ১৯৭৫ সালের শুরু থেকেই তারা গ্রাউন্ড ওয়ার্ক শুরু করে। ১৯৭৫ সালের ১৬ এপ্রিল তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী কোরবান আলী বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশে এত সংবাদপত্র এবং সাময়িকী থাকার কোনা প্রয়োজন নেই। ২৭ এপ্রিল তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত নিউজপ্রিন্টের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দেশে এর অপচয় না করে বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হবে। ১৬ জুন ১৯৭৫। এই দিন বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্বের চূড়ান্ত ঘোষণা আসে। জারি করা হয় সংবাদপত্র ডিক্লারেশন বাতিল আইন। ১৭ জুন এটি কার্যকর হয়। দেশে মাত্র চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব সংবাদপত্র এই আইনের বলে বাতিল হয়ে যায়। যে চারটি বাতিলের হাত থেকে বেঁচে যায়, সেগুলাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। (১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর এই আইনটি বাতিল করা হয় এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্র-সাময়িকীগুলা পুনঃপ্রকাশিত হতে থাকে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’-এর নীতি বলে অভিহিত করেছিলেন)।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির