post

সাহিত্যিকদের দায়িত্ববোধ আগামীর প্রত্যাশা

হেলাল আনওয়ার

০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
উহারা চাহুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ। -কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য একটি শিল্প। শিল্পীর শিল্পিত চিন্তা-চেতনা, আর গবেষণার বহিঃপ্রকাশই হলো সাহিত্য। এই সাহিত্য শুধু ভাবের বিষয় নয়, অগ্নিদাহনের মতো যার অমিত তেজ রবি রশ্মির মতো দিগি¦দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দ্যুতির বিচ্ছরণে আলোকিত হয়ে ওঠে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি দশ দিগন্ত। সেই নির্মল আলোর উত্তাপে সন্দিগ্ধ এবং সুপ্ত আত্মারা খুঁজে পায় শান্তির অমিয় ধারা, স্বস্তির পেলবতা আর নিরাপত্তার ক্যানভাস। তাই সাহিত্যিক যদি প্রলুব্ধতার ঘেরা টোপে নিজেদেরকে আবিষ্ট করে রাখেন তাহলে সে সাহিত্য মূল্যহীন ও বন্ধ্যা হয়ে যায়। সেই সাহিত্যের মধু নির্যাসও হয়ে ওঠে তিক্ত ও বিস্বাদ। আর বিস্বাদ সাহিত্য নিয়ে এই সমাজ কেবল হতাশায় নিমজ্জিত হবে না বরং ক্ষয় হতে হতে এই সমাজ এক সময় লয় হয়ে যাবে। এজন্য সাহিত্যিকগণ যেমন হবেন সমাজ, ধর্ম, গোত্র, এমনকি সব দিক দিয়ে সচেতন তেমনি হবেন সংস্কারক। শিল্পী যদি তার রৈখিক চিত্রকল্পে ভুল করেন তাহলে অবশ্যই তার গোটা শিল্পকর্মের ওপর প্রভাব পড়বে। ঠিক তেমনি, সাহিত্যিক যদি তার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এড়িয়ে যান এবং সাহিত্য রচনা করেন তাহলে তা হবে নিজ সমাজ বা নিজ জাতির সাথে এক ধরনের প্রতারণার শামিল। সমাজসচেতন সাহিত্যিকগণকে অবশ্যই একজন দায়িত্ববান হিসেবে মনে করা উচিত। সমাজের দায়বদ্ধতাই তাদেরকে সুন্দরের পূজারি হতে সাহায্য করবে। কেননা, হাজার কোটি মানুষের তৃষিত হৃদয় তাদের সৃষ্টিকর্মের দিকে তাকিয়ে আছে। ধোঁয়াশার আঁধার কেটে সত্যের আলোক শিখা প্রজ্বলনের গুরু দায়িত্ব একমাত্র সাহিত্যিকদের স্কন্ধে। এ জন্য সমাজ বিনির্মাণের স্বাপ্নিক চাহনি থাকতে হবে আমাদের সাহিত্যিকদের। পবিত্র আল কুরআনের একটি সূরার নামই হলো আশ শুয়ারা। শব্দটি আশ শি’রুন থেকে এসেছে। যার অর্থ কবিতা। শি’রুন শব্দটিকে কর্তাবাচ্যে বলা হয় আশ শায়েরু। আর শায়ের শব্দটির বহুবচন হলো আশ শুয়ারা। যার অর্থ কবিগণ। এই সূরাতে কবি বা সাহিত্যিকদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচিত হয়েছে। এই সূরার অন্তর্নিহিত ভাব অনুধাবন করলে বুঝা যায়, কবি বা সাহিত্যিকেরা দেশ, জাতি আর সমাজের জন্য কতবড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কবি বা সাহিত্যিকেরা হলেন সমাজের সার্চলাইট, যা সমাজের ওপর খুব সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সাহিত্যের মাধ্যমে যত সহজে ভাবের আদান প্রদান করা যায় বোধ করি এত সহজে আর কোন মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তাই সাহিত্য রচনার সময় সাহিত্যিকদের অবশ্যই ভীষণভাবে সচেতন থাকতে হবে। সাথে সাথে তাদেরকে জবাবদিহিতার মনোভাবও পোষণ করতে হবে। আজকের আলোচনায় তাওহিদি সমাজগঠনে একজন কবি বা সাহিত্যিকের ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। সমাজ বা সমগ্র জাতির হিত সাধনের লক্ষ্যে যারা কিছু রচনা করেন (সাহিত্য মান বিচারে) তাদেরকে আমরা সাহিত্যিক বলে থাকি। এই সাহিত্য দুই ধরনের। তাই সাহিত্যিকগণও দুই ধরনের। এক. আস্তিক। দুই. নাস্তিক। যাকে বলতে পারি তাওহিদপন্থী ও নিরীশ্বরপন্থী। তাওহিদপন্থী হলেন যারা মহান রাব্বুুল আলামিনের একত্ববাদকে স্বীকার করেন, বিশ্বাস করেন এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের বাস্তব জীবনকে পরিচালনা করেন। অর্থাৎ-পৃথিবীতে মহান স্রষ্টার একক কর্তৃত্বকে প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেন। আর যারা একত্ববাদকে অস্বীকার করে এবং বহুত্ববাদকে ধারণ করে যারা ইচ্ছে মতো লাগাম ছাড়া সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হয় মূলত তারাই হলো বিপথগামী এবং দ্বিতীয় পন্থী। মহান রাব্বুল আলামিন এদের সম্পর্কে ফরমান জারি করে বলেন, আর সেই সব কবির কথা। গোমরাহ লোকেরাই তাদের পেছনে চলে। তুমি কি দেখনাই যে তারা পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় এবং তারা এমন সব কথা বলে যা তারা করে না। (সূরা আশ শোয়ারা : ২২৪-২২৬) কিন্তু প্রথম শ্রেণীর কবিরা এ থেকে ভিন্ন। তারা নিজ প্রবৃত্তির দাসত্ব করেন না। ইচ্ছে মতো লাগাম ছাড়া চলতে পারেন না। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “(অবশ্যই তাদের কথা আলাদা) যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে, বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করেছে এবং তাদের উপর জুলুম করা হলে শুধু প্রতিশোধ নেয়। আর জুলুমকারীরা শিগগিরই জানতে পারবে তাদের পরিণতি কী। (সূরা আশ শোয়ারা : ২২৭) এ জন্য ভালো কবি বা সাহিত্যিক হতে হবে। যে কবি বা সাহিতিকদের দ্বারা দেশ, সমাজ এবং জনগণ উপকৃত হয়। ভালো কবি বা সাহিত্যিক কখনো গ্যাঁট ছাড়া চলতে পারে না। তাদের বৈশিষ্ট্য হলো: ক. তিনি সর্বপ্রথম পাক্কা মুমিন হবেন। অর্থাৎ সব কিছুরই নিয়ন্তা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করবেন। জীবন ও মৃত্যুর একমাত্র মালিক আল্লাহ। যিনি এক ও অদ্বিতীয়। তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। পরকাল, হাশর, সিরাত, মিজান, পাপ-পুণ্য এসব কিছুর হিসেব একমাত্র তার ইচ্ছে। এসব কিছুকে যিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস স্থাপন করবেন এবং তার লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবেন তিনিই হবেন সার্থক কবি বা সাহিত্যিক। খ. এবং তিনি যা বিশ্বাস করবেন এবং লিপিবদ্ধ করবেন তা যেন বাস্তব জীবনে আমল করেন। তাকে জানতে হবে আল্লাহর কথা, হে মুমিনগণ কেন তোমরা সেই কথা বলো যা তোমরা (বাস্তব জীবনে) করো না। এটা আল্লাহর কাছে বড় গোনাহ যে তোমরা যা বলো তা তোমরা করো না। (সূরা আস সাফ : ২-৩) গ. একজন সাহিত্যিক বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকবেন। কেননা, তিনিতো সদাসর্বদা তাকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। তার কাজ-কর্ম, চলাফেরা, চিন্তা-চেতনায়, সব কিছুতেই মহান রবের রহস্য ভান্ডার খুঁজে পাবেন। এ জন্য প্রকৃত সাহিত্যিক সর্বদা মহান রবের ধ্যানে মশগুল থাকবেন। ঘ. আর যে সাহিত্যিক বা কবি নিজের স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য অন্য কারোর সম্পর্কে দুর্নাম করবেন না। অর্থাৎ ব্যঙ্গ বা বিদ্রƒপ করে কাউকে খাটো বা হেয়প্রতিপন্ন করবে না। এ জাতীয় কবিদের সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিন শুধু তিরস্কারই করেননি বরং যে উল্লিখিত বর্ণনার ভিন্নমত পোষণ করে তাদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছেন। মানুষ সামাজিক জীব। আর ধর্ম-বিশ্বাসই হলো মানুষের প্রকৃত জীবনীশক্তি। ভাল ফসলের জন্য যেমন ভাল বীজের এবং ভালো ক্ষেতের প্রয়োজন তেমনই ধর্মবিশ্বাস যদি কল্যাণকর না হয় তাহলে সে সমাজের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এমনকি তার মনুষ্যত্বও লোপ পায়। এ জন্য সুখী, সমৃদ্ধশালী ও কল্যাণমূলক সমাজগঠনের জন্য তাওহিদপন্থী মানুষের কোন বিকল্প নেই। যার জবাবদিহিতার ভয় নেই সে বেপরোয়া হতে বাধ্য। আল্লাহর নিকট যার জবাবদিহিতার ভয় নেই সে সমাজের কল্যাণ তো দূরের কথা ক্ষতি সাধনই তার কাম্য হয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের দিকে লক্ষ্য করতে পারি। সে যুগের কবিতা বা সাহিত্যকর্ম সবই মনগড়া ধর্মবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। তারা যা রচনা করতো তাতে সমাজের হিত সাধনতো হতোই না বরং তা সমাজের ওপর কুপ্রভাব বিস্তার করে এক গোত্র অন্য গোত্রের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহ আর কলহে লিপ্ত হতো। নিজ মতাবলম্বীদের সাময়িকভাবে বিনোদন দিলেও তা সামাজিক অশান্তিকে দূরীভূত করতে পারেনি। বরং ইতিহাসবেত্তাগণ তাদেরকে বর্বর এবং বিশৃঙ্খলা জাতি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কেননা, ঐসব কবি অশান্তির বিষবাষ্প সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছিল। পক্ষান্তরে মহানবী (সা)-এর আবির্ভাবের পর যে সব তাওহিদপন্থী সাহিত্যিক নিজস্ব সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজ বিনির্মাণ করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাদের গৌরবময় সাফল্য গাথা আজো ইতিহাস স্মরণ করে। হযরত আবু বকর (রা), হযরত ওমার (রা), পন্ডিত মহাবীর হযরত আলী (রা), রাসূলের সভাকবি হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা) প্রমুখ কবি সাহিত্যিকগণ সরাসরি তারা সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হন। এমনকি তাদের লেখনীর মাধ্যমে যেমন ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ত্বরান্বিত হয়েছে তেমনি বিশৃঙ্খল সমাজকে সুশৃঙ্খল করতেও সবিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। স্বয়ং মহানবী (সা) তাদের সাহিত্যকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করতে আরো উৎসাহ প্রদান করেছেন। এক্ষেত্রে একজন লেখক বা সাহিত্যিককে যেসব গুণাবলির ধারক ও বাহক হতে হবে তা নি¤œরূপ : ক. সঠিকভাবে ধর্মবোধ জাগ্রত থাকতে হবে। তাকে মানতে হবে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র মালিক বা স্রষ্টা হলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তিনি ভাল এবং মন্দের মালিক। জীবন-মরণের চাবিকাঠি একমাত্র তার হাতেই। তিনি ঘোষণা করেন, “বল, আমার নামাজ, আমার রোজা, আমার জীবন, আমার মরণ সবই আল্লাহর জন্য।” (সূরা আনয়াম : ১৬২) খ. ধর্মীয় জ্ঞান থাকা একজন লেখকের লেখনীর জন্য খুবই জরুরি। সেজন্য তাকে ধর্মচর্চা করতে হবে। অর্থাৎ তাকে ধর্মীয়গ্রন্থ এবং তৎসহ নানাবিধ ধর্মীয় সাহিত্য অধ্যয়ন করতে হবে। কেননা জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরজ। রাসূল (সা) বলেন, জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরজ। (আল হাদিস) জ্ঞান আহরণের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও। (আল হাদিস) দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান শিক্ষার বয়স। (আল হাদিস) সুতরাং জ্ঞান শিক্ষার প্রতি নবী পাক (সা) কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন তা উল্লেখিত হাদিস দ্বারা অতি সহজেই অনুমান করা যায়। আর যদি হয় লেখক কিংবা সাহিত্যিক তাহলে তো আর কথাই থাকে না। কারণ, একজন লেখকের যদি ধর্মীয় জ্ঞান না থাকে তাহলে তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে কিভাবে তাওহিদের দাওয়াত পেশ করবেন? কিভাবে তিনি সমাজের মানুষের অর্বাচীন মানসিকতাকে পরিবর্তন করবেন? কিভাবে তিনি পঙ্কিলতাময় সমাজকে সংস্কার করবেন? গ. কবি বা সাহিত্যিকেরা গভীর চিন্তাশীল ও খেয়ালি হয়ে থাকেন। এটা তাদের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। সজাগ থাকতে হবে যে তাদের খেয়ালিপনা যেন তাদেরকে ঈমানহারা না করে। কারণ, ঈমান হলো সবার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ঈমান হারা মানুষ ফলহীন বৃক্ষের সমান। তার চিন্তা-ভাবনা আর লেখনীর উদ্দেশ্যই যেন হয় মানুষকে ধর্মীয় বোধ জাগ্রত করা। তাহলে আমাদের সমাজ সেই লেখকের মাধ্যমে যেমন উপকৃত হবে আবার তিনি নিজেও এর মাধ্যমে লাভবান হবেন। ঘ. একজন কবি-সাহিত্যিক হবেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আর লেখকের দৃষ্টি এক নয়। লেখক বা কবি সাধরণ মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারেন। আর সাধারণ মানুষ তা পারে না। সুতরাং যদি লেখক তার অন্তরদৃষ্টির ভাবকে ভাষার মাধ্যমে পরিপূর্ণতা দান করেন নিজস্ব আকিদার উপর ভিত্তি করে। তাহলে সেই লেখকের মাধ্যমে সমাজ ও জাতি উপকৃত হবে। ঙ. একজন কবি বা সাহিত্যিক জাগতিক মোহ থেকে বিমুক্ত হবেন। একমাত্র আল্লাহ ভিন্ন আর কোন মোহ যেন তাকে আচ্ছন্ন না করে। তিনি মনে করবেন, স্বার্থ একজন মানুষকে দিকজ্ঞান শূন্য করে মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দেয়। মানবতা আর মানবিক দায়িত্ববোধকে ভুলিয়ে দিয়ে থাকে। সুতরাং এ বিষয়ে সাহিত্যিককে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। চ. কবি বা সাহিত্যিককে অবশ্যই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হতে হবে। তাকে মনে রাখতে হবে যে ব্যক্তিত্ব মানুষকে অবমূল্যায়ন থেকে হেফাজত করে। যার সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়- চবৎংড়হধষরঃু পধহ নব নৎড়ধফষু ফববঢ়বহবফ ধং ধ ঃড়ঃধষ য়ঁধষরঃু. সত্যি যদি সাহিত্যিকগণ এভাবে নিজেকে গড়তে পারেন। তাহলে অবশ্যই তিনি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবেন। ছ. একজন লেখককে অবশ্যই উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। কারণ চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান। চরিত্রহীন মানুষকে কেউ পছন্দ করে না। সাহিত্যিক যদি চরিত্রহীন হন তাহলে তার সাহিত্যে এর প্রভাব পড়বে। আর জনগণ ঐ জাতীয় সাহিত্য কখনো গ্রহণ করে না। লেখক হবেন জাতির শিক্ষক। এটা মাথায় রেখেই সাহিত্যিককে এগিয়ে যেতে হবে রাসূল (সা)-এর যুগে তার সাহাবীগণের অনেকেই ছিলেন সাহিত্যের বড় সাধক। যারা তাদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে ইসলামী তাহজিব, তমদ্দুনকে সর্বগ্রাহ্য করার নিরন্তর প্রচেষ্টা করেছেন। আর তাতে সফলও হয়েছেন। এসব সাহিত্য রচনা করে তারা সম্মানিত হয়েছেন। পেয়েছেন ভূয়সী প্রশংসাও। তাদের সাহিত্যের গতি এত তীব্র ছিলো যে কাফিররা পর্যন্ত ভয় পেয়ে যেত। কাফিরদের তির্যক মন্তব্যের দাঁতভাঙা জবাব দিতেন এই সাহিত্যের মাধ্যমে। দাওয়াত ও তাবলিগের সুমহান দায়িত্ব সাহিত্যের মাধ্যমে পালন করতেন। তাওহিদের মূলমন্ত্র দিগি¦দিকে ছড়িয়ে দিতেন কবিতার মাধ্যমে। যুদ্ধ-বিগ্রহ আর হেজার জবাব দিতেন কবিতার মাধ্যমে। সে জন্য রাসূল পাক (সা) এসব সাহিত্যিককে আরো উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্য রচনায় উৎসাহ প্রদান করতেন। এমনকি তাদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা করে তাওহিদের প্রচার ধারাকে আরো এগিয়ে নিতেন। সাহিত্যিকেরা হবেন একেকজন দ্বীনের দায়ী। তাদের সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষকে সৎকাজের আদেশ দিবেন আর অসৎকাজ থেকে ফিরে আসার জন্য উৎসাহিত করবেন। এসব সাহিত্যিকগণ দ্বীনমুখী সমাজগঠনে নিজেকে একজন দায়িত্ববান হিসেবে মনে করবেন। তার জন্য অবশ্যই তাকে খোদামুখী চিন্তার অধিকারী হতে হবে। কেননা আল্লাহপ্রেমিক হওয়ার জন্য এটাই তার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমাদের সাহিত্যিকদের এটা অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে, একজন সাধারণ মানুষের যে দায়িত্ব আর কর্তব্য একজন সাহিত্যিকের দায়িত্ব তার চেয়ে অনেকগুণে বেশি। আসুন, আমরা জেনে নিই দাওয়াত সম্পর্কে আল্লাহর কী বক্তব্য : তোমদের মধ্যে একদল লোকের এমন হওয়া উচিত, যারা কল্যাণের দিকে (মানুষকে) আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করবে। মূলত তারাই হবে কামিয়াব। (সূরা আলে ইমরান-১০৪) তাদেরকে যদি আমি পৃথিবীতে ক্ষমতার অধিকারী করি তখন তারা (সমাজে) সালাত কায়েম করবে, জাকাত প্রদান করবে, সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করবে। (সূরা আল হাজ্জ : ৪১) তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত। তোমাদিগকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দিবে, মন্দ কাজ হতে (নিজেকে) বিরত রাখবে। আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। যদি আহলে কিতাবগণ ঈমান আনয়ন করতো তবে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হতো। তাদের মধ্যে কতক লোক ঈমানদার আর বেশির ভাগই তারা কাফির। (সূরা আলে ইমরান : ১১০) উল্লিখিত আয়াত থেকে একথা সুস্পষ্ট যে আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান করা এটা মুমিনের জন্য গুরুদায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব সাহিত্যিকগণের ওপরও বর্তায়। যদি তাদের এ দায়িত্ববোধ থেকে লেখনীকর্ম পরিচালনা করেন তাহলে তিনিই হবেন তাওহিদপন্থী। কবিতা সম্পর্কে আল্লাহর নবী প্রিয় রাসূল (সা)-এর অনেক হাদিস আছে। যার সারমর্ম একই। মূলত ভাল কবিতা বা সাহিত্যের প্রতি তিনি যেমন উৎসাহী ছিলেন আবার মন্দ বা খারাপ কবিতার প্রতি ঘৃণাও প্রকাশ করেছেন। রাসূল (সা) বলেন, কবিতাতো এক ধরনের কথামালা। আর কথার মধ্যে যেগুলো উত্তম ও সুন্দর, কবিতার মধ্যেও সেগুলো উত্তম ও সুন্দর। আর কথার মধ্যে যেগুলো খারাপ ও ঘৃণিত কবিতার মধ্যেও সেগুলো খারাপ ও ঘৃণিত। ইমাম বোখারি তার রচিত আদাবুল মুফরাদ গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে একটি হাদিস উদ্ধৃত করে বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, কবিতা কথার মতই। ভালো কথা যেমন ভালো ও সুন্দর তেমনি মন্দ কবিতা মন্দ কথার মতই মন্দ। হযরত ইবনে রাশিক তার রচিত উমদা গ্রন্থে আরো একটি হাদিস উদ্ধৃত করে বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, কবিতা সুসামঞ্জস্য কথা মালা। যে কবিতা সত্যনিষ্ঠ সে কবিতা সুন্দর। আর যে কবিতায় সত্যের অপলাপ হয়েছে সে কবিতায় কোনো মঙ্গল নেই। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন- একদা এক বেদুঈন রাসূল (সা)-এর কাছে এসে আলাপ করতে লাগলো। তার আলাপে বিমোহিত হয়ে রাসূল (সা) বলেন, কোন কোন বর্ণনায় জাদু রয়েছে। আর কোন কোন কবিতায় রয়েছে প্রকাশ্য জ্ঞান। (বুখারি, আবু দাউদ, তিরমিজি) অপর এক বর্ণনায় আছে যে, আমর ইবনে আহতামের আলাপ যখন তাকে বিমোহিত করেছিল তখন তিনি তার জবাবে ছন্দবদ্ধ ভাবে (কবিতা করে) বলেছিলেন। (আল ইকদুল ফারিদ) আল্লাহর রাসূল (সা) কবিতা রচনাতে যেমন উৎসাহ প্রদান করেছেন তেমনি কবিতা শুনতেও বেশ আগ্রহ প্রকাশ করতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত শারিদ আস সাকাফি হতে বর্ণিত একটি হাদিস- তিনি বলেন, আমি একদা রাসূলের পেছনে অনুসরণ করছিলাম। পথিমধ্যে রাসূল (সা) বললেন, তোমার কি উমাইয়া ইবনে আবি সালাতের কবিতা জানা আছে? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন, আবৃত্তি কর। আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করলাম। (মুসলিম) ভাল কবিতার ব্যাপারে রাসূল (সা) যেমন ছিলেন উৎসাহী আবার মন্দ কবিতার বেলায়ও তিনি ছিলেন আপসহীন। এমনকি তিনি বলেন- তোমাদের কারো পেটে (মন্দ) কবিতা থাকার চেয়ে যে পেটে পুঁজ জমে তা পচে যাওয়া অনেক উত্তম। (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ) তিনি এসব কবিকে অভিসম্পাত দিয়ে বলেন, যে ইসলাম সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক ও নিন্দামূলক কবিতা বলে তার জিহবা ধ্বংস হোক। সুতরাং আমাদের সাহিত্যিকদের এ বিষয়ে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। সর্বশেষে বলা যায় প্রবহমান ¯্রােতের মতো কিংবা তার চেয়ে আরো গতিময় আমাদের জীবনপ্রবাহ। মানুষ এ ক্ষণস্থায়ী জীবন থেকে অশান্তির দিকে প্রতিনিয়ত ধাবমান। হিসাব নিকাশের চূড়ান্ত পরিণতি যা মানুষের অনিবার্য ভোগ্য একটি বিষয়। মানুষের জীবনের জাগতিক বিষয়াদির ওপর নির্ভরশীল এই চূড়ান্ত সমীকরণ। তাই অবশ্যই মানুষকে হতে হবে কল্যাণমুখী, হিতৈষী এবং সংস্কারক। যোগ্যতাভেদে তাকে হতে হবে সচেতন এবং নিষ্ঠাবান। একজন সাহিত্যিক তার মুক্তচিন্তা আর গবেষণার মাধ্যমে পরম প্রভুর নৈকট্য লাভের চেষ্টাই হবে তার লক্ষ্য। সাহিত্যের সকল উপমা এবং নিখাদ চিন্তার স্বরূপ উদঘাটন করে একজন সাহিত্যিক সমাজবিপ্লব সাধন করতে পারেন। এজন্য তাকে একজন সমাজ অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সাথে সাথে তাকে পরকালীন চিন্তা মাথায় রেখে সাহিত্য নির্মাণ করা উচিত। তাকে মনে রাখতে হবে, যদি কেউ এক জাররা পরিমাণও ভালো কাজ করে তবে সেদিন তার প্রতিদান দিয়ে দেয়া হবে এবং কেউ যদি এক জাররা পরিমাণও মন্দ কাজ করে তবে সেদিন তার প্রতিদান দিয়ে দেয়া হবে। (সূরা আল ক্বারিয়াহ : ৬-৭) সুতরাং একজন সাহিত্যিকের এ অনুভূতি থেকেই তাকে সাহিত্য রচনা করতে হবে। তাহলে একজন মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে তিনি যেমন পৃথিবীতে নন্দিত হবেন, আর আখিরাতেও তিনি হবেন অধিক সম্মানিত। মহান রাব্বুল আলামিন তাকে পুরস্কৃত করবেন। কেননা, মহানবী (সা) বলেন, মুমিন তরবারির দ্বারা জিহাদ করে আবার কবিতার দ্বারাও জিহাদ করে। কবিতার আঘাত তীরের চেয়েও তীব্র হয়। (আল হাদিস) আমাদের কবি-সাহিত্যিকগণ যদি তথাকথিত আধুনিকতাকে, অশ্লীলতাকে ধারণ করে মহান রবের পথকে ভুলে যায় তাহলে তা হবে তাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। দায়িত্ব এবং কর্তব্য, যোগ্যতা আর পারদর্শিতা সব কিছু নিয়ে মহান রবের সম্মুখে জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আর যদি গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে এ দায়িত্ব আর কর্তব্যকে অবহেলা বা অনাদর করি তাহলে অবশ্যই তার পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সুজলা সুফলা আমাদের এই সাহিত্যবান্ধব দেশের কিছু কিছু বিকৃত চিন্তার কবি এবং সাহিত্যিক যারা নিরন্তর সুশীলচিন্তার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে আল্লাহবিরোধী সাহিত্য রচনায় নিমগ্ন। হৃদয়ের উৎসারিত হতাশা, বেদনা আর দুরাশা যেন প্রবাহিত ঝড়ো বাতাসের মতো সমাজ আর জাতিকে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে। আর এ বিশৃঙ্খলতার জন্য দায়ী একমাত্র কলমদার কবি ও সাহিত্যিকেরা। কেননা, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। পরিশেষে বলবো দীঘল রাতের শ্রান্ত সফর শেষে কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে একি ঘন-সিয়া জিন্দেগানির বাব তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান শ্রান্ত খাব অস্ফটু হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি। রাত পোহাবার কতো দেরি পাঞ্জেরী। (পাঞ্জেরী, ফাররুখ আহমদ) হে রব, তুমি আমাদের কবি সাহিত্যিকদের বিবেককে জাগ্রত করো। তারা যেন তাদের লেখনীর মাধ্যমে সত্যিকারের দ্বীনের মুবাল্লিগ হতে পারেন। তারা যেন একত্ববাদকে গ্রহণ করে এবং বহুত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করে। এই হোক আমাদের আগামীর প্রত্যাশা। লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির