post

সৈয়দ আলী আহসান চেনা কণ্ঠস্বর

অচেনা জ্যোতিষ্ক

৩০ জুন ২০১২
মোশাররফ হোসেন খান বহু বর্ণিল প্রজ্ঞাপ্রবর সৈয়দ আলী আহসান। ইন্তেকাল করলেন ২৫ শে জুলাই, ২০১২। তাঁর ইন্তেকালে আমরা হারালাম এমন এজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বকে, যিনি ছিলেন একই সাথে অজস্রতার আধার। একটা কালের তিনি প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। সৈয়দ আলী আহসান একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে রয়ে গেছে তার বিশাল অবদান। কিন্তু সেটাই তার জন্য একমাত্র কোনো বিশেষণ নয়। এমন কি তিনি যে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হয়েও বাংলায় অধ্যাপনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, এই ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তও আমাদের জন্য ততোটা বিস্ময়কর নয়-যতোটা ঘটেছে তার প্রজ্ঞাদীপ্ত সমুদ্রমান ব্যাপক শিল্প-সাহিত্যের কর্মধারায়। শিক্ষা বিস্তারটি তার মৌল চিহ্নিত করণে যথেষ্ট নয়। বরং এর বাইরের বিশালত্বই সৈয়দ আলী আহসানকে শনাক্তযোগ্য করে তোলে অনেক বেশী। তিনি নিজে লিখেছেন। সাহিত্যের মৌলিক বহু শাখা-প্রশাখায় অবিশ্রান্তভাবে বিচরণ করেছেন। তার অসাধারণ গদ্যশৈলী কিংবা ভাষাভঙ্গির দৃষ্টান্ত কেবল বাংলাদেশেই নয়, এই উপমহাদেশে নজিরবিহীন। এটা যে আদৌ কোনো অত্যুক্তি নয়, এর প্রমাণ তো রয়ে গেছে তার বিপুল সৃষ্টি সম্ভারে। এই সকল ঝলমলে গদ্যের প্রণোদনায় আমাদের অসংখ্য লেখক উজ্জীবিত এবং স্নাত। আবার তিনি যখন শিল্প-সাহিত্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নিমগ্ন হন, তখন মনে হয়Ñতিনিই আমাদের শিল্প-সাহিত্যের প্রধানতম ব্যাখ্যাতা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিকÑসর্বোপরি বিশ্বসাহিত্যের একজন প্রবল প্রবক্তা। সর্বাংশেই নির্মেদ, বিশ্লেষাত্মক এবং গ্রহণীয়। তার মধ্যে আমরা শিল্প-সাহিত্যের বিশ্লেষণ কিংবা ব্যাখ্যার একটি যুগান্তকারী অভিনব টেকনিকের সাথে পরিচিত হলাম। এ কথা তো বলাই সঙ্গত যে, সৈয়দ আলী আহসান ছিনে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রবক্তা, বিশ্লেষক এবং বিশ্বসাহিত্যের এক অক্লান্ত পরিব্রাজক। তিনি ছিলেন আমাদের শিল্প-সাহিত্যের একজন আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি। অভিভাবকও বটে। সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন এক অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন, চিত্রকলা, দেশ, রাষ্ট্র, বক্তৃতাÑএমনকি রন্ধনশৈলী বিষয়েও তার আগ্রহ, উদ্দীপনা এবং মননের কোনো কমতি ছিল না। প্রশ্ন জগতেই পারে, এত বিষয়ে তিনি কিভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন? কিন্তু জবাব পাওয়া দুষ্কর। সৈয়দ আলী আহসান দীর্ঘকাল নিজের হাতে লিখতেন না। ডিকটেশনের মাধ্যমে অন্যকে দিয়ে লেখাতেন। যারা লেখক তারা জানেন, একটি লেখা কত শ্রম ও সাধ্য-সাধনার পর তৈরি করা যায়। কত যে কাটা-ছেঁড়া, পরিবর্তন, যোগ-বিয়োগ করতে হয়Ñতার কোনো হিসাব থাকে না। কিন্তু এই দুরূহ কাজটি সৈয়দ আলী আহসান কেমন সাবলীল গতিতে করে যেতে পারতেন। নিজের হাতে না লিখলেও তার সেইসব ডিকটেড করা লেখার ভেতর ভাষা, তথ্য এমনকি বাংলা ও অন্যান্য ভাষার কোটেশনের অংশগুলো উঠে আসতো জীবন্তভাবে। তার স্মরণশক্তি এতই প্রখর ছিল যে, বিশ্বসাহিত্যের দরোজা, জানালা, তৈজসপত্র এমনকি সূচাগ্র পর্যন্তও তিনি স্পর্শ করতে পারতেন। পাঠক হিসাবেও তার জুড়ি মেলা ভার। আর বক্তৃতাও যে একটা অনবদ্য শিল্প হতে পারে, তার প্রমাণ তো পাওয়া গেল সৈয়দ আলী আহসানের মাধ্যমে। যারা তার বক্তৃতা শুনেছেন তারা নিশ্চয় জানেন যে, তার বক্তৃতার প্রতিটি শব্দই ছিল সুনির্বাচিত, শিল্পী এবং সাহিত্যের অনুষঙ্গ। সন-তারিখ, তথ্যাদি, ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল, তত্ত্ব কিংবা হুবহু কোটেশন সহ তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা বলে যেতে পারতেন। অনেকের লিখিত বক্তব্যও এমন সুন্দর-সুশৃঙ্খল বা হৃদয়গ্রাহী হয় না। এই এক অসাধারণ যোগ্য বা ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছিলেন। তার রেখা এবং বক্তৃতার মধ্যে কোনো প্রভেদ টানার সুযোগ ছিল না। সৈয়দ আলী আহসান শিল্প-সাহিত্য-সং®কৃতির প্রায় সকল বিষয় স্পর্শ করে গেছেন। তার বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, পদ্মাবতী, মধ্যযুগের কাব্য মধুমালতী প্রভৃতি গ্রন্থ আমাদের এক বিশাল সম্পদে পরিণত হয়ে গেছে। এছাড়া তার রচিত আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গ, শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য প্রভৃতি গ্রন্থ আমাদের সাহিত্যে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। সৈয়দ আলী আহসানে বড় অবদানÑবাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের সাথে আমাদেরকে পরিচিত করে তোলা। সেগুলোকে বাংলা সাহিত্যের অনুসঙ্গে যুক্ত করা। তা না হলে সরহপা, কাহ্নপা কিংবা চর্যাপদÑএর মত বিষয়গুলো হয়তো বা আমাদের দৃষ্টির অন্তরালেই রয়ে যেত বহু দিন। আবার তার অনূদিত ইডিপাস, হুইটম্যানের কবিতা কিংবা জার্মান সাহিত্য একটি নিদর্শনÑএর মত বিশ্ব সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোও হয়তো বা তেমনভাবে পাওয়া যেত না। তিনি বিশ্ব সাহিত্যের একজন অক্লান্ত পরিব্রাজক বলেই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে এমন সাবলীল মন্থন। মৌলিক, সম্পাদিত ও অনূদিতÑসব মিলিয়ে শতাধিক গ্রন্থের জনক তিনি। সংখ্যা কিংবা গুণগতমানÑযে কোনো বিচারেই হোক না কেন, এগুলো সমান গুরুত্বপূর্ণ। সৈয়দ আলী আহসান এই সকল কর্মধারায় যথেষ্ট স্পষ্ট আমাদের কাছে। একজন লেখক এবং পণ্ডিতের কাছে এগুলোই কাম্য বটে। কিন্তু তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমটাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ ব্যক্তি হিসাবে, মনন ও মেধার প্রখরতার জন্য তার কাছে আরও ব্যাপকতা ও পূর্ণতার দাবী রাখাই সঙ্গত। সে দাবী তিনি পূরণ করেছেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হলো তার কাব্যগ্রন্থ অনেক আকাশ। গ্রন্থের নামটিই শনাক্ত করে দেয় যে তিনি কতটা আধুনিক মানসে জারিত। প্রকৃত অর্থে এর অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলোও সেই চারিত্র্যের প্রতিনিধিত্বকারী। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ, যেমন: একক সন্্যধায় বসন্ত, অনেক আকাশ কিংবা সহসা সচকিত প্রর্ভতিও আধুনিক বাংলা কবিতার এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। একটা বিবেচনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। আমাদের, অর্থাৎ এদেশীয় কবিতার আধুনিকতা বলতে যা বুঝায়, তার শুরুটাই বা বলি কেনÑমূল স্তম্ভ বা ভিত্তিই হলো চল্লিশের দশক। ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, আহসান হাবীবসহ একগুচ্ছ সবুজ প্রতিভাই প্রকৃত অর্থে আমাদের, অর্থাৎ বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার জনক বা প্রাণপুরুষ। এরা প্রত্যেকেই নিজস্ব গতি এবং নদীর প্রতীক। প্রত্যেকেরই নিজস্বতা আছে। কিন্তু মূল প্রবাহ সেই একইÑআধুনিকতা। এরপর তো আমাদের কবিতা ফুলেÑফলে শোভনে আর ব্যাপকতায় অনেক দূর এগিয়েছে। তবুও এটাই মান্য এবং গ্রাহ্য হওয়া উচিৎ যে, মূলত চল্লিশের দশকই আমাদের আধুনিক কবিতার উৎসভূমি। চল্লিশের অন্য কবিদের প্রসঙ্গ এখানে থাক, সৈয়দ আলী আহসান আমার পূর্ব বাংলা শিরোনামীয় যে অসাধারণ তিনটি কবিতা লিখেছেনÑতার সমকক্ষ কিংবা এর সাথে তুলনীয় আর দ্বিতীয় কোনো কবিতা কি আমরা পেয়েছি? সন্দেহাতীতভাবে তার এই কবিতাগুচ্ছ আমাদের আধুনিক কবিতার এক দৃষ্টান্তহীন মাইল ফলক হয়ে রইলো। এই কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব এবং শীর্ষ আসন স্থায়ী। সৈয়দ আলী আহসানের শুধু আমার পূর্বÑবাংলা কবিতাকে কেন্দ্র করেই একটি পৃথক গ্রন্থ রচনা করা যায়। বরং সেটাই সময়ের দাবী। কারণÑ “আমার পূর্ব-বাংলা কি আশ্চর্য শীতল নদী অনেক শান্ত আবার সহসা স্ফীত প্রাচুর্যে আনন্দিত একবার কোলাহল, অনেকবার শান্ত শৈথিল্য আবার অনেকবার স্তিমিত কন্ঠস্বরের অনবরত বন্যা এখানে নদীর মতো এক দেশ শান্ত, স্ফীত, কল্লোলময়ী বিচিত্ররূপিনী অনেক বর্ষের রেখাঙ্কন এ আমার পূর্ববাংলা যার উপমা একটি শান্ত শীতল নদী” না, এ কোনো সাধারণ উচ্চারণ নয়। এই উচ্চারণ এবং এই অভিব্যক্তির আবেদন সুদূরপ্রসারী। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রবাসে বসে বহু সঞ্চিত এক বেদনাবাহী স্মৃতির মধ্য দিয়ে উচ্চারণ করেছিলেনÑ “বহুদেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে? দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে!” আর কবি সৈয়দ আলী আহসান তার স্বদেশকে নির্মাণ করেছেন এইভাবেÑ “আমার পূর্ব বাংলা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায় একটি প্রাগাঢ় নিকুঞ্জ আমার পূর্ব-বাংলা অনেক রাত্রে গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দের মতো। এখানে আমার পৃথিবী অনেক রূপময়ী” সন্দেহ নেই, এ এক আবেগঘন প্রেম ও প্রজ্ঞার নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র স্বাদেশিক সাবলীল উচ্চারণ। আমাদের কবিতায় যা সম্পূর্ণ নতুন এক স্বাতন্ত্র্যিক মাত্রা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রইলো। উদ্দেশ্য ছিলো সৈয়দ আলী আহসানের শিল্প-সাহিত্য অনুষঙ্গে কিছুটা পথ হাঁটা। সেটাই আপাতত : সম্ভব হলো। তার ব্যাপক বিশাল কর্মজীবন, সামগ্রিক মূল্যায়ন এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে এবং স্বল্প সময়ে আদৌ সম্ভব নয়। এর জন্য আরও কিছুটা কাল হয়তো অপেক্ষার প্রয়োজন হবে। কারণ সৈয়দ আলী আহসান তো কেবল একজন প্রাজ্ঞ পুরুষই ছিলেন না, ছিলেন সর্বকূল প্লাবী এক স্রোতোবাহী নদী। প্রকৃত অর্থে, সৈয়দ আলী আহসান আমাদের কাছে চেনা কন্ঠস্বর বটে, তবে এখনো অনেক অচেনা এক জ্যোতিষ্ক। সৈয়দ আলী আহসানের মৃত্যুর পর দিন লেখা [২৬.৭.২০০০] একটি বেতার মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে আমার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছিÑ সৈয়দ আলী আহসান বহুকাল দিয়েছেন আলো-ছায়া শিল্পের সুষমা সিক্ত করেছেন এই বাংলার আবাদের জমি সে ছিল তৃষ্ণার বৃষ্টি। হতে পারে উপল উপমা কিম্বা তারও অধিক-বহুবর্ণ, অনির্ণীত ছবি। বহুদর্শী কালবৃক্ষ। আর এই উপমহাদেশে পৃথক প্রবর। যেন তিনি অরণ্যের সেনাপতি, দাঁড়িয়ে আছেন সম্রাট এক স্বতন্ত্র, রাজ বেশে। নাকি বিশাল জলধিÑতীরভাসা স্রোতোবাহী নদী! প্রজ্ঞার বিভায় দীপ্তিহীন অভিজ্ঞান। বৈশ্বিক ব্রাজক বটে, কণ্ঠে তবু স্বদেশী সঙ্গীত। সর্বত্র সুদৃঢ় পদক্ষেপ, সুশোভন অবদান- কোন্ নামে ডাকি তাকে? আপাতত : ব্যখ্যার অতীত। বিপুল বিস্ময়কর! আদৃত্যু ছিলেন বেগবান ইতিহাস, নাকি প্রবাদ-পুরুষ আলী আহসান! লেখক : কবি ও সম্পাদক, নতুন কলম ও নতুন কিশোরকণ্ঠ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির