post

স্মৃতিতে আবদুল মান্নান

সৈয়দ তৌহিদুর রহমান

২৬ জুলাই ২০১৮
পূর্বসূরিদের চেয়ে আমাদের মধ্যে জ্ঞানার্জন, সহমর্মিতা, দান-খয়রাত, ইবাদত-বন্দেগি সবকিছুর কমতি দেখা যাচ্ছে। আমাদের আত্মসমালোচনাটা একটু গভীরভাবে হওয়া দরকার। ইমাম গাজজালি প্রায় আটশ’র মতো বই লিখে গেছেন, তাহলে তাঁকে কি পরিমাণ পড়তে হয়েছে একটু ভেবে দেখুন। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিশ্ব সাহিত্য’ প্রবন্ধ পড়লে আঁচ করা যায় তিনি কী ব্যাপক পড়ালেখা করতেন। নজরুল ইসলাম আল কুরআনের কাব্য অনুবাদ শুরু করেছিলেন। ‘রামায়ণ মহাভারত’ নজরুল ইসলামের বলা যায় মুখস্থ ছিল। এ জামানার লেখক আবদুল মান্নান তালিব, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখের খোঁজ নিয়ে দেখুন তারা জ্ঞানার্জনের জন্য কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন। আবদুল মান্নান তালিব তো প্রতিদিন রাত ১২টায় ঘুমাতেন আবার ভোর ৩টায় উঠে লেখাপড়া শুরু করতেন। শেষ জীবন পর্যন্ত এটা তাঁর অভ্যাস ছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রায়ই বলতেন, আমার ঘরে তুমি দামি ফার্নিচার ইত্যাদি কিছুই পাবে না, এমনকি তোমার ভাবীর গয়না-পত্তরও তেমন কিছু নেই। আমাদের সংসারে থাকার মধ্যে আছে বই বই আর বই। লাইব্রেরি মানে পড়ার ঘর ছাপিয়ে শোয়ার ঘর, ডাইনিং, ড্রইং এমনকি রান্নাঘরের ওপরের তাক পর্যন্ত বই স্থান করে নিয়েছে। শোবার খাটের দু’পাশেই বই। আমাকে বলতেন, ‘তোমার অবাধ স্বাধীনতা আছে সব ঘরেই তুমি ঢুকতে পার। আমাকে বই দেখিয়ে প্রায়ই বলতেন, শিল্পকলার বিপুল কালেকশন আছে আমার। আমি শিল্পকলা নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেছি। এটা নিয়ে কাজ করার প্রবল ইচ্ছা আছে আমার। যদিও এ বিষয়ে একটা বই তিনি লিখেছেন। আর তোমাদের তাকিদে আমি রাসূল সা.-এর সীরাত বিষয়ে প্রচুর লেখাপড়া করেছি। তবে সত্যি কথা বলতে কি, সীরাতের এই সংগ্রহটা ছিল আমার আব্বার। আমি সেগুলো যতœ করে রেখে দিয়েছি। এর মধ্যে অনেক ফার্সি গ্রন্থও রয়েছে।’ আবদুল মান্নান সৈয়দের বাসায় গেলে সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হতো। কবির মৃত্যুর পর গ্রীন রোডের সুবাস্তু টাওয়ারে গিয়ে দেখলাম গদ্যশিল্পী মাহবুবুল হক, কবি আসাদ বিন হাফিজ, কবি হাসান আলীম, কবি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ অনেকে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। মাহবুবুল হক ভাই আমাকে দেখেই উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, তোমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। মাহবুব ভাই আরো বললেন, যতবার আমার সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে ততবারই তোমার খবর নিয়েছেন। তখনও আমি মনে মনে বলছিলাম আমার জানা সংবাদটা যেন সত্যি না হয়। কারণ আবদুল মান্নান সৈয়দ স্যারের সাথে আমার যে বিস্তর কাজ বাকি পড়ে আছে। একটা পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ দিয়েছেন, সরকারি লোকদের অত্যাচারে বাকিটুকু আর দিতে পারেননি। আবু বকর রা. ওমর রা. ওসমান রা. ও আলী রা. অর্থাৎ চার খলিফাকে নিয়ে ছোটদের জন্য চারটা পৃথক বই লিখে দিতে চেয়েছিলেন। রাসূল সা.-এর ওপর একটা পরিপূর্ণ সিরাত গ্রন্থ লিখতে চেয়েছিলেন। কবি মোরশেদ আলীর কবিতাসমগ্র সম্পাদনা করে দিতে চেয়েছিলেন। আরও কত কী? সমাজ সংসারে এ ধরনের হাজারো পরিকল্পনা আমাদের থাকে তার কতটুকুই বা বাস্তবে রূপায়িত করতে পারি! নানা পরিকল্পনার ছক আঁকতে আঁকতে একদিন পৌঁছে যান মৃত্যুর দুয়ারে। বাস্তবায়িত হয় মহান আল্লাহর পরিকল্পনা। ‘প্রত্যেক জীবনকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’Ñ এভাবে সত্যি হয় মহান রবের এই বাণী। যাহোক, এনার্জি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া ঘড়ির কাঁটার মত পা টেনে টেনে তিনি যে খুব দ্রুত তার শেষ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তা আমরা সামনে থেকে অনেকেই বুঝতে পারিনি। ঘড়ির পেসমেকারটা সময় মত না পাল্টালে যে সেটা একদিন অচল হয়ে যায় তা আমাদের অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল। শেষবার অসুস্থ হওয়ার পর আবদুল মান্নান তালিব সাহেবকে সাথে নিয়ে আমাকে বারবার তার বাসায় যেতে বলতেন দোয়া করার জন্য। আমি তালিব সাহেবকে সাথে করে গিয়েও ছিলাম। সেদিন সারাদিন ছিলাম কবির বাসায়। সারাক্ষণ বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ হয়েছিল। ঘরোয়া আয়োজনে ব্যাপক খাওয়া দাওয়াও হয়েছিল। একপর্যায়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ বললেন, তালিব ভাই, আট বছর আগে সেবার আমি যখন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম তখন হাসপাতালে আপনি যে দোয়া করে দিয়েছিলেন তারপর থেকে দিব্যি ভালো ছিলাম। আরো একবার দোয়া করে দেন, দেখবেন ঠিক ভালো হয়ে যাবো। আবদুল মান্নান তালিবকে তিনি পীর মানতেন। বলতেন, তালিব ভাই হচ্ছেন, আমাদের সাহিত্যের পীর। কথা প্রসঙ্গে বলতে হচ্ছে, কবি আল মাহমুদও আল্লামা আবদুল মান্নান তালিবকে ওস্তাদ মানেন। ১৯৮৬ সালে ৭১ নিউ এলিফ্যান্ট রোডের বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের অফিসে আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে আমার আমার প্রথম আলাপ। দীর্ঘ বছরের কত স্মৃতি আজ আমাকে আন্দোলিত করছে। আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাংলা সাহিত্য পরিষদের সাহিত্য ক্লাস পরিচালনার সময়। দীর্ঘ দিন তিনি এই সাহিত্য ক্লাস পরিচালনা করেছেন। অসংখ্য তরুণ লেখক তার সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছে। হাতে ধরে সাহিত্যের নানা দিক শিখিয়েছেন অনেককে। আজ সবার নাম আমারও মনে নেই। যারা নিয়মিত আসতেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, কবি গোলাম মোহাম্মদ, কবি হাসান আলীম, কবি নাসির হেলাল, কবি ওমর বিশ্বাস, কবি মৃধা আলাউদ্দিন, রফিক মুহম্মদ, খালিদ সাইফ প্রমুখ। আমি প্রায় দিন উপস্থিত থাকলেও ক্লাসে মনোনিবেশ করতে পারিনি। কারণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ভিন্নরকম ব্যস্ততা আমাকে সব সময় তাড়া করে ফেরে। এর মধ্যে আর যাই হোক অন্তত সাহিত্য করা যায় না। আমাকে লেখার জন্য খুব বেশি তাগাদা দিয়েছেন, আশির দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মতিউর রহমান মল্লিক। তিনি ঘাড়ে পাক দিয়ে আমার কাছ থেকে দু’একটা লেখা আদায় করে নিতেন। নিয়মিত না লেখার জন্য আমাকে যারা তিরস্কার করেছেন তারা হলেন, আবদুল মান্নান তালিব, কবি আল মাহমুদ, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ, জনাব আজিজুল ইসলাম, কবি সাজজাদ হোসাইন খান, কবি মোরশেদ আলী, কবি সোলায়মান আহসান, কবি হাসান আলীম, কবি মোশাররফ হোসেন খান, কবি গোলাম মোহাম্মদ, খালিদ সাইফসহ অনেকে। তবে সৈয়দ স্যার মনে করতেন আমি নিয়মিত লিখি। আমার গল্পের বই বের না হওয়াতে একদিন অনেক ধমক দিয়েছিলেন। তারপর হো হো করে হেসে বলেছিলেন, ‘ঘরামীর চালে ছাউনি থাকে না।’ গল্পের পান্ডুলিপিটা তিনি বার বার দেখে দিতে চেয়েছিলেন। যাহোক, আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে আমার সম্পর্ক গভীরতর হয় কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র সম্পাদনার সময়। আবদুল মান্নান সৈয়দ স্যার, আমি, কবি ওমর বিশ্বাস, কখনো কবি হাসান আলীম রাত ৯টা ১০টা পর্যন্ত কাজ করতাম। মাঝে ভাবী কয়েকবার ফোন দিতেন। স্যার বলতেন, রানু, তৌহিদের কাছে আছি। তোমার চিন্তা করার দরকার নেই। ঠিক সময় মতো চলে আসবো। তিন চার ঘণ্টার মধ্যে ভাবীর সাথে প্রায় দশ বারো বার কথা হতো। দু’জন দু’জনকে অসম্ভব রকম ভালোবাসতেন। যখনই বাসায় যেতাম দেখতাম দু’জন কোন না কোন কাজে ব্যস্ত। আমি গেলেই সব কাজ বাদ। বলতেন, আজ আর তোমাকে ছাড়ছিনে। খেয়ে তারপর যেতে হবে। শুরু হয়ে যেত গল্প, আড্ডা। বারবার ভাবীকে হুকুম করতেন, রানু, চা দাও, এটা দাও, সেটা দাও। মানে একভাবে হুকুমের পর হুকুম করতেই থাকতেন। ভাবীও একটার পর একটা হুকুম তামিল করতেন। আশ্চর্য ব্যাপার ভাবীকে একবারের জন্যও বিরক্ত হতে দেখিনি। এক দিনের একটা ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কেটে আছে। আমি আর আবদুল মান্নান সৈয়দ স্যার চা পান করছি, সহসা স্যারের হাত থেকে গ্লাস ও পানির জগ পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল। আমি ভাবলাম নির্ঘাত একটা হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটে যাবে! কারণ আমি দেশের অধিকাংশ বড় কবি সাহিত্যিকের বাড়িতে গিয়েছি। সেখানে স্বচ্ছন্দে সহাবস্থান খুব কম পরিবারেই দেখেছি। আমরা জানি, দুনিয়াতে অনেক নামি-দামি লেখকই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। একটা ঘটনা না বলে পারছি না। ১৯৮৩’র দিকে কলকাতার প্রখ্যাত লেখক মনমথ নাথ ঠাকুরের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে সেদিন এ ধরনের একটা কাপ-পিরিচ ভাঙার ঘটনা ঘটেছিল। বাবু মনমথ নাথ ঠাকুরের বাবা জমিদার ছিলেন। সেই সুবাদে মনমথ নাথ ঠাকুর ছিলেন জমিদার পুত্র। তবে দেশ ভাগের পর জমিদারি না থাকলেও ঠাট বজায় ছিল। আমি তো তাজ্জব ওনার স্ত্রী এই জমিদার স্বামীকে কাপ-পিরিচ ভাঙার অপরাধে ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করেছিলেন। ওনার তাড়া খাওয়া দেখে আমরাও ওনার সাথে সাথে ঐ বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলাম। এ কথা মনে হলে আমাদের এখনো হাসি পায়! তবে এ ক্ষেত্রে আবদুল মান্নান সৈয়দ স্যারের সহধর্মিণী মানে ভাবি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। রানু ভাবীও ওপারের মেয়ে। কিন্তু খুবই শান্ত স্বভাবের। জগ-গ্লাস ভেঙে গেলে ভাবী বললেন, ভেঙেছে ভাঙুক! তুমি ওতে হাত দিতে যেও না। হাত কেটে যাবে। ভাবী দ্রুত এসে নিজেই টুকরো কাচ সাফ করা শুরু করে দিলেন। এই ধরনের আন্তরিকতা ও দরদভরা লেখক পরিবার দ্বিতীয়টি দেখিনি আমি। বলাবাহুল্য ‘কবি গোলাম মোহাম্মদ গীতিসমগ্র’ পুরোটা সম্পাদনা করে দিয়েছি। আজ বারবার সৈয়দ স্যারের কথা মনে পড়ছে। স্যার থাকলে কাজটা খুব ভালো হতো হয়তো। একটা কথা বলা দরকার সৈয়দ পরিবার হিসেবে স্যার খুব গর্ববোধ করতেন। বলতেন, ‘সৈয়দ পরিবারের মেয়েরা কখনো বাইরের অনুষ্ঠানে যোগদান করে না। তোমার ভাবীকে আমি কখনো কোন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাই না। আমার মেয়ের বিয়েতে আমি বাম ঘরানার কোন লেখককে দাওয়াত করিনি।’ সত্যিই একমাত্র মেয়ে জিনানের বিয়েতে সেদিন আবদুল মান্নান তালিব, সাজজাদ হোসাইন খান, শাহাবুদ্দীন আহমদ, নাসির হেলালসহ আমরা কয়েকজন মাত্র সাহিত্যাঙ্গনের লোকজন উপস্থিত ছিলাম। আর উপস্থিত ছিলেন কবির আত্মীয়-স্বজন। বাম ঘরানার শত শত লেখক বন্ধু কাউকেই তিনি দাওয়াত দেননি। যা হোক শেষ জীবনে মোটেও একা একা থাকতে পারতেন না। অধিকাংশ সময় নাতিদের নিয়ে সময় কাটাতেন। আড্ডা দিতে খুব পছন্দ করতেন। সে কারণে মাঝে মাঝেই আত্মীয়-স্বজনকে বাসায় খাওয়ার দাওয়াত দিতেন। তা ছাড়া হাতেগোনা দু-একজনকে বাসায় দাওয়াত দিতেন। পারিবারিক ব্যাপারে খুবই সজাগ ছিলেন। আমাকেও অনেক বার দাওয়াত দিয়েছেন। আমি মোটেও খেতে পারিনে। সে জন্য কোন দাওয়াত সহজে গ্রহণ করতাম না। কিন্তু স্যারের বাসার দাওয়াতে আমাকে যেতেই হতো। না গেলে দু’জনেই খুব রাগ করতেন। আর দাওয়াতটা শুধুই আমাকে দেয়া হতো। এককভাবে কেন শুধু আমাকে দাওয়াত দেয়া হতো জানি না। তবে কখনো কখনো আমাকে আর আবদুল মান্নান তালিব সাহেবকে দাওয়াত দিতেন। একবার ২৬ মার্চ সকালে ফোনে বাসায় খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমি সকালে যেতে পারিনি দুপুরে বারবার ফোন দিচ্ছেন যাওয়ার জন্য, কিন্তু দুপুরে আমি ছিলাম ডেমরায়। কোনোভাবেই ডেমরার কাজ সেরে আমি সময় মতো আসতে পারিনি। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল ঢাকায় ফিরতে। স্যার বললেন, যত রাতই হোক আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। স্যারের বাসায় পৌছাতে আমার রাত ৯টা বেজে গিয়েছিল। খাবার টেবিলে বসে আমার তো চোখ ছানাবড়া। প্রায় ২০ পদের তরকারি। একটা আস্ত মুরগির ঝোল পুরোটাই নাকি আমার জন্য। গরুর গোশত, পাবদা মাছ, রুই মাছ, পুঁটি মাছ, দুই তিন পদের শাক, ডাল, বগুড়ার গুটি আলুর চচ্চড়ি, শজনের ডাঁটা চচ্চড়ি, ভর্তা ইত্যাদি। অসংখ্য দিন একসাথে খেয়েছি তবুও বোঝাতে পারিনি আমার পেটটা নিতান্তই ছোট। সেবার তিনি নিজ হাতে তুলে দিচ্ছেন, আমি যে মোটেই খেতে পারছিনে তা কোনোভাবেই মানতে চাইছেন না। বার বার বলছেন, আমি নিজে গিয়ে বাজার করে এনেছি আর তোমার ভাবী রান্না করেছে। যাহোক, কোন মতে খাওয়া শেষ করলাম। গল্প করতে করতে রাত সাড়ে ১১টা বেজে গেল কোনোক্রমেই ছাড়তে চাচ্ছেন না। আমার বাসার গেট বন্ধ হয়ে যাবে ভেবে আমি খুব অস্থির। স্যার বলছেন, আরে ১০টা বাজে বস পরে যাবে। ভাবী যখন বললেন, ১০টা নয় সাড়ে ১১টা বাজে। তখন দেখলাম খুব পেরেশান হয়ে পড়লেন। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে আমাকে লিফটে তুলে দিলেন। বললেন, বাসায় পৌঁছে ফোন না দেয়া পর্যন্ত আমরা ঘুমাতে পারবো না। আমি অবশ্য বাসায় পৌঁছেই ফোন দিয়েছিলাম। আবদুল মান্নান সৈয়দ স্যার খুব ভোজনপ্রিয় ছিলেন, খাওয়াতেনও সবাইকে। তবে সবাইকে বাসায় দাওয়াত দিতেন না। মগবাজারের উজ্জ্বল হোটেলে অসংখ্য খাওয়ার আড্ডা হয়েছে। কোন কোন দিন একই আসরে বসে দু’পর্ব, তিন পর্ব খাওয়া হয়েছে। বাংলা সাহিত্য পরিষদ প্রসঙ্গে প্রায়ই বলতেন, তালিব ভাই হচ্ছেন বাংলা সাহিত্য পরিষদের মাথা আর তৌহিদ হচ্ছে রক্ত। রক্ত ছাড়া কিন্তু মাথা টিকে থাকতে পারে না। এজন্যই আমি তৌহিদকে এতটা সমীহ করে চলি। আমাকে অসম্ভব বিশ্বাস ও পছন্দ করতেন। তার ফলে জীবনের সব ধরনের কথা আমাকে খোলাখুলি বলতেন। অত্যন্ত গোপন বিষয়েও কোন রাখ-ঢাক করতেন না। নিজ জীবনের অনেক ঘটনা আমাকে সবিস্তারে বলেছেন। একুশে বইমেলায় (২০১০) প্রকাশিত উপন্যাস ‘ইছামতির এপার ওপার’ নিয়ে কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের সময় আমরা মুসলমানরা চরমভাবে নিগৃহীত হয়ে দেশ ত্যাগ করেছিলাম। আমাদের পরিবারের দেশ ত্যাগের কাহিনীও খুবই মর্মান্তিক। আমার বয়স তখন চার-পাঁচ বছর হবে। আমাদের বাড়িঘরে হিন্দুরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। লুটপাট করেছিল সবকিছু। রায়ট তখন পুরোদস্তুর চলছে। আমরা সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম এদেশে। কিভাবে যে একটা ডিঙি নৌকায় নদী পার হয়েছিলাম ভাবতে গেলে গা শিউরে ওঠে। সে ঘটনা এখনো আমাকে বিমোহিত করে। এরপর আমি কলকাতা পড়তে গিয়ে জীবনানন্দ দাশ, প্রবোধ চন্দ্র সেন, মোহিত লাল মজুমদারসহ অনেকের ওপর কাজ করেছি বটে, পাশাপাশি আমার জন্মভূমির মুসলমানরা কেমন আছেন তারও খোঁজ-খবর নিয়েছি। বর্তমানে পশ্চিম বাংলার মুসলমানরা লেখা পড়ার সুযোগ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। দু’একজন যারা লেখা পড়া শিখেছে তাদের চাকরি হয় না। পশ্চিম বাংলার মাত্র ২ ভাগ মুসলমানও সরকারি চাকরি করে না। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষিত অমুসলিমদের প্রায় অধিকাংশই চাকরি করছে। প্রায় দশ বছর আগের কথা। সেদিন কবি মোর্শেদ আলী ভাই আমার সাথে ছিলেন। আমি ও মোর্শেদ আলী ভাই সেদিন তাঁকে ১৯ খণ্ডের একসেট কুরআনের তাফসির উপহার দিয়েছিলাম। আবদুল মান্নান সৈয়দ আমাকে বলেছিলেন, শোবার ঘরে গিয়ে এমন জায়গায় বইগুলো সাজিয়ে রেখে এস যাতে প্রতিদিন আমাদের নজরে পড়ে। আমি ঠিক বেড সুইচের পাশে বক্স খাটের মাথার ওপরে তাফসিরগুলো সাজিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি দেখে বার বার বলছিলেন, যথোপযুক্ত জায়গায় কুরআন শরীফ রাখা হয়েছে। একেবারে মাথার ওপরে। পড়তে না পারলেও প্রতিদিন পবিত্র কুরআনের ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। তিনি প্রায়ই আমাকে আজিজ সুপার মার্কেটের পাঠক সমাবেশে যেতে বলতেন। আমি খুব একটা যেতে পারতাম না। আবার আমাদের অনেকেরই আজিজ মার্কেটের অহেতুক আড্ডায় যোগ দেয়ার মত সময় ছিল না। তবে সৈয়দ স্যারের অনুরোধে মাঝে মাঝে আমাকে যেতে হতো। পাঠক সমাবেশের মালিক বিজু ভাইয়ের দোতলার অফিসে বসে কথা হতো। তিনি বার বারই বলতেন, বিজুর এখানে কিন্তু কাউকে ঢুকতে দেয় না। আমার একান্ত লোককে আমিই বসতে দিই। তারপর পাশের হোটেলে চা নাস্তা ও আড্ডা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টার। সেখানে সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যক্তিনীতি, পেটনীতি সবই থাকত। আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে দেখা হলেই প্রথমেই জানতে চাইতেন তালিব ভাই কেমন আছেন। তারপরই শুরু করে দিতেন আবদুল মান্নান তালিবের গুণগান। বলতেন, বর্তমান বিশ্বে তালিব ভাইয়ের মত গুণী লোক খুব কমই আছে। মরলে টের পাবা। একই সাথে সাহিত্যিক, কবি, সাত আটটা ভাষা জানেন, ছন্দ জানেন আবার কুরআন হাদিস ফেকাহর গভীর জ্ঞান আছে! এমন লোক দুনিয়াতে খুব কমই আছে। তোমাদের এদিকে আবার বেঁচে থাকতে তো দাম পাওয়া যায় না। দাঁত থাকতে দাঁতের দাম দিতে হয়। প্রতিটি কথা বলতেন আর হো হো করে হাসতেন। কবি সাজজাদ হোসাইন খানের কথাও দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন। বলতেন, সাজজাদ হচ্ছে অন্নদা শঙ্কর রায়ের মত একজন অতি শক্তিশালী ছড়াকার। তবে স্বতন্ত্র। সাজজাদ হচ্ছে আমার চেলা। ও হচ্ছে আমার ছাত্র আবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মল্লিক ভাই অসুস্থ হওয়ার পরে প্রায় প্রতিদিনই খোঁজ-খবর রাখতেন। বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে একবার গুণীজন সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে জেনে খুব আপ্লুত হলেন। এর মধ্যে মল্লিক ভাইকে বাংলা সাহিত্য পরিষদ গুণীজন সংবর্ধনা দেয়াতে আবদুল মান্নান সৈয়দ যারপরনাই অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। তাকেও সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তবে একটা কথা, তোমরা যাকে সংবর্ধনা দাও সে লোক কিন্তু আর বেশি দিন বাঁচে না। তবে আমি এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না। বলে আরও একচোট হো হো করে হাসলেন। গুণীজনদের তালিকা দেখে খুব খুশি হলেন। তবে বললেন গফুর ভাইয়ের নামটা থাকা দরকার। মানে ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর। আগেই মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম নামটা প্রস্তাব করেছিলেন তবে আবদুল মান্নান সৈয়দের বিশেষ অনুরোধেই পরে বাংলা সাহিত্য পরিষদ সংবর্ধিত গুণীজনদের তালিকায় গফুর স্যারের নামটা এসেছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দের জীবন বহুদূর বিস্তৃত। আমরা তাঁকে একজন কর্মবীর বলে মনে করি। বহু বিচিত্র পথে তিনি পদচারণা করেছেন। তিনি একাধারে ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ এবং আপাদমস্তক একজন লেখক। দিগন্ত বিস্তৃত সোনালি-রূপালি আলোয় ঝলমলে তাঁর সাহিত্যসম্ভার। সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি হেঁটেছেন অত্যন্ত দাপটের সাথে। তাঁর এই বিশাল-বহুমুখী-বহুধাবিস্তৃত রচনাসম্ভারকে ‘বহুতল বিশিষ্ট ইমারত’-এর সাথে তুলনা করেছেন অনেকেই। যে ইমারতের প্রতিটি কক্ষই আলাদা, স্বাধীন, স্বতন্ত্র এবং মণি-মুক্তা খচিত। অনেক বছর আগে থেকেই আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখার সাথে আমার পরিচয় ছিল। সত্তরের দশকের কিছু প্রতিভাবান কবি বাংলা কবিতায় সম্পূর্ণ নতুন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কাব্যধারা সৃষ্টির জন্য বিস্তর নিরীক্ষণ শুরু করেন। আমরা মনে করি আবদুল মান্নান সৈয়দ তাদের মধ্যে অন্যতম। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর কবিতায় বিভিন্ন আবহের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুশীলনের ছাপ রেখেছেন। কবিতায় তিনি নানা রঙের ব্যবহার করেছেন অবলীলায়। কবিতার আকাশে তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে পাঠকের মনে অবস্থান করবেন বহুযুগ ধরে। এছাড়া সত্তরের দশকের সাহিত্য মেলায় অন্য যাঁরা বিশেষভাবে উজ্জ্বল তাঁরা হলেন, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ (১৯৪০-), আফজাল চৌধুরী (১৯৪২-২০০৪), রফিক আজাদ (১৯৪৩-), আসাদ চৌধুরী (১৯৪৩-), তিতাশ চৌধুরী (১৯৪৫-), আবু কায়সার (১৯৪৫-), সাযযাদ কাদির (১৯৪৭-), আবুল হাসান (১৯৪৭-৭৫), ফরহাদ মজহার (১৯৪৭-) প্রমুখ। যাহোক, সাহিত্যের মাঠে আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন একজন সফল নায়ক। তাঁর সমস্ত লেখালেখি পাঠ করার সৌভাগ্য আমার এখন পর্যন্ত না হলেও তাঁর বিভিন্ন রকমের সাহিত্য পাঠ করে আমি অতিশয় অবাক হয়েছি। এত বিশাল বিস্তৃত পরিসরে যিনি নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন, তা বড় পরিসরে তালিকাবদ্ধ অবস্থায় আমাদের জানা থাকা আবশ্যিক। সে উদ্দেশ্যে তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর পরিপূর্ণ একটা আলেখ্য আমি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। উল্লেখ্য যে, এই তথ্যের প্রায় সবটুকুই আমি লেখক থেকে সংগ্রহ করেছি। এজন্য আমি সবিনয়ে মরহুম আবদুল মান্নান সৈয়দের কাছে কৃতজ্ঞ। জাহিদা মেহেরুননেসার কাছেও আমি যারপরনাই ঋণি, কারণ তার কৃত পুস্তিকাও এক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। যাহোক, মান্নান সৈয়দের গুরুত্ব বাংলা সাহিত্যে যুগযুগান্তরের পথ পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সত্যের মতো বদমাশ’ একটি অসাধারণ গল্পগ্রন্থ। যদিও এটি ষাটের দশকে লেখা, তবু গল্পের আঙ্গিকে রয়েছে আধুনিক রীতির ছাপ। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য লেখকদের লেখার বৈশিষ্ট্য হলো আত্মদর্শন। তাঁর ‘সত্যের মতো বদমাশ’ গল্পগ্রন্থে ষাটের দশকেই তার প্রমাণ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এর পরেও তিনি অসংখ্য গল্প লিখেছেন। কথা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। সব ধরনের পাঠকের জ্ঞাতার্থে লেখকের কর্মময় জীবনের পরিপূর্ণ একটি চিত্র উপস্থাপন করা হলো। জন্ম ও পরিচিতি : আবদুল মান্নান সৈয়দ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমার জালালপুর গ্রামে ১৮ শ্রাবণ ১৩৫০, ৩ আগস্ট ১৯৪৩-এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ সৈয়দ এ. এম. বদরুদ্দোজা (১৯১০-১৯৮৯), মাতার নাম আলহাজ কাজী আনোয়ারা মজিদ (১৯২০-২০০৩)। পড়ালেখা : পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমার জালালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। সেখানে তিনি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর দেশবিভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকায় এসে পুনরায় শিক্ষাজীন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করেন। কর্মক্ষেত্র : আবদুল মান্নান সৈয়দ একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট এমসি কলেজসহ দেশের অনেক স্বনামখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন কয়েক বছর। সর্বশেষ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কলার-ইন-রেসিডেন্স ছিলেন। লেখালেখি : অনেকের মতো কবিতার হাত ধরেই লেখালেখির জগতে প্রবেশ আবদুল মান্নান সৈয়দের। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। তবে কেবল কবিতা নিয়েই থেমে থাকেননি, কবিতার পাশাপাশি সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা। কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, জীবনী ইত্যাদি বিষয়ে অনেক বই লিখেছেন। যে সামান্য ক’জন লেখক সমালোচক সাহিত্যের ক্ষেত্রে অসম্ভব অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ তাদের মধ্যে অন্যতম। সম্পাদনাও তাঁর কর্মক্ষেত্রের বিশেষ অংশজুড়ে রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন তিনি। এর মধ্যে নজরুল-রচনাবলী, ফররুখ-রচনাবলী, মোহাম্মাদ ওয়াজেদ আলী-রচনাবলী, শ্রেষ্ঠ কবিতা : মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ১১টি পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন সময়। এর মধ্যে যেমন লিটলম্যাগ আছে তেমনি আছে প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকা। রেডিও টিভিতেও সমালোচনা সাহিত্যসহ সমসাময়িক অনেক বিষয়ে আলোচনা করেছেন। দিয়েছেন অনেক বক্তৃতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা, অভিভাষণ ও লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন এবং কলকাতা সাহিত্য একাডেমিতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন অনেকবার। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে পড়ানো হয়। ইংরেজি, ফরাসি, হিন্দি, উর্দু, জাপানি, সুইডিস প্রভৃতি ভাষায় তাঁর একাধিক লেখা অনূদিত হয়েছে। আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যসাহিত্যের নিদর্শন হিসাবে তাঁর একটি গল্প পড়ানো হয়। গল্পটির নাম ‘অধঃপতনÑঞযব ঋধষষ’। ব্যাপক গবেষণা করেছেন, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কায়কোবাদ, শাহাদাৎ হোসেন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ফররুখ আহমদ, সিকান্দার আবু জাফর প্রমুখকে নিয়ে। তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র আধুনিক বাংলা সাহিত্য। কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, ফররুখ আহমদকে নিয়ে তিনি সর্বাধিক কাজ করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ সংখ্যা দেড়শতাধিক। ভূমিকাও লিখেছেন অসংখ্য গ্রন্থের। চিত্রকলার প্রতিও স্যারের বেশ আগ্রহ ছিল। ‘বিংশ শতাব্দীর শিল্প- আন্দোলন’ বিষয়ে একটি বইও লিখেছেন তিনি । আগেই বলেছি সাহিত্যের সকল শাখায় অবদান রেখেছেন মান্নান সৈয়দ। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সমালোচনা সাহিত্য, স্মৃতিকথা, সম্পাদনা ইত্যাদি বিষয়ে এ পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে, তার মোটামুটি বিষয়ভিত্তিক একটা তালিকা এখানে তুলে ধরা হলো। এ কাজ জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং সাহিত্যসেবীদের জন্যও অপরিহার্য বলে মনে করি। এ লেখার ভেতরে অনেক অসম্পূর্ণতা থাকতেই পারে। লেখকের ওপর তথ্যধর্মী আরো কাজ ক্রমশ বিস্তৃত হবে বলে আশা করি। লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থাবলির তালিকা নিম্নরূপ : কবিতা : জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭), জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা (১৯৬৯), মাতাল মানচিত্র (১৯৭০, অনুবাদ-কবিতা) ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ (১৯৭৪), নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৫), কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৮২), পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮২), পার্ক স্ট্রিটে এক রাত্রি (১৯৮৩), মাছ সিরিজ (১৯৮৪), বিদেশি প্রেমের কবিতা (১৯৮৪, অনুবাদ-কবিতা), পঞ্চশর (১৯৮৭), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৭), আমার সনেট (১৯৯০), সকল প্রশংসা তাঁর (১৯৯৩), নীরবতা গভীরতা দুই বোন বলে কথা (১৯৯৭), নির্বাচিত কবিতা (২০০১), কবিতাসমগ্র (২০০২), কবিতার বই (২০০৬), হে বন্ধুর বন্ধু হে প্রিয়তম (২০০৬)। ছোটগল্প : সত্যের মতো বদমাশ (১৯৬৮), বলো যাই পরোক্ষে (১৯৭৩), মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা (১৯৭৭), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), উৎসব (১৯৮৮), নেকড়ে হায়েনা আর তিন পরী (১৯৯৭), গল্প (২০০৪), মাছ মাংস মাৎসর্যের রূপকথা (২০০১), নির্বাচিত গল্প (২০০২), শ্রেষ্ঠ গল্প (২০০৭)। উপন্যাস : পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী (১৯৭৪), কলাকাতা (১৯৮০), পোড়ামাটির কাজ (১৯৮২), অ-তে অজগর (১৯৮২), সে সংসার হে লতা (১৯৮২), গভীর গভীরতর অসুখ (১৯৮৩), প্রবেশ (১৯৯৪), ক্ষুধা প্রেম আগুন (১৯৯৪), শ্যামলী তোমার মুখ (১৯৯৭), শ্রাবস্তীর দিনরাত্রি (১৯৯৮), ভাঙা নৌকা (২০০৬)। প্রবন্ধ গ্রন্থ: শুদ্ধতম কবি (১৯৭২), জীবনানন্দ দাশের কবিতা (১৯৭৪), নজরুল ইসলাম : কবি ও কবিতা (১৯৭৭), করতলে মহাদেশ (১৯৭৯), দশ দিগন্তের দ্রষ্টা (১৯৮০), বেগম রোকেয়া (১৯৮৩) ছন্দ (১৯৮৫), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯৮৬), নজরুল ইসলাম : কালজ কালোত্তর (১৯৮৭), চেতনায় জল পড়ে শিল্পের পাতা নড়ে (১৯৮৯), পুনর্বিবেচনা (১৯৯০), দরোজার পর দরোজা (১৯৯১), ফররুখ আহমদ : জীবন ও সাহিত্য (১৯৯৩), বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা (১৯৯৪), বাংলা সাহিত্যে মুসলমান (১৯৯৮), রবীন্দ্রনাথ (২০০১), আধুনিক সাম্প্রতিক (২০০১), নজরুল ইসলামের কবিতা (২০০৩)। জীবনী গ্রন্থ: শাহাদাৎ হোসেন (১৯৮৭), জীবনানন্দ দাশ (১৯৮৮), ফররুখ আহমদ (১৯৮৮), আবদুল গনি হাজারী (১৯৮৯), সৈয়দ মুর্তাজা আলী (১৯৯০), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী (১৯৯৪), প্রবোধচন্দ্র সেন (১৯৯৪)। কিশোর গ্রন্থ: বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) (২০০২), ভুতুড়ে কাণ্ড (২০০২)। আত্ম-জীবনী: আমার বিশ্বাস (১৯৮৪), স্মৃতির নোটবুক (২০০০), সম্পাদকের কলমে (২০০৬)। নাটক: নাট্যগুচ্ছ (১৯৯১), নাব্যসমগ্র (২০০৯)। প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা: বাংলা একাডেমীর একুশে পদকসহ এ পর্যন্ত শতাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। সংবর্ধিত হয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে। সর্বশেষ জাতীয় প্রেসক্লাব ‘সমগ্র সাহিত্যকর্মের জন্য’ বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘গুণীজন সংবর্ধনা’ পেয়েছেন ২০০৯-এ। কবির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৫৯ সালে, ইমাম স্মৃতি পুরস্কার ‘সত্যাসত্য’ গল্পের জন্য। ওমেন্স হল (বর্তমানে রোকেয়া হল), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। গল্পটি ‘সত্যের মতো বদমাশ’ গল্প গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এরপর উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে আছে : ১৯৭৩ হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (শুদ্ধতম কবি, প্রবন্ধগ্রন্থ), লেখক শিবির, ঢাকা। ১৯৭৫ সুমন্ত প্রকাশন সাহিত্য পুরস্কার (শুদ্ধতম কবি, প্রবন্ধগ্রন্থ) কলকাতা। ১৯৮১ আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (করতলে মহাদেশ, প্রবন্ধগ্রন্থ), ফরিদপুর। ১৯৮১ বাংলা একাডেমী পুরস্কার (প্রবন্ধ ও গবেষণা), ঢাকা। ১৯৮৬ চারণ সাহিত্য পুরস্কার (অনুবাদ ও গবেষণা) ঢাকা। ১৯৯১ ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার (প্রবন্ধ ও গবেষণা) চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র, চট্টগ্রাম। ১৯৯৩ ত্রিভুজ সাহিত্য পুরস্কার (কবিতা), ত্রিভুজ সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা। ১৯৯৮ নজরুল একাডেমী পুরস্কার (নজরুল-গবেষণা), চুরুলিয়া, বর্ধমান, ভারত। ১৯৯৯ বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক, ঢাকা। ২০০০ কবি তালিম হোসেন ট্রাস্ট পুরস্কার (নজরুল-গবেষণা), ঢাকা। ২০০০ নজরুল পদক (নজরুল গবেষণা), নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা। ২০০১ নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার (সামগ্রিক সাহিত্য) নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, ঢাকা। ২০০২ কবি সুকান্ত সাহিত্য পুরস্কার (প্রবন্ধ-গবেষণা) কবি সুকান্ত সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা। ২০০২ অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (কবিতা) অলক্ত সাহিত্য সংসদ, কুমিল্লা। ২০০৩ একুশে পদক (প্রবন্ধ-গবেষণা) বাংলাদেশ সরকার। ২০০৬ স্বাধীনতা ফোরাম সম্মাননা (কবিতা) স্বাধীনতা ফোরাম কেন্দ্রীয় সংসদ, ঢাকা। ২০০৬ নজরুল পদক (নজরুল গবেষণ) নজরুল একাডেমী, ঢাকা। ২০০৭ বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র পুরস্কার (সমগ্র সাহিত্য), ঢাকা। সর্বশেষ ২০১০ বাংলা সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার ও গুণীজন সংবর্ধনা প্রাপ্ত হন। সব্যসাচী এই লেখককে আরও বেশি করে জানা এবং তাঁর সাহিত্যকর্ম ও জীবনাদর্শ আলোচনা করার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের জাতির মহান ব্যক্তিত্বদের কথা আমাদেরকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে। আমাদের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে তাদের অবদান অপরিসীম। আমাদের ভবিষ্যৎ উত্তরসূরিদেরকে এ সম্পর্কে অবহিত করা আমাদের দায়িত্ব। লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির