post

ছাত্রজীবনের অর্জনীয় বর্জনীয় দিক

ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান

০৮ জুন ২০২০

ছাত্রজীবন হচ্ছে জীবনে সফলতার প্রথম ধাপ। এখান থেকেই জীবনকে জানা শুরু হয়। মানুষ পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র, তারকারাজি, ভূমণ্ডল ইত্যাদি জানতে শুরু করে ছাত্রজীবনে। ছাত্রজীবনই জীবনের ভিত্তি। কবি মোতাহের হোসেন মানুষকে দ্বিজ বলেছেন। কারণ প্রত্যেক প্রাণীই একবার জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু মানুষ তার ব্যতিক্রম, মানুষ দুইবার জন্মগ্রহণ করে। প্রথমে সে অন্যান্য প্রাণীর মতোই মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হয়। আবার সে শিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী যেভাবে মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হয় সে অবস্থাই মৃত্যুবরণ করে। শুধুমাত্র আকার আকৃতিতে বড় হয়। কিন্তু মানুষ শিক্ষার মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করে পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে। সে জানান দেয় আমি আশরাফুল মাখলুকাত। সে তার জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে পৃথিবীর অজানাকে জানতে শিখে। একজন ছাত্রই পারে একটা জাতিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে। তাই বলা যায় ছাত্রজীবনই হলো বাস্তব জীবনের ভিত্তিস্তর। যেমন কোনো ইমারতের ভিত্তি স্থাপন যত বেশি শক্তিশালী হয় ওই ইমারত তথা কাঠামো তত বেশি শক্তিশালী হয়। তেমনি ছাত্রজীবন যদি সুন্দর ও আদর্শিক হয় তাহলে তার বাস্তব জীবনটা সুন্দর হবে।

ছাত্রজীবনের বর্জনীয় দিক

১. টাকার পিছু নেয়া : টাকা ছাড়া পৃথিবী অচল তবুও টাকাই মানুষকে অমানুষ বানায়। টাকাই মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়। ছাত্রজীবনে যে টাকার পিছনে দৌড়ায় সে বেশি দূর এগোতে পারে না, পারলেও ঐ ছাত্রের মাঝে মনুষ্যত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ছাত্রজীবন হবে তপস্যা করার সময়। বাস্তব জীবনের ভিত্তি স্থাপন করার সময়। এ সময় যদি কোনো ছাত্র টাকার পিছনে সময় ব্যয় করে ঐ ছাত্রের ভবিষ্যৎ কিন্তু বেশি দূরে যেতে পারে না। কোন কারণে নিজের ভবিষ্যৎ উন্নতি করতে পারলেও দেশ ও জাতির কোন উপকারে আসে না। আজকে আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতি লেজুড়বৃত্তি হওয়ার কারণে ছাত্ররা জীবনটাকে মনে করে টাকা। টাকা ছাড়া জীবনটাই অনর্থক। টাকাটাই জীবনেরও সকল সফলতা। এক কথায় অর্থই অনর্থের মূল।

২. নারী : প্রত্যেক মানুষের একটি বয়ঃসন্ধিকাল আছে। এসময় সবার মাঝে একটা পরিবর্তনের আবহ দেখা যায়। এ সময়টা বাংলাদেশে ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৪-২০ বছর আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ১০-১৮ বছর। এসময় ছেলে-মেয়েরা নিজেদেরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। আবিষ্কার করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ঐ সময়ে আমাদের দেশের অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী অকালে ঝরে পড়ে। আরে ভাই সকল কিছুর একটা সময় আছে, সময়ের জন্য অপেক্ষা কর। তাহলেই ভালো কিছু আশা করা যায়। এক্ষেত্রে এ অবস্থার জন্য আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আমাদের পারিবারিক শিক্ষা, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশে দায়ী। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তাকে আল্লাহর ভয় শিক্ষা দেয় না। বড়দের সাথে কেমন আচরণ হবে, ছোটদের সাথে কেমন আচরণ হবে এ বিষয়গুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বর্তমানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তার ফলে আমরা আজ সমাজে পাচ্ছি এক ধরনের শিক্ষিত অপদার্থ। যারা শুধু নিজেকেই নিয়ে পড়ে থাকে। electronics device ফবারপব এর কারণে আজকে আমাদের ছাত্রসমাজ অনেকাংশে ফবারপব-মুখী হয়ে যাচ্ছে।

৩. লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি : নেতৃত্ব মানুষের স্বভাবজাত একটি বিষয়, এটি মানুষ জন্মলগ্ন থেকে পাওয়া। তারপরও আমাদের দেশে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির কারণে অনেক মেধাবী ছাত্র তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারছে না। পৃথিবীর উন্নত দেশে ছাত্ররাজনীতির মূলকাজ মেধা বিকাশে সময় ব্যয় করা। ছাত্ররাজনীতি বলতে আমি স্বাভাবিকভাবে যা বুঝি তাহলো ছাত্রছাত্রী সংশ্লিষ্টদের কল্যাণের জন্য রাজনীতি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করবে, ডিগ্রি অর্জন করবে, নিজের ক্যারিয়ার গড়বে- প্রশ্ন, এক্ষেত্রে রাজনীতি করার প্রয়োজনটা কী? প্রয়োজন আছে এই জন্যই যে, শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে যে বৈষম্য অনিয়ম তা দূর করার জন্য ছাত্ররাজনীতি ভূমিকা রাখতে পারে। ভূমিকা রাখতে পারে ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে। আজকে যারা ছাত্র আগামী দিনে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার। সমাজ ও রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেয়ার রাজনৈতিক ও একাডেমিক যোগ্যতা তাদেরকে অর্জন করতে হবে। দেশ ও সমাজের প্রতি আগামীর ভবিষ্যৎ প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের একটা দায়িত্ববোধ তো আছেই। একজন ছাত্র যে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ ছাত্র সংসদের নেতা হতে চায়, তার চিন্তা চেতনায় থাকতে হবে আমি কিভাবে সবার চেয়ে চরিত্রবান নীতিবান ও মেধাবী হবো। প্রতিদিন তাকে ক্লাসে উপস্থিত হতে হবে, সহপাঠী ছাত্রদের কাছে তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। তাকে নিয়মনীতি মেনে ক্যাম্পাসে চলতে হবে। তাকে যদি সত্যিকারের নেতা হতে হয় তাহলে সে প্রথমে নিজেকে বোঝার চেষ্টা করবে, নিজের বিচার-বুদ্ধি দিয়ে আসল মনুষ্যত্বকে খুঁজে নিবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাসে আজ অবধি সহিংসতা চলছে। ক্যাম্পাসগুলোতে এখন আর পড়ালেখার চর্চা হয় না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কোন বিবেকবান মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় যেতে পারে না। রাজনৈতিক নেতারা তাদের নিজেদের স্বার্থে ছাত্রদের পড়াশুনার জায়গা থেকে সরিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কথা বলছি কিন্তু আমরা প্রধান সমস্যাটিকে সামনে নিয়ে আসছি না। যে ছাত্রের হাতে বই থাকার কথা তার হাতে অস্ত্র কেন? আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের আখের গোছানোর জন্য ছাত্রদেরকে ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

ছাত্রজীবনের অর্জনীয় দিক

১. যোগ্যতা : এ গুণ কেউ যদি অর্জন করে তাহলে টাকা, নারী, নেতৃত্ব এ তিনটিই তার পিছনে দৌড়াবে। যেমন একজন গরিব মেধাবী ছাত্র তারই ক্লাসমেট এলাকার কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির মেয়েকে ভালোবাসে বা প্রেম নিবেদন করে তবে দেখবেন সমাজে একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাবে, ঐ ছেলের বাবা-মাও অপদস্থ হতে পারে। আর ঐ ছেলেই যদি ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, অথবা ইঈঝ ক্যাডার হয়ে এলাকায় আসে দেখবেন সমাজের ঐ প্রভাবশালী ব্যক্তিটিই তার মেয়ের বর হিসাবে ঐ ছেলেকে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ভাবে ধরনা দিবে। টাকার জন্য যে ছেলেটি বিভিন্ন সময় অনেক জায়গায় হাত পেতে ফল পায়নি সেই যোগ্যতা অর্জন করলে টাকা নিতে না চাইলেও মানুষ তাকে টাকা দিয়ে যাবে। যেমন, একজন সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, তিনি যখন অবসরপ্রাপ্ত হন তখন তিনি চান রিলাক্স মুডে থাকতে কিন্তু তিনি পারেন না, কারণ কোন না কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যারকে অফার করে বসবে। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় হলো ব্যক্তি অধ্যক্ষকে অনার করে না। করে উনার যোগ্যতাকে উদ্দেশ্য দেশের অভিভাবক সমাজ মনে করে।

২. সততা : সততা মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা দুনিয়ায় ও আখেরাতে সফলতার চাবিকাঠি। আল্লাহ তায়ালা বলেন একজন সৎ ব্যক্তি সর্বস্তরে সম্মানিত হন। দরুন একজন সৎ Accountant IT expert না তার মানে ও তো বেশি যোগ্য নয়। মোটামুটি কম্পিউটার অপারেট করতে পারে। অপর দিকে আরেকজন IT expert কিন্তু সৎ নয়। আপনি আপনার কোন অর্থলগ্ন প্রতিষ্ঠানের ক্যাশিয়ার (Accountant) হিসাবে কাকে নিয়োগ দিবেন। অবশ্যই আপনি কম যোগ্যতাসম্পন্ন সৎ ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিবেন। এর কারণ হলো কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি দ্বারা আপনার প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। উনি আস্তে আস্তে উনার কাজে যোগ্য হয়ে উঠবে। অপর দিকে যোগ্যতাসম্পন্ন অসৎ ব্যক্তি দ্বারা আপনি কখনো সফলতার মুখ দেখবেন না। তাই বলা যায় সততাই হলো বড় যোগ্যতা।

উপসংহার : উন্নত বিশ্বে আমাদের দেশের মতো ছাত্ররাজনীতি নেই বললেই চলে। উন্নত বিশ্বে একজন ছাত্র প্রথমে তার ক্যারিয়ার গড়ে তারপর দেশের প্রয়োজনে সে রাজনীতিতে আসে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নৈতিকতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত হওয়ার দরুন আজ আমরা না ছাত্রদেরকে তাদের পাঠ্যপুস্তকে ব্যস্ত রাখতে পারছি, না নৈতিকতা শিক্ষা দিতে পারছি। যার ফলে ছাত্র-ছাত্রী সমাজে যে যার মত করে জীবন অতিবাহিত করে। যার ফলে তারা জড়িয়ে পড়ছে অনৈতিক সম্পর্কে। তাই এখন সময়ের দাবি এ জাতিকে গড়তে হলে একটি নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করে দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা দরকার। না হয় জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে। লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির